![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাগরিবের আজানের ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের ইফতার টেবিলগুলোতে পরিচিত খাবারের সারি - সোনালি খাস্তা বেগুনি, মচমচে পিয়াজু, আর গরম আলুর চপ। রমজানের ইফতার এইসব ভাজাপোড়া খাবার ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ। কিন্তু কেন রোজা ভাঙার জন্য আমাদের প্রথম পছন্দ এই ভাজাপোড়া খাবার? কেবল স্বাদের কারণে নয়, এর পেছনে আছে শারীরবৃত্তীয়, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
কেন আমরা ভাজা খাবার চাই?
প্রায় ১৪ ঘণ্টার রোজার পর শরীর লো ব্লাড সুগার ও শক্তির অভাবের সম্মুখীন হয়। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই এমন খাবার দরকার যা তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদান করতে পারে। আর ভাজাপোড়া খাবার সেই চাহিদা পূরণ করে দ্রুত।
কার্বোহাইড্রেট (বেগুনির বেসন, পিয়াজুর মসুর ডাল বা যে কোনো ধরনের ডাল, বা আলুর চপের আলু) দ্রুত গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তে শর্করা বৃদ্ধি করে।
চর্বি (তেলে ভাজার ফলে) উচ্চ ক্যালোরির যোগান দেয়, যা দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা দূর রাখতে সাহায্য করে।
মচমচে টেক্সচার ও চর্বিযুক্ত স্বাদ মস্তিস্কের প্লেজার সেন্টারকে উদ্দীপিত করে, যা আমাদের এসব খাবারের প্রতি বাড়তি আর্কষন তৈরি করে।
তবে শুধু শারীরিক চাহিদা নয়, সাংস্কৃতিক অভ্যাস ও নস্টালজিয়ার কারণে আমরা ইফতারে এইসব খাবার খেতে চাই। ছোটবেলা থেকেই রমজানের সন্ধ্যা মানেই রান্নাঘর থেকে আসা বেগুনি-পিয়াজু ভাজার শব্দ ও গন্ধ - এটি স্মৃতি, পরিবার ও ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত।
কেন ভাজাপোড়া খাবার এত জনপ্রিয়?
ভাজা খাবার জনপ্রিয় কেবল স্বাদের জন্য নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য হওয়ার কারণেও বাংলাদেশে ইফতারের প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে।
১. উপকরণের স্বল্প ব্যয়
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের তুলনায় ভাজা ইফতার আইটেমের প্রধান উপাদানগুলো খুবই সস্তা ও সহজলভ্য-
- বেগুন (বেগুনি তৈরির জন্য)
- মসুর ডাল ও পিয়াজ (পিয়াজু তৈরির জন্য)
- আলু (আলুর চপ তৈরির জন্য)
বেসন (ছোলার আটা বা যে কোনো ধরনের আটা যা বেগুনি ও পিয়াজুর ব্যাটারে / খামিতে ব্যবহৃত হয়)
মাংস, মাছ, বা দুগ্ধজাত খাবারের তুলনায় এসব উপাদান অনেক কম খরচে বেশি মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব।
২. রাস্তার ইফতার বাজার ও ছোট ব্যবসার সুবিধা
বাংলাদেশে ইফতার মানেই রাস্তার স্টল ও ফুটপাতের বাজার। এই সব অস্থায়ী দোকানগুলি খুব কম বিনিয়োগে প্রচুর লাভ করতে পারে।
একটি বড় কড়াই, তেল, আর কয়েকটি সাধারণ উপাদান দিয়েই ব্যবসা শুরু করা যায়।
শ্রমজীবী মানুষ, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ কম খরচে পেট ভরানোর জন্য ভাজাপোড়া খাবার কেনেন।
রমজানে ইফতার বাজার ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এক মাসের আয় নিশ্চিত করে। এখানে এও বলা যেতে পারে যে, এই খাবার গুলো ফাস্ট ফুড হিসেবেও পরিগনিত হতে পারে। কেননা বিশ্ব বাজারে ফাস্টফুডগুলোর মধ্যেও ভাজা খাবারের আধিক্য দেখা যায়। এধরনের খাবার গুলো মূলত স্বল্প আয়ের মানুষদের লক্ষ্য করেই তৈরি করা হয়েছিল শুরুর দিকে।
৩. খাদ্য সংরক্ষণের সহজ উপায়
বাংলাদেশে এখনো অনেক পরিবারে রেফ্রিজারেশন সুবিধা নেই। ভাজাপোয়া খাবার অন্যান্য রান্নার তুলনায় বেশি সময় ধরে নষ্ট না হয়ে টিকে থাকে। ফলে ইফতারের আগে বড় পরিমাণে রান্না করে সংরক্ষণ করা সহজ হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ভাজা ইফতারের উৎপত্তি কোথা থেকে?
