নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একজন সমালোচক,তবে তা সংশোধনরে জন্য। আবার একজন প্রশংসাকারিও বটে, তবে তোষামোদকারি নয়।জানতে চাই অনেক কিছু।হতে চাই কালের সাক্ষী।

মুসাফির নামা

সত্যানুসন্ধানী

মুসাফির নামা › বিস্তারিত পোস্টঃ

মজিদের পাঠশালা (ছোট গল্প)

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:৫৪




রাত দশটার মতো বেজে চলল।আমবশ্যার রাত,তারওপর গ্রামের রাস্তা দশটা বাজতেই শন শন করছে।দুরে দুই একটা বাড়ি থেকে ইলেক্ট্রিক লাইটের আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাতেই কবির বাজার থেকে বাড়ির দিকে চলল।আজ বাজার থেকে ফিরার পথে কবির কাউকে সাথে পায়নি।তারওপর আমবশ্যার এরকম নির্জন রাস্তা কবিরের মনে একটু ভয় জাগিয়ে দিল।মনের ভয় দূর করার জন্য কবির গলা ছেড়ে গান গাওয়া আরম্ভ করল,”ধবলা বকরে...’’।সামনে রাস্তার ধারে মজিদ ভাইয়ের বাড়ি।অনেকে মজিদ পাগলা বললেও কবির মজিদ ভাইকে খুবই সম্মান করে।তাকে মজিদ ভাই ই বলে, চায়ের দোকানে দেখা হলে চাও খায়, একসাথে গল্পগুজব করে। তারপরও মজিদ ভাইকে তার কেমন যেন ভয় লাগে। তাই মজিদ ভাইয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় গানের আওয়াজ আরো বাড়িয়ে দিয়ে কবির পথ চলতে লাগল।

-কবির, কবির....

কেউ একজন পেছন থেকে তাকে ডাকছে, স্পষ্ট মজিদ ভাইয়ের কন্ঠ, একে বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়।কবির বুকে থুক দেয়,আয়াতুল কুসরি পড়া আরম্ভ করে, আবার ডাক শুনে

-কবির, কবির

কবির পেছনে তাকিয়ে দেখে হারিকেন হাতে মজিদ ভাই।

-মজিদ ভাই, আমায় ডাকতেছ?
-হু, একটু এদিকে আস।

কবির কাছে গিয়ে বলে,
-মজিদ ভাই, বাজার থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গেছে, আমায় তাড়াতাড়ি যেতে হবে।বাড়িতে মা অসুস্থ।
-হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে।আমি কি তোমাকে আটকিয়ে রাখব।
-আমার পাঠশালাটা দেখে যাও আর আমার স্টুডেন্টদেরও ।
কবির মজিদের ভাঙ্গা ঘরের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকায়।দেখেতো তার চোখ ছানাবড়া।মজিদের চৌকির উপর কতগুলো কুকুর, বেড়াল আর তাদের প্রত্যেকের সামনে বই; মাঝখানে একটি কুপি বাতি জ্বলছে।এই দৃশ্য দেখে ভয়ে তার গলায় শুকিয়ে যাবার অবস্থা।
-মজিদ ভাই, আজকে আসি, আরেক দিন দেখব তোমার পাঠশালা।
কবির দ্রুত বেগে সেখান থেকে হাঠা শুরু করল।

পেছন থেকে মজিদ কয়েকবার ডাকল,
-কবির শুন, কবির ,কবির...

আর গানটান বাদ দিয়ে কবির দ্রুত বাড়ি পৌঁছে গেল।বাসায় ফিরে কবির শুনে ,তার মায়ের ভীষন জ্বর এসেছে; এমনকি বমিও করেছে। কবির ধারণা মজিদ ভাই নিশ্চয়ই কোন সাধারন মানুষ না, না হয় মায়ের জ্বরের কথাতো সে এমনি এমনি বলেছে; কিন্তু বাড়িতে ফিরে দেখে তাই ঘটে গেল। তারপর আবার কুকুর বেড়ালের মত জাত শত্রু এক চৌকির উপর বসে আছে, শুধু তাই নয় রীতিমত বই নিয়ে বসে আছে।দোয়া কালাম পড়ে কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে কবির ঘুমাতে গেল।

