![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি তোমাদের মাঝে খুজিয়া ফিরি আমার বিশ্বলোক; নরকে গেলেও হাসিয়া বলিব আমি তোমাদেরই লোক।
বাংলাদেশে শাসক বদলায়, সরকার বদলায় কিন্তু পুলিশের চরিত্র বদলায় না। রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে জনগণ ভেবেছে—এবার হয়তো থানার দরজা খুলবে তাদের জন্য, এবার হয়তো পুলিশ দাঁড়াবে জনগণের পাশে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। পুলিশের হাতে নির্যাতন, গুম-খুন, মামলার হয়রানি, ঘুষ, রাজনৈতিক দমন—সবই অব্যাহত থেকেছে। এই সত্য আবারও স্পষ্ট হয়েছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস, নির্বিচারে গ্রেফতার, এমনকি হলে ঢুকে নির্যাতনের দৃশ্য গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অথচ সরকার বদলানোর পরও একই চিত্র দেখা গেল— সম্প্রতি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও পেশাজীবীদের আন্দোলনে পুলিশ আবারও পুরনো ভূমিকায় ফিরে যায়: লাঠিচার্জ, গ্রেফতার, আতঙ্ক সৃষ্টি। জনগণের চোখে এই বাহিনী এখনো শাসকের অস্ত্র, জনগণের রক্ষক নয়।
এর কারণ শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার নয়; বরং গভীর কাঠামোগত সমস্যা। আজকের বাংলাদেশ পুলিশ এখনো বহন করছে ১৮৬১ সালের Police Act-এর ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। সেই আইন বৃটিশরা বানিয়েছিল বিদ্রোহ দমন ও শাসকের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশও সেই একই কাঠামো আঁকড়ে ধরে আছে। ফলে পুলিশ কার্যত জনগণের নয়; বরং শাসকের পাহারাদার। এখন প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি এই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ভেঙে নতুন পথে হাঁটতে পারবে? পুলিশ কি ভয়ের প্রতীক থেকে আস্থার প্রতীকে রূপ নিতে পারবে? জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণের জন্য এটি কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়, বরং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের মৌলিক শর্ত।
বাংলাদেশের পুলিশ কাঠামো বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ ভারতে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বৃটিশদের চোখে ছিল সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা। এই বিদ্রোহ দেখিয়ে দিয়েছিল—যদি স্থানীয় জনগণ ও সৈন্যরা একত্রিত হয়, তবে ভারত শাসন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বিদ্রোহ দমনের পর বৃটিশরা বুঝল, তাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি স্থানীয় দমনযন্ত্র, যা জনগণের ভেতর থেকেই গড়ে উঠবে, কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এই প্রেক্ষাপটেই প্রণীত হয় ১৮৬১ সালের Indian Police Act। এর দর্শন ছিল—পুলিশ জনগণের কাছে নয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি করবে; কাজ হবে মূলত law and order বজায় রাখা, অর্থাৎ জনগণের আন্দোলন, বিদ্রোহ বা প্রতিরোধ দমন করা; এবং কাঠামো হবে আধা-সামরিক, যেখানে কমান্ড ওপর থেকে নিচে চাপানো হবে। এই আইনে পুলিশকে কখনোই “public service” বা “community protection” বাহিনী হিসেবে ভাবা হয়নি; বরং শাসকের চোখ-কান ও লাঠি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। বৃটিশরা তাদের দেশ থেকে পুলিশ আনেনি, স্থানীয় মানুষকেই পুলিশে নিয়োগ দিয়ে ঔপনিবেশিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। ফলে বাহিনী দেশি চেহারা ও ভাষা ধারণ করলেও আনুগত্য ছিল বিদেশি শাসকের প্রতি। এর তিনটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ছিল—প্রথম, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ; দ্বিতীয়, জবাবদিহির অভাব; তৃতীয়, দমনকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। এই কারণেই আজও পুলিশ জনগণের কাছে আস্থার নয়, বরং ভয়ের প্রতীক।