নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাঝে মাঝে চাই কেউ আমার কথা শুনুক। এইতো।

মুহাম্মদ মাহিন

মুহাম্মদ মাহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সংসার

২৪ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:২২

নাহারের বিরক্তির সীমা এখন চুড়ান্তে। একেতো ভর দুপুরে আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি, তার উপর কিছুক্ষণ আগে একটা গাড়ির কারণে তার শাড়ি কাদায় ভরে গেছে। অন্য কোন দিন হলে এতটা খারাপ লাগত না। কিন্তু আজ তার বিয়ের দিন।
নাহারের পরনে তিন রঙা জামদানী। সবুজ আর লালের মাঝে সাদার একটা পাড় চলে গেছে। ঠিক সবুজ না, টিয়া রং বললে বেশি ভাল হবে। নাহার শাড়ির সাথে মিলিয়ে লাল-সাদা রঙের কাচের চুড়ি পরেছে। সবুজ খুঁজে পায়নি। কিন্তু তার কান,নাক খালি। গেল মাসে গোসল করতে গিয়ে কানের দুল হারিয়েছে। আর নাকে সে আগেও কিছু পরত না। কানের দুল আবার নেবে নেবে করেও নেয়া হয়নি।
বিয়ের সাঁজ বলতে শাড়িটা পরেছে আর মুখে গাড় লালের লিপস্টিক। ব্যাপারটা এতটাই সাবলীল যে, কেউ তাঁকে দেখে বুঝতে পারবে না যে আজ নাহারের বিয়ে।
বিয়ে অবশ্য হয়ে গেছে। মতিঝিলের একটি লোকাল কাজি অফিসে বিয়ে সেরেছে ওরা। রুদ্র ওকে নামিয়ে কোথায় যেন গেছে। নাহার মোহাম্যাডান স্পোর্টিং ক্লাবের গলিটার ঠিক পাশেই দাঁড়ান। একেতো শুক্রবার ,তার উপর জুম্মার পর। তাই রাস্তা ঘাট একরকম খালি। যদিও কোন কারণ নেই ভয় পাওয়ার, কিন্তু কারণ ছাড়াই নাহারের ভয় করছে। ওদিকে কিছুক্ষণ পর পর বিশাল বিশাল বাজ পড়ছে। “রুদ্র কোথায় গেল?”, এই ভাবনায় বৃষ্টির মাঝেও নাহারের ঘাম ঝরছে। কিন্তু বৃষ্টির পানি চুল ভিজিয়ে নাহারের ফর্শা গাল দুটো বেয়ে নিচে পড়ছে, যার কারণে ঘাম দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কপালের ভাজ ভয়টাকে পুরোটা ঢাকতে দিল না।
হলুদ কটকটে একটা পাঞ্জাবি পরে জোরে জোরে ছুটে আসছে রুদ্র। ওর হাতের মধ্যে কি যেন। প্যাকেটে বন্দি থাকায় বোঝা যাচ্ছে না।
-একটু দেরী হয়ে গেল। দোকান পাঠ খোলা নেই খুব একটা।
-কোথায় গিয়েছিলে?
-মিষ্টি আনতে। কিন্তু পেলাম না।
-তাহলে এখানে কি?
-মিষ্টি পান। মিষ্টি জর্দা দেয়া। নাও, খাও।
-এই অবস্থায় পান খাব?
-মিষ্টি মুখ করবে না?
-রুদ্র?........
এই বলেই চুপ করে গেল নাহার। আজ বিয়ের দিন। সে কোন রকম ঝগড়া চায় না।
-নাহার, সি.এন.জি তো পাচ্ছি না। বৃষ্টি থেমে গেলেই বাসে উঠবে? নাকি আরেকটু দেরী করবে?
