নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাঝে মাঝে চাই কেউ আমার কথা শুনুক। এইতো।

মুহাম্মদ মাহিন

মুহাম্মদ মাহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফানুস

৩১ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:৪৪


“আচ্ছা আকিফ তুই কি আমাকে একটা ফানুস এনে দিতে পারবি?”
“এটা আবার কি?খায় না মাথায় দেয়?”
“কেন তুই কখনও ফানুস দেখিস নাই?ঐ যে বেলুনের মত। নিচে আগুন ধরানোর ব্যাবস্থা থাকে। সেখানে আগুন ধরালে ওটা আকাশে উড়ে যায়।”
“গ্যাস বেলুন?”
“আরে না গাধা, গ্যাস বেলুনতো অনেক বড় থাকে। এগুলা একেবারে ছোট। কাগজ দিয়ে বানায়। ট্যাংলেড ম্যুভিটাতে দেখিস।ওখানে ফানুস দেখায়।”
“তুই এটা দিয়ে কি করবি?”
“আমি ওড়াবো, আমার খুভ ইচ্ছা করতেছে। তুই কি আনতে পারবি?”
“আমি নামই শুনলাম প্রথম, কই পাওয়া যায় সেটা কিভাবে জানব?”
“আমি এতকিছু বুঝি না, তুই তাড়াতাড়ি এনে দে, আমি আমার জন্মদিনে একটা ফানুস ওড়াব। ওটার নিচে আমি একটা কাগজ বেঁধে দেব। আমার কিছু না বলা কথা সেখানে লেখা থাকবে।”
“কি কথা?”
“বললামইতো না বলা কথা। তোরে বলব কেন? আর তুই দাড়ি ছোট করছিস কেন? তোকে দাড়িতে মানায়। এখনতো চোরের মত লাগতেছে। পরেরবার দাড়ি বড় করে আমার সাথে দেখা করবি”
“এখনকি চলে যাচ্ছিস?”
“হুম,বসে থেকে তোর এই চোর মুখ দেখার ইচ্ছা নাই।”
“ও”...............
জেলে বসে এই কথাগুলোই ভাবছিল আকিফ। সেদিন ও বলতে পারেনি ওকে। চিঠিটা মানি ব্যাগেই ভাজ করা ছিল। রূপা এটা পাবে কিনা কে জানে? এখনতো চিঠিটা জেলার এর কাছেই আছে। একবার চেয়ে নিয়ে পড়া যায়। মনে মনে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে কতটুকু মনে আছে। আর জেলার খুবই ত্যাঁদড়। যেকোন কাজে আগে টাকা দেখাতে হয়। আর আকিফের কাছে এখন টাকা নেই। কি আর করার চোখ বন্ধ করে চিঠিটা পড়া শুরু করল।
“ রূপা,
কেমন আছিস? একটু একটু ৩টা বছর আমরা সাথে ছিলাম। দেখলি কেমন করে দিনগুলা চলে গেল। আমার কাছে মনে হচ্ছে এই তো সেদিন পরিচয়। তুই একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে ভার্সিটিতে এলি, আমাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপন দিনে। আমি রবির ক্যামেরাটা নিয়ে ছবি তুলছিলাম। তুই হটাৎ আমাকে এসে বললি, “ এই ক্যামেরাম্যান আমার কিছু ছবি তুলে দাওতো। ভাল হলে কিন্তু ফি পাবে,আর তোমার ফেসবুক আইডি আমাকে দিও। আমি তোমাকে রিকুয়েস্ট পাঠাব। ছবিগুলো আমাকে ইনবক্স করে দিও।” আমি সেদিন তোর কথা শুনে হা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। যদিও আমার ক্যামেরায় তুই আর ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করতে পারিস নি। তোর বান্ধবীদের সাথেই চলে গেছিস। তারপরেও কিছু ছবি আমি তুলেছিলাম। তুই রিকুয়েস্ট পাঠাসনি, কিন্তু আমি পাঠিয়েছিলাম। আর তোর ছবিগুলাও তোকে পাঠিয়েছিলাম। এবং তুই বলেছিস প্রত্যেকটা ছবি নাকি অসম্ভব বাজে হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কেন যেন ছবিগুলা বাজে লাগেনি। বরং ভালই লেগেছে। যাক সেসব কথা। একটা কথা তোকে বলার ছিল। অনেকদিন থেকেই বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সাহসে কুলালো না, তাই বলা হয়নি।
কথাটা হচ্ছে আমি তোকে ভালোবাসি। কেন যেন প্রতিদিন তোকে না দেখলে আমার ভাল লাগে না। আমি কি বলব বুঝতে পারছি না।কিন্তু তোকে আমার অনেক দরকার।”

হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে গেল আকিফের। জেল খানায় কোন আয়না নাই। দাড়িগুলো কতটুক বড় হল দেখার কোন উপায় নাই। কিন্তু ভালই বড় হয়েছে। চুলতো আগেই বড় ছিল। এখন লালন ফকিরের মত মাথায় জটা বাধা যায়। হঠাৎ করেই এসব খেয়াল করছে আকিফ। রাত আনুমানিক ৩টা বাজে। রুপার সাথে প্রতিরাতেই কথা হত। ফেসবুকে। নিশাচর মেয়ে ছিল রূপা। খুভ রাত জাগতে পারে। এখনও কি জেগে আছে? নিশ্চই জেগে আছে। এখন কার সাথে কথা বলে রূপা? এসব চিন্তাই মাথায় আসছে আকিফের। কিভাবে যে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না।
৪ মাস জেলে আছে আকিফ। জেলে থাকার কোন কারন নাই। শুধু সাথে থাকা কিছু কাগজ ওকে আজ এখানে এনে দিয়েছে। না, সেদিন নাবিলের কথাটা শোনা উচিৎ হইনি। আকিফের রুমমেট নাবিল। একদিন হঠাৎ কিছু কাগজ দিয়ে বলল যে এগুলা একটু ফটোকপি করে এনে দিতে। ১০০ কপির মত লাগবে। আকিফ তেমন কিছু ভাবেনি। আর খুলেও দেখেনি ভেতরে কি কাগজ আছে। ফটোকপি করাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। দোকানদারই ধরিয়ে দিয়েছিল। কাগজগুলো ছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংঘটন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের কিছু বিজ্ঞাপন বার্তা।
প্রশাসন এ ব্যাপারে ছাড় দিতে নারাজ।
আকিফের বাবা অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে ছাড়াতে পারেনি। এমনকি এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করা যাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত পরিবার হলে যা হয় আর কি। এ নিয়ে আকিফের কোন চিন্তাও নেই। আর নাবিলতো যথারীতি উধাও।
জেলে আকিফের দিনগুলো একইভাবে কাটে। একটাদিন আরেকটা দিনের সমান। দুটো দিনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। সকালে ঘুম থেকে ওঠে। সারাদিন কিছু না করে সময় কাটায়। প্রথম কয়েকদিন রিমান্ডেই কেটে গেছে। কিছুই করাতে পারছে না দেখে প্রশাসন এখন আর মাথা ঘামাচ্ছে না। আর আদালতে কেসতো চলছেই। মাঝে মাঝে যেতে হয় হাজিরা দিতে। তবে এখন জেলারের মুখে শোনা যাচ্ছে খুভ শীঘ্রই মামলার রায় হবে। এসব নিয়েই দিন কেটে যায়। আর তাছাড়া জেলের মানুষজন খুভ আপন। আড্ডাতেই দিনটা কেটে যায়। এখানে ছোট গন্ডীতে সবাইকেই মনে হয় খুভ নিরীহ মানুষ। কাওকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এদের সবাই সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ। এদের কেউ খুনী, কেউ ধর্ষক,কেউ ডাকাত কিংবা চোর। এসব নিয়ে কোন আক্ষেপও নেই ওদের মাঝে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই একমত। ওরা সবাই নিয়তির কাছে বন্দী। সবাই পেটের দায়ে,কিংবা জীবনের আক্ষেপে আজ এখানে। রহিম নামের একটা ছেলের সাথে কথা হচ্ছিল সেদিন। ছেলেটা এসেছে ধর্ষন মামলায়। লতিফা নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করত। প্রথম দেখায় ভাল লেগে গেছে মেয়েটাকে। একটা সময় খুভ ঘনিষ্ট হয়ে যায় লতিফার সাথে। এরপর প্রেম, এরপর ভালোবাসা। কিন্তু একদিন জানতে পারে লতিফার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মানতে পারেনি রহিম। আর তাছাড়া লতিফাও এ বিয়েতে রাজি ছিল। নিজেকে খুভ অসহায় লেগেছিল তার। আর নিজের অসহায়ত্বকে ঢাকতেই একদিন সর্বনাশ করে দিল লতিফার। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে সে কত বড় ভুল করেছে। সেদিন লতিফার সাথে এ কাজটা না করলে হয়ত লতিফা বেঁচে থাকত। বেঁচে থাকত রহিমের ভালোবাসা। লতিফা সেদিন আত্মহত্যা করে। আর রহিম এই চার দেয়ালে বন্দী। এরকম হাজারও রহিম আছে এই জেলে। সবারই কিছু নিজস্ব কারন আছে, আছে কিছু খোঁড়া যুক্তি নিজেকে দায়মুক্ত করার, কিন্তু মুক্তি তাদের নেই। এদের সাথেই দিনটা খুভ ভাল কেটে যায়, আর রাতটা কাটে রুপার ভাবনায়। রুপার সাথে কথা বলতে থাকে। মাঝে মাঝে কল্পনায় চিঠি লেখে। মাঝে মাঝে গানও শুনায়। রূপা হঠাৎ হঠাৎ কল করে বলত, “এই আকিফ, একটা গান শোনাত। কিন্তু কোন প্রেমের গান শুনাবি না। অবশ্য প্রেম ছাড়া কোন গানও হয় না। আচ্ছা ঠিক আছে তোর যেটা ভাল লাগে সেটাই শোনা।”
প্রথম প্রথম লজ্জা লাগত আকিফের। পরে অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। এখনও মাঝে মাঝে ওকে মনে করে গান গেয়ে যায় আকিফ। রাতের বেলায় খুভ একটা খারাপ লাগে না, গান গাইতে। আচ্ছা রূপাকি জানে আকিফ এখন জেলে। ওর কোন বন্ধুরাও আসেনি আজ পর্যন্ত ওর সাথে দেখা করতে। শুধু বাবা এসেছিল কয়েকবার। প্রতিবারই চোখে পানি নিয়ে ফেরত গেছে। আকিফ বাবার চোখের পানি সহ্য করতে পারেনি, কিন্তু বাবার সামনে নির্বাক শ্রোতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। একবার ইচ্ছে হয়েছিল বাবাকে জিজ্ঞেস করার যে রূপা কেমন আছে? কিন্তু সাহস হল না। আর বাবাকে এই প্রশ্ন করার মুখও ছিল না আকিফের। বাবা শেষ এসেছিল ২মাস আগে। আবার কবে আসবে কে জানে? এদিকে জেলার ইদানিং খুভ সুন্দর ব্যাবহার করছে আকিফের সাথে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু কথা বলছে। আকিফকে এও বলেছে আকিফ নাকি নির্দোষ,শুধু প্রশাসনের কারনেই নাকি সে কিছু করতে পারছে না। মাঝে মাঝে তার বউএর হাতে রান্না করার খাবার এনে দিচ্ছে আকিফের জন্য। জেলারের এমন অভূতপূর্ব আচরণ এখন আকিফের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না আসলে কি হচ্ছে।
অবশেষে আকিফের মামলার রায় দিল। ফাঁসির আদেশ হল আকিফের। এ রায় আকিফকে শুনানো হল। আকিফের বাবা এবার দেখা করতে এলেন। আকিফ কিছুই বলল না। শুধু বলল, “আমার মানি ব্যাগে একটা চিঠি আছে। চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়েন।”। আর কিছুই বলেনি আকিফ।
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে আকিফ। কালো একটা থলেতে মুখ ঢুকানো হচ্ছে আকিফের। পৃথিবীটাকে আর একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আকিফের। চলে যাচ্ছে এ নিয়ে কোন আফসোস নেই। একটা কথাই শুধু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, “ফানুসটা দেয়া হল না।”

প্রথম প্রকাশ- ৩১ অক্টোবর, ২০১৪.

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.