নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলােদশী

নজরূল আলম

আ িম বাংলােদশী

নজরূল আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবন রক্ষার ইনজেকশনে জীবননাশ হাত বাড়ালেই পেথিডিন-মরফিন

২৬ শে জুন, ২০১১ রাত ৮:৩৬





রাজধানীর ৫৬/৫৭ নম্বর মিটফোর্ডের ডেল্টা মেডিক্যাল করপোরেশনের পেথিডিন বিক্রির লাইসেন্স রয়েছে। ওষুধের দোকানটিতে পেথিডিনের দাম জিজ্ঞেস করলে একজন বিক্রয়কর্মী বলেন, 'এক অ্যাম্পুল হলে ৩০০ টাকা। বেশি নিলে দাম একটু কম নেওয়া যাবে।' মগবাজারের আনিকা ফার্মেসিতে গেলে দাম চাওয়া হয় ৪০০ টাকা। ২০ টাকার ইনজেকশনের দাম এত বেশি কেন প্রশ্ন করলে দুটি দোকানের বিক্রয়কর্মীদের একই উত্তর_ঘাটে ঘাটে 'নজরানা' দিয়ে পেথিডিন-মরফিনের কোটা তুলতে হয়। তা ছাড়া মাদক কর্মকর্তাদেরও মাসোহারা দিয়ে খুশি রাখতে হয়।

জানা যায়, মিটফোর্ড ছাড়াও শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মগবাজার মোড়ে গেলে যে কেউ ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই 'ক' শ্রেণীর মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ইনজেকশন পেথিডিন ও মরফিন কিনতে পারবে। তবে ২০ টাকা মূল্যের ইনজেকশনের দাম দিতে হবে কমপক্ষে ৩০০ টাকা, যা সংকটের সময় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। পেথিডিন একদিকে যেমন বেদনানাশক ওষুধ, তেমনি প্রচণ্ড নেশা সৃষ্টিকারী। দীর্ঘদিন পেথিডিন ইনজেকশন ব্যবহারের ফলে নেশাসক্ত ব্যক্তির পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং পরিণামে মৃত্যু ঘটে। এ জন্য এর অপব্যবহার রোধ করতে মাদক আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এসব তথ্য জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আবু তালেব।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ অনুসারে সরকারি নিবন্ধন ছাড়া পেথিডিন ও মরফিন উৎপাদন এবং বিক্রি করা যায় না, তেমনি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেউ তা ব্যবহারও করতে পারে না। তবে একাধিক দিন মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধের দোকানে পরিচয় গোপন রেখে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, সেখানে পেথিডিন কেনার জন্য কোনো ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র লাগে না। তা ছাড়া নির্দিষ্ট মূল্যে যেকোনো পরিমাণ পেথিডিন পাইকারি মূল্যে কেনা যায়। কোতোয়ালি থানাধীন প্যারামাউন্ট ড্রাগ হাউসের মালিক সুশীল ঘোষ জানান, অন্যান্য ওষুধের মতো পেথিডিনও পাইকারি বিক্রি করা হয়। তবে এর জন্য কোতোয়ালি সার্কেলের একজন মাদক পরিদর্শকসহ আরো অনেককে মাসোয়ারা দিতে হয়। তাঁর মতো আরো ৫০ জন পেথিডিন বিক্রির লাইসেন্সধারীকে একইভাবে লাখ লাখ টাকা মাসোয়ারা দিতে হয় বলেও তিনি দাবি করেন।

বিভিন্ন সূত্র মতে, খোদ ঢাকা নগরীতে পেথিডিন ও মরফিনের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার চলছে। ২০০ খুচরা লাইসেন্সধারী বিক্রেতা বছরে তিন লাখ পেথিডিন ও মরফিন কোটা পেলেও এর অধিকাংশ মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধের বাজারে বিক্রি করে দেন, যা খুচরা ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে নেশাসক্তদের হাতে চলে যায়।

