নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাঝে মাঝে চাই কেউ আমার কথা শুনুক। এইতো।

মুহাম্মদ মাহিন

মুহাম্মদ মাহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

তামাক পাতা

১৩ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৮

ঈদের পর আর খুব বেশি দিন ক্লাস নেই। টার্কে সামার সেশনে যারা যায় তাদের এদিকে একটু সুবিধা। ৯০ দিনের জায়গায় ৭৬ দিন কর্ম দিবস। ৬৬ তম দিনের কথা বলছি। সবে মাত্র সবাই ঈদের ছুটি শেষ করে টার্কে ফিরেছে। আমি সকালেই ব্র্যাকের গাড়িতেই এসেছি। এসেই দেখি আমার রুমম্যাট হাসান এখনও আসেনি। আমি লাগেজ আনলক করে জামাকাপড় কাপবোর্ডে রাখলাম। চাদর বিছালাম। রুমটা হালকা একটূ ঝাড় দিলাম। পরিষ্কার পরিছন্নতায় আমার একটু বাতিক আছে। হাসান আসতে আসতে বিকেল হল। তার নীল রঙের লাগেজ আর কাঁধে গিটার। এসেই এক গাল হাসি দিয়ে,
-ভাই, কি অবস্থা?
-ভাল, তোর এত দেরী।
একটু পরেই এলাম। নিজের মত করে।
এসেই ব্যাগ আর গিটার রেখে বেরিয়ে গেল। এই ছেলেটা খুব নিঃশ্চুপ। বেশির ভাগ সময় ডর্মের ভেতর থাকত। ছায়ানীড় ডর্মটাও এমন। নিরব সবুজে ঘেরা পরিবেশ। সারাদিন রুমে থাকলেও খুব একটা খারাপ লাগবে না। আমি নিজেও যে খুব বের হইনা। বলা যায় এক রকম ডর্মের পরিবেশটাই ভাল।

তিন জনের জন্য একটা রুম। রুম গুলো একটার সাথে আরেকটা লাগানো। সমান্তরালে করা হয়েছে, দুপাশে টিনশ্যাড বিল্ডিং মাঝে একটু উঠানের মত খোলা জায়গা আছে। গুল্ম শ্রেণীর গাছ হাসনা হেনা বসানো আছে তিনটা । উঠানের ঠিক মাঝে ইংরেজি ভি অক্ষরের মত সরু হাটার রাস্তা যেটা গেটের কিছু আগে এসে শেষ হয়ে সিমেন্টের বানানো মেঝেতে গিয়ে শেষ হয়েছে। আর সীমানার দিকের জায়গাটায় চারটা চারটা করে গোসলখানা আর ল্যাট্রিন দেয়া আছে। গেট দিয়ে ঢুকেই হাতের ডানে পড়বে ডর্ম সুপারভাইজারের কামরা। আর অপর পাশের বাম দিকের কোনাটায় ছিল আর এস কর্মীর রুম। বাকি গুলোতে ছাত্ররা থাকত। ছাত্রী থাকার রেকর্ড ছায়ানীড়ের নেই। তবে লোকমুখে শোনা যায় কাপবোর্ডের ভেতরও নাকি মেয়ে পাওয়া গিয়েছিল। সেসব গুজব বৈকি।

রুমের সামনে হাটা হাটি করার জন্য ২ফিট করে মেঝে বানানো আছে। বাম পাশের বাথরুমের সামনের হাটাহাটির জায়গাটা ধূমপায়ীদের জন্য নির্ধারিত। তাও শুধু রাত ১০ থেকে ভোর ৬.৩০ পর্যন্ত।তবে বেশির ভাগ সময় সেখানে শুয়ে বসেই ধুমপানের কারবারটা সারা হয়। স্মোকিং জোনের ঠিক পাশেই আমাদের আর.এস.এস সালামের রুম ছিল। সেটা হচ্ছে ভোর ৬.৩০ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গোপনীয় স্মোকিং জোন।সেটার ভেতর স্মোকিং করা কালে নিজেকে ইল্যুমিনেটি বা অপাস দাইয়ের মত গোপন সংগঠনের লোক বলে মনে হতেই পারে। শুধু মাত্র কিছু সংখ্যক লোকই সেখানে বিড়ি খাওয়ার সাহস বা অধিকার পেয়েছিল। ডোর্মের বাইরে অবশ্য স্মোকিং জোন আছে। তবে সেখানে একমাত্র সিগারেট না থাকলেই যাওয়া হত। কারও না কারও কাছে থাকবেই, চাইলেই ২-১ টান দেয়া যেতে পারে।

