![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উপনিবেশের শোষণ আর পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন এ দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রাচ্যের মানুষের মনের অনেক না বলা কথা ভাষা পেয়েছে এডওয়ার্ড সাইদের চিন্তায়। পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী তৎপরতা, তাদের আধিপত্য আর দমননীতির সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে রচিত ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে কালজয়ী লেখকের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একজন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পশ্চিমের আধিপত্য বেশ দক্ষতার সাথে শনাক্ত করেছেন।
প্রাচ্যের অতীত পশ্চিমের নিজের মতো করে নির্মাণের মাধ্যমে পাশ্চাত্যকে হেয় করার অপচেষ্টা রুখে দিতেও চেষ্টা করেছেন সাইদ। পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন আর সাংস্কৃতিক নির্মাণের পাশাপাশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্মাণের মতো গোলক ধাঁধা থেকে প্রাচ্যকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
ইতিহাস রচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ করে একুশ শতকে এসে ইতিহাস চর্চা করতে গেলে প্রায় সকল শ্রেণির গবেষককে নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন পশ্চিমা সূত্রের উপর। এক্ষেত্রে সাইদের চিন্তাধারা সর্ম্পকে জানা থাকলে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। প্রখ্যাত গবেষক এডওয়ার্ড সাইদের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১ নভেম্বর জেরুজালেমে। তাঁর বাবা ও মা উভয়েই ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী। কায়রো আর জেরুজালেমে বার বার স্থানান্তরের কারণে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি সাইদ। এরপর তিনি ১৯৪৭ সালে জেরুজালেমের সেন্ট জর্জেস একাডেমীতে ভর্তি হন। এরপর আরব ইসরাঈল যুদ্ধ শুরু হলে সাইদের পরিবার আবার জেরুজালেম থেকে কায়রো চলে যান
নামের প্রারম্ভে এডওয়ার্ড আর শেষে আরবি সাইদ নাম থাকার কারণে শিক্ষাগত ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কায়রোতে গিয়ে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকাকালীন সময়েই ভবিষ্যত দুরদর্শী সাইদের পরিচয় মেলে। ১৯৫১ সালে তিনি কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচ্যুসেটস অঙ্গরাজ্যের নর্থফিল্ড মাউন্ট হারমন স্কুলে ভর্তি হন। এখানে শিক্ষালাভের সময় ধীরে ধীরে সাইদের চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি ক্লাসেও অনেক ভাল ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হন।
১৯৬৩ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে সাইদের কর্মজীবন শুরু হয়। ২০০৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি হার্ভাডে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। এর পাশাপাশি ১৯৭৫-৭৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে সাইদ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৩ সালে রেইথ বক্তৃতামালায় অংশ নেয়ার সময় তাঁর দার্শনিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে একজন জগৎবিখ্যাত তাত্ত্বিকের স্থানে আসীন করে। এর পাশাপাশি সাইদের কয়েকটি রচনা প্রাচ্য ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে রচিত ইতিহাসের উপনিবেশিক প্রভাব ও বস্তুনিষ্ঠতা শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে এডওয়ার্ড সাইদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সাইদ। ১৯৭৭ সালের দিকে নিজ যোগ্যতায় ফিলিস্তিনি পার্লামেন্টের প্রবাসী সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে ইসরাঈল-ফিলিস্তিন চুক্তির শর্ত পছন্দ না হওয়াতে ১৪ বছরের এই দায়িত্বে ইস্তফা দেন। কর্মময় জীবনে অবসর খুব কমই লেছে সাইদের। জীবনের শেষভাগে এসে মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখতে পেয়েছেন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। তারপর ২০০৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মারা যান নির্যাতিত মানুষকে মুক্তির পথ দেখানো এই মহান দার্শনিক।