১৯৮০ সালের ঘটনা।আমাদের গ্রামে ভীষণ কলেরা লাগল।সে কলেরায় একরাতে মজিদ ভাইয়ের বাবা-মা, দু’ভাই-দু’বোন সবাই মারা যায়।পুরো গ্রামে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ মারা যায়।তখন কলেরার স্যালাইনের মত সস্তা চিকিৎসাতো দুরে থাক তেমন কোন চিকিৎসাই বের হয়নি।তারওপর এই রোগ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছিল ভীষণ কুসংস্কার।যেগ্রামে একবার কলেরা লাগত সে গ্রাম একেবারেই ছাপ করে দিত।অনেকে ভাবত অভিশাপ, আবার অনেকে ভাবত শয়তানের আছর লাগছে।দরজা জানালা আটকিয়ে সবাই জপত ’’আসছে এবার হজরত আলী, মারবে তোরে কড়ায় বাড়ি’’। কেউ দু’পা ওয়ালা ঘোড়া দেখত, অনেক আরো হাবিজাবি দেখা আরম্ভ করত। ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হত না। অনেকে গ্রাম ছেয়ে পালিয়ে যেত। কোন কোন ঘরে লাশ দু’তিনদিন পড়ে থাকত; কেউ ভয়ে সে দিকে যেত না। ঘরের মধ্যে এতগুলো লাশ পড়ে আছে, অথচ কেউ এগিয়ে আসছেনা; মজিদও ভয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে গেল।সে যে গেল,আর মজিদের কোন খবর ছিল না।

প্রায় বিশ বছর পর হঠাৎ মজিদ আবার গ্রামে ফিরে আসল। মজিদ বলে, সে ভয় দূর করার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য বের হয়ে গেল। তার সে অস্ত্র কী? জিজ্ঞেস করা হলে সে বলত, তা হচ্ছে জ্ঞান। সে এই জ্ঞানের সন্ধানেই পথে পথে ঘুরেছে। মজিদ জ্ঞানমূলক কথা বার্তায় চেয়ারম্যান চাচাও রীতিমত বিম্মিত। তাই তিনি তার মুক্তিযুদ্ধের জীবন এবং পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হিসাবে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা নিয়ে যে বই লিখতে চায় তার দায়িত্ব মজিদকেই দেয়।প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মজিদ আসে, একঘন্টার মতো সেখানে সময় দেন। চেয়ারম্যান চাচা যে কাহিনীগুলো বলেন, এগুলোকে চমৎকার সাহিত্যিক ভাবে রুপায়িত করে তুলেন মজিদ।এতে করে মজিদ অবশ্য প্রতিদিন একশ টাকা করে পান।এটাকায় মজিদের খুব ভালভাবেই দিন চলে যায়।তাছাড়া সে কিছু কুটির শিল্পের কাজও শিখেছে, সেখান থেকেও কিছু আয় হয়।

মজিদের জ্ঞানগর্ভ কথায় সবাই বিম্মিত হলেও সবাই তাকে কেমন যেন একটা ভয় পায়। এই নিয়ে মজিদের আফসোস থাকলেও কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামের মানুষের জন্য এই ধরণের আচরণ স্বাভাবিক, মজিদ তাই ধরে নেন।তবে এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান চাচাই ব্যতিক্রম,তিনি বিন্দুমাত্রও ভয় পান না।১৯৮০ সালের কথা উঠলেই তিনি বলেন, কি অবস্থা না তখন হয়েছিল, গ্রামের রাস্তায় কোন মানুষকেই দেখা যেত না।বিভিন্ন ঘর থেকে মৃত লাশের গন্ধ আসত কিন্তু কেউ সাহস করে সেগুলোর সৎকারের কোন উদ্যোগ নেয়নি।তিনিই প্রথম নিজ হাতে এসব লাশ সৎকারের উদ্যোগ নেন।তারপর গ্রামের আরো দুই একজন তার সাথে অংশগ্রহন করে। মজিদকে তিনি বলেন, তিনদিন পর্যন্ত তার মা-বাবা,ভাই-বোনের লাশ পড়েছিল।তিনি সেগুলোর সৎকার করেন।