ভাজাপোড়া ইফতার নতুন কিছু নয় - এর ইতিহাস জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য ঘাটতি ও ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবের সঙ্গে।
দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকটে বেঁচে থাকার উপায়
১৯৪৩ সালের বাংলা দুর্ভিক্ষ ও ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশি দুর্ভিক্ষে, খাবারের অভাব এত তীব্র ছিল যে অল্প উপাদানে বেশি মানুষের পেট ভরানোর উপায় খুঁজতে হতো। ভাজা খাবার কম খরচে বেশি ক্যালোরি সরবরাহ করত, ফলে অনেক পরিবারের জন্য এটি জীবন রক্ষাকারী খাদ্য হয়ে উঠেছিল। সয়াবিন তেলে আর্বিভাব ঘটে এই সময়েই এবং বেশি করে তেল দিয়ে রেধে খাওয়ার প্রচারনার অন্যতম প্রধান কারন ছিল এই চর্বি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শ্রমজীবী মানুষ
ব্রিটিশ আমলে বাংলার জুট ও টেক্সটাইল শিল্পে শ্রমিকদের জন্য কম খরচে বেশি এনার্জি পাওয়ার বিকল্প খুঁজতে হতো। ভাজাপোড়া খাবার, বিশেষ করে পিয়াজু ও বেগুনি, দ্রুত ও সস্তায় তৈরি করা যেত, যা শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করত। এখানে যদি আমরা দেখি ভারতীয় স্ট্রিট ফুড, তবে তাতেও তেলে ভাজা খাবারের আধিক্য দেখতে পাওয়া যাবে। এমনকি পাপড় তাদের এখনও নিত্য দিনের খাবার। এই খাদ্যাভাসের সাথে ঔপনিবেশিক ফিঙ্গার ফুডের যোগাযোগ পাওয়া যায়।
এই ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশে ভাজা খাবার শুধুমাত্র রুচির ব্যাপার নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
বর্তমানে কি এই অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে?
নগর জীবনে স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ইফতারে এখন অনেকেই খেজুর, ফল, বাদাম খাচ্ছেন দ্রুক শক্তি পেতে। গ্রিলড মাংস / কাবাব বা দুগ্ধজাত খাবার খাচ্ছেন প্রোটিনের জন্য।
স্মুদি ও জুস বা সরবত খাচ্ছেন তেলের বদলে স্বাস্থ্যকর উপায়েহাইড্রেটেড থাকার জন্য।
কিন্তু এই পরিবর্তন গুলো কিছুটা হলেও মূলত উচ্চবিত্ত ও শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ আজও বেগুনি-পিয়াজুকে ইফতারের বেছে নিচ্ছেন যা যদিও বা অন্যান্য খাবার যেমন মুড়ি, ছোল থাকছে।
কেন আমরা ইফতারে ভাজাপোড়া খাবার খাই? কারণ এটি শুধুমাত্র রুচি বা অভ্যাসের বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা, ঐতিহাসিক অবস্থা ও শারীরিক চাহিদার প্রতিফলন।
যদিও স্বাস্থ্য সচেতনতার আলোচনায় ভাজা খাবারের সমালোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো - এটি সুলভ, সহজলভ্য, এবং কোটি মানুষের জীবনের অংশ। শুধু যে তেলে ভাজা খাবারেই তেল থাকে, তা কিন্তু নয়। বাজারে পাওয়া প্রকৃয়াজাত এমন কোনো খাবার পাওয়া যাবে না যাতে তেল থাকে না। সে বিচারে বেগুনি হয়তো তুলনা মূলকভাবে স্বাস্থ্য সম্মত। তাই বরং ভালো তেল, স্বাস্থ্যকর রান্নার কৌশল ও বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা দরকার, যাতে আমাদের ঐতিহ্য বজায় রেখেই স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনা যায়।
তবে আপাতত, আরেকটি রমজান বেগুনির খাস্তা স্বাদ আমাদের ঐক্য, ইতিহাস ও টিকে থাকার গল্প বলে যাচ্ছে। চলতে থাক।
২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:১৬
মুনতাসির বলেছেন: এই লেখাটা লেখার আগে খেয়াল করে দেখলাম, আমি যখন সাইকেল চালাই, যেহেতু অনেক খুদা লাগে, তখন ও অবচেতন মনে ভাজা খাবার খেতে ভালবাসি। যেমন কত কেজি চিলি চপ যে আমরা ভুটানে খেয়েছিলাম তার হিশাব করা হইনি। এটা শুদু যে আমার হয় টা নই। তখন ভাবলাম এটা কেন? তারপর বুজলাম এই ভাল লাগাড় যুক্তি আছে!
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৪৮
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: এই রমজানে প্রথম দিন একটা বেগুনি আর একটা পিঁয়াজো খেয়েছিলাম। তারপর দিন থেকে পুরো রোজায় ফল খেয়েছি। চিনির শরবতও খাইনি। আলহামদুলিল্লাহ। সুস্থতায় কেটেছে রমজান।
সুন্দর পোস্ট