টার্কে সিগারেট এর ব্যাপারে একটু ঝামেলা পোহাতে হয়। ভেতরে সিগারেট পাওয়া যায় না। শুক্রবার নামাজের জন্য বের হলে তখন কিনে নিয়ে আসতে হয়। তাও ভেতরে ঢোকার সময় চেকিং সহ হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আমি একবার পান নিয়ে এসেছিলাম। পুরো পান খুলিয়ে দেখাতে হয়েছে ভেতরে কি আছে। একবার আশিক ভাবল এটা নিয়ে একটা মজা করা যাক। এক শুক্রবারে নামাজের পর ২ প্যাকেট বেনসন, ২প্যাকেট গোল্ডলীফ আর ২প্যাকেট আকিজ বিড়ি সাথে নিয়ে ঢুকল। যথারীতি চেকিং এর সময় আশিক সেই বিড়ির প্যাকেট বের করল।
-বিড়ি??
-জ্বি, স্যার।
-বিড়ি খাও তুমি? ক্লাস নাই তোমার? ব্র্যাকের পোলাপাইন বিড়ি খায়?
-স্যার আসলে ঠেলায় পড়লে সবাই খায়। এই যে ব্যানসন দেখছেন স্যার। এটা স্মোকিং জোনে বের হলে খাব। নিজের সম্মানের একটা ব্যাপার আছে স্যার। এরপর রাতে ডর্মে গেলে খাব গোল্ডলীফ। আর রাত ১২টার পরে তামাক বেশি লাগে স্যার। তাই বিড়ি। ১২টাকায় ২০টা। আসি স্যার। পরে কথা হবে।
স্যার কিছুক্ষণ হা করে আশিকের চলে যাওয়া দেখলেন। তারপর অন্যদের চেকিং শুরু করলেন।

-কিরে কি বই পড়িস?

আমার কথায় পৃথিবীতে ফিরে এলো হাসান। বইয়ের পোকা না বলে ড্রাগন বললে ভাল হবে ছেলেটাকে। সাথে করে কিছু বই নিয়ে এসেছিল। এরপর আমাদের লাইব্রেরির সব বই ও পড়ে ফেলেছে এই কয়দিনে।

টার্কে reading for pleasure নামে একটা লাইব্রেরী সেশন আছে। লাইব্রেরী থেকে নিজের পছন্দ মত যেকোনো একটা ইংরেজি বই আনতে হবে। সেটা পড়ে শেষ করে আবার জমা দিতে হবে। তখন লাইব্রেরিয়ান একটা মৌখিক পরীক্ষা নেবেন পড়ে ফেলা বইটার উপর। কিন্তু লাইব্রেরিয়ান হাবিব ভাইকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে উনি জীবনে একাডেমিক বই ছাড়া অন্য কোন বই খুলেও দেখেননি। এদিকে মাহমুদ সকাল ৯টায় গিয়ে নিয়ে এসেছে ১৬ পৃষ্ঠার একটা কমিক বই। পুরো ডর্ম হাসতে হাসতে শেষ। তার সোজা উত্তর “আমার বই পড়তে ভাল লাগে না”। কিন্তু আমার ভাগ্যে এমন বই পড়েনি। আমি বিকেলের দিকে লাইনের ধকল পেরিয়ে ফ্রেঞ্চ লেখক টামি হোগের “লাকি’স ডে” নামে একটা বই নিয়ে এসেছিলাম। অর্ধেক পড়ার পর আর মজা পাইনি। সেখানেও হাসান বিশাল এক বই নিয়ে এলো। ৩দিনের মাথায় ফেরত ও দিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করায় বলল আগেই পড়া ছিল।