-নাহ! এখনই উঠব। উত্তরার বাস পাওয়া কষ্টকর এখান থেকে। ওনারা বসে থাকবেন। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে।
-বৃষ্টিটা একটু কমুক।
-একই কথা। আর এমনিতেও ভিজেই আছি।
-ঠিক আছে চল।
বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তরার একটা দোতলা বি.আর.টি.সি আসল। নাহার আগেই উঠল। নীচে জায়গা খালি ছিল তারপরেও সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। ভাগ্য এই জায়গায় ভাল। নাহার দোতলার একেবারে প্রথম সিটটা পেয়ে গেছে। ওর এই জায়গাটা খুব পছন্দের। দোতলা বাসে উঠলে চেষ্টা করে এখানটায় বসার। খুব একটা পায় না। আজ পেয়ছে। আসলে বলতে গেলে দোতলা পুরোটাই খালি। নাহার বসলে তার পাশের সিটেই রুদ্র বসল।
ছেলেটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না, একটু আগে ভাড়া করে আনা সাক্ষী দিয়ে তার বিয়ে হয়েছে। তিনবার কবুল বলার জায়গায় সে চারবার কবুল বলেছে। কাবিনের যেখানটায় বরের সই করতে হয় সেখানে না করে ফেলেছে কনের জায়গায়। কাজী ক্ষেপে গিয়েছে। কাজীর রাগ করাটা স্বাভাবিক। একেতো তাদের কোন সাক্ষী ছিল না। কাজি কিছুতেই এই বিয়ে দেবে না। আইনি জটলতা আছে। নাহারের কাকুতি-মিনুতিতে কাজি রাজি হয়েছে। সাক্ষী একজন হল কাজি অফসের কাজের ছেলেটা। আর নিচে নেমে রুদ্র একজন রিক্সাওয়ালা আর একজন সি.এন.জি ড্রাইভার নিয়ে এল। দুজনকেই ১০০টাকার দুটো নোট দিয়েছে। কাবিন নিয়েও ঝামেলা হয়েছে। রুদ্র কিছুতেই ২০০০ টাকার বেশি কাবিন করবে না। এর চেয়ে বেশি ও দিতেই পারবে না। কাজি কিছুতেই বুঝাতে পারছে না যে এখন ৫০০০টাকার নিচে কাবিন হয় না। রুদ্র বলল “ইসলামে তো এমন কোন নিয়ম নেই।” তখন কাজি চেতে গেল, “ভাই, জুম্মার নামাজে যাব। আপনি বিয়ে করলে করেন, না হলে আমাকে যেতে দেন। আপনার সাথে তর্ক করতে পারব না।” নাহার মীমাংসা করল শেষে।
এমন সব ঝামেলার লেশ মাত্র চিহ্ন তার এখন চেহারাতে নাই। বরং তার ভাগের দুশ্চিন্তাও নাহার একাই করছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে রুধ্র ভেজা পকেট থেকে একটা পলিথিনে মোড়ান ব্রিস্টলের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। টান দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেক ধকল গেছে আজ।
কিন্তু নাহারের বাধ ভেঙ্গে গেল।
-এই, উঠ আমার পাশ থেকে। ওপাশে যাও। যাও, ওপাশে।
রুদ্র একটু ভয় পেয়ে উঠে গেল। নাহার বাসের ছোট জানালার পাশে মাথা রেখে বসে রইল। সে কিছুক্ষণ কাঁদবে। সে চায় না এই কান্নাটুকু রুদ্র দেখতে না পাক।
এয়ারপোর্টের সামনে এসেই তারা নেমে পড়ল। হাজী ক্যাম্পের সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে উত্তর খান। “প্রবীণ নিবাস” নামে একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে সেখানে। বিয়ের পরের খাওয়াটা তারা এখানেই খাবে। কিন্তু সেখানে যেতে যেতে বিকেল হয়ে গেল। তাই দুপুরের খাওয়া ধরা যাবে না। বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ার টেকার কামরুল ভাই রুদ্রের পরিচিত। রুদ্র মাঝে মাঝে এখানে আসে। এদের সাথে সময় কাটায়। এখানে আসার ইচ্ছেটাও রুদ্রের ছিল। নাহারের কাছে ভাল লেগেছে বিষয়টা। ঢোকার মুখেই কামরুল ভাইএর সাথে দেখা।
-আপনাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সবাই শেষ। আপনার মোবাইল বদ্ধ কেন?
-বন্ধ নাকি? চার্জ নেই মনে হয়।
-ভাবি আসসলামুলাইকুম। আপনি দেখি ভিজ্জা শেষ। আসেন আসেন। রহমত? কইরে তুই? এই একটা গামছা-টামছা কিছু দে। ভাবি ভিতরে আসেন।
চার তলা বাড়ি। পুরোটাই বৃদ্ধাশ্রম। কামরুল ভাই কেয়ারটেকার যার স্বভাব হল সব কথার মধ্যে “শেষ” শব্দটা ঢোকান।
-ভাই, সবাই কি খেয়ে ফেলছে?
-নাহ! কেউ খায় নাই। যে শুনছে আপনি নতুন বউ নিয়া আসবেন। কেউ কিছু খায় নাই। এ দিকে চিন্তায় আমি শেষ।
-বলেন কি? খাওয়ার দেন তাড়াতাড়ি।
-দিতাছি, আপনেরা আসেন।
কামরুল ভাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। খুব বেশি মানুষ আছে এখানে তাও না। সব মিলিয়ে ২৬ জন। ১৪ জন মহিলা, বাকি সবাই পুরুষ। আর কাজের মানুষ রহমত।
-নাহার। তুমি মাথা মুছে নিয়েছ? কামরুল ভাইকে একটা শাড়ি দিতে বলি? ভেজা শাড়ি, ঠান্ডা লাগবে তোমার। কতক্ষণ আর পরে থাকবা?
