নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৈয়দ মূসা রেজা

সৈয়দ মূসা রেজা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গণি স্কুল: চলে গেলো আমাদের বন্ধু জিএম

২৪ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৫৮


‘...যদি আমি আবার জন্ম নিতে পারতাম
তা হলে কি হত?
এ জীবন বদলে নতুন এক পৃথিবী বেছে নিতাম!
সব ভুল শুধরে - ঝরঝরে ব্লেডের মত
ধারাল কিছু একটা বানিয়ে !
তুলকালাম কাণ্ডের নায়ক হয়ে পৃথিবীর রুপ-রস
চুষে খেয়ে নিজেই হাততালি দিয়ে চারদিক মুখরিত
ক্ষমতার আয়নায় মুখ দেখে, মোসাহেব নিয়ে চারপাশে
ঘুরে বেড়ান!
না আসলে তা নয়,
না, তেমন সহজ
চাবিকাঠি হাতে পেলেও রূপ বদলের
ফুসলান এই পর্বে পা পড়ত না,
শুরুটা যেমন ছিল তেমনই থাকত,
ভুলগুলো সযত্নে বসিয়ে দিতাম
টাইমলাইনের স্ব স্ব স্থানে।
খালি সময়রেখাকে,
শুরু থেকে শেষ, শ্লো করে দিতাম,
কমপিউটারে ভিডিও এডিটের সময় হরহামেশা যা সম্ভব,
কয়েকটি বোতাম টিপে এদিক সেদিক।
যেন ধীরে শেষ হয়,
কেবল গতি কমিয়ে দেয়া।
ওই ভুল, ওই বিভ্রান্তি ওটাই তো আমি
যাকে জীবন বলে শ্বাস ফেলি,
ওই সে অতীতের আমাকে উপভোগ পুনরায়,
আরেকবার, ও ভাবেই বারবার,
তবে ধীর ধীরে ধীরে,
অনেক সময় ধরে।
জীবন- অনেক কান্না, ভালোবাসা,
মার ধর, শালা শুয়োর,কুত্তার কামড়,
হাজার তাড়না, কারও চোখ গরম,
‘ভাষা সামলান ভাই আমরা বড় হব’
নাকের সিনকি ঝেড়ে না ফেলে পকেটে সগর্বে পুরে রাখা হায়,
কিছু ‘কপি-মানুষ’ এবং সারমেয় সন্তান
কিন্তু
তারপরও সব ছাপিয়ে
জীবন
উজ্জ্বল এক স্বপন!...’

ক. জয়নাল মেইল করেছে মূসাকে, ‘স্বপনকে নিয়ে স্মরনিকা বের হবে, লিখতে হবে।’ কাজটা কঠিন। অকালগত বান্ধবের স্মৃতিচারণে বেদনা রয়েছে। সে সাথে স্বপন। বা মূসার ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে মিশে আছে চাঁদপুর। চাঁদপুরের সাথে মূসার শৈশব কৈশোর গেঁথে আছে একই সূতায়। স্বপনের কথা বা (টুলটুলের ভাষায়)‘ন্যাংটাকালের’ যে কোনও বন্ধুর কথা বলতে গেলে অনিবার্য ভাবে চাঁদপুর আসবে। আসবে মূসার সমগ্র শৈশব থেকে শেষ কৈশোর পর্যন্ত সকল রোদ-বৃষ্টি-ঝড়। আসবে সবুজ বসন্ত। কিংবা দুঃসহ যন্ত্রণার কথকতা। আসবে আপন কিছু মানুষের কথা। স্বপন বা জিএমের সুতো ধরে আসবে অনেকের কথা। কাজেই স্বপনের জের ধরে মুলত মূসা আজ অতীতের শিকড়ে ফিরে যাব। ফিরে যাবে সময়ের এক বিশাল আংগিনায়। তবে এটা ইতিহাসের হাত ধরে একশ ভাগ প্রত্যাবর্তন নয়। ‘‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কি বাদ দেয় কত কি রাখে। কত বড়কে ছোট করে ছোট কে বড় করিয়া তোলে। সে আগের জিনিষকে পাছে ও পাছের জিনিষকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়। ... আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভাল করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে আমাদের অগোচরে পড়িয়া থাকে।’’ স্বপনের কথা বলতে বলতে এই চিত্রপটের একটা অংশের দিকে হয়ত খানিকট নজর দেয়া হবে।

খ.‘চাঁদপুর ভরপুর জলে স্থলে মাটির মানুষ আর সোনার ফলে।’ এই চাঁদপুরে মূসার জন্ম। ওর ডাকনাম পারভেজ। মূসা তার মায়ের মুখে বহুবার শুনেছে, ওর জন্ম হয়েছিল ড. ঘোষের হাসপাতালে। জন্মের পরপরই ও কেঁদে ওঠেনি। মিসেস ঘোষ নাকি বলেছিলেন, ‘এই ছেলে ড. ঘোষের থাপ্পড় না খেলে কাঁদবে না নাকি!’ এ কথা শোনার পর মূসা কেঁদে উঠেছিল। চাঁদপুরে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে, চার্চের পেছনে ছিল এই হাসপাতাল । ড.ঘোষ অকালে গত হয়েছিলেন। হাসপাতালও টিকেনি। মিসেস ঘোষ পরে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন। এ সবই মায়ের মুখে শোনা। মূসা তার ছোট বেলায় এই হাসপাতালের ধ্বংসস্তুপ কেবল দেখেছে। (সৈয়দ মুহাম্মদ মূসা কাজিম) নূরী সাহেব নামে পরিচিত মূসার আব্বা। চাঁদপুর কে, জি, স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন। নূরী সাহেবের জীবন অসাধারণ ঘটনা বহুল। বহু ভাষায় পন্ডিত অতি বিশাল মাপের এই মানুষ নিজের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
এদিকে, মূসার মায়ের একান্ত ইচ্ছায় ওর লেখাপড়ার হাতে খড়ি দিয়েছিলেন ‘দরবেশ নানা।’ নতুন একটা শ্লেটে আলিফ, বে, তে, লিখলেন ‘দরবেশ নানা।’ তারপর পেন্সিল ধরিয়ে দিলেন মূসার হাতে। মুসার হাত ধরে তিনি সে আলিফ, বে, তের উপর হাত বুলালেন । তার আগে মূসাকে নানার সাথে সাথে পড়তে হয়েছে, ‘রাব্বি জেদনি এলমান।’
সেই মহাপ্রাণ দরবেশ নানার আসল নাম ধাম কিছুই আজ আর মূসা মনে করতে পারে না। শ্বেতশুভ্র দাঁড়ি, কোমল হাসির সেই অনন্য ব্যক্তিত্বের বাড়ি ছিলো ফেনীতে। কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজীতে অনার্স এবং পরবর্তীতে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেছিলেন, মুসা শুনেছে। দরবেশ নানার কথায় আঞ্চলিকতার বিন্দুমাত্র ছাপ ছিলো না। বৃটিশ আমলে রেলের বড় পদে চাকুরি করতেন। পরে হঠাৎ তাঁর মনে সুফি ভাব প্রবল হয়ে ওঠে। তিনি লোভনীয় সে চাকুরি অবলীলায় ছেড়ে দেন। তারপর খোদার নাম জিকির করা এবং অনিকেত পাখির মত এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানর এক নতুন জীবনের সূচনা করেন। কোথাও বেশিদিন থাকতেন না। কোনো দুঃখ তাঁকে স্পর্শ করত না। অমলিন, চির অম্লান এক আলোর দ্যুতির মত তিনি ঘুরে বেড়াতেন এখানে সেখানে। সারাদেশে। মাঝে মাঝে এসে মূসাদের বাসায় উঠতেন। এককালে তিনি রেলে চাকুরি করতেন। সে কারণে রেলে যাতায়াতে টিকেটের কোনো সমস্যায় দরবেশ নানাকে পড়তে হয়নি। যে যাই হক, হাতে খড়ি উপলক্ষ্যে মূসাদের বাসায় সেদিন মিলাদ মহফিলের আয়োজন হয়েছিল।
আর মূসার স্কুল জীবন শুরু হয়েছিলো লেডি প্রতিমা গার্লস হাই স্কুলের মাধ্যমে। মূসার আম্মা, সৈয়দা সায়ীদা বানু, ও স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। বানু বা ভানু দিদিমনি নামে সবাই তাঁকে চিনতেন। চাঁদপুরের প্রথম দিকে যে কয়জন মুসলিম শিক্ষিকা ছিলেন মূসার মা তাদের একজন। হিন্দু প্রভাবের কারণে মূসা দেখেছে তার ছোট বেলায় শিক্ষিকাদের ‘দিদিমনি’ ডাকা হত। লেডি প্রতিমা স্কুলে শিক্ষিকাদের ‘আপামনি’ ডাক চালু হয়েছিল অনেক পড়ে। স্কুলের হেড মিসট্রেস মূসা যাকে বড় মাসিমা বলে ডাকত, সেই মণিকা মজুমদার ভারতীয় এক নাগরিককে বিয়ে করলেন। তারপর স্কুলের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন কোলকাতায়। তার আগে তার স্বামীকে পাকিস্তানি নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