সন্ধ্যের পর মজিদ চেয়ারম্যান চাচার বাড়িতে বই লেখার কাজে আসলেও বেশিরভাগ সময় বই লেখার চাইতে গল্পগুজবেই কেটে যেত।দেখা যেত,পুরো সময়জুড়ে একপাতা লেখা হয়েছে।এই নিয়ে মজিদ কথা বলতে গেলেই চেয়ারম্যান চাচা বলত, এত তাড়াহুড়া কেন? শেষ একদিন হবেই। চেয়ারম্যান চাচা যেমন নিজের গল্প বলত, তেমনি মজিদের বিশ বছর নিরুদ্দেশের বিভিন্ন কাহিনীও শুনত। চেয়ারম্যান চাচা প্রায়ই আফসোস করে বলত, ’’মজিদ,তোর বাবা এত ভিতু ছিল সে আর বলব কি? এত করে বললাম, মুক্তিযুদ্ধে চল।বলে কিনা,তার কথা বলতেই শরীর কাঁপে আবার বন্ধুক হাতে যুদ্ধ করবে, এই তার পক্ষে সম্ভব নয়।অথচ দেখ যুদ্ধ করেও আমি বেঁচে আছি অথচ সে এখন আর দুনিয়াতে নাই।আহ! আমার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল।”

একদিন মজিদ দুপুর বেলা বেশ রুদ্রমূর্তি নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে হাজির ।এসেই উচ্চস্বরে চাচা চাচা বলে ডাকা শুরু করে,
-কিরে মজিদ এই অসময়ে? তাও খুব রাগান্বিত অবস্থায়।
-চাচা আমার কদমকে দবির হত্যা করে ফেলেছে।আপনাকে এর বিচার করতে হবে।
-বলিস কি? আর কদমটা কে?
-চাচা,সে আমার ছাত্র ।
-তোর ছাত্র! কার ছেলে?
-কারো ছেলে নয়, সে একটা কুকুর।
চেয়ারম্যান চাচাতো হো হো করে হেসে উঠলেন। ”একটা কুকুরের জন্য তুই আমার কাছে বিচার নিয়ে আসলি?”
-কুকুর বলে কি একটা নিরপরাদ জীবকে এভাবে হত্যা করবে?
চেয়ারম্যান সাহেব এবার বসলেন; তারপর মজিদকেও বুঝিয়ে বসতে বললেন।
-আচ্ছা দবির কেন অযথা তোর কুকুরকে হত্যা করতে যাবে? নিশ্চয়ই তোর কুকুর তাকে কামড় টামড় দিয়েছে; তাই দবির ক্ষিপ্ত হয়ে এই কাজ করেছে।
-কামড় দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমি কদমকে খুব ভালভাবে চিনি। সে অযথা কাউকে কামড় দেওয়ার কথা নয়, দবির নিশ্চয়ই কোন অপকর্ম করেছে।আপনি দবিরকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, দেখবেন সব ঘটনা বের হয়ে আসবে।
-মজিদ শুন, শান্ত হয়। একটা কুকুরের জন্য আমি যদি মানুষের বিচার করতে যাই, তাহলে লোকজন আমাকেও তোর মত পাগল ভাবা শুরু করবে।
-না চাচা, আপনাকে এর বিচার করতেই হবে।
-আমার পক্ষে এই বিচার করা সম্ভব নয়।তারচেয়ে তুই আমাকে বল,ওর এত সুন্দর নাম ’কদম’ রাখার কারণ কি?
কদমের প্রতি চেয়ারম্যান চাচার এমন আগ্রহে মজিদ কিছুটা শান্ত হয়।

-চাচা ওর গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল হলুদ, তারওপর সাদা সাদা অনেকগুলো পশম দাঁড়িয়ে থাকত যেন চার পাওয়ালা বিশাল একটা কদমফুল।
-সে কদমের আবার মুখ আছে,লেজ আছে” চেয়ারম্যান সাহেব হাসতে হাসতে বলল।