হাসানের বিষয়টা খুলে বলতে হয়। প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খায়। দিনে ২প্যাকেট শেষ করে আরেক প্যাকেট খুলতে হয়। হুম মাঝে মাঝে অন্যদের দেয়। তবে বেশির ভাগ সময় একা একা থাকে বলে খুব একটা শেয়ারিং হয় না। খুব বেশি মানুষের সাথে মিশে না। লাইব্রেরী, ডর্মের স্মোকিং জোন আর রুম। এ ছাড়া আর কোথাও যাতায়াত নেই। হাসানের আরেকটা দিক হচ্ছে ও সত্যি খুব আড্ডা প্রিয়। কিন্তু সবার সাথে ও কথা বলে না। তার ভাষায় সবার সাথে নাকি তার রাশি মেলে না। সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে গিয়ে টার্কের সুপারেন্ডেন্টের সাথেও এক ঘাত হয়ে গেছে এ নিয়ে। বিষয়টা ছিল এই সিগারেট । যাদুঘরের ঢোকার সাথে সাথেই যাদুঘরের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন হাসানের মত স্মোকারের পক্ষে ১২টা পর্যন্ত সিগারেট না খেয়ে থাকাটা সত্যি বেদনাদায়ক। কিন্তু গেটের দারোয়ান বলছে স্যার না বললে যেতে দেবে না। কি আর করার হাসান সরাসরি স্যার এর কাছে গিয়ে সিগারেট খাওয়ার অনুমতি চাইল। আর স্যারও আকাশ থেকে পড়ল। টার্কের সুপারেন্ডেন্ট, যার কথায় টার্কের সবাই ওঠে বসে সে কোন ছাত্রের কাছে এ ধরনের আবদার প্রত্যাশা করতে পারেনি। রাগ দমিয়ে সুন্দর করে হাসানকে কিছু কথা শোনাল। বলল,
-না, আমি তোমাকে অনুমতি দিতে পারছি না। আর তুমি এটা আমাকে কিভাবে জিজ্ঞেস কর? আমি তোমার বাবা হলে এটা জিজ্ঞাসা করতে পারতে? আর তোমার কি মিনিমাম সেন্স অফ প্রপোশন নেই? কাকে কি জিজ্ঞাসা করতে হয় এটাও জানো না?
দাঁতে দাঁত চেপে হাসান চলে এলো। টার্ক কিংবা হাসানের জীবনের ইতিহাসে সেটাই ছিল হাসানের রেকর্ড করা দিন। এতটা সময় নাকি এর আগে সিগারেট ছাড়া ছিল না। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম কবে থেকে সিগারেট খায়। বলল ক্লাস সিক্স থেকে। আমি বললাম তুই তো দেখি আসলেই বখাটে ছেলে।

এই বখাটে ছেলেটাই দেখি একদিন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিল। ঈদের ছুটির ৭-৮ দিন আগে হঠাৎ আমাকে এসে বলল,
-ভাই আমি আর সিগারেট খাব না। এখানে ৬ প্যাকেট আছে। আপনি এগুলো নিয়ে নেন।
আমিও টুকটাক খাই। কিন্তু এতগুলো? আমি বললাম,
-কি হয়েছে?
-মায়া নিষেধ করেছে। বলেছে আর যদি সিগারেট ছুই তবে নাকি ওর মরা মুখ দেখব। সিগারেট ছাড়া হয়তবা খারাপ লাগবে তবে ওর মরা মুখ দেখতে পারব না।
বুঝলাম এবার আর ওকে দিয়ে সিগারেট ছোঁয়ানো সম্ভব হবে না।

হাসানের লাইফের দুইটা দুর্বলতা। এক হচ্ছে সিগারেট আর একজন হচ্ছে মায়া। মায়াকে ছাড়া হাসানকে কল্পনা করা যায় না। মায়ার আসল নামটা কেউ জানে না। এমনকি আমিও না। তবে দেখি মাঝে মাঝে তার সাথে কথা হচ্ছে নয়ত চ্যাট। টার্কের আরেক প্যারা হচ্ছে ফোনের নেটওয়ার্ক। এটাও পাওয়া যায় না। ছাড়ানীড়ে ঢোকার সময় গেটের সামনে কিছুটা পরিষ্কার। টেলিটক আর গ্রামীণ আবার একটু সুবিধা হয় এ ক্ষেত্রে। এ-দুটো কিছুটা ভাল সার্ভিস দিত। হাসানকে দেখতাম রাতের বেলায় গ্রিল ধরে বসে মায়ার সাথে কথা বলছে নয়ত চ্যাট করছে। সবদিন যে বলত তা না। তবে হাসানের এয়ারটেল এর নেটওয়ার্ক এই জায়গাটা ছাড়া কাজ করত না। জায়গাটাতে মশাও ছিল প্রচুর। মায়াকে খুব ভালবাসত ছেলেটা। কিন্তু মায়া বাসত না। ও নাকি হাসানকে শুধুই বন্ধু হিসেবে দেখতে চায়। গত দেড় বছর ধরে এই চলছে। কথা-বার্তা, ঘুরাঘুরি সবই হচ্ছে। তবে সবই বন্ধুত্ব। ভালোবাসার ছিটে ফোটাও নাকি নেই।
-তুই কি সত্যি মায়াকে ভালবাসিস না?
-বাসি ভাই। নিজের থেকেও বেশি।
-তাহলে মায়া?
-ও বাসে না। এতে আমার কি করার আছে?
-কি করার আছে মানে কি? খামাখা একটা মেয়ের পিছে ঘুরে লাভ আছে? ভুলে যা ওকে। পরেতো কষ্ট পেয়ে নেশা ধরবি।
-ভাই, ওর হাসিতেই আমার নেশা। এই যে কথা বলছে, আমার সাথে মজা করছে, হাসছে, দুষ্টুমি করছে এসবকিছুই আমার নেশা। এর চেয়ে বড় নেশা আমাকে আর কি ক্ষতি করবে? আর ও আমাকে ভালবাসে না এটাও একটা সত্য। কিন্তু ওকে ছাড়া থাকাটা আমার পক্ষে খুব কঠিন। যেভাবেই থাকুক আমার সাথেই থাকুক। আমি আর কিছুই চাই না।
-কবে থেকে এই কাহিনী?
-অনেক আগ থেকেই। একদিন ক্লাস শেষ করে দেখি ও গায়েব। ফোন দিয়ে জানলাম সাত তালার সিঁড়িতে আছে। গিয়ে দেখি ভা ভা করে কাঁদছে। এত সুন্দর ছিল দৃশ্যটা। বাইরে বৃষ্টি আর ভেতরে মায়ার কান্না। ওর বাম চোখের নীচের পাতায় একটা তিল আছে। আমি অবশ্য আগে খেয়াল করিনি। সেদিনই প্রথম খেয়াল করলাম তাও ও বলায়। কান্না জড়ানো সুরে বলল, “তুই কখনও আমার দিকে খেয়াল করিস না। আমার চোখের পাতায় একটা তিল আছে জানিস?”। আমি খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম এই তিলটা আর কোনদিন লোনা জলে ভেজাব না।
-বাহ! তুই তো দেখি আরেক মজনু। ও কাঁদছিল কেন?
-আমিও জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল “দাড়ি শেভ করেছিস কেন?”, আমি বললাম “তুই কি এইজন্য কাঁদছিস?”। তারপর হাসাহাসি শুরু। মেয়েটা অনেক চাপা স্বভাবের। ভেতরের কথা কাউকে বলে না। আর প্রচুর মিথ্যা বলে।
-বলিস কি? তবেতো ঝামেলা।
-কিন্তু আমার সাথে বলে না।
-কেন?
-আমি নাকি ওর সব বলা ফ্রেন্ড। এই জন্য।