বড় মাসিমা চলে যাওয়ার পর স্কুলটি নতুন হেড মিসট্রেস হয়ে এলেন হামিদা (সম্ভবত রহমান) বেগম। তিনি এসে ‘দিদিমনি’ বিদায় করে দিলেন। চালু হল ‘আপামনি।’
লেডি প্রতিমা স্কুলটিতে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কো এডুকেশন ছিল। মূসার সাথে ও স্কুলে আরও দুইতিনজন ছেলে পড়ত। তাদের একজন অনুপ চক্রবর্তী। অন্যজন কালাম। কালামের চেহারা সুরুত কিছুই মনে নেই। অনুপের বাসা ছিল চৌধুরী মসজিদের কাছে। চৌধুরী মসজিদের কাছে, মূসার এক সহপাঠি রুবিদের বাসা ছিল। বাসাটা দোতালা। চারদিকে দেয়াল ঘেরা। রুবিরা সাত বোন। কোনো ভাই ছিলো না। ওর বাবার সিগারেটের এজেন্সি। সেকালে ভদ্রলোক বেশ টাকাঅলা ছিলেন। রুবিদের সব বোনই নানা সাংস্কৃতিক কাজ কর্মের সাথে জড়িত ছিল। রুবি ছাড়া মূসা আর সে সব সহপাঠির নাম অনায়াসে মনে করতে পারে, তাদের মধ্যে রয়েছে মিনু, মেহেরুন্নেসা, বিককু এবং রাজিয়া। মিনু এবং রুবি দু’জনেই সংগ্রামী। বিশেষ করে মিনু। ভাঙ্গা স্বপ্নের বিরান মাঠের উপর কি করে সবুজ, স্বচ্ছ শ্যামল- সুন্দর আরেক পৃথিবী গড়ে তোলা যায় তার উদাহরণ দিতে হলে মিনুকে মনে করতে হবে। মনে করতে হবে বারবার।

ক্লাস ফাইভে ওঠার পর স্কুল বদল। অনুপ চলে গেল ডিন এন হাইস্কুলে। লেডি প্রতিমার পর্ব শেষ করে মূসাকে ভর্তি হতে হবে গণি মডেল হাইস্কুলে। এটা আগেই ঠিক করা ছিল। এই স্কুলে মূসার এক নানা পড়েছেন। তখন মূসার দুই মামা পড়ছেন। আর স্কুলের হেড মাস্টার কাদের স্যারের প্রচন্ড নাম ডাক। মূসার আব্বার সাথে তার সর্ম্পক বেশ বন্ধু সুলভ। এখানে এসে পরিচয় হল, মহন, স্বপন, করিম, এনায়েত, বোরহান, ফারুক, বসির, সৈয়দ, নান্নু, নুরু, খলিল, কামাল, তফু, টুলটুল, সুবোধ চক্রবর্তী, ওসমানী, বেনী মাধব ঘোষ, মামুন, অরবিন্দ, মুস্তাফিজ,সফিক, তাজুল, কাতলা শফিক, নাসির, জাফর , মহিউদ্দিন, আইয়ুব আলী, মফিজ, ইত্তেহাদ, মকবুল, জাফরসহ বিশাল এক দলের সাথে। যারা পরে আজীবনের বন্ধু হয়ে ওঠে।

মূসার স্কুল জীবনের শ্রেণিবান্ধবদের মধ্যে অনেক আগে গেছে বোরহান। ও ডাক্তার ছিল। জিএমের খবর পাবার কয়েকদিন পর জয়নালের আরেক মেইল করে জানায়, ‘বিদায় নিয়েছে মোস্তাফিজ।’ মহনও একই মেইল করেছিল। মোস্তাফিজ পেশায় উকিল ছিল। ও গেছে ২ নভেম্বর। স্কুল জীবনের পরে মোস্তাফিজের সাথে আর দেখা হয়নি মূসার। স্কুলে থাকাকালে গুড়ি গুড়ি অক্ষরে দ্রুত লিখতে পারত মোস্তাফিজ। ওর এমন মোক্তারি হাতের লেখা পড়তে কষ্ট হত শিক্ষকদের। আর এ জন্য মোস্তাফিজের ওপর গণি স্কুলের এ্যাসিটেন্ট হেড মাস্টার বশিরুল্লাহ স্যার একদিন বেশ ক্ষেপে উঠেছিলেন।