পরের দিন সন্ধ্যে মজিদ আবার প্রতিদিনকার মতো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি গেল বই লেখার জন্য।

-হ্যারে মজিদ,তুই নাকি পুলিশের কাছেও গিয়েছিস?
-যাবো না! এভাবে একটা অবলা জীবের হত্যার কোন বিচার হবে না, তা কি হয়?
-তো তারা কি বলল?
-বলবেন না, ওরা একেবারেই মুর্খ, আমাকে একরকম পাগল সাব্যস্থ করে বের করে দিল।

চেয়ারম্যান সাহেব আবার হাসতে হাসতে বলল,
-তুই আসলে বড্ড ভাল, একটা অবলা জীবের প্রতি তোর যে মায়া তা অসাধারণ। অথচ সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে ওদের দায়িত্ব আমাদের উপর।আফসোস আমরা এখন অনেক নিচু স্তরে চলে গেছি।
-চাচা জানেন, আমাদের হাসান মুসাফির বাড়ি আসছে।
-কোন হাসান?
-ঐযে আমাদের হাসান চাচার ছেলে; দৈনিক কালের সাক্ষীর রিপোর্টার।
-তুই জানলি কিভাবে?
-জ্বী,আমাকে হুদহুদ বলেছে।
-এই হুদহুদটা আবার কে?
-আমার একটি কবুতর।
চেয়ারম্যান সাহেব আবারো অট্টহাসি দিলেন,
-ওরা তোকে খবর দেয়,আর তুই ওদের কথা বুঝিস?
-বুজব না কেন? আমি ওদের শিক্ষক না।
চেয়ারম্যান চাচা হাসতে হাসতে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন,
-তো তোর ছাত্ররা কেমন শিখছে?
-চাচা ভালই, কুকুরগুলো খুবই শিক্ষকভক্ত, শিখেও খুব দ্রুত; তবে বিড়ালগুলো একটু পাজি আছে,অল্পতে সব ভুলে যায় আর খুবই আরাম প্রিয়।মাঝে মধ্যে আমি যে ওদের শিক্ষক সেটাও ভুলে যায়।
চেয়ারম্যান সাহেব মজিদের এসব কথায় হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরিয়ে ফেললেন।বললেন ’’এসব কুকরে, বিড়ালের কথা বাদ দেয়, তারচেয়ে বল ওই রিপোর্টার কখন আসবে?’’
-সেটা এখনও জানা যায়নি।
-ছেলেটার তাহলে গ্রামের কথা মনে পড়ছে।সে ছোটবেলা একবার দেখেছি।হাসান আমার বাড়ি নিয়ে এসেছিল, কেমন কাঠ ঠোকরা স্বভাবের, তখনই আমি বুঝেছি এই ছেলে বড় হয়ে গ্রাম, গ্রামের মানুষকে চিনবে না।অথচ দেখ,তার বাবা প্রায়ই মাসে গ্রামে আসে। গ্রামের মানুষের খোঁজখবর নেয়। আমার বাড়িতে আসলেতো কোন সালিশ থাকলে আমি তাকেই সালিশের জন্য বসিয়ে দিই। হাসান আসলে খুব ভাল একজন মানুষ কিন্তু আফসোস ৭১ এ সে পাকিস্থানের অখন্ডতার পক্ষে সমর্থন জানায়, যদিও সে জান্তা সরকারের কর্মকান্ডের ঘোর বিরোধী ছিল। তবে একদিকে সুবিধা হয়েছে, তার কারণে পাক বাহিনী কোন দিন আমাদের গ্রামে আসেনি। আর তার ছেলেটা দেখ, হইছে পুরা বিপরীত।
-কেন চাচা, ও খুব ভাল রিপোর্ট করে।
-রির্পোট করেনা, চাই। চেয়ারম্যানরা সব খারাপ, তারাও তো মানুষ, কিছু ভুলভ্রান্তি তাদেরও থাকতে পারে,তারওপর তাদের চলতে হয় তেরো রকমের মানুষের সাথে।
-চাচা সেতো সব চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে লেখেনি, দু’একজনের বিরুদ্ধে লিখেছে।
-আচ্ছা ওসব বাদ দেয়; তুই আমাকে বল এই যে রাতের বেলা নির্জন একটা বাড়িতে কুকুর বেড়ালদের পড়াস তোর ভয় করেনা?
-চাচা আপনাকে বললাম না ভয় দূর করার অস্ত্রতো আমার হাতেই।আর যাকে ভয় করার দরকার, তাকে তো ঠিকই ভয় করি।
-তুই ঠিকই বলেছিস।আমার এক হিন্দু শিক্ষক ছিলেন, তিনি খুব চমৎকার পড়াতেন। মাঝে মধ্যে তিনি বলতেন, মানুষ অন্ধকারকে ভয় পায় অথচ যাকে ভয় পাবার দরকার তার সম্বন্ধে পুরাই বেখবর।অবশ্যই ৭১ এ তিনি পুরোপরিবার সহকারে ভারতে চলে যান,আর ফিরে আসেননি।আচ্ছা মজিদ, তুই আজকে যায় কালকে আবার আছিস।

