নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হোসেন মৌলুদ তেজো

লিখতে ভালোবাসি

হোসেন মৌলুদ তেজো › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে লোকালয়ে স্বপ্নরা জ্বলে স্বার্থের আগুনে

১০ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:১৫

কানিশাইল রোডে উচ্চবিদ্যালয়ে আজ বৈশাখকে বরণ করে নেয়ার উৎসব! বাহারি রঙের বেলুন আর রঙ্গীন কাপড়ে সাজানো হয়েছে পুরো স্কুলের মাঠ, স্কুলের মূল ভবন। ছড়ানো ছিটানো শুকনো মড়মড়ে গাছের পাতা পরিষ্কার করে চলছে উৎসবের পুরো প্রস্তুতি হেডস্যারের চোখে মুখে আজ রাজ্যের তৃপ্তি। তার চেয়ে বেশি খুশি ছড়িয়ে আছে ছাত্রছাত্রীদের পোশাকে, মুখে। সবার মাঝে আনন্দের হিল্লোল, বাসন্তী রঙের শাড়ি আর আলতা পড়া মেয়েরা স্কুলের পরিবেশকে করে তুলেছে আরো রঙীন। একটু পরেই শুরু হবে বৈশাখী উৎসব। উদ্বোধনি ভাষণ, আলোচনা তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ছকে বাধা একঘেয়েমি জীবনে একদিনের জন্য হলেও ব্যতিক্রমি উদ্দীপনা। আজ পাঠ্যবইয়ের অত্যাচার কাউকে স্পর্শ করতে পারবে না। আজ শুধু উৎসব, আনন্দ আর নতুন বছর বরণের মুগ্ধতা। হেডস্যারের নিজ উদ্যোগে এই বৈশাখী বরণ অনুষ্ঠানের এত আয়োজন। স্কুলের হেডস্যার ব্যস্থতার সাথে পরখ করছেন সব প্রস্তুতিপর্ব। কোথাও যেন কোন ঘাটতি না থাকে সেদিকেই তার খেয়াল। ছাত্র-ছাত্রীদের সেচ্ছাসেবক দল কাজ করে চলছে অনুষ্ঠানের সফলতার জন্য। দলে দলে ভাগ করে কেউবা কাজ করছে, কেউবা আবার অপেক্ষার বিরক্তিকর সময়টুকু কাটাচ্ছে গল্পগুজব করে, গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বসে।

প্রস্তুতি চলাকালে স্কুলের সীমানার পশ্চিমদিকটায় হঠাৎ চেঁচামেচি শোনা যায়। হেডস্যার সমস্যা দেখার জন্য এগিয়ে যান। গিয়ে দেখেন একটা ছেলেকে স্কুলের কয়েকজন ছাত্র ধরে টানাটানি করছে। হেডস্যার তাদের হাত থেকে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই একজন জানায়, ছেলেটা বহিরাগত এই পাড়ারই। সে স্কুলের ছাত্র না। কিন্তু সমস্যা এখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে ছেলেটা স্কুলের একজন ছাত্রীর সাথে অশোভন আচরণ করেছে আবার উল্টো দাপট দেখাচ্ছে। হ্যাডস্যার কথাটা শুনে স্থির থাকতে পারলেন না। তার মনে হলো তিনি ক্রোধে মাতাল হয়ে যাবেন। কোন কিছু চিন্তা না করেই তিনি ছেলেটার গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলেন। ছেলেটা কোন কিছু বোঝে উঠার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে যেতে বললেন। কিছুদূর গিয়ে ছেলেটা ঘুরে দাঁড়ালো, হ্যাডস্যারকে উদ্দেশ্য করে বললো, “হ্যাড মাষ্টারের বা”চা তুই আমার গায়ে হাত দিয়েছিস, তোর অনুষ্ঠানের বারোটা না বাজিয়ে আমি ছাড়বো না” বলেই সে উন্মাদের মত
দৌড়োতে শুরু করলো।