সত্যি কথা বলতে কি, স্বপনের সাথে মূসার পরিচয় কেবল গণি স্কুলের গণ্ডিতে নয়। স্বপনের মা, সুরাইয়া খালা ছিলেন মূসার মায়ের ছাত্রী। আর মূসার খালার ক্লাসমেট। এ ছাড়া ওর বড় বোনেরা পামেলা ও ডেইজি খালার সহপাঠি ছিল। সে সুবাদে স্বপনের বড় বোনদের মূসা খালা বলেই ডাকত। স্বপনের পুরো নাম, গোলাম মহিউদ্দিন ভুইয়া। সংক্ষেপে জিএম ভুইয়া। গণি স্কুলের জীবনে স্বপনকে জিএম বলেই ডাকত। ওর বাবা আয়াত আলী ভুইয়া মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। ওদের বিত্ত- বৈভব ছিল। বলা যায় স্বপন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিল। তবে স্বপনের মায়ের জীবন বেশ উর্মিমুখর ছিল। সে কারণেই হয়ত তিনি স্বপনকে চোখে চোখে রাখতেন। পড়ালেখা করছে কিনা তা রীতিমত ‘সুপারভাইসাবগিরি’ করতেন। সুপারভাইজার শব্দটির এই খোলনলচে কি নুরা বদলে দিয়েছিল! না মূসার স্পষ্ট মনে নেই। নূরার কল্যাণে অনেক ‘খাস্তা ও আখাস্তা’ গল্প শোনা হয়ে গিয়েছিল স্কুল জীবনে। একদিকে গল্পের বই পড়ার সীমাহীন ঝোঁক। অন্যদিকে নূরার গল্প। দুই মিলে বহুল কথিত ‘ইচড়ে পাকার’ পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে যায় গুরুজনদের অগোচরে।
অবশ্য, ওরা যে সময় হৈ চৈ করে বেড়াচ্ছে। খেলছে। সাঁতার কাটছে। এর গাছের বরই (কুল) ওর গাছের আম পাড়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সে সময় স্বপনের পক্ষে বাসা ছেড়ে বাইরে বের হওয়ার জো ছিল না। ওকে ক্লাসের পড়া মুখস্ত করতে হয়েছে। মূসা একেবারে ছাড়া গরু ছিল না। তা বলে ওর নিষেধের ‘দড়ি’ স্বপনের মত ওত টাইট ছিল না।

মূসার আব্বার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। দেশের ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করতে হবে। এমনি এক জেদ ছিল আগাগোড়া। সেই ১৯৪৬ সালে বাংলা ও আসামের মুসলমান তরুণদের জন্য প্রচলিত ব্যয়ের অর্ধেকে বিমান পরিচালনা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন কোলকতায়। তৎকালীন কোলকাতায় সাড়া জাগান প্রতিষ্ঠান নওজোয়ান মজলিশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নূরী সাহেব।
যে যাই হক, সে সময় তিনি চাঁদপুরের চৌদ্দ কলোনীর মাঠে বিকেলে ছেলে মেয়েদের জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার আয়োজন করেছিলেন। এ ছিল বিনোদন, শরীর চর্চা এবং শিক্ষার এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ। গড়ে তুলেছিলেন, চিলড্রেনন্স ট্রেনিং এন্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টার বা সিটিএন্ডডব্লিউসি নামে এক অনবদ্য প্রতিষ্ঠান। কুচকাওয়াজ, শরীরচর্চা ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানে আরও শিক্ষার আয়োজন ছিল।
চার্চ ওর্য়াল্ড সার্ভিস নামে খিস্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান সে সময় সারা দেশের শিশুদের জন্য গুড়ো দুধ, ঘন সিরাপ, সয়াবিন তেল সহ নানা খাদ্য দিত। ট্রেনিং সেন্টার তা পেতো এবং বিতরণ করত। গুড়া দুধ ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় বিশেষ পরিচিত ছিল না। প্রথম দিকে দুধ বিতরণ করার পর বহু ছেলে - মেয়ে তা পরদিন ফেরৎ আনে। বলে, ‘স্যার এগুলা মেমসায়েবগো দুধ খাওয়া যাইব না।’
গুড়া দুধ নিয়ে এই ভুল ভাঙ্গানোর জন্য নূরী সাহেবকে শেষ পর্যন্ত একজন আলেমের সাহায্য নিতে হয়েছিল। অনেক ছেলে মেয়েই এই প্রতিষ্ঠানে আসত শ্রেফ খাবার বা রেডক্রশের নানা গিফট বক্সের লোভে। এ ভাবেই নূরী সাহেব আজকের দিনের ‘পড়ার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচির পথিকৃত হয়ে উঠেছিলেন। সে খবরও অনেক পরে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। সে যাক, স্বপন এই সেন্টারেও এসেছে। তবে স্থায়ী ছাত্র হয়নি। কিংবা তখনও স্বপনের সাথে মূসার সর্ম্পক ঘন হয়ে উঠেনি।

স্কুল জীবনে স্বপন বা জিএম প্রথম সারির ছাত্র ছিল। নামাজ পড়ত নিয়মিত। গণি স্কুলের হেড মাস্টার কাদের স্যার ছিলেন কড়া তবলিগি। ছাত্রদের তবলিগ করার জন্য উৎসাহ দিতেন। তা ছাড়া হেড মাওলানা স্যার, সেকেন্ড মাওলানা স্যার, ছোট মজিদ স্যার, বড় মজিদ স্যার, সিদ্দিক স্যার, রফিক স্যার, হক স্যার, বশিরউলাহ স্যার সবাই ছিলেন সক্রিয় নামাজী। নিজেরা নামাজ আদায় করতেন। ছাত্রদের নামাজে আদায়ের প্রেরণা দিতেন। প্রয়োজনে ‘বেতাগাজির ওষুধ’ মানে বেত প্রয়োগে এরা কেউ দ্বিধা করতেন না। দুপুরে নামাজ না পড়লে নামের তালিকা ধরিয়ে দেয়া হত হেড মাওলান স্যারের হাতে। পদাধিকার বলে এই তালিকা রাখা কাজটি করত ক্লাস ক্যাপ্টেন করিম পাটোয়ারী। আরবি পিরিয়ডে তার তালিকাভুক্ত অপরাধী ছাত্রের পিঠে সপাৎ সপাৎ নেচে উঠত হেড মাওলানা স্যারের বেত। স্বপন এই বেত্রাঘাত খেয়েছে বলে মূসার মনে নেই। মূসার পিঠে অনেকবার এই বেত পড়েছে।
দীনেশ চক্রবর্তী ইংরেজী পড়াতেন। তাঁর হাতেও বেত শোভা পেত। ওটা শোভাই পেত। বা তাঁর হাতের অলংকার ছিল। দীনেশ স্যারের বেতের ব্যবহারের দরকারই পড়ত না। অপরাধীকে তিনি এমন কড়া কথা বলতেন তাতে মনে হত বেত মারলেই শাস্তি কম হত। দীনেশ স্যারের এ হেনও ‘বাক্যাস্ত্র’ স্বপনকে আঘাত করেনি। এর কৃতিত্ব সুরাইয়া খালার। না হলে স্বপনের মত ‘শান্ত শিষ্ট ন্যাজ বিশিষ্ট’ ছাত্র উৎছন্নে যেত।
১৯৭০ সালে মেট্রিক পাশ করার আগ পর্যন্ত এমন কোনও ঘটনা নেই যেখানে স্বপনকে দুষ্ট হিসেবে তুলে ধরা যায়। স্কুল পালিয়ে মনিং শো দেখার কাজটি স্বপন করেছে কিনা মূসা মনে করতে পারে না। সে সময় সিনেমা হল গুলোতে ম্যাটিনি, ইভেনিং ও নাইট শো হত। আর শুক্রবার ও রোববারে মনিং শো হত। সাধারণ ভাবে মনিং শোতে ইংরেজী ছবি দেখান হত। যে কারণে অন্য কোন শোতে ইংরেজী ছবি দেখান হলে সে সময় মূসার অনেক ক্লাসফেন্ডই বলত, ‘আজ সন্ধ্যায় ‘মনিং শো’ হবে।’ মানে ইভেনিং শোতে ইংরেজী ছবি দেখান হবে । মূসাও বলেছে এমন কথা।