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলেও পাকিস্তানি শাসনে পুলিশের চরিত্র বদলায়নি। নতুন কোনো গণমুখী কাঠামো গড়ে ওঠেনি, বরং সেই ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক আইনই বহাল থাকে। ব্রিটিশদের দমনযন্ত্র এবার পাকিস্তানি শাসকের অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় মানুষদের পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের আনুগত্য বাধ্যতামূলকভাবে করাচি ও ইসলামাবাদের প্রতি রাখতে হতো। ফলে পুলিশ কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নয়, পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থরক্ষাকারী বাহিনী হয়ে ওঠে। এর ফলেই পুলিশের প্রতি গভীর অবিশ্বাস জন্ম নেয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলি, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ-ইপিআর যৌথ দমন—সবই প্রমাণ করে পুলিশ ছিল জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শাসকের যন্ত্র। জনগণের চোখে পুলিশ মানে হয়ে দাঁড়ায় ভয়, দমন আর অন্যায়ের পাহারাদার। স্বাধীনতার আগ পর্যন্তও উপমহাদেশে পুলিশ কখনো জনগণের বন্ধু হতে পারেনি; বরং ১৮৬১ সালের মডেলকেই আরও শক্ত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যর্থতা—মুক্তিযুদ্ধের পরও একই উত্তরাধিকার: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ জনগণকে নতুন আশা দিয়েছিল—স্বাধীন দেশের পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু, ভয়ের প্রতীক নয়। কিন্তু বাস্তবতা ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশেও পুলিশ বহন করেছে সেই ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক মডেল, যা মূলত শাসকের নিরাপত্তার জন্য তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের Police Ordinance আসে তদারকি, প্রশিক্ষণ ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে থানার জবাবদিহি জনগণের কাছে নয়, বরং মন্ত্রীর কাছে রয়ে যায়; আইনগত কাঠামো অপরিবর্তিত থাকায় পুলিশকে গণমুখী করার সুযোগ তৈরি হয়নি; এবং পুরোনো দমনকেন্দ্রিক সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে।
১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সামরিক শাসনে পুলিশ আরও স্পষ্টভাবে দমনযন্ত্রে পরিণত হয়। সরকারি বিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক-ছাত্রদের প্রতিবাদ দমনে লাঠিচার্জ, গ্রেফতার ও নির্যাতন ছিল নিয়মিত ঘটনা। ১৯৭৫–১৯৮৫ সময়ে Amnesty International ও Human Rights Watch বারবার জানিয়েছে—রাজনৈতিক দমন, অমানবিক হেফাজত ও নির্বিচার গ্রেফতার ব্যাপক ছিল। Transparency International-ও পুলিশকে অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে, যেখানে জনগণের আস্থার সংকট প্রকট।
মূলত তিনটি কারণে পুলিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ভাঙতে পারেনি—আইনগত কাঠামোর স্থবিরতা, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সাংগঠনিক সংস্কৃতির অভাব। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় পেশাদারিত্বের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য গুরুত্ব পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে মানবাধিকার ও জনগণের সেবার মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি। তাই স্বাধীনতার স্বপ্নে দেখা “জনগণের পুলিশ” আজও বাস্তব হয়নি; পুলিশ রয়ে গেছে শাসকের হাতিয়ার হিসেবেই।