সন্ধ্যের আগেই গ্রামে পৌঁছে যাবার কথা, অথচ বাস স্ট্যান্ডে এসে থামল রাত এগারটা।বহু চেষ্টা করেও একটা রিকশা পায়নি।বাসস্ট্যান্ড থেকে হাসানদের বাড়ি প্রায় দু’মাইল।তারপরও কি আর করা, হেটেই রওয়ানা দিল।ভরাপূর্নিমার জ্যোৎস্না শোভিত গ্রামের পথে হাটতে হাসানের মোটামুটি ভালই লাগছে।একটা সিগারেট ফুকতে ফুকতে সে হেটে চলল।বেশ কয়েকবছর পর বাড়ি আসলেও পূর্ণিমার আলোতে পথ চিনতে তার ভুল হয়নি। মনে হচ্ছে, সামনে রাস্তার পাশে ছোট ঘরটা, এটা পার হলেই হাসানদের বাড়ী। ছোট ঘরটা পার হওয়ার পরে পেছন থেকে কেউ একজন যেন তাকে ডাক দিল; হাসান ,হাসান বলে।
পেছন ফিরে দেখল হারিকেন হাতে মোটামুটি মধ্যম বয়সী একজন লোক।হাসান কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আমাকে ডাকছেন।
-হ্যাঁ,তোমাকে ডাকছি।
-কিন্তু আপনি কে? আমিতো আপনাকে চিনি না।
-কেন হাসান চাচা কখনও তোমাকে কিছু বলেনি? আমি মজিদ। ৮০ সালের কলেরায় আমার মা-বাবা,দু’ভাই-দু’বোন সবাই মারা যায়, এরপর থেকে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাই।
-জ্বী, জ্বী।এবার মনে পড়েছে,বাবা মায়ের মুখে আপনাদের কথা অনেকবার শুনেছি। কিন্তু আপনি তো নিরুদ্দেশ হয়ে ছিলেন,তা আবার ফিরে আসলেন কবে?
-এই ছয়মাসের মত হবে।
-কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে?
-চিনবোনা, আমিতো তোমার পত্রিকার নিয়মিত পাঠক।তাছাড়া হুদহুদ আমাকে বলেছে , তুমি আজকে আসবে।
-এই হুদহুদটা আবার কে?
-আমার একটি কবুতর।
-তারা আপনাকে নিউজ দেয় আর আপনি তাদের ভাষা বোঝেন?” কিছুটা অবাক হয়ে হাসান প্রশ্নটি করল।
-বুঝবনা কেন, আমি তাদের শিক্ষক না।

এবার বিম্ময়ের চেয়ে হাসানের কৌতুহলটা বেশি জেগে উঠল।

-আপনি তাদের পড়ান?
-হ্যাঁ,আমার একটি পাঠশালাও আছে।
-চলেন, আপনার পাঠশালাটি দেখে আসি।