হাসানের ভালোবাসার গভীরতা অনেক ছিল। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম এর পরিণতি নিয়ে। ভালোবাসা কোন নিয়ম নীতি মেনে চলে না এটা যেমন সত্য তেমন ভালোবাসার পরিপূর্ণতা চাওয়াটাও সত্য। শঙ্কিত ছিলাম এ ব্যাপারটা নিয়ে। এরই মাঝে একদিন ঈদের ছুটি চলে এলো। ছুটীর ঠিক আগের দিন হাসান জিজ্ঞাসা করছে,
-ভাই, কাল সকালের ক্লাসটা করেই আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি। ভালো কোন -রেস্তোরার খোঁজ দিতে পারেন?
-কেন? হঠাৎ রেস্তোরা?
-মায়াকে নিয়ে খেতে যেতাম। আপনাকে বলা হয়নি। মায়া জানিয়ে দিয়েছে সেও আমাকে ভালোবাসে।
-অভিনন্দন। এটা সত্যি একটা খুশির সংবাদ। কবে বলল?
-এইতো কয়েক দিন আগে। কাল দেখা করতে যাচ্ছি।
-যা, ভাল লাগল। তুই এক কাজ করিস। একটা রুফটপ ক্যাফে আছে গুলশান ২ এর দিকে। একেবারেই নতুন। ঘুরে আয় ওকে নিয়ে। ভাল লাগবে তোর। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।
-আচ্ছা ভাই। আর আমি চাই না এ খবরটা কেউ জানুক। আর মায়াও চায় না।
-আচ্ছা ঠিক আছে কেউ জানবে না।

আমার খবরটা শুনে খুব ভালই লাগল। হাসান সিগারেট ছেড়ে দিল। ছেলেটা পড়াশোনাও সিরিয়াস। ওদের ফ্যামিলিও ভাল। নাহ! মেয়ে সত্যি খুব ভাল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে চলে এলাম তারপর হাসানের সাথে আর কথা হয়নি। নিজের কাজ নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। ঈদের ছুটি শেষ হলে আমি আবার ঢাকা চলে আসি। টার্কের ৬৬ তম দিনে আবার দেখা হয় হাসানের সাথে। রাতের বেলায় গোসল করে বের হচ্ছি। আমার আবার রাতে সব কাজ শেষে একটা শাওয়ার নেয়ার অভ্যাস আছে। শাওয়ার নেয়া শেষে মাথা মুছতে মুছতে চোখ গেল বারান্দায়। এক কোনায় বসে আছে হাসান, হাতে জলন্ত সিগারেট।
-কিরে? ঈদের বন্ধেই সিগারেট ছেড়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা শেষ?
-যার কাছে প্রতিজ্ঞা ছিল সেই নাই, তাই প্রতিজ্ঞাও নেই?
বলেই চোখ নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে হাসান। কিছু বলতে যেয়েও বললাম না কারণ স্পষ্ট দেখতে পারছি হাসানের চোখ ভিজে আছে। এই ছেলেকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। তাই এইসময় কিছু জিজ্ঞেস করাটা আসলে খুব বেমানান লাগল আমার কাছে। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারছি যে কতটুকু জায়গা খালি হয়ে গেল ওর। এ শুন্যতা গুলো পরিমাপ করে দেখা যায় না। বোঝা যায় তাও খুব অল্প। এই ছেলেটাকে যখন থেকে চিনি তখন থেকেই দেখতাম পরী ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তারপরেও ব্যাটে বলে সবসময় মেলে না। নিয়তির কাছে কিছুই করার থাকে না।