ওরিয়েন্টালিজম রচনার পরপর সাইদের সৃষ্টিশীলতাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার সুযোগ হয় বিশ্বের অন্যান্য তাত্ত্বিকের। বিশেষ করে পশ্চিমা আধিপত্যে নাস্তানাবুদ বুদ্ধিভিত্তিক পরিমণ্ডলে সাইদ পাঠককে একটি নতুন স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সাইদের আবির্ভাব পশ্চিমা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আধিপত্যবাদী ধারাকে অনেকটাই নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। মিশেল ফুকোর দর্শনে জ্ঞান ও ক্ষমতার যে দ্বান্দ্বিক অবস্থানের কথা উল্লেখ ছিল তাকে অনেকটাই বাস্তবে ফুটিয়ে তুলে পাঠকের দৃষ্টিগোচর করাতে সক্ষম হয়েছিলেন সাইদ। সাইদের গবেষণা দীর্ঘদিন উপনিবেশের আগ্রাসনে জীর্ণপ্রায় অঞ্চলগুলোর মানুষের অবমুক্তির তীব্র বাসনা, সংস্কৃতি বিকাশের রুদ্ধ সম্ভাবনা ও পশ্চিমা নির্মাণে ফুটে ওঠা অলীক জ্ঞানপ্রকল্পে সেগুলোর ভিন্ন উপস্থাপনার মুখোশ মানুষের সামনে খুলে দিতে সক্ষম হয়।
কর্মজীবনে সাইদ একজন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও বেশ দক্ষতার সাথে পশ্চিমা আধিপত্যবাদী নীতি ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন। পশ্চিমা জ্ঞানপ্রকল্পে একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক অবস্থান বার বার কানাগলিতে ঘুরে ফিরে গুমরে মরতে বসলে তখন অনেকটাই আলোর পথ দেখান সাইদ। একটি বিষয় ঘিরে প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাসের আঙ্গিনা ছেড়ে বেরিয়ে এসে সাইদ কিছুটা ভিন্ন পথে যাত্রা করার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তথাকথিত অনুন্নত বিশ্বের মানুষের মনোজাগতিক ক্ষেত্রে সাইদের আবেদন হয়ে ওঠে এক অন্যরকম প্রতিবিম্ব হিসেবে। তিনি একই সাথে পশ্চিমা শিল্প-সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদের কথা তুলে ধরে তা থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন।
প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের ইতিহাস উপনিবেশ সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করে রচিত হওয়াও সেই ইতিহাস সাইদের রোষানল থেকে মুক্তি পায়নি। সাইদের দর্শন বোঝার
পর সহজেই মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় সেই মিশনারী প্রকল্পের উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক সংগঠনের ধারণা কিংবা গ্যালিভার ট্রাভেলস এর মতো বিদঘুঁটে কল্পকাহিনীর মূল শেকড়টা কোথায়। তত্ত্বকাঠামো জটিল বিন্যাসের সাথে কোথায় প্রাচ্যতত্ত্বের মূলসুর নিহিত আছে তা বোঝার চেষ্টা করেছেন সাইদ। এই ধরণের বিশ্লেষণ উত্তর-আধুনিক চিন্তাকাঠামোতে সাইদকে বিশেষ একটি স্থান করে দিতে সক্ষম হয়েছে। উপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তির পর জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে তাদের আজন্ম আধিপত্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে নতুন করে আগামীর চিন্তা করার সুযোগ ঘটে সাইদের চিন্তাধারার আলোকে।
প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা উপনিবেশের প্রয়োজনে জাতিতত্ত্ব ও জাতি-ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যে বিশেষ ধারার প্রবর্তন করেছেন তা থেকে বেরিয়ে জাতীয়তা ও আত্মপরিচয় অন্বেষণের যাত্রা মূলত সাইদের দর্শন থেকেই শুরু হয়েছিল। ওরিয়েন্টালিজম সাইদকে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় ৩০ টির মতো ভাষায় এর অনুবাদ করা হয়। বিশেষ করে উপনিবেশিত অঞ্চলের নিষ্পেষিত মানুষের কাছে ওরিয়েন্টালিজম ছিল অনেকটাই মুক্তির পথ প্রদর্শক। ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে সাইদ বর্ণনা করেছেন‘ ইতিহাস, প্রতœতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো সবই উপনিবেশের নির্মাণ।
পশ্চিম ইতিহাসকে তার প্রয়োজনে, তার মতো করে, তাদের প্রতিপালিত ইতিহাসবিদদের মাধ্যমে নির্মাণ করেছে। সাইদের দৃষ্টিতে এই ইতিহাস উপনিবেশিত অঞ্চলের নিষ্পেষিত মানুষের কণ্ঠরোধকল্পে নির্মিত একটি প্যারাডাইম। সাইদ একে আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও জাতিগত পরিসর থেকে একটি অঞ্চলের উপর পশ্চিমের কর্তৃত্বের বৈধতা দিয়ে থাকে। এই আধিপত্যবাদী নীতির পেছনে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার কঠোর সমালোচনা করেছেন সাইদ।
