![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুনিয়ার প্রতিটি কাজের নির্দিষ্ট সময় থাকে। সে সময় সে কাজটির ফল যত ভালোভাবে ভোগ করা যায়, অন্য সময় তা করা যায় না। যেমন_ শীতকালে শীতের পোশাক যতটা বিক্রি হয় গরমকালে তা হয় না। ব্যবসায়ীরা শীতকালে শীতের পোশাকের গোটা বছরের ব্যবসা করে নেন। ঈদ মৌসুমে পোশাক ব্যবসায়ী ও প্রস্তুতকারীরা বিরাট অঙ্কের মুনাফা অর্জন করে থাকেন। বর্ষাকালে যানবাহন মালিকদের ব্যবসা জমজমাট হয়। তেমনি পরকালের জন্য নেকি উপার্জনের বিশেষ মৌসুম হলো মাহে রমজানুল মোবারক। এমনিতেই মোমিনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরকালের উপার্জনে ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু রমজানুল মোবারকে এদিকে বিশেষভাবে, ভালোভাবে মনোযোগ দেয়া উচিত।
রমজানুল মোবারকের প্রতি যত্নবান হওয়া মোমিনের জন্যই সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ, রমজানুল মোবারক হলো পরকাল উপার্জনের ভরা মৌসুম। এ মাসে ভালো কাজের প্রতিদান এত অধিক যে, কোনো ব্যক্তি একটি নফল আদায় করলে, অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করার সওয়াব পাবেন। আর এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করার প্রতিদান পাবেন। এ মাসটি ধৈর্য ও সবরের মাস। আর ধৈর্য-সবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। এটি সহমর্মিতার মাস। এটি এমন এক পুণ্যময় মাস যে মাসে মোমিনের রিজিকে প্রবৃদ্ধি ঘটানো হয়ে থাকে। এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে তার গোনাহ মাফ হয়ে যায়, জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পাওয়া যায় এবং রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াবের অংশীদার হওয়া যায়, কিন্তু রোজাদারের সওয়াবে কোনো হ্রাস হয় না। মোটকথা রমজানুল মোবারক একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস, নেকি অর্জনের ভরা মৌসুম। এমন গুরুত্বপূর্ণ মাসকে মোমিন কিছুতেই অবহেলা করতে পারে না।
এ মাস মূলত মুসলমানকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার জন্য এসেছে। এ মাসে পরিশুদ্ধ হওয়ার ও আখেরাতের জন্য কামাই করার অবারিত সুযোগ। এজন্যই এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, 'যখন রমজান আগমন করে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।' (বোখারি : ২/৬৭২, মুসলিম : ২/৭৫৮)। হাদিস শরিফে আরও এরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান আগমন উপলক্ষে সাহাবিদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, 'তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসটি বরকতময়। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর এ মাসের সিয়াম ফরজ করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুর্বিনীত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয় সে একেবারেই বঞ্চিত ও হতভাগা।' (সুনানে নাসাঈ : ৪/১২৯)।
এ মাসে একটি নফল আমল করলে একটি ফরজ আমল করার সওয়াব পাওয়া যায়। একটি ফরজ আমল করলে সত্তরটি ফরজ আমলের সওয়াব পাওয়া যায়। হাদিস শরিফে আছে, 'যে ব্যক্তি রমজানে একটি নফল আমল করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল।' (শুয়াবুল ঈমান : ৩/৩০৫-৩০৬)। কিন্তু দিন দিন রমজানের গুরুত্ব ও পরিচ্ছন্নতা আমাদের থেকে উঠে যাচ্ছে এবং তা অনেকটা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন রমজানে যতটা না রোজার মাহাত্ম্য ও তার পরিচ্ছন্নতার দিকে গুরুত্ব দিই তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই রমজানের আনুষ্ঠানিকতার প্রতি। ইফতারিতে কী খাব? আর সেহরিতে কী খাব? বাজার কী করব? ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রমজানের মাহাত্ম্য বিধ্বংসী কার্যকলাপের দিকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। তাই রমজান আসে রমজান যায়, কিন্তু আমাদের আমলের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না। সারা বছর তো আমরা আমাদের আমলের পরিশোধন-চিন্তা করিই না, এমনকি রমজান মাসেও আমাদের আমল স্বাভাবিক থাকে। আগের তুলনায় একটুও পরিবর্তন হয় না।
রমজান আমাদের খাদ্যে পরিবর্তন ঘটায়, পরিবর্তন ঘটায় পোশাক-আশাকে, হাট-বাজারের খরচসহ অনেক কিছুতে। রমজানে আমরা খাদ্যে উন্নতি আনার চেষ্টা করি, হাট-বাজার আগের তুলনায় ভালো করার চেষ্টা করি, কিন্তু আমলে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করি না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের রমজান মাস দিয়েছেন আমল পরিশুদ্ধ করার জন্য। আমরা তা না করে বরং উল্টোটাই করছি। এতে একদিকে যেমন আমরা রমজানের মতো মহান একটি মাসের মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, অন্যদিকে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতার কারণে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধে নিপতিত হচ্ছি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, রমজান উৎসব-অনুষ্ঠানের নাম নয়; বরং তা হচ্ছে পানাহার, স্ত্রী সম্ভোগের বাহ্যিক চাহিদাগুলো পরিত্যাগ করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা ও প্রতারণার কাজ পরিত্যাগ করে না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহ তায়ালার কোনো প্রয়োজন নেই।' (আল হাদিস)। অন্য বর্ণনায় আছে, 'রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষার ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ মিথ্যা কথা ও পরনিন্দার দ্বারা তাকে ছিদ্র করা না হয়।' (সহিহ ইবনে খুযায়মা : ১৮৯২)। এ মাসটি অন্য মাসের মতো নয়। রোজার মাধ্যমে অন্তরে আল্লাহভীতি ও ঈমানি লজ্জা সৃষ্টি হয়। রোজাদার ক্রমে গোনাহ থেকে দূরে সরতে থাকে। রোজা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষাকারী ঢালস্বরূপ হয়ে যায়। তবে এর জন্য শর্ত হলো গিবত-শেকায়েত ও মিথ্যা কথা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
একাধিক হাদিসে এ দুটি গোনাহের ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। অথচ রমজানে এ দুটি গোনাহ আমাদের থেকে বেশি হয়। গিবত-শেকায়েত, অনর্থক কথাবার্তার মাঝে রমজানের মহামূল্যবান সময়গুলো বিনষ্ট করে দিই। আমাদের অনেকে রমজানে সারা দিন কাজ না থাকায় গিবত করে সময় কাটায়। সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, আমরা গিবতকে বড় ধরনের কোনো অন্যায় মনে করি না। বরং আমাদের অনেকে এভাবে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যে, এ কথা আমি অমুকের সামনেও বলতে পারব। অথচ কারও সামনে তার দোষচর্চা করতে পারলেই গিবত জায়েজ হয়ে যায় না। বরং পেছনে দোষচর্চা করা যেমন কবিরা গোনাহ, সামনে দোষচর্চা করাটাও কবিরাহ গোনাহ।
©somewhere in net ltd.