এদিকে আমাদের কালচারাল নাইট চলে এসেছে। টার্ক মানেই কালচারাল নাইট। খুব জম-জমাট একটা অনুষ্ঠান হবে এবার বোঝা যাচ্ছে। অডিশন এর তারিখ দিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই নিয়ে ছেলে পেলের প্রস্তুতি চলছে পুরো দমে। আমার ক্লাসের মেয়ে আশরাফি আর আমি একটা নাচ দিতে চাচ্ছিলাম। এটা নিয়ে অবশ্য ঈদ এর আগ থেকেই কথা হচ্ছে। গান সিলেকশন, এডিটিং, নাচের স্টেপ সব মিলিয়ে ব্যস্ত দিন কাটল। হাসান শর্ট ফিল্ম করছে। ওটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে কোন কিছু নিয়ে ও কোন কষ্টে আছে। ব্যাপারটা আমার কাছেও ভাল লেগেছে। দুঃখ ভুলতে পারাটাও একটা বড় ব্যাপার। শুন্যতা সবাই কাটিয়ে উঠতে পারে না। ও পেরেছে কি পারেনি তা নির্ধারণ করাটা একটু কঠিন। কারণ চুপ করে থাকা মানুষগুলো অনেক ভয়ঙ্কর হয়। এরা পেটের ভেতর এটম ব্যোম নিয়ে মুখে হাসি নিয়ে আসতে পারে। কালচারাল নাইটের দিন এক হাসানকেই কোথাও দেখিনি। সারাদিন ডর্মের ভেতরই ছিল। আমার নাচটা খুব মজার হয়েছে। স্টেপ মেলেনি ঠিক মত, মাঝে নাচের স্টেপ ভুলে গেছি। তাও খুব মজা করেছি। আমি মঞ্চে উঠে অন্যরকম হয়ে যাই। ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের একটা পার্ট ছিল মঞ্চ নাটক। বাংলাদেশের ইতিহাসের উপর নাটক করে দেখাতে হয়। প্রতিটা শাখার জন্য আলাদা আলাদা টপিক থাকে। আমাদের পড়েছে সিপাহী বিদ্রোহ। আর সিপাহী বিদ্রোহ মানেই মঙ্গল পাণ্ডে। আমি করেছিলাম মঙ্গল পাণ্ডের রোল। ছেলে-পেলেরা খুব খেয়েছে। পরেতো আমার নামই হয়ে গেল মঙ্গল পাণ্ডে। রিহার্সাল কি করেছি খেয়াল নেই। মঞ্চে উঠে শুধু তাল মিলিয়ে গেছি, চরিত্রে ঢুকে গেছি এই যা। বাকিটা আল্লাহর রহমত। মোটামুটি আমাদের নাটকটা ফ্লপ খায়নি। মান-সম্মান ছিল এটাই বেশি।