’৭০এর আগে একবার এক ঘুর্ণিঝড়ের পরদিন মূসা দেখে স্বপন কয়েকজন কামলা নিয়ে ঘুরছে। ঝড়ে ওদের নির্মীয়মান বাড়ির বাঁশ-টিন উড়িয়ে নিয়ে সামনের খালে ফেলেছে। জলোচ্ছাসে ডাকাতিয়া নদী ফুলে ওঠায় খালও ভরে গেছে পানিতে। ঘোলা পানি তখন তোড়ে আসছে। অথচ আগের দিনও এ খালের পানি ছিল তলে। স্বপন সে খাল থেকে ঝড়ে উড়ে আসা বাঁশ -টিন উদ্ধারের জন্য কামলাদেরকে নিয়ে কাজ করছে । মূসার মনে হলও ভিন্ন আরেক স্বপনকে দেখছে। ওর স্কুলের স্বপনের সাথে এই স্বপনের মিল নেই। নিজের পায়ের মাপের চেয়ে বড় স্পঞ্জ-চপ্পল পড়ে কামলাদের নিয়ে কাজ করাচ্ছে ও। নির্দেশ দিচ্ছে। পায়ের মাপের যেয়ে প্রায় দ্বিগুন বড় স্পঞ্জ পড়ে কেনও বের হয়েছিল মূসা জানে না। দৃশ্যটা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল। স্বপন হয়ত ওর বাবার স্পঞ্জ পড়ে এসেছে। ওর বাবা ছিলেন বিশালদেহী। তার পায়ের মাপের জুতো সাধারণ ভাবে চাঁদপুরে পাওয়া যেত না। এ কথা বহুবার শুনেছে। স্বপনও ওকে দেখল। কিন্ত স্বপনের তখন ‘দাঁড়াবার সময়তো নাই।’ কাজেই আলাপ জমল না সেদিন। স্বপনের চরিত্রে এ ভাবেই দায়িত্বের অ আ ক আঁকা হয়ে গিয়েছিল। হয়ত খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানেও সুরাইয়া খালার ভূমিকা রয়ে গেছে, মূসা ভাবে। দায়িত্বের এই বীজ পরবর্তীতে স্বপনের জীবনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল, বনফুল নামে পরিচিত বলাই চাঁদ মুখোপধ্যায় নিজের স্মৃতি রোমন্থন করতে যেয়ে লিখেছিলেন, মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর তারা সাত বন্ধু বটবৃক্ষকে সাক্ষী রেখে প্রতীক্ষা করেছিলেন, তাদের মধ্যে এই বন্ধুত্ব চির অটুট থাকবে। কেউ কাউকে কোনদিন ভুলে যাবেন না। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুর থাবায় তারা কেবল ছড়িয়ে ছিটিয়ে যান নি বরং সেই ‘সহ-প্রতিজ্ঞ’ বন্ধুদের সবার নামও আর মনে ছিল না! মূসা বা তার কোনও বন্ধু এমন প্রতিজ্ঞা করেছে বলে জানা নেই। তারপরও তারা পরস্পরকে ভুলে যায় নি। মূসা জানে, এটা সম্ভব হত না এককালের ক্লাস ক্যাপ্টেন করিম পাটোয়ারী, কোটিপতি ব্যবসায়ী জয়নাল আর চিকিৎসক গোলাম মহিউদ্দিন ভুইয়া ওরফে স্বপন ওরফে জিএমের প্রচেষ্টা ছাড়া।
কর্মক্ষেত্রে এসে নিজেদের মধ্যে এই যে রসঘন যোগাযোগ তার অনেকটাই সাঙ্গ হয়েছে স্বপনের চেষ্টায়। ও সবার খোঁজ রাখত। কে কোথায় আছে তা খুঁজে বের করত। কক্ষ থেকে হারিয়ে যাওয়া কোনও নক্ষত্র খুঁজে বের করার ধৈর্য নিয়ে যোগযোগ করত। বহুদিন (সাব্বির আহমেদ বা এস এ) ওসমানীর খোঁজ ছিল না। জয়নাল স্বপন দু জনেই এ জন্য বেশ উদ্বিগ্ন। ‘কোথায় গেল শালা?’ মাঝে মাঝে ওদেরকে এ প্রশ্ন করতে শুনেছে। স্কুল জীবনে পাঠে ওসমানী ওকে দেদার সাহায্য করেছে, জয়নাল মুক্ত কন্ঠে এ কথা শতবার স্বীকার করেছে। শেষ পর্যন্ত ওরা বের করে ছাড়ে যে হতভাগা এখন বৃহত্তর সিলেটের এক চা বাগানে ডাক্তারি করছে। মূসার সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিল স্বপন তার মোবাইল থেকে ফোন করে। একজন ব্যস্ত সংসারী মানুষের পক্ষে কি করে এত সময় দেয়া সম্ভব হয়? বিশেষ করে ‘নিজমুখো’ এই সময়ে দাঁড়িয়ে কি করে ‘পরমুখো’ বা ‘বন্ধুমুখো’ হয়ে ওঠা যায় কখনও ভেবে বের করতে পারেনি মূসা। সায়েন্স ল্যাবের স্বপনের অফিসে বেশ কয়েকবার গেছে মূসা। সেখানেও দেখছে হাসি মুখে রোগী দেখছে। আগে রোগী বিদায় করে পরে দেশে ছুটি কাঁটাতে আসা মূসার সাথে গল্প করেছে।