জানা যায়, নজরদারির অভাবে পেথিডিন সারা দেশে এখন একটি সহজলভ্য ওষুধ হিসেবে বেচাকেনা হচ্ছে। ঢাকা নগরীতে ২০০সহ সারা দেশে প্রায় ৫০০ ডেঞ্জারার্স ড্রাগস (ডিডি) লাইসেন্সধারী রয়েছেন। ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি ডিডি লাইসেন্সধারী রয়েছেন পাবনায় ৪০, যশোরে ৩৫, বরিশালে ৩৫, খুলনায় ৩২, চট্টগ্রামে ৩০, বগুড়ায় ২২, সিলেটে ২০ এবং রাজশাহীতে ২০ জন। হাত বাড়ালেই যে কেউ অনায়াসে তাঁদের কাছ থেকে পেথিডিন ও মরফিন পেতে পারে। দেশের বড় বৃহৎ ওষুধের মার্কেট মিটফোর্ডে পাইকারি দরে পাওয়া যায় পেথিডিন ও মরফিন।

মাদক কর্মকর্তা (উপপরিচালক) মজিবুর রহমান পাটোয়ারী জানান, ডেঞ্জারার্স ড্রাগস লাইসেন্সধারীকে পেথিডিন ও মরফিন ক্রয়কারী ব্যক্তির ব্যবস্থাপত্র সংরক্ষণ করে তা নির্ধারিত রেজিস্টারে বিবরণী আকারে লিখে রাখতে হয়। ফলে কোনো সময় মাদক পরিদর্শকরা যাচাই করে দেখতে পারেন এর কোনো অপব্যবহার হয়েছে কি না।

সূত্র মতে, দেশের সর্বোচ্চ ওষুধের পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার মিটফোর্ডকেন্দ্রিক একটি চক্র পেথিডিন-মরফিনকে সহজলভ্য ওষুধ হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মাদক কর্মকর্তারা লাখ লাখ টাকা মাসোয়ারার লোভে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন বলে খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকেই অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোতোয়ালি মাদক সার্কেল পরিদর্শক নুসরাত ইয়াসমিন অবশ্য অভিযোগটি স্বীকার করেননি। অনিয়ন্ত্রিত পেথিডিন-মরফিন বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না_এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দেননি তিনি। নুসরাত কালের কণ্ঠকে জানান, এক অ্যাম্পুল পেথিডিন ও মরফিনের দাম যথাক্রমে ১৭ টাকা ৪২ পয়সা ও ১৭ টাকা ৮৯ পয়সা। তবে তা লাইসেন্সধারীরা বিক্রি করে থাকেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মূলত প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক হাসপাতালের আশপাশে পেথিডিন ও মরফিনের খুচরা লাইসেন্স ইস্যু করা হয়, যাতে রোগীর অস্ত্রোপচারের সময় লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে সহজে পেথিডিন ও মরফিন পাওয়া যায়। কিন্তু এ নিয়মকে পুঁজি করে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে একটি চক্র।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালকে ঘিরে ৫০টির মতো পেথিডিন-মরফিনের খুচরা লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক লাইসেন্সধারী বছরে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার অ্যাম্পুল ইনজেকশনের কোটা পান। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ ওষুধের মতোই তাঁরা পেথিডিন ও মরফিন বিক্রি করছেন। অথচ এ ইনজেকশন বিক্রি করতে হলে ক্রেতার কাছে একজন এমবিবিএস পাস মেডিসিন ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপপরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, মিটফোর্ডের ডেঞ্জারার্স ড্রাগসের পাইকারি বাজারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মিটফোর্ড এলাকায় ৫০ জনকে ৫০টি ডেঞ্জারার্স ড্রাগ লাইসেন্স দেওয়া হলেও তাঁরা সারা দেশের আরো ১৫০ জন লাইসেন্সধারীর 'মনোনীত ব্যক