কালচারাল নাইটের পর ফাইনাল এক্সাম। টার্কের দিন এখন ঘণ্টায় গুনছে সবাই। হাম আর ইংরেজি পড়েছে একই দিনে আর তার পরের দিন ডেভ পরীক্ষার পর সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। শেষ রাতে চলে এলো টার্ক। আমাদের ডর্ম টিউটর ছিলেন জসীম স্যার। উনি ছোট খাট একটা বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে ওনার রুমে নিয়ে আমাদের এক্টিভিটির সার্টিফিকেট গুলো দিয়ে দিলেন। তারপর টুক টাক আড্ডা দিয়ে যে যার রুমে চলে গেল। আমি রুমে এসে হাসানকে দেখলাম না। একটু পরে স্মোকিং জোনে গিয়ে দেখি কান্নার রোল পড়ে গেছে। সবার সেকি কান্না। কেউ দেয়াল ধরে, কি পিলারে হেলান দিয়ে, কেউ মেঝেতে শুয়ে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, যতরকম ভাবে পারা যায় সবাই বুক ভেজাচ্ছে। আমি আবার এদিক থেকে একটু পাষাণ গোত্রের মানুষ। আমাকে জড়িয়ে ধরেও দু-চার জন কেঁদেছিল কিন্তু আমি কাঁদতে পারলাম না। আমার মত আরেকজন আছে যে কি না কাঁদেনি। হাসান। তখনও তার হাতে সিগারেট। আমি কান্নাকাটির পালা শেষ করে প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ওর পাশেই বসলাম।
-কিরে, কি অবস্থা?
-আপনিতো ভাই সেই নাচেন। ভাল লাগছে।
-তুই দেখলি কই? তুই তো ছিলি না সেখানে।
-আপনার নাচের সময় ছিলাম। ভাল লাগছে।
-তো এই দুইদিন তো মুখ খুললি না। তুই কি মায়ার ব্যাপারটা নিয়ে এখনও আপসেট?
-একটা হালকা বাতাস নাক দিয়ে বের করে মুখটাকে বাম পাসে অল্পখানি বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকালো। অল্প মুহূর্তের জন্য ওর চোখ দুটো দেখলাম। অনেক কথা বলে যাচ্ছে নীরবে ওর দৃষ্টি। তারপর আবার মুখ নামিয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে লাইটার সিগারেটের আগায় ছুঁইয়ে খুব লম্বা করে ঘন কিছু টান দিল।
-আমি আপসেট কি আপসেট না এতে মায়ার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু যায় আসে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
-সেটাই। মনের মধ্যে কোন কিন্তু রেখে ঘুরিস না। দিনশেষে মানুষগুলো এমন।
-অনেক কিছু ভেবেছি বুঝলেন। দোষগুলো আসলে আমারই। আমার আগে থেকেই নিজের ব্যাপারগুলো বোঝা উচিৎ ছিল।
-কোন ব্যাপারগুলো?
-এই যে, ও আর আমি অনেক আলাদা। তাছাড়া ওর বাবা মা মেনে নেবে না। এই সেই। পুরোন গল্প গুলো। ভাই সত্যি বলতে কি আমি প্রেমে পড়া গোত্রের মানুষ না। আমার দ্বারা প্রেম কখনও সম্ভব ছিল না। কিভাবে যে এই মেয়েটা ভেতরে এসে বসে গেছে বুঝতে পারিনি। এই যা বিপদ হল আর কি। এছাড়া বাকি সবকিছু ঠিক ছিল।
-মায়ার এখন কি অবস্থা?
-জানিনা ঠিক। তবে ধারণা করছি কারও সাথে রিলেশনে আছে। ভালই আছে। এইতো।
-কি থেকে কি হয়ে গেল। বুঝলাম না কিছু।
-আমি নিজেও কিছু বুঝিনি। শুধু দেখেছি অন্য একটা মানুষের সাথে তার হেটে চলে যাওয়া। এইতো। আপনি অবস্থান গানটা শুনেছেন? ইথারের?
-হুম।
-“তুমি এত সহজেই ভুলতে পার।
অন্য কাউকে জড়িয়ে ধর।
আমি কেন শুধু ভুলে যেতে পারি না।” ভুলে যাওয়াটা খুব সহজ তাইনা?
-হুম যদি হাতে অপশন থাকে। তুইও ভুলে যা। খামাখা বসে থেকেতো লাভ নেই।