শেখ হাসিনার আমলে পুলিশের ফ্যাসিস্ট রূপান্তর: ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ আরও স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক দমনযন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে বহন করা ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক কাঠামো—কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও দমনকেন্দ্রিক সংস্কৃতি—সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ বাহিনীসমূহ এই প্রক্রিয়াকে আরও তীব্র করে তোলে: RAB প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনে প্রধান হাতিয়ার হয়; DB গুম ও নির্বিচার গ্রেফতারে কুখ্যাত হয়ে ওঠে; আর APBn কার্যত ক্ষমতার রক্ষক বাহিনী হিসেবে কাজ করে। এরা সাধারণ থানার জবাবদিহির বাইরে পরিচালিত হওয়ায় জনগণের আস্থা ও মানবাধিকার মানদণ্ড ভেঙে পড়ে।
২০১৮–১৯ সালের শিক্ষার্থী আন্দোলন দমনে পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও নির্বিচার গ্রেফতার ১৪–১৯ বছরের কিশোর-যুবকদের ভয় দেখানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একই চিত্র দেখা যায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আন্দোলনে, যেখানে পুলিশ আবারও লাঠিচার্জ, গ্রেফতার ও হেনস্থা চালায়। বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধেও মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে মতপ্রকাশ দমন করা হয়। Odhikar (২০০৯–২০২৩) অনুযায়ী এ সময়ে রাজনৈতিক গুমের সংখ্যা ৬০০-এর বেশি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ২০০০ ছাড়িয়েছে। Transparency International (২০২১) পুলিশকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান আখ্যা দিয়েছে, যেখানে ৭৪% মানুষ পুলিশের প্রতি আস্থা রাখে না। Amnesty International জানিয়েছে—RAB ও DB-এর বিরুদ্ধে অর্ধেকেরও বেশি অভিযোগ রাজনৈতিক দমন বা মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত।
ফলত, শেখ হাসিনার আমলে পুলিশ জনগণের বন্ধু নয়, বরং আরও শক্তিশালী শাসক-কেন্দ্রিক দমনযন্ত্রে পরিণত হয়। ১৮৬১ সালের কাঠামোর উত্তরাধিকার, কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষ বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার মিলিয়ে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার পরিবর্তে ভয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। শিক্ষণীয় বিষয় হলো—দমনকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ভাঙা না গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সরকারেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।
বাংলাদেশে পুলিশ দীর্ঘদিন ধরেই আস্থাহীনতার প্রতীক। ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহার পুলিশকে জনগণের নিরাপত্তা নয়, বরং ভয়ের প্রতীক করেছে। Odhikar Human Rights Reports (২০০৯–২০২৩) অনুযায়ী পুলিশের হাতে ৬০০-এর বেশি গুম এবং প্রায় ২০০০ বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের আন্দোলন দমনেও পুলিশ গুলি, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও নির্বিচার গ্রেফতার ব্যবহার করে।
Human Rights Watch ও Amnesty International জানিয়েছে, হেফাজতে নির্যাতন, আইনগত প্রক্রিয়া উপেক্ষা, এবং মামলার রেকর্ড গোপন রাখা নিয়মিত ঘটনা। Transparency International (২০২১) পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে ৭৪% মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা রাখে না। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় থানায় মামলা নিতে ঘুষ, প্রভাবশালীদের পক্ষপাতিত্ব এবং তথ্য গোপনের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন, যা আবারও প্রমাণ করে—পুলিশ জনগণের নয়, শাসকের হাতিয়ার।
এই সব তথ্য স্পষ্ট করে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দমনের ধারাবাহিকতা পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে পুলিশ দমন সংস্কৃতির বাহিনী হিসেবে টিকে আছে। শিক্ষণীয় বিষয় হলো—গণতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া পুলিশ কখনোই জনগণের আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হতে পারবে না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের পুলিশ কেমন?