হ্যাডস্যার ভাবলেন মীমাংসা হয়ে গেছে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে স্কুলের দিকে রওয়ানা দিলেন। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। শুরু হলো উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। কিন্তু হঠাৎ ছাত্রদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তিনি বাইরে এলেন, তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন কয়েকটা ছেলের স্কুলের দিকে উম্মতাল দৌড় আর তাদের হাতে দুপুরের রোদে চিকচিক করছে ছুড়ি, রামদা... তিনি সাথে সাথে গেইট বন্ধের জন্য চিৎকার দিলেন। ছেলেগুলো এসে গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে স্কুলের গুষ্টিউদ্ধার করল আর কেউবা গেটে লাথি দিতে থাকলো সজোরে। তিনি দিকভ্রান্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন কিন্তু কোন রাস্থা পাচ্ছিলেন না। আর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা অসহায়ের মতো স্যারের চারপাশে দাঁড়ালো যেন তিনিই তাদের একমাত্র ভরসাস্থল কেউবা আবার অসহায়ের মতো রাস্থা খুঁজছিল। বাইরে তখনো ছেলেদের তান্ডব চলছে। আজ উৎসবের বারোটা বাজিয়েই ছাড়বে। এমন সময় তাদের এসে থামতে বললেন এলাকার স্থানীয় নেতা। অতিউৎসুক কিছু মানুষ দাড়িয়ে দেখতে লাগলো কি হচ্ছে এখানে। নেতার কথায় ছেলেগুলো শান্ত হলো তবে তারা এর সমাধান চায়। ঐ নেতা হ্যাডস্যারের বিচারের আশ্বাস দিলেই তবে এরা সুবোধ বালকের মতো অস্ত্র গুটিয়ে চলে যায। বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠান ওইখানেই ইতি টানে। ছাত্রছাত্রীরা সবাই যার যার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। শুধু হ্যাডস্যার তাকিয়ে দেখেন তার বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানের যবনিকা।

একটু পরেই ঐ নেতা স্কুলে এসে হ্যাডমাষ্টার শাহেদ আলীকেই এ ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে বিবেচনা করে এবং এর দায়বার বহন করার হুমকি দিয়ে যায়। স্কুরের অফিস কক্ষে শাহেদ আলী আর কয়েকজন হতভম্ব শিক্ষক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকেন। তারা বুঝতে পারেন না এখন কি করা উচিত। আর ঐ দিকে স্থানীয় আরো নেতারা জড়ো হতে থাকেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নিজের কার্য নির্ধারণের জন্য। যে ছেলেটাকে স্যার মেরেছেন তাকে ডেকে আনা হয় আর সে সোজা জানিয়ে দেয় হ্যাডস্যারের বিচার না হলে সে শাহেদ আলীকে দেখে নেবে। নেতারা ধমক দিলে সে চুপ হয় বটে তবে তার ক্রোধাগ্নি কমে বলে মনে হয় না। তারপর ঐ নেতার উদ্যোগ সবাই চা পান খেয়ে নির্যাতিত ছেলেকে সামনে মটরসাইকেলে চড়িয়ে মিছিল করে স্কুল অভিমুখে যাত্রা করে। আর ঐ ছেলেটা বীরের বেশে মিছিলে সবার আগে মটরসাইকেলে চড়ে স্কুলের দিকে রওয়ানা দেয়। শাহেদ আলীর অফিস কক্ষের সামনে এসে মিছিল থামে। স্থানীয় এক নেতা গিয়ে স্যারকে জানিয়ে আসেন যে তার এই অন্যায় কর্মের জন্য এবং ছেলেদের শান্ত করার জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আজ বিকেলেই তাকে ঐ নেতার বাসায় যাওয়ার জন্য বলা হয়। শাহেদ আলী কিছুই বলতে পারলেন না, তিনি শুধু জানলেন যে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু তিনি যখন প্রথমে এতে অস্বীকৃতি জানালেন তখন তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, “তাহলে আপনার মেয়েকেই পাঠান, শাস্তি না হয় তারই হোক।” সবাই হেসে উঠে। মনে হলো যেন অনেকদিন পর হাসার সুযোগ পেলো। শাহেদ আলী নতমাথায় তাদের সব কথা মেনে গেলেন। ভদ্রলোকর বৈশিষ্ট্যইতো এক থাপ্পর খেয়ে আরেক গাল পাতিয়ে দেয়া। তিনি বুঝতে পারলেন তাকে বিচারে আসতেই হবে হয়তো ঐ ছেলেটার কাছে মাপও চাইতে হতে পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই... অতঃপর নেতারা চলে গেলেন বিচারের প্রস্তুতি নিতে। সবার দৃষ্টি স্কুলের বৈশাখ বরণ অনুষ্ঠান থেকে বিকেলের ঐ বিচারের দিকেই চলে গেল। শাহেদ আলী হতবিহব্বল হয়ে দেখতে লাগলেন ঐ ছেলেদের উল্লাস। জীবনের এতোগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসে এখন হয়তো ঐ ছেলেটার কাছে হাতজোড় করতে হবে।