ভিতরে ডুকতেই হাসান তাজ্জ্বব। একি খাটের উপর কুকুর বিড়াল গোল করে বসে আছে, তাদের সামনে আছে বই, মাঝখানে একটা কুপি বাতি। হাসানকে দেখেই একটা বিড়াল মিঞাও বলে দৌড় দিল।
-দেখলে, বিড়ালগুলো কি রকম ফাঁকিবাজ।পরে বলবে, আমি ভয় পেয়েছিলাম।
মজিদের ঘরের চারপাশে প্রচুর বই ছড়িয়ে চিটিয়ে আছে যেন এক অগোছানো লাইব্রেরী।একটা চেয়ারের উপর বসতে বসতে হাসান জিজ্ঞাস করল,
-আচ্ছা মজিদ ভাই, এই বিশ বছর আপনি কোথায় ছিলেন?
-ভয় দূর করতে অস্ত্র সংগ্রহে বের হয়েছি। পরে দেখলাম, সে অস্ত্র হচ্ছে জ্ঞান।
এবার হাসান মজিদকে বসতে বলল,
-আসলে মজিদ ভাই, খুবই ক্লান্ততো তাই আপনাকে বসতে না বলে বসে পড়লাম।আচ্ছা মজিদ ভাই, আপনি ওদের না পড়িয়ে মানুষকেইতো পড়াতে পারেন।
-তাতো আমি চাই, কিন্তু কেউ ভয়ে আমার কাছে পড়তে চায়না।তবে কুকুর বিড়ালদেরও শিক্ষার দরকার আছে। তুমি একটা গরু অথবা ছাগলকে জন্মের পর জঙ্গলে ছেড়ে দেয়, দেখবে তার আচরণ একরকম আর বাড়িতে আমরা তাদের লালন পালন করি বলে তাদের আচরণ এরকম। আর তুমি ডগ স্কোয়াডের কুকুরগুলো দেখো নাই, কত দক্ষ ওগুলো, তা কি শিক্ষাদিক্ষা ছাড়া হয়েছে?
-আচ্ছা মজিদ ভাই, আজকে উঠি,পরে কথা হবে।


সকাল বেলা কেউ একজন হাসানকে বাহির থেকে ডাকছে,
-হাসান,হাসান
-কে?” হাসান ভিতর শোয়া থেকে বলে।
-হাসান, আমি কবির।
-ও কবির, ভিতরে আস।

-কি করে জানলি আমি এসেছি?
-তোর চাচার কাছ থেকে জানলাম। তা দোস্ত কতদিন পর আসলা, ভাবছি এবার ভাবিকে নিয়ে আসবা।
-তা তো জীবনের একটা অংশ, জীবন না।
-হু, এনেছিস সাথে করে একটা ব্যাগ; তাতে আছে কয়েকপিস জামা কাপড় আর খাতা-কলম।এটাই কি জীবনের সব?
-তুইতোরে অনেক জ্ঞানী কথা শুরু করছিস।ঘটনা কি?
-মজিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক কিছু জানতে ফেরেছি, তাই দু’একটা কথা বলতে পারি।
-ও মজিদ ভাই।রাতে আসবার পথে ওনার পাঠশালাটা দেখে আসলাম।
-তুই ওনার ঘরে ঢুকেছিস!
-হ্যাঁ,
-তোর ভয় করেনি?
-কি যা তা বলছিস, ভয় করবে কেন?
-আরে মজিদ ভাই কোন সাধারন মানুষ না, কুকুর বিড়াল ওনার কথা মতো চলে।
-তুইও ট্রেনিং দেয়, দেখবি তোর কথা মতোও চলবে। তুই এখন বস, একসাথে নাস্তা করব আগে একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।

দুই দিন পর মজিদ হাসানকে নিয়ে চেয়ারম্যান চাচার বাড়িতে হাজির।

-চাচা,চাচা..
-কে মজিদ নাকি?” ভেতর থেকে চেয়ারম্যান চাচা বলল।
-জ্বী ,চাচা আমি মজিদ।
-তুই একটু বস আমি আসছি।

কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান চাচা বের হয়ে আসলেন। চেয়ারম্যান চাচাকে দেখে মজিদ এবং হাসান দুইজনেই দাঁড়িয়ে গেলেন।
-কি মজিদ, এই সময়? আর তোমার সাথে ও কে?
-চাচা,আমাদের হাসান চাচার ছেলে হাসান মুসাফির।

চেয়ারম্যান চাচার চেহারা হাস্যজ্জুল হয়ে উঠল, সামনে এগিয়ে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ”বাবা আমি তোমার লেখার খুবই একজন ভক্ত।আমি প্রত্যেকদিন তোমাদের পত্রিকাটি পড়ি আর তোমার লেখা খুজি।আমি তোমার ঐ লেখাটা আলাদা করে রেখে দেয়েছি।”
-কোন লেখাটি চাচা?
-ঐ যে, ’মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা’।সেখানের তুমি লিখেছিলে ”মুক্তিযোদ্ধারা যে মতেরই হোননা কেন, তাদেরও ভুলক্রটি থাকতে পারে কিন্তু বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দেওয়ার জন্য চাই বিশাল সৎসাহস।অতএব তাদের মর্যাদা করতে শিখুন”
বলতে বলতে চেয়ারম্যান চাচার চোখে পানি চলে আসল। ”তা বাবা তুমি কবে আসলে আর আমার কাছে হঠাৎ কেন আসলে?”
-চাচা, প্রথমত এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে আর দ্বিতীয়ত এসেছি আপনার সহযোগিতা চাইতে।
-কি ধরণের সহযোগিতা আমাকে খুলে বল।
-আপনিতো জানেন মজিদ ভাইয়ের একটি ছোট পাঠশালা আছে কিন্তু ভয়ে কেউ সেখানে যায় না।আমরা চাচ্ছি আপনার বাড়িতেতো বেশ কয়েকটা ঘর আছে, সেখান থেকে একটাতে যদি এই পাঠশালাটা শুরু করা যেত।
চেয়ারম্যান সাহেব হাসানের প্রস্তাবে খুবই খুশি হয়ে বললেন,
-এতো আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তোমরা ব্যবস্থা কর,আমি পাঠশালার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করব।
-চাচা খুবই খুশি হলাম। আমি চাচ্ছি ঐ পাঠশালা দিনের বেলা সকলের জন্য খোলা থাকবে আর রাতের বেলা মজিদ ভাই যেসব ছেলেমেয়েরা দিনে স্কুলে যেতে পারে না, তাদের পড়াবে।এর দেখাশুনার দায়িত্ব থাকবে মজিদ ভাইয়ের উপর।
-তুমি যেমনি চিন্তা করছ, এটাই সর্বোৎকৃষ্ট। আমি এই পাঠশালার নাম দিলাম মজিদের পাঠশালা।

এটা বলতেই তিনজনই হেসে উঠলেন।


ছবিসূত্রঃ-নেট

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:০১

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: হাঁ, আসল অস্ত্র হচ্ছে জ্ঞান। গল্পের মাধ্যমে শিক্ষার মর্যাদা তুলে ধরেছেন। পড়ে ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ মুসাফির নামা।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৫৫

মুসাফির নামা বলেছেন: মন্তব্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

২| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:২৪

রাজসোহান বলেছেন: ভাই অনেক বানান ভুল।

অট্রহাসি, ডুকবো, বুজবো। জ্ঞান নিয়ে ছোটো গল্পে বানান ভুল বেমানান। গল্পে প্লাস।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৫৬

মুসাফির নামা বলেছেন: ধন্যবাদ ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।

৩| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৩:২৭

বিদ্রোহী চাষী বলেছেন: রহস্য,রস,শিক্ষা সবই আছে।চমৎকার লাগল।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:০৫

মুসাফির নামা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৪৮

প্রামানিক বলেছেন: চমৎকার গল্প। খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:০৭

মুসাফির নামা বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।

৫| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৫২

বিজন রয় বলেছেন: পরিপূর্ণ গল্প।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৫৬

মুসাফির নামা বলেছেন: মন্তব্যেই খুবই প্রীত হলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.