বাংলাদেশের পুলিশের দমনমুখী চরিত্র ও জনগণের আস্থাহীনতা বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। বিভিন্ন দেশে পুলিশ সংস্কার হয়েছে—বিশেষত যেখানে ঐতিহাসিকভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক ব্যবহার প্রবল ছিল, সেখানে কাঠামোগত পরিবর্তন, স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক তদারকি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ভারতে ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের Prakash Singh vs. Union of India মামলার রায়ে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, কিছু রাজ্যে যেমন কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে কমিউনিটি পুলিশিং চালু হয়েছে, যা স্থানীয় আস্থা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। নেপালে ২০০৭ সালের নতুন পুলিশ আইনে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ, স্থানীয় জনগণের কাছে জবাবদিহি ও বিশেষ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়, ফলে পুলিশ ধীরে ধীরে ভয়ের প্রতীক থেকে আস্থার প্রতীকে রূপ নেয়।
ব্রিটেনে চিত্র একেবারেই ভিন্ন। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় পুলিশ কাঠামো নেই; প্রতিটি অঞ্চলের পুলিশ স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির মধ্যে পরিচালিত হয়। পুলিশ কমিশনার জনগণের ভোটে নির্বাচিত কাউন্সিলরের কাছে দায়বদ্ধ, কেন্দ্রীয় সরকার নয়। এই বৈপরীত্য গুরুত্বপূর্ণ—যারা উপমহাদেশে দমনমূলক কেন্দ্রীয় পুলিশ কাঠামো দাঁড় করিয়েছিল, সেই ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে সবসময় বিকেন্দ্রীভূত পুলিশ ব্যবস্থা বজায় রেখেছে। জার্মানিতেও একই প্রবণতা: প্রতিটি ল্যান্ড (রাজ্য) নিজস্ব পুলিশ ফোর্স চালায়, যার তদারকি স্থানীয় সরকারের হাতে। পাশাপাশি মানবাধিকার শিক্ষা, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও কমিউনিটি পুলিশিং জনগণের আস্থা নিশ্চিত করেছে।
এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করে যে, কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত পুলিশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, আর বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক তদারকি ও কমিউনিটি পুলিশিং আস্থা গড়ে তোলে। বিশেষ বাহিনী বা কেন্দ্রীয় ইউনিটকেও যদি গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় আনা যায়, তবে পুলিশ সত্যিকার অর্থে জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক মডেল ও RAB, DB, APBn-এর রাজনৈতিক ব্যবহার এ পাঠ উপেক্ষা করেছে। তাই কাঠামোগত, সাংগঠনিক ও আইনি সংস্কার এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার বাহিনী নয়; এটি জনগণের সেবা ও আস্থার প্রতীকও হতে হয়। ম্যাক্স ওয়েবারের “monopoly of legitimate violence” তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রের কাছে আইনিভাবে সহ্যযোগ্য সহিংসতার একমাত্র অধিকার থাকে। তবে গণতন্ত্রে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবিক মূল্যবোধ অপরিহার্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের নয়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও বিচার বিভাগের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও কমিউনিটি পর্যায়ের তদারকি অপরিহার্য। ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক মডেল এবং বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, যখন পুলিশ শাসকের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে, তখন রাজনৈতিক বিরোধী বা আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার ব্যবহৃত হয়, আর সাধারণ নাগরিকদের সেবা ও নিরাপত্তা উপেক্ষিত হয়।
গণতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুযায়ী পুলিশকে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে হবে—যেমন সঠিক ও দ্রুত মামলা প্রক্রিয়া, নির্যাতন ও গুম প্রতিরোধ, স্বচ্ছ তথ্য ব্যবস্থাপনা। আন্তর্জাতিক তুলনা যেমন বৃটেন, জার্মানি, নেপাল ও ভারত দেখিয়েছে, স্বচ্ছতা, স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ এবং কমিউনিটি পুলিশিং–এর মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব।