তিনি নিজের চেহারা কল্পনা করার সাহসও পাননা। অন্যান্য শিক্ষকরা চলে গেলে শাহেদ আলী পুরোটা দুপুর অফিসেই কাটান। নিজের চোখের সামনে নিজের নতমস্তক কল্পনা করে শিউরে ওঠেন তিনি। তার স্ত্রী, আর মেয়ের কাছে, এ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তার অবস্থান কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে তিনি ভাবতে পারেন না। এতোটা বছর ধরে যে ব্যক্তিত্ব তিনি তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন আজ তার পতন দেখতে পাচ্ছেন। তিনি জানেন এরপরে তিনি এই এলাকার সবার হাসির পাত্র হয়ে যাবেন। সবাই তাকে নিয়ে হাসবে, ঠাট্টা করবে। এদের কারো সামনেই আর মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবেন না। বিকেলের দিকে তিনি ওই নেতার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তিনি একটি বারের জন্যও মাথা তুলে তাকাতে সাহস পাননি কারণ তিনি জানেন তিনি যদি মাথা তুলেন তাহলে দেকতে পারবেন কেউ না কেউতার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মিটিমিটি করে হাসছে তিনি পুরোটা পথই মাথা নিচু করে চলেন। নেতার বাসায় ঢুকেই দেখেন বারান্দায় ঐ ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে রাজ্যের তৃপ্তি, ঠিক যে তৃপ্তিটা ছিল সকালে তার চোখে মুখে। তিনি আর তাকাতে পারেন না... নিজের অসহায়ত্বকে সহ্য করতে পারেন না। কিছুক্ষন পরেই শুরু হলো বিচার। নেতা প্রথমে শুনলেন ছেলেটার ভাস্য তারপর শুনলেন শাহেদ আলীর কথা। সবশুনে তিনি রায় দিলেন শাহেদ আলী অন্যায়ভাবে তাকে মেরেছেন তিনি তা না করলেও পারতেন। শাহেদ আলী ভেতরে ভেতরে একটু হাসেন। তিনি চোখ তুলে দেখেন ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। তিনি তার মুখে হাসিটাকে কোন জীবন্ত মানুষের হাসি ভাবতে পারলেন না, তার মনে হলো এ হাসি যেন শ্মশান যাত্রীর নরক উল্লাস। তিনি তার ভিতর একধরনের কান্না শুনতে পেলেন ঘুমের ভিতর শিশুর যেরকম কান্না বাজে ঠিক সেরকম। নেতা তাকে অনুরোধ করেন ছেলেটার কাছে মাফ চাওয়ার জন্য আর ভবিষ্যতে এরকম না করার অঙ্গীকার। শাহেদ আলী নির্বিকার ভাবে নেতার কথা পালন করেন। তিনি তাকিয়ে দেখেন একদল গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন মানুষের হাসি তারা আজও জানে না কোথায় তারা নোঙর করবে কি তাদের ঠিকানা। তিনি তার নিজেকে ওই বয়সে চিন্তা করেন তিনি দেখতে পান তিনি ঘুড়ি উড়াচ্ছেন, তার হাতে নাটাইল আর তার ঘুড়ি আকাশে উড়ছে গন্তব্যহীন কিন্তু স্বপ্নময়। অথচ এদের হাতে দুপুরের রোদে চিকচিক করে ওঠে অস্ত্র এর যেমন গন্তব্যহীন তেমনি স্বপ্নহীন। তিনি উঠে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে একজন পরাজিত পরিব্রাজকের মতো বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। তিনি অনুভব করেন অসংখ্য জোড়া চোখ তাকে অবলোকন করছে রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে এদের মধ্যে দু’এক জোড়া হয়তোবা সহানুভূতিরও হতে পারে। তিনি স্কুলের সামনা দিয়ে যাওয়ার সময় আঁতকে উঠেন। স্কুলের মাঠে এখন উড়ছে বিভিন্ন রঙের পতাকা, কিন্তু এখন সবই তার কাছে বিবর্ণ। দোকানের সামনে দাড়িয়ে ঐ ছেলেটা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ে। সেই ধোয়া বাতাসে মিলিয়ে গেলেও শাহেদ আলী তার খোচা অনুভব করে।