স্বপনের সূত্র ধরে এখানে করিমের বদলি এবং সে বদলি ফেরানর গল্প এসে যেতে পারে। করিম তখন মৎস্য উন্নয়নের নিযুক্ত আধা সরকারি সংস্থার দুঁদে ইউনিয়ন লিডার। দাবি দাওয়া আদায় বা ইউনিয়নের কোনও কাজ নিয়ে এক তপ্ত মুর্হুতে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, চেয়ারম্যানকে যাচ্ছে তাই বলে বসে। ফলং- বদলি। এবং সেই কাপ্তাই বা পার্বত্য চট্রগ্রামের কোথাও।
খবর শুনে স্বপন হায় হায় করে উঠে। মুখে বলে, ‘স্কুলে শয়তানি বাদরামি করার জন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে নালিশ করে বহুবার হেডমাওলানা স্যারের বেত খাওয়াইছস। তার একটা হক্কের বিচার আছে না।’ করিম কথাটা নালিশের ভঙ্গিতে মুসাকে বলেছিল অনেক পরে। মুসা জবাবে বলে, ‘এক্কেবারে হক কথা কইছে। শালা তোর বারো বছর বনবাস হওয়া উচিত ।’ করিম সে কথা শুনে হাসে। বন্ধুদের এ গঞ্জনায় কত যে আনন্দ ওর হাসিতে তা বোঝা যায়।
সে যাক, সে সময় ক্ষমতাসীন একজন শক্তিশালী ব্যক্তির সাথে স্বপনের গভীর জানাশোনা ছিল। গ্রাম সুবাদে তাঁকে বহুকাল ধরে স্বপন চেনে। কিন্তু তাঁকে দিয়ে কাজ হল না। করিমের নামে অভিযোগ মারাত্বক। বদলি ফেরান গেল না। ওদিকে করিম পচঁছে সেই পার্বত্য চট্রগ্রামে। এবার স্বপন রাস্তা বদলায়। ধরে বসে দিদারকে। দিদার সে সময় উপ সচিব। করিমের ব্যাপারে দিদারেও গরজ ছিল। কেবল ব্যাটে- বলে এক করতে পারছিল না। এবার দিদার নিজে সরাসরি ফোন করে সেই ‌আধা সরকারি সংস্থার নতুন চেয়ারম্যানকে। তাকে বলে, ‘স্যার আমি অমুক। আর করিম আমার ক্লাস ফেন্ড আমি সেখানে আছি করিমও সেখানে থাকতে পারত। স্যার ওকে বদলি করে ঢাকায় আনতে পারলে খুবই খুশি হব। আরেকটা কথা স্যার, আপনাদের বিভাগের মন্ত্রী মহোদয়কে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। আপনি যদি না পারেন তাহলে বলেন, আমি মন্ত্রী মহোদয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করি।’

জবাবে চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, ‘দিদার সাহেব জীবনে বহু তদবির দেখেছি, তদবির করেছি। তবে এ রকম তদবির এর আগে আর দেখেনি। করিম পাটোয়ারীর ফাইলের অবস্থা কি দেখে নেই এক সপ্তাহ পরে আপনাকে জানাব।’ এক সপ্তাহ পরে করিমের ফোন পেল দিদার। ‘দোস্ত আমি ফতুল্লা অফিসে জয়েন করেছি!’ জানাল ও।

তেহরান থেকে ঢাকায় ছুটিতে ফেরার আগে মুসা জিএমকে ই-মেইল করে তারিখ জানিয়ে দিয়েছে। প্রতিবার জিএম জবাব দিয়েছে, ‘ঢাকায় আসার পর বন্ধুদের সাথে বসতে হবে। একটু সময় দিবি। দ্বিতীয়ত বিমান বন্দরে গাড়ি পাঠাব, কোন ফ্লাইটে আসবি জানা।’ মূসা অবশ্য জিএমের গাড়ি নেয়নি। এখন মনে হয় অন্তত একবার দু’বার নিলে ভাল করত। জিএম খুশি হত। ওকে খুশি করার সে সুযোগ আর হবে না।
এর আগে একবার ভাইরাসের হামলার মূসার কমপিউটারের সব গড়বড় হয়ে যায়। একই সাথে নষ্ট হয়ে যায় সুমন-নচিকেতা-অঞ্জনের গানসহ সংগীতের সকল ফাইল। ‌সে সময়ে ইন্টারনেট ততো ব্যাপক ছিল না। ব্যাপারটা মেইলে জিএমকে জানানর পর ঢাকা থেকে কয়েকটা গানের সিডি পাঠিয়ে দিয়েছিল। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী ইরাকে হামলা করার পর জিএমের উদ্বেগমাখা মেইল পেল। ‘দোস্ত কেমন আছস জানা। দুঃচিন্তায় আছি!’ ‘যুদ্ধ হচ্ছে ইরাকে, ইরানে তার কোনও ছায়া নেই। অথবা ভয়ের কারণ নেই।’ মূসা জানাল।
২০০৩ সালের শেষের দিকে জিএম মেইল করল, সম্ভব হলে ‘গজ’ (ইরানি এক জাতের অতি মজাদার মিস্টি) পাঠাবি। জিএম ইরানের ঐতিহাসিক নগরী ইস্পাহানের কাছাকাছি কোথায়ও ছিল। ইস্পাহানের ‘গজ’এর খ্যাতি আছে। জিএম এ জিনিসের মজা জানে। তবে বিদেশ থেকে জিনিষ পাঠান বেশ কষ্ট। সমস্যা ওজন। সাত পাঁচ বিবেচনা করে কারও হাতে মিস্টি পাঠান মূসার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠল না। নিজে দেশে ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে যাবে। ঠিক করল।
এর মধ্যে জিএম আবার মেইল করল, ‘খুব ঝামেলা যাচ্ছে। দোয়া করবি।’ বাড়ি জমি নিয়ে ওর ঝামেলা ছিল। মূসা ভাবল সেগুলোই হয়ত ‘সেয়ানা’ হয়ে উঠেছে। কিংবা ছানাপোনা ‘বিয়াইছে।’ ঢাকায় একবার স্বপনকে মূসা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কিরে বুড়া বয়সে জমি-জিরাত নিয়া ঝামেলায় পড়লি!’ ‘আসলে ঝামেলা হয় বুড়া বয়সেই।’ বেশ ক্লান্ত এবং তিতা স্বরে জবাব দিয়েছিল জিএম। ২০০৪ সালে জিএমের কোন মেইল পেয়েছে বলে মনে করতে পারছে না। এ বছর ছুটিতে দেশে ফিরছে, যথারীতি তারিখ জানাল জিমএকে। ওর পক্ষ থেকে কোনও জবাব এল না। বা এবার গাড়ি পাঠানর কোনও প্রস্তাব দিল না। অবাক হল মূসা।
দেশে ফিরে প্রথমে ফোন করল আসাদকে। ‘বাসায় আছেন। আসছি।’ আসাদ বলল, ‘ভাগ্যক্রমে কেবল আজই বন্ধের দিনে বাসায় আছি। অফিসের কাজের চাপে দম বের হওয়ার যোগাড়। আসেন।’
‘আমার কি দুভার্গ্য। ভেবেছিলাম এমন সুযোগে ভাবীর সাথে আড্ডা দেব। তা আর হল না। কি আর করা।’ ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘তা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে আসছি।’
‘বুড়ো ভাল হয়ে যান, আসুন, ও বস্তু নিয়ে এলে ভালই হবে।’
মূসা এরপর ফোন করল জয়নালকে। ‘জিএমের খবর কি?’ অভিমান ভরা স্বরে জানতে চাইল। ঠান্ডা গলায় জয়নাল জবাব দিল, ‘ওর শরীরটা খারাপ। ব্যাংককে গেছিল। তিনদিন ছিল।’ মাত্র তিনদিন কেনও ছিল! রোগ কি বা কি চিকিৎসা চলছে সে কথা এড়িয়ে গেল। তবে রোগটা কঠিন কিছু। সে কারণেই জিএম হঠাৎ এমন নীরব হয়ে গেছে। বুঝতে পারল মুসা। আর এ প্রশ্নের জবাবে জয়নাল পরিস্কার কিছু বলল না। মনে হল কিছু লুকাতে চাইছে। ‘স্বপনের মায়ের লিভারের যে রকম সমস্যা হয়েছিল, তাই মনে হচ্ছে।’ মূসার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কথার ফাঁকে আসাদ জানতে চাইল, ‘বস্তুটি কোথায়, দেখি?’
‘আনি নাই।’ মূসার জবাব শুনে মনে হল আসাদ একটু অবাক হল।
মূসা তারপর বলল, ‘জানেন আমাদের স্কুলফ্রেন্ড জিএমের কঠিন অসুখ হয়েছে। ব্যাংককে গিয়েছিল তিনদিন ছিল। মনটা খারাপ। ক্যামেরা ছাড়া চলে এসেছি।’
দুঃখ বেদনার সময়গুলোতে আসাদের সাথে কথা বললে বুক হালকা হয়ে আসে। ৯০ সালে আম্মা মারা যাওয়ার পর মূসা দেখেছে। রহস্য পত্রিকাতে লেখালেখির সূত্র ধরে মূসার সাথে কিছু চমৎকার মানুষের পরিচয় হয়েছিল। কাজী (আনোয়ার হোসেন)ভাই নিজের চারপাশে এক বিশাল তারকালোক গড়ে তুলেছেন। আসাদ তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম এক ছায়াপথ। আসাদের সাথে মূসা মন খুলে আলাপ করে। ওর জীবনের খুব কম বিষয় আছে যা আসাদ জানে না। সদারসিক আসাদের সাথে আলাপের আনন্দই আলাদা। যারা ওর সাথে কথা বলেনি, সাধারণ আলাপও যে শিল্পের পর্যায় উঠতে পারে তারা কখনও তা বুঝতে পারবে না। ওটা লিখে বোঝানর ক্ষমতা থাকলে মুসা পৃথিবীর সেরা ‘লেখাশিল্পী’ হত। শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ বা কাজী আনোয়ার হোসেন মূসার কাছে লেখার কৌশল শেখার জন্য ঘোরাঘুরি করতেন ।