দুজন কিছুক্ষণ নীরব হয়ে সেখানে বসে রইলাম। আমার সিগারেট শেষ হলে আমি রুমে এসে পরদিন ডেভ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছি। হাসানও কিছুক্ষণ পর রুমে এসে পড়তে বসল। শীট হাতে নিয়ে রি-ভাইস দিতে দিতেই এক পলক ওর দিকে তাকালাম। কত বড় বোঝা সাথে নিয়ে চলছে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ব্যর্থতার বোঝার সমুদ্রের অতলের মত। শুরুটা হয়ত দেখা যায় কিন্তু শেষটা যে কোথায় তা ঠিকমত আন্দাজও করা যায় না। আমাদের সমাজে সমুদ্রের বালির সৈকতের মত মানুষগুলো খুব ভাল ভাবেই টিকে থাকতে পারে। যে দিকে স্রোত সেদিকে ছুটে চলে যায়। এরা সমদ্রের আঘাত পায় না, পায় মলিন ঢেউয়ের পরশ। গভীর স্মুদ্রের উত্তাল ঢেউ এদের কাছ পর্যন্ত আসতে আসতেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে চুর্ন-বিচুর্ন হয়ে যায়। আমি তাদের ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী বলে থাকি। আর কিছু আছে সুমুদ্রে মাঝে গড়ে ওঠা পাথর খন্ডের মত যারা উত্তাল ঢেউগুলোর শক্ত ঝাপটা সহ্য করে ঢেউয়ের শীতল পরশ কূলের জন্য পাঠিয়ে দেয়। প্রতিদিন হাজার প্যাসকেলের চাপ আর সুমুদ্রের ঢেউয়ের লক্ষ নিউটন বলের বিরুদ্ধের লড়াই করে যেতে হয় অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য। আমরা শুধু দূর পাড় থেকে তাদের পৈশাচিক অকৃত্তিম সুন্দরতা মানব লোচনের রেটিনার পর্দায় ক্ষনিকের জন্য আটকাতে পারি, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথেলামাস তাদের চাপের পরিমান নির্ণয় করতে পারে না। বিধাতার সৃষ্টির এ এক আজব রূপ। মানব মস্তিষ্ক অপরের বেদনা বুঝতে পারে কিন্তু অনুভব করতে পারেনা।
সেদিনের পর তার সাথে আবার দেখা হল সেপ্টেমবারের ২ তারিখ। মুহাম্মদপুর টাউন হলের সামনের রাস্তা দিয়ে আনমনে হেটে যাচ্ছে। ডাক দিয়েছিলাম শোনেনি। তখন তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। একবার বলেছিলাম সিগারেট ছেড়ে দিতে। তখন ও বলেছিল,
-"মানুষ বড় শ্বার্থপর। সে নিজেকে জ্বলতে দেখতে পারে না। তার প্রতিশোধ নেয়ার প্রবনতা উপর থেকে দেয়া। এ প্রতিশোধ নেয়ার প্রবনতার জন্যেই পৃথিবীতে খুনের উৎপত্তি। তার নিজের চোখ দিয়ে অপরকে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে ধ্বংস হতে দেখতে হয়। তা না হলে তার আত্মতৃপ্তি আসে না। নিজেকে শান্ত করতে পারে না। ভেতরের পশুটা বের হয়ে চলে আসে বারবার। আমি আমার নিজের পশুকে বেধে রাখার জন্য সিগারেটকে জ্বলতে দেখি। বারবার এবং বারংবার। এতে অন্তত অন্য একজন মানুষ আমার ভেতরে থাকা পশু থেকে বেঁচে যায়।"

তার ঠিক ১বছর পর ওর সাথে দেখা হল কামারপাড়া আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হসপিটালের বেডে। অতিরিক্ত ধুমপাণের কারণে ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পরেছে ওর। ডাক্তারের ভাষায় স্মল সেল ক্যান্সার। অর্থাৎ ক্যান্সারের দুটো ধাপের মধ্যে এটা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। নিশ্চিত মৃত্যু। বাঁচানোর সম্ভাবনা নেই বলেই জানেন সবাই। শরীরের অবস্থা এতই খারাপ যে কেমো দেয়া যাচ্ছে না। ধরেই নেয়া যেতে পারে এ রোগী এখন বোনাস জীবন নিয়ে পড়ে আছে যেটা যেকোন সময় শেষ হয়ে যেতে পারে।

মাথায় এসবের ঘোরপাক নিয়েই ওর দিকে তাকালাম। সে এক বীভৎস চেহারা। ওর শরীরের শুধু হাড়গুলো টিকে আছে। নাক দিয়ে খাবারের নল লাগানো। মুখে এখন আর খাওয়ার দেয়া হচ্ছে না। মাথার চুল কেটে ফেলা হয়েছে। ঠোটগুলিয়ে শুকিয়ে সাদা রঙ্গের হয়ে আছে। হাতে ক্যানোলা লাগাতে লাগাতে ছিদ্র অনেক হয়ে গেছে। হাত দেখেই বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার সুই ঢোকানোর কোন জায়গা বাকি রাখেনি। এর মাঝেও ওর চোখ দুটো শুধু আগের মতই পরীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কথাটা বেমানান। কিছুটা কাব্যিক। শুনে মনে হচ্ছে শুধুই পাঠকের মন জয় করার জন্য লেখা। কিন্তু ব্যাপারটা সত্য। আমি আর ও কিছুক্ষন একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর চোখের ভাষা পড়তে সমস্যা হল না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ভেতরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাসানকে, যার শুধু বাহিরের খোলসটা শেষ হয়ে যাওয়ার বাকি ছিল।