সন্ধ্যা নেমে আসে। শাহেদ আলী বাড়ি পৌছুলে তার স্ত্রী খাবার বেড়ে দেয় কিন্তু তিনি খেতে পারেন না। তিনি অনুভব করেন এক উদ্ভ্রান্ত লোকালয় যেখানে স্বপ্নরা জ্বলে স্বার্থের শ্মশানে আর তার চিতার এক একটা কাঠ এই লোকালয়ের এক একজন মানুষ। তারা বুঝতেও পারছে যে তারাও জ্বলছে চিতার আগুনে। রাতে শাহেদ আলীর স্ত্রী সবশুনে হতবাক হয়ে যান। তার মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে অনর্গল। তারপরও শাহেদ আলী ভুলে যেতে চান আজকের দিন। কিন্তু পারেন না মানুষ তার অসহায়ত্বকে কখনও আড়াল করতে পারে না, নিজে থেকে কোনদিন পালিয়ে বাঁচতে পারে না। তাই তিনি অস্থীর হয়ে পায়চারি করতে থাকেন। তার বার বার মনে আসে ছেলেদের বিদ্রুপের হাসি। তিনি জানেন কাল যখন আবার একই পথে স্কুলে যাবেন সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। তাকে নিয়ে আলোচনা করবে। তারপরও তিনি এসব ভাবতে চান না। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিটি দিন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তবুও শান্তি পান না। তার স্ত্রী তার মাথায় হাত রাখে। বিশ বছরের অভস্ত্য হাতে স্বামীর মাথায় বিলি কাটে কিন্তু শাহেদ আলীর ঘুম আসেনা। সে বুকে তিনি প্রশান্তরি বৃষ্টিতে ভিজেন সে বুক আজ যেন শুকিয়ে মরুভূম। তিনি বালিশে মাথা গুজে চুপচাপ পড়ে থাকেন আর কানিশাইল রোডের সিনেমাহলের পিছনে কয়জন ছেলে বসে বসে নেতাদের গুনকীর্তন করে। নেতা মহান বলে তার দীর্ঘায়ু কামনা করে... তাদের হাত চঞ্চল হয়ে ওঠে, গাঁজার কলকি হাত বদল করে চলে এহাত থেকে ওহাতে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:০৪

হাবিব বলেছেন: পাশাপাশি দুটি পোস্ট দৃষ্টিকটু লাগে

২| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.