তবে সেদিন আলাপ তেমন জমল না। মূসার বারবার মনে হচ্ছিল জিএমকে ফোন করা দরকার। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। কি যে দুসংবাদ শুনবে, ভেবে ভাল লাগছিল না। কাজেই আলাপ জমবে কেন? আসাদের হাতেও একগাদা কাগজ ছিল। কি যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ দেখছে, বলেছিল। এর মধ্যে মূসা সাহস করে জিএমের বাসায় ফোন করল। জিএম তখনও ঘুমাচ্ছে। মূসা বলল, ‘আবার ফোন করব।’
ঘন্টা খানেক পরে দ্বিতীয়বার ফোন করল। এবার জিএমকে ডেকে দেয়া হল।
‘হ্যালো।’ গলার স্বর শুনে চমকে উঠল মূসা। কি ভীষণ ক্লান্ত স্বর। গমগমে সেই সদা প্রাণবন্তু ভাবটির আর কিছুই নেই।
‘কেমন আছস দোস্ত?’ কোনও ঠাট্রা নেই। মশকরা নেই।
‘ভাল।’ মূসা কবে এসেছে জানতে চাইল এবার।
‘তোর শরীর কেমন?’ মূসা বলল।
‘ভাল।’ তারপর তেমন শীতল কন্ঠেই বলল, ‘কেমোথেরাপি চলছে।’
‘কেমোথেরাপি!’ চমকে উঠে মূসা সাথে সাথেই গলা যথা সম্ভব স্বাভাবিক করে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করল। আসাদ কাগজ পত্র থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল। বোঝা গেল আসাদ ও কথাটা শুনে চোট খেয়েছে।
‘ও আচ্ছা। কেমোথেরাপি দিলে তো বেশ কিছু সাইড এফেক্ট দেখা দেয়। তোর তেমন হচ্ছে কি?’
‘হচ্ছে। কিছু খেতে পারছি না। তরমুজ আর কলা কেবল খানিকটা খেতে পারছি।’
‘মিস্টি খেতে পারছ!’
‘না। প্যানক্রিয়েজে সমস্যা। সুগার বেড়ে আছে মিস্টি একদম নিষেধ।’ জিএম জানাল।
ইরান থেকে ‘গজ’ নিয়ে এসেছে সে কথা মূসা বলল না।
জিএমের আলাপে মনে হচ্ছে ও দম পাচ্ছে না। তাহলে লিভারে নয় অসুখ প্যানক্রিয়েজে। কেমোথেরাপি চলছে শোনার পর মূসার পক্ষে বাক্যালাপ চালিয়ে নেয়া কষ্টকর হয়ে উঠল। তারপরও কয়েকটা কথা বলল। শেষে ফোন নামিয়ে রেখে মূসার মনে হল আজাব থেকে রক্ষা পেল।
‘আসাদ কেমোথেরাপির কথা শুনে কি আমার গলা কাঁপছিল?’
‘না বেশ সুন্দর করে কথাটা কাটিয়ে নিতে পেরেছেন দেখলাম।’
আসাদ সান্তনা দিল নাকি সত্য বলল তা নিয়ে সংশয় আছে মূসার। তা হলে শেষ পর্যন্ত এই! এ জন্যেই পরিস্কার করে কিছু বলেনি জয়নাল। জিএম ওদের সেই বাল্যবান্ধব। হাসিখুশি। রসিকতা প্রিয় বান্ধব। তার দেহে এ কোন ব্যাধি! মূসার বুকে একটা বেদনার ভারি পাহাড় ভর করল।

জয়নালের অফিসে যথারীতি এবারও বন্ধুসভা বসল। ২০০৫ সালের ১৩ এপ্রিল শুক্রবার ছিল দিনটি। জিএম এল একটু দেরি করে। বাবার মতই ও বিশালদেহী। কিন্তু এখন ওই মানুষটা প্রায় আধখান হয়ে গেছে। হাস্যরস নেই। গতবারও মূসাকে কথার ল্যাং মেরেছে। নিরীহ স্বরে প্রশ্ন করেছে, ‘এই মূসা বিয়ে করছস কয় বছর?’ প্রশ্ন শুনে মূসা একটু অবাক হল। মানসাংকে বরাবরই খারাপ। মূসা আসলে মৌলিক ভাবেই যে কোন অংকেই খারাপ। ‘গণিতের তেজে কাহারো হৃদয় শুস্ক হইয়া উঠে কাহারো হৃদয় আলোকিত হইয়া উঠে।’ মূসা বরাবরই ওই প্রথম দলের প্রথম কাতারের মানুষ। তদুপরি হাতে ক্যালকুলেটর নেই। কাজেই হিসেব কষতে সময় লাগছিল। কিন্তু সে সময় দিল না স্বপন। তার আগেই বলল,‘না মানে রাত নয়টার সময় ফোন করি শুনি, ‘দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়েছে।’ সকাল নয়টায় ফোন করি শুনি, ‘দরজা বন্ধ, ঘুম থেকে এখনও উঠে নাই।’ ব্যাপার কিরে শালা?’ ফারুক, মফিজ, টুলটুল, দিদার, জয়নাল, করিম, এনায়েত, সফিকসহ বাকি বন্ধুরা হো হো করে উঠল। মূসার কথা মুখ থেকে বের হওয়ার সুযোগই পেল না। কিন্তু এবার বেশির ভাগ সময়ই গালে হাত দিয়ে বসে রইল জিএম। কিছু কথা-বার্তা বলল। তাও নেহাৎ মামুলি। কথার সেই ফুলঝরি নেই। কথায় নেই সেই আতশবাজি। বা মিছরির ছুরি। স্বপনকে দেখে মনে হল, ভিন্ন জগতের ডাক শুনতে পেয়ে জীবনের ট্রানজিট লাউঞ্জে বসে থাকা এক অন্য মানব। অথচ বন্ধুদের এ আড্ডায় কারও কোনও ভড়ং নেই। পদ নেই। বা নেই পদবি । সবাই স্ব স্ব পরিচয়ের লেবাস বাইরে খুলে রেখে ছেলেবেলার পরিচয়ের সরল পোশাকটি পড়ে এখানে এসে বসে। দেশেএ রকম বন্ধুসভা বিরল তা অবশ্য মূসা জোর দিয়ে বলতে পারবে।