সাইদ বস্তুত ইতিহাসবিদ ছিলেন না। তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের কঠোর সমালোচনা করে তাদের একরৈখিক ইতিহাস নির্মাণের প্রবণতা সুস্পষ্ট করেছেন। এই বিশ্লেষণ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের ইতিহাস দর্শনে যুক্ত হওয়ার ফলে ঐ অঞ্চলসমূহের সুযোগ হয়েছে তাদের ইতিহাস বাস্তবতার নিরিখে পর্যবেক্ষণ করা। আর অতীত গবেষণার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে তথ্যসূত্র নির্ভর গবেষণা করে নিজ জাতিসত্তার পরিচয় নির্মাণের কাজ করা। সাইদ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন প্রাচ্য পশ্চিমের কাছে অজানা। এই পরিসর থেকে পশ্চিম প্রাচ্য সম্পর্কে একটি রোমান্টিকতায় ভুগে কিছু অলীক কল্পনার জাল বিস্তার করতে পারে। প্রাচ্যের বাস্তবতা তাদের কাছে অজ্ঞাত হওয়াতে প্রাচ্য নিয়ে গবেষণা করে এ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ কোনো ধারণা প্রতিষ্ঠা করা পশ্চিমের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রাচ্য নিয়ে পশ্চিমের অধ্যয়ন ও গবেষণা কেবলমাত্র কিছু পূর্ব নির্ধারিত চিন্তাধারার সারবত্তায়ন ও আরোপকরণ মাত্র।
পশ্চিম তাদের গবেষণা বা আলোচনার শুরুতেই পশ্চিমকে মানদণ্ড বিবেচনা করে থাকে। আর প্রাচ্যকে তারা বোঝায় ভিন্ন স্থান হিসেবে যেখানে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব নয়, একমাত্র সম্পদ ও ঐশ্বর্য ছাড়া যেগুলো দখল করতে চায় পশ্চিম। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে পাশ্চাত্যের মানুষেরা ঔপনিবেশিক শাসনে বন্দি প্রাচ্যে এসে তাদের পূর্ব অনুমিত জ্ঞান প্রকল্পের সংশোধন না করে তা প্রাচ্যের উপর জোরপূর্বক আরোপ করার চেষ্টায় সদা সচেষ্ট থেকেছে। পশ্চিম প্রাচ্যতত্ত্বের নামে বিশেষ ডিসকোর্স বা আখ্যান তৈরি করেছে তার আলোকে ‘পশ্চিমের মানুষ প্রাচ্যের উপর আধিপত্য করবে আর প্রাচ্য আধিপত্যের শিকার হবে। এসব ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা প্রমাণিত। তাই পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করার সুযোগ প্রাচ্যের নেই।
এই দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত প্রাচ্যতাত্ত্বিক জ্ঞানপ্রকল্পে প্রাচ্যের মানুষকে নিজেদের শাসন করার ক্ষেত্রে অযোগ্য ও অক্ষম বলে প্রমাণ করা হয়েছে। তাই তাদেরকে তাদের অতীত জানতে গেলে পশ্চিমের মাধ্যমে পশ্চিমের মতো করে জানতে হবে। তাদের নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে হলে আশ্রয় নিতে হবে কোনো এক পশ্চিমা
আয়নায়’। এই ধরনের চিন্তাধারা ঔপনিবেশিক দেশসমূহে পশ্চিমের প্রভাবমুক্ত ইতিহাস চর্চার দ্বার অনেকটাই রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
এই রুদ্ধদ্বার খুলে মুক্ত স্বাধীন চিন্তাকে অনুসঙ্গ করে সামনে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল সাইদের ওরিয়েন্টালিজম। সাইদ প্রাচ্যের মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনের স্বরূপ। প্রাচ্যও অনুধাবন করতে শিখলো নিজেদের অতীত জানতে হবে, নিজেদের মতো করে জানতে হবে, নির্মাণ করতে হবে নিজেদের আত্মপরিচয়। এর ফলে ইতিহাসতত্ত্বেও একটি গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সাইদের তথ্যনির্ভর বক্তব্য আর প্রাঞ্জল
উপস্থাপনা, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এর পাশাপাশি সংস্কৃতি আর ক্ষমতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার রীতি সহজেই আকৃষ্ট করে প্রাচ্যের অতীত গবেষকদের। তাঁরা নিজেদের ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে তথ্যনির্ভর উপায়ে রচনা করার তাগিদ অনুভব করেছিল। জাতিসত্তার পরিচয় নির্মাণে ইতিহাস ও প্রাচীনত্বের গবেষণায় একটি জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিমা আধিপত্যবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক অনুশীলনের বাইরে একটি জ্ঞানের জগৎ থাকতে পারে এই ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট করেছেন সাইদ।
প্রতিবাদী লেখার ভাষায় সাইদের অনুসৃত নীতি উত্তর-ঔপনিবেশিক কাউন্টার- ডিসকোর্সকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। কালের আবর্তে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে এই কাউন্টার-ডিসকোর্স একটি জনপ্রিয় চিন্তামাধ্যমে পরিণত হয়। পাশ্চাত্যে প্রচলিত জ্ঞানের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েও নিয়েও তিনি হয়েছিলেন একজন জনপ্রিয় চিন্তাবিদ। পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে কলম ধরায় বহুবার খুনের হুমকি পেতে হয় তাঁকে, কিন্তু স্তব্ধ হয়নি এই মহান বিপ্লবীর কণ্ঠস্বর। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে সাইদ ছিলেন অনেক বেশি বাস্তববাদী। পিএলও-র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকলেও তিনি পিএলও-র সকল কার্যক্রম অবলীলায় সমর্থন করতে পারেননি। ফলে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে এডওয়ার্ড সাইদের চিন্তাধারা বেশ গুরুত্বের সাথে স্থান করে নেয়। অন্যদিকে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব পোষণকারী সাইদ সাম্রাজ্যিক ও অগণতান্ত্রিক আরব শাসকদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পাননি। সাইদের চিন্তাধারায় প্রতিফলিত কাউন্টার ডিসকোর্সকে নিচের কয়েকটি ধারার মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে।
১. প্রতিবাদী লেখনী ও বাস্তবজীবনে তার অনুশীলন
২.পশ্চিমা ক্ষমতাচক্র আর জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
৩.পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচার-প্রপাগণ্ডার বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন
৪. ঔপরিবেশিকতা ও পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ মানুষকে মুক্তির চেতনায় উদ্দীপ্ত করা
৫. লেখনীর মাধ্যমে পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন, ক্ষমতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার অন্তর্নিহিত সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করা।
৬. জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন চিন্তাকাঠামোর সংযুক্তি।
৭. ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র এবং কসমোপলিটন-এর পক্ষে আমৃত্যু কাজ করে যাওয়া।
৮. জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নির্যাতিত মানুষকে মুক্তির আহবানে জাগিয়ে তোলা।
পশ্চিমাদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রাচ্য কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু ১৯৮০ সালে প্রকাশিত সাইদের ‘দা কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন’ মধ্যপ্রাচ্যের তীব্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের প্রতি আলোকপাত করে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমির দাবিকে ন্যায্য বলে প্রমাণ করেন। ‘আফটার দা লাস্ট স্কাই’-এর মধ্যে তিনি এই চিন্তাধারাকে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখেছেন কিভাবে একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে জন্ম নিয়ে আজন্ম পাপের দায়ভার বহন করতে হয়। পশ্চিমের উপস্থাপনায় একজন ফিলিস্তিনির রূপ কখনও সর্বহারা শরণার্থী, কখনও খুনী-সন্ত্রাসী কিংবা একজন অপহরণকারী।
সাইদ দেখিয়েছেন মাতৃভূমির ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে ফিলিস্তিনিরা কিভাবে পশ্চিমা মিডিয়া আর উপস্থাপনার রাজনীতির শিকার হয়ে একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক ইমেজে বন্দি হয়ে আছে। যার ধারাবাহিকতা লক্ষ করা গেছে ‘দা পলিটিক্স অব ডিসপজিশন’ এবং ‘কাভারিং ইসলামে’ও।
তবে সাইদ ঐপনিবেশিক অঞ্চলগুলোতে বিদ্যমান জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসনকে অনেক সুচারুরূপে তুলে ধরেছেন ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচ্যুয়াল’ বইটিতে। এখানে বুদ্ধিভিত্তিক সন্ত্রাস কিভাবে পুরো বিশ্বকে ত্রাস সৃষ্টির সাথে গ্রাস করে নিচ্ছে তা প্রতিফলিত হয়েছে। বিপ্লবী এই লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ফ্রম অসলো টু ইরাক অ্যান্ড দি রোড ম্যাপ বইটিতেও পশ্চিমা আগ্রাসনের চুলচেরা বিশ্লেষণ লক্ষ করা গেছে। এই বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ সাপেক্ষে সাইদ উত্তর-ঔপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্সকে বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব-সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়ের সাথে আলোকময়তার দর্শন তথা ঔপনিবেশিকতার সম্পর্ক অনেক গভীর।
এই দিক থেকে বিচার করা হলে ইতিহাসতত্ত্বে সাইদের উত্তর-ঔপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্স আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে। বিশেষ করে প্রচার মাধ্যম প্রচারের আলোয় আনতে সক্ষম হলে মিথ্যা কিভাবে সত্যে পরিণত হয়,আর সত্য কিভাবে অন্ধকারে হারিয়ে যায় তা প্রথম স্পষ্ট হয়েছে সাইদের বিশ্লেষণে। এই বিষয়গুলো ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আলোচিত হওয়া জরুরী।
©somewhere in net ltd.