এইবার মুখ খুলল নাহার।
-নাহ! একেবারে বাসায় গিয়েই খুলব। মাথা মুছে নিয়েছি। চল। ওনাদের বসিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না।
সবাই এক সাথে বসে খাওয়া শুরু করলেন। আজ রান্নার আইটেম ভাল হয়েছে। মুরগী, খাসী, পোলাও, সবজি আর চিংড়ি মাছের আইটেম। খাবার বেড়ে দিচ্ছে নাহার। কামরুল ভাই অনেক মানা করেছেন কিন্তু শোনেননি। রুদ্র অবশ্য নির্বাক। সে পানির জগ হাতে নিয়েই দাড়িয়ে ছিল বেশির ভাগ সময়। নাহার জানে ওর পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব হবে না। খাওয়ার মাঝেই রহমতকে পাঠান হয়েছিল দই আনতে। খাওয়ার শেষে একটু মিষ্টি মুখ হবেই।
সবশেষে খেতে বসল কামরুল ভাই, রহমত, নাহার আর রুদ্র। সবার মধ্যে খাওয়ার স্পীড বেশি রুদ্রের।
-এই আস্তে খাও। আর খাওয়ার মাঝে শব্দ হচ্ছে কেন তোমার?
এটা শুনে রহমত হেসে দিল। রহমতকে ঝাড়ি দিল কামরুল ভাই।
-সব জায়গা দাঁত কেলানী। খাইতে বইছস খা। এত দাঁত কেলানী কেন? ফাযিল কোনহান কার।
খাওয়া শেষ করে গল্প আড্ডা মেরে, ময়-মুরুব্বীদের দোয়া নিয়ে বের হতে হতে সন্ধ্যে সাতটা। নাহার চেয়েছিল কিছুক্ষণ হাটে। এদিকে আবার কাঁচা রাস্তা আছে। শহরের এত কাছে কাঁচা রাস্তা পাওয়া যায়, নাহারের সেটা কল্পনাতেও আসেনি। হাটার চিন্তাটা রুদ্রর কারণে সফল হল না। কারণ আজ তাদের প্রথম দিন, বাসা কিংবা বাসর কোনটাই ঠিক-ঠাক হয় নি।
বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছে। কিন্তু আসবাব পত্র কেনা হয়নি। এখন যাবে মিরপুর ১০ এ। স্টেডিয়ামের নিচে কিছু আসবাবের শো-রুম আছে। কম দামের ভেতর ভাল জিনিস পাওয়া যায়। সেগুলো নিয়ে গোছগাছের ব্যাপার আছে। বাসাও এদিকেই নেয়া হয়েছে। জায়গাটার নাম কালাপানি। এক রুমের বাসা। সাথে লাগোয়া বাথরুম আর রান্না ঘর।
এতসব চিন্তা মাথায় নিয়ে এই সন্ধ্যায় রোমান্টিক হাটা দেয়া রুদ্রের পক্ষে সম্ভব না জেনেই এই প্ল্যান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে নাহার। এয়ারপোর্ট রোড থেকে সি.এন.জি পেল ওরা। ভেতরে ঢুকেই হেলান দিয়ে বসে গেল রুদ্র। কিছুক্ষণ পর প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। অন্ধকারে নাহার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন সিগারেটের গন্ধ নাহারকে বিরক্ত করছে না। বরং আবছা আলোতে রুদ্রর চেহারাটা ওকে একটা অচেনা মায়ায় বেধে ফেলছে। রুদ্র বরাবরই বাম হাতে সিগারেট খায়। ডান হাতে হাত রাখল নাহার। শক্ত করে একটা চাপ দিয়ে রুদ্রের ডান কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। রুদ্র নিশ্চুপ। নাহার জানে এই ছেলে কিছুই বলবে না। ভালবাসার ভ-ও এই ছেলে বোঝে না।
স্বাভাবিক মানুষের সংসার বোধহয় এভাবে শুরু হয় না। কিন্তু এতিম খানায় বড় হওয়া দুটো এতিমের সংসার এর থেকে ভাল করে শুরু করার কোন উপায় নাহারের জানা নেই। থাকলেও সামর্থের মধ্যে নেই। শুধু আছে রদ্রর হাত খানি। যে হাত ধরে বাকি পৃথিবীটা কাটাতে চায় নাহার।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.