এবার মূসা ভিডিও করছে। মনে মনে কামনা করছে, স্বপনের সেই হাসিটা একবার হলেও যেন দেখা দেয়। কিন্তু একবারও সেই উচ্ছসিত হাসিটা আর জিএমের মুখে দেখতে পেল না। এক ফাঁকে ক্যামেরাটা মহন নিল। এ বছর নতুন আরেক বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গেছে। জয়নাল জানাল মূসাকে। মাসুদ। ’৭০সালের পর আর ওর সাথে দেখা হয়নি। মাসুদকে মনে করতে পারল না মূসা। মাসুদও পারল না। বেশ দু’পক্ষের দোষ কাটাকাটি হয়ে গেল। মাসুদ বলল, ‘তাহলে এখন থেকেই আমরা আবার পরিচিত হলাম দোস্ত, ঠিক আছে?’
মূসা সায় দিল। সন্ধ্যার দিকে ঝড় বৃষ্টি এল। আড্ডা শেষ করে জয়নালের অফিস থেকে যখন বের হল তখনও বৃষ্টির কাঁদুনি চলছে। মুশকিল। রিক্সা নেই।
‘মূসা কোথায় যাবি?’ স্বপন জানতে চাইল।
‘ধানমন্ডি, ২৭ নম্বরের মোড়ে, গিন্নি সপরিবারে ওখানে অপেক্ষা করবে।’
অন্য সময় হলে ‘সপরিবার’ নিয়ে মশকরা করত। কিন্তু আজ স্বপন কথাটা খেয়ালই করল না।
‘চল নামিয়ে দেই।’ স্বপনের দায়িত্ববোধ তার ভাঙ্গাচোরা শরীরের ভেতর থেকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। রাজি না হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মাহবুবকেও গাড়িতে তোলে। ’৭১ সালের পর মাহবুবের সাথে দেখা হয়েছে গতবার। তাও এই বন্ধুসভায়। পুরান বন্ধুকে নতুন করে আবিষ্কারের খবরটি মূসাকে দিয়েছিল জিএম। চাঁদপুরে ও আর মূসা একই পাড়ায় থাকত। মুসা ‘চৌদ্দ কোয়াটারে।’ আর মাহবুব থাকত ‘দশ কোয়াটারে।’ মাহবুবের মাথায় বিশাল টাক এখন শোভা বর্ধন করছে। টাকই তা প্রমাণ করছে ও যে হর্টিকালচারের দুর্ধষ ডক্টর । এ ছাড়া ওর আর তেমন কিছু বদলায় নি। ওর বাসা মিরপুরের দিকে। বৃষ্টি শেষের এ সময়ে গ্রিন কর্ণারের চেয়ে ২৭ নম্বরের মোড় থেকে রিক্সা বা গাড়ি পাওয়া সহজ হবে। ২৭ নম্বরের কাছে, ভোল পুরির একটা দোকান আছে। মূসা ও মাহবুবকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে জিএমের গাড়ি আবার উল্টোমুখো সায়েন্স ল্যাবের দিকে রওনা হল। নিজের গন্তব্যের উল্টো দিকে লিফট দেয়ার লোক ঢাকা শহরে আর কয়জন আছে? ‘রাত হয়ে গেছে রাস্তাঘাট ভাল নয়।’ এমন যুক্তি দিয়ে এর আগেও মূসাকে নামিয়ে দিয়েছে জিএম।
ঢাকায় মূসা এবার আরও একটা খারাপ খবর পেল। মূসার পুরান সহকর্মী রহিমার বড় ছেলে জন্ডিসে ভুগছে। শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছেলেটা কোমায় চলে গেছে। মূসা মোবাইলে একদিন কথা বলল রহিমার সাথে। ফোনের ও পাশ থেকে লক্ষী বোন রহিমা কান্নায় ভেংগে পড়ল। ও ছেলেটিকে দেখতে যেতে সাহস পেল না। কি বলবে রহিমাকে! তেহরানে ফেরার আগেই শুনল, ছেলেটি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। প্রতিদিনই মূসার মনে হয় রহিমাকে একটা চিঠি লেখা উচিত। কিন্তু মূসা ভেবে পায় না, সন্তানহারা এক মাকে কি লিখবে। রহিমার কথা ভাবলেই তার সেই কান্না ভেজা স্বরটি শুনতে পায়। রহিমার বেদনা অনুভব করছে। কিন্তু সে জন্য সান্তনা জানাতে পারছে না। পারছে না সান্তনার যুৎসই একটা বাক্য খুঁজে বের করতে। মানুষের ভাষা কেন এত সীমাবদ্ধ । বা মূসা কেন শব্দ খুঁজে পায় না।

বন্ধুদের আড্ডার ভিডিও এডিট করে শেষ পর্যন্ত আট মিনিটের ছবি বানাল মূসা। কাজটা কঠিন নয়। বা আহামরিও কিছু নয়। কিন্তু করতে ভারি ঝামেলা হল। বার বার বিদ্যুৎ সাহেব ভেগে যায়। সেফ করার সময় পাওয়া যায় না। ফলে আবার প্রথম থেকে শুরু। এ ভাবে একই কাজ কয়েক দফা করার পর তবেই তা শেষ হল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা গান কি দেবে? মান্না দের কথা মনে হল। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের কলিগুলো স্বাভাবিক ভাবেই মনে বেজে উঠল। কিন্তু গানটা মূসার কমপিউটারে নেই। যোগাড় করতে হল।