অনেক কষ্টে হাসিমুখ করে বললাম,
-"কিরে শুকিয়ে গেলি দেখি।"
-"সেলাইন ছাড়া আর কিছু দেয় না। কি করব বলেন?"
-"ব্যাপার না। সুস্থ হয়ে গেলে সব খাবি।"
-"আর সুস্থ। আমি জানি ভাই আমার কি অবস্থা।"
খালাম্মা দাড়িয়েছিল পাশে। এ কথা শোনার পরেই দেখলাম ওনার চোখ ভিজে আসছে। কিছু বলতে চাইছেন তারপরেও বলতে পারছেন না। পেঠে ধরা ছেলের এমন করুনতি যেন আর সহ্য করতে পারছেন না। একসময় দেখলাম বেডের গ্রীল ধরে ফুপিয়ে কাঁদা শুরু করলেন। আমি কিছু বলার আগেই হাসান বলে উঠল।
-"আম্মা তোমার এই নাটক অন্য কোথাও গিয়ে কর, আমার বিরক্ত লাগছে। যাওতো আমার সামনে থেকে যাও।"
এরপর দেখলাম খালাম্মা বারান্দার দিকে চলে গেল। কিন্তু আমার চুপ করে থাকাটা নিজের আত্মসম্মান সায় দিল না।
-''মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতেছিস? নিজের কি অবস্থা করছিস। পরী পরী করে নিজের জীবনটা শেষ করে দিলি। লাভটা কি হল? এখন তো তোর মাই কাঁদছে তাই না? ভাল লাগছে খুব?"
-"যেদিন প্রথম মায়া আমাকে ছেড়ে চলে যায় সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওকে শুধু ভুলে থাকার চেষ্টা করে গেছি ভাই। প্রতিদিন, প্রতিটা ক্ষণ। কিন্তু পারিনি। ওর কথা গুলো কানে বাজত সবসময়, চোখ মেলেই ওকে দেখতে পেতাম। চোখ বন্ধ করেও রেহাই পেতাম না। সবসময় মনে হত এখনই বুঝি আসবে। চেনা জায়গাগুলোতে গেলে পা থেমে যেত। ওর চুলের গন্ধটাও আমার খুব চেনা। হঠাৎ করে যখন সে গন্ধটা নাকে আসে, পাগলের মত ছটফট করতে থাকি একনজর দেখার জন্য। এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব না ভাই। জানতাম আম্মা আমার এ অবস্থা সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু আমিও তো সহ্য করতে পারিনি । প্রতিবার মন চেত হাতের ভেইনটা কেটে ফেলি কিংবা কোন গাড়ির নীচে চাপা পড়ে যাই। ব্রিজ থেকে লাফ দেই বা গলায় দড়ি দেই। কিন্তু পারিনি । শেষ মুহুর্তে মার চেহারাটা চোখে এসে ভাসে। এতটা যন্ত্রণা আর কিছুতে নেই মনে হয়। এই যে এখন চলে যাচ্ছি আস্তে আস্তে করে, এতে কিন্তু ভাল হয়েছে। এই যে আমি কষ্ট পাচ্ছি। মা আমার কষ্টগুলো দেখছে। আস্তে আস্তে মাও বুঝে যাবে মরে যাওয়াটা আমার জন্য কতটা সুখের। তখন আর কাঁদবে না। কিন্তু একবারে যদি হুট করে চলে যেতাম তবে মাও আমার মত অনেক বড় বোঝা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। এখন হয়ত বোঝাটা আগের থেকে একটু ছোট হবে। লাভ এতটুকুই।"
আমি স্তব্দ হয়ে ওর চোখের পানে কিছুক্ষন চেয়ে থাকি। তারপর …….

তারপর আজ অনেকদিন হয়ে গেছে। হাসানের সাথে দেখা হওয়ার ঠিক পরের দিন সকালেই হাসান মারা যায়। দাফন-কাফন , শেষ খাওয়া দাওয়া, চল্লিশা সবকিছুতেই আমি ছিলাম। আন্টির সাথে মাঝে মাঝে দেখা করতে যেতাম, এখন খুব কম যাওয়া হয়।

আর মায়ারর খবর জানি না। জানি না মেয়েটা দেখতে কেমন? তার আসল নামকি? কোথায় আছে? কার সাথে চলছে? ভাল নাকি মন্দ? হাসানের মারা যাওয়ার খবর কি পেয়েছে? পাওয়ার পরে কি করেছে? গিয়েছে কি কখনও হাসানের কবরের কাছে? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর কখনও পাইনি। মাঝে মাঝেই আমি হাসানের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। বিশেষ করে কোন কারণে মন খারাপ হলেই। কিংবা কোন কারণে মন বেশি ভাল থাকলেই। কোনদিন দেখিনি কোন মেয়েকে আসতে। মাঝে মাঝে খালাম্মার আবদারে ওনাকে নিয়ে আসতাম। মেয়েটাকে কি তবে সত্যি ভুলে গেছে হাসানের সাথে তার স্মৃতিগুলো? ভুলে যাওয়া কি সত্যি এত সহজ? এর উত্তর কোনদিন খুঁজে পাইনি।

শুধু ভার্সিটিতে যতদিন ছিলাম ততদিন কোন মেয়ে দেখলেই মনে হত এই বুঝি সেই মেয়েটা যার দেয়া যন্ত্রণাগুলোকে তামাকের পাতায় পুড়িয়ে দিত হাসান।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.