বাংলাদেশে বাস্তবতা ভিন্ন; পুলিশ এখনও শাসকের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক আস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পুলিশকে শাসকের হাতিয়ার থেকে জনগণের সেবক বানানো জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন—১৮৬১ সালের দমনমূলক আইন বাতিল, স্বচ্ছ নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি, স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশিং ও ডিজিটাল স্বচ্ছতা, এবং মানবাধিকার ও সেবার মূল্যবোধে প্রশিক্ষণ।
গণতান্ত্রিক তত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা নির্দেশ করে—বাংলাদেশের পুলিশের আস্থা অর্জন করতে হলে কেবল কাঠামোগত সংস্কার নয়, সাংগঠনিক সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তনও অপরিহার্য।
বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কার এখন আর বিলম্ব করা যায় না। ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক মডেল, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বিশেষ বাহিনীর দমনকেন্দ্রিক ব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ ইতিহাস স্পষ্ট দেখিয়েছে যে শুধু সরকার বদলালেই পুলিশ জনগণের বন্ধু হবে না। এজন্য একটি সম্পূর্ণ কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমে আইনগতভাবে ১৮৬১ সালের Police Act বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক পুলিশ আইন প্রণয়ন করতে হবে। নতুন আইনে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ থাকতে হবে—পুলিশের মূল দায়িত্ব হলো জনগণের সেবা ও নিরাপত্তা, শাসকের নয়। পাশাপাশি পুলিশ কমিশনকে আইনগতভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত থাকে।
পুলিশকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাত থেকে মুক্ত করে স্থানীয় স্বশাসিত সরকারের অধীনে আনা অপরিহার্য। এতে থানা ও ইউনিটের কর্মকাণ্ড স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিচার বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ হবে। RAB, DB, APBn-এর মতো বিশেষ বাহিনীও একই কাঠামোর অধীনে আনতে হবে এবং রাজনৈতিক দমন থেকে মুক্ত করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং ও সামাজিক তদারকি চালু করে প্রতিটি থানা জনগণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে এবং আস্থা ও সহায়তার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। স্থানীয় সভা, নাগরিক মনিটরিং, অনলাইন ট্র্যাকিং (GD, FIR, রিমান্ড) বাধ্যতামূলক করা হবে।
পুলিশের প্রশিক্ষণ ও সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা হবে। মানবাধিকার, সেবা মূল্যবোধ এবং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করে পুলিশকে শাসক রক্ষার বাহিনী থেকে জনগণের সেবক বানানো হবে। মামলার সমস্ত তথ্য ডিজিটাল ও অনলাইনে ট্র্যাকযোগ্য হবে এবং থানার কার্যক্রম নিয়মিত পর্যালোচনা ও স্বচ্ছ রিপোর্টিং-এর আওতায় আনা হবে। অতীতে গুম, খুন ও রাজনৈতিক দমন কার্যক্রমে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করা হবে, এবং বিশেষ বাহিনী ও থানার কর্মকর্তা-অফিসারদের ওপর স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদারকি চালু হবে।
বাস্তবায়ন রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রথম ১–২ বছরে নতুন আইন প্রণয়ন ও কমিশন স্থাপন, ২–৩ বছরে বিশেষ বাহিনী ও থানার কাঠামো পুনর্গঠন, ২–৪ বছরে কমিউনিটি পুলিশিং ও ডিজিটাল সিস্টেম চালু করা এবং পর্যায়ক্রমে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সম্পন্ন করা হবে। পাশাপাশি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, রিপোর্টিং এবং বিচারের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে।
এই রূপরেখা কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়; এটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন। পুলিশকে জনগণের আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক বানানো সম্ভব, যদি আমরা আইনগত স্বাধীনতা দিই, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করি, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করি এবং অতীতের অন্যায় কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিত করি। সংক্ষেপে, জনগণের পুলিশ হবে সেই বাহিনী যা ভয়ের নাম নয়, বরং আস্থা, নিরাপত্তা ও সেবার প্রতীক। এটি বাংলাদেশের সোনার ভবিষ্যতের এক অপরিহার্য শর্ত।
কেমন হবে জনগণের পুলিশ?
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ পুলিশের ধারণা কেবল স্বপ্ন নয়; এটি একটি বাস্তবায়নযোগ্য মডেল, যা আইনগত সংস্কার, কাঠামোগত পরিবর্তন, মানবাধিকার শিক্ষা এবং জনগণের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের উপর ভিত্তি করে তৈরি। ত্রিস্তরীয় কাঠামোতে পুলিশকে গড়ে তোলা হবে। প্রথম স্তর হলো জাতীয় পুলিশ কমিশন, যা স্বাধীন ও আইনগতভাবে শক্তিশালী হবে। কমিশন নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং বিশেষ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা করবে এবং সরকার বা রাজনৈতিক দলের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। কমিশনের বার্ষিক রিপোর্ট জনগণ ও সংসদে প্রকাশযোগ্য হবে। দ্বিতীয় স্তর হলো স্থানীয় স্বশাসিত স্তর, যেখানে থানার কার্যক্রম স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিচার বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ হবে। এখানে কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়িত হবে, স্থানীয় সভা ও নাগরিক মনিটরিং বাধ্যতামূলক হবে, এবং ডিজিটাল ট্র্যাকিং (GD, FIR, রিমান্ড) সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। তৃতীয় স্তর হলো ইউনিট ও বিশেষ বাহিনী, যেমন RAB, DB, APBn। এই ইউনিটগুলোও একই জবাবদিহি কাঠামোর অধীনে থাকবে, রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ হবে এবং শুধুমাত্র জনগণের সেবা ও নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। মানবাধিকার ও সেবা-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হবে।
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন অপরিহার্য। পুলিশ প্রশিক্ষণ হবে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং সেবার মূল্যবোধ-ভিত্তিক। শাসক রক্ষার মানসিকতা বাদ দিয়ে জনগণকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা হবে। সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে সমন্বয় এবং মনিটরিং বাধ্যতামূলক হবে। প্রযুক্তিগত স্বচ্ছতার মাধ্যমে মামলার তথ্য, জিডি, গ্রেফতার ও রিমান্ড সম্পূর্ণ ডিজিটাল হবে। স্বচ্ছ রিপোর্টিং এবং নিরীক্ষা নিশ্চিত করা হবে, যাতে জনগণ এবং স্বাধীন তদারকির মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রম প্রতিদিন পর্যবেক্ষণযোগ্য হয়।
অতীতের অন্যায়ের পুনর্বিচারের ব্যবস্থা থাকবে। গুম, খুন, নির্যাতন ও রাজনৈতিক দমনমূলক কার্যক্রমে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করা হবে এবং বিশেষ বাহিনী ও থানার কর্মকর্তাদের উপর স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদারকি চালু করা হবে। স্থানীয় পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশিং, ডিজিটাল স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকার শিক্ষার সমন্বয়ে জনগণের আস্থা পুনর্গঠন করা হবে। থানাকে ভয়ের নাম নয়, আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হবে। নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে সমাজে শৃঙ্খলা ও মানবিক মূল্যবোধ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাস্তবায়ন রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রথম ১–২ বছরে আইনগত ও কমিশন সংস্কার, ২–৩ বছরে স্থানীয় স্তরে জবাবদিহি ও কমিউনিটি পুলিশিং, ২–৪ বছরে বিশেষ বাহিনী পুনর্গঠন ও প্রশিক্ষণ সংস্কার, ২–৫ বছরে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং চলমানভাবে অতীতের অন্যায় বিচার ও জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা হবে। এই মডেল বাস্তবায়ন করলে পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু, শাসকের হাতিয়ার নয়। জনগণ নিরাপদ এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। এটি কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়—বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের মূল ভিত্তি।
২| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫২
কামাল১৮ বলেছেন: আমাদের পুলিশ জনগনের পুলিশ হয়ে গড়ে উঠেনি।পুলিশ মবকে ছেড়েদিয়ে যারা মবের শিকার তাদের ধরে নিয়ে যায়।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩২
নতুন বলেছেন: পুলিশের হাতে নির্যাতন, গুম-খুন, মামলার হয়রানি, ঘুষ, রাজনৈতিক দমন—সবই অব্যাহত থেকেছে। এই সত্য আবারও স্পষ্ট হয়েছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাস, নির্বিচারে গ্রেফতার, এমনকি হলে ঢুকে নির্যাতনের দৃশ্য গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
পুলিশের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেইনিং এ বিরাট ঘাপলা আছে। রাজনিতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে।
পুলিশের হাতে বন্দুক আছে, শেখ হাসিনা বা অন্য কেউই বলতে পারে গুলি কর। কিন্তু একটা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে গুলি করার আগে ব্যক্তি পুলিশটিরও নৈতিক একটা দায়ীত্ব আছে। ট্রিগারটা চাপার আগে তারও ভাবতে হবে যে সে একজন মানুষ হত্যা করছে।
২০২৪ এ অনেক পুলিশকেই খুশি মনে গুলি করে সেটা উপভোগ করতে দেখা গেছে। এটা একজন নৈতিক, মন মনন সম্র্পন মানুষের লক্ষনা।
রাজনিতিক কর্মী, পুলিশে সাইকোপ্যাথ/সোসিওপ্যাথের পরিমান বেড়ে গেছে।