‘না ও গানটা দিও না।’ মানা করল গিন্নি। ‘গ্রান্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিজ যিশুদা ঘুমিয়ে আছে যে কবরে’ কিংবা ‘অমলটা ভুগছে দুরন্ত ক্যান্সারে জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়’ শুনে জিএম ভাইয়ের ভাল লাগবে না।’ গিন্নি বলল। মূসার কাছে বারণটা যৌক্তিক মনে হল।
শেষে ‘নীল আকাশের নীচে’ গানটার মিউজিক ব্যবহার করল। সব কাজ শেষ। এবার বার্ন করার পালা। ডিভিডি বার্ন করতে দিয়ে মূসা সালাওয়াত পড়ল। তেহরানের যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করা হক সালাওয়াত অম্নি জবাব পাওয়া যাবে, ‘আল্লাহুমা সালে আলা মোহাম্মদ ওলা আলে মোহাম্মদ।’ মূসার জন্য এ এক দারুণ অভিজ্ঞান। এ দফা দরূদে কাজ হল। বিদ্যুৎ গেল না। চাকতি দহন বা ডিভিডি ডিস্ক বার্ন হল। সহি-সালামতে। একবারেই।

এরমধ্যে আরেকবার জিএমের বাসায় গেল। করিম ও জয়নালের সাথে। সায়েন্স ল্যাবের ভেতরে ওর বাসা। ভাবী এই ঝামেলার সময়ও মেহমানদারি করতে ভুললেন না। জিএমকে ধমক দিল মূসা, ‘এই বেটা খবরদার গালে হাত দিয়ে ও ভাবে বসবি না।’
‘ঠিক আছে বসব না।’ ভাল ছেলের মত স্বীকার করল। কিন্তু কথা বলার সময় জিএমের হাত আবার সেই গালে চলে যাচ্ছে। এই শরীর নিয়েও জিএম নিয়মিত ওর অফিসে বসে। রোগী দেখে। শুনে ভাল লাগল মূসার। ওকে সাহস দেয়ার জন্য বলল, ‘তুই তো ডাক্তার তোর এত মন খারাপ করার কি আছে?’ স্বপন আস্তে আস্তে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ ওটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
মূসা কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে। ‘তুই তো অনেকদিন ডাক্তারি করস। মেডিক্যাল মিরাকলে বিশ্বাস করস?’
‘করি।’ এবার মনে হল জিএম একটু চাংগা বোধ করছে।

এক গ্যাঞ্জামের কারণে মূসাকে ঢাকায় এক সপ্তাহ বেশি থাকতে হল। কিন্তু তারপরও আসার আগে আর জিএমের সাথে দেখা করা হল না। মূসার হাজার একটা কাজ শেষ হওয়ার নয়। তেহরানে ফিরে নিয়মিত জয়নালের মাধ্যমে জানতে চেয়েছে জিএমের খবর। দিদারের কাছে ফোন করেছে বার দুয়েক এক কাজে, তখনও জানতে চেয়েছে জিএম কেমন আছে। ওদের সংক্ষেপে জবাব ‘ভাল আছে।’

রোজার দিনে মূসার কষ্ট হয়। কষ্ট হয় রোজার সময় কাজ করতে। এ কষ্ট কমে না। রোজার মাসে আলসে মূসা আলসেতর হয়ে পড়ে। রোজার মধ্যে ও ধীরে ধীরে কাজ করছে। কাজের ফাঁকে ই-মেইল খুলে দেখল জয়নাল জানিয়েছে, জিএম আর নেই। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ওর জন্ডিস দেখা দিয়েছিল। ভর্তি করা হয়েছিল হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। ৪ নভেম্বর (২০০৫) রাতে ও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। মূসাকে মেইলটা করা হয়েছে সাত তারিখে। সম্ভব হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী সৈয়দকে খবরটা মেইল করতে বলেছে জয়নাল। ওর কাছে সৈয়দের ঠিকানা নেই। দিদার ওর হলি ফ্যামিলির খরচের দায়ভাগ বহন করেছে, তাও জানিয়েছে জয়নাল। নিজে কি করেছে সে কথা চেপে গেছে । স্তব্দ হয়ে বসে রইল মূসা। ওর কড়া ঠাট্রার জবাবে কোনও বদ মশকরা তো করেনি জয়নাল, একবার ভাবল! জিএমের চলে যাওয়ার খবরটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। মূসা গিন্নিকে খবরটা দিল দুই দিন পর। আসাদকে খবরটা দিল আরও পরে।

ঘ. শেষ পর্যন্ত স্মরণিকা বের করা হয়নি। এর মধ্যে ওপারে চলে গেছে করিম পাটোয়ারী আর ফারুক। সুবোধ চক্রবর্তী কোথায় আছে জানি না। অরবিন্দের শরীর খারাপ। ভুগছে (কাতলা) শফিক। মহিউদ্দিন কেউ রাখে না। ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মামুন এবং দিদার বোধহয় যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছুক নয়। তাই শুনেছি। গণি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে জীবন কানাই চক্রবর্তী পুরানো ছাত্রদের সঙ্গে পরম আগ্রহে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। সৈয়দ ফেসবুকে নেই। ফলে জানি না কোথায় আছে। কেমন আছে। বাংলাদেশের অন্যতম চক্ষু বিশেষজ্ঞ হজরত আলী(মহন) অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে। বন্ধুদের বিপদে সাড়া দেয়। ঝিমিয়ে গেছে জয়নাল এবং এনায়েত। নান্নুকে ফেসবুকে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় খলিলকেও। যোগাযোগ রাখছে প্রায় নিয়মিত। নাসির এখন চাঁদপুরের সর্বজন প্রিয় মেয়র।
‘...জানালার ও পাশ থেকে মাটি ডেকে উঠলো,
ঘরে আয় ঘরে আয়।
তাইতো এখন ফেরার সময়।
বাড়ি ঘর সংসার স্বদেশ বিদেশ
কিংবা সং সাজাই সার নাকি সংয়ের ষাড়।
সার আমার সব জমা হিসেব
গলে যাচ্ছে একে একে।
রাতে বালিশে মাথা ঠেকাতেই
সেই ডাক সেই আহবান
আয় কোলে আয়
মাটি ডাকে নিবিড় আবেগে।
ফিরতে হবে
বাতাসের সিঁড়ি বেয়ে
আকাশের আংগিনায়
পুরোন মুখ, বন্ধুদের সুখগুলো,
সন্তান কিংবা নিজের শেকড়
আর দেখা হবে না
তাতে কি আর যায় আসে!
ওপাশে আসমান মাটির কোলে ঘুম
তারপর জেগে ওঠা অনন্তের ঠিকানায়
ওখানেই না হয় দেখা হবে
দেখা করো...।’
***

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:৪০

রাজীব নুর বলেছেন: অনেক বড় পোষ্ট। তবু পড়লাম।
ব্লগে নিয়মিত থাকুন। অন্যের পোষ্ট পড়ুন। সুন্দর মন্তব্য করুন।

২৪ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:৩৮

সৈয়দ মূসা রেজা বলেছেন: ধন্যবাদ। থাকার চেষ্টা করবো।

২| ২৭ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ। থাকার চেষ্টা করবো।

ভালোবাসা নিরন্তর।

২৭ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৯

সৈয়দ মূসা রেজা বলেছেন: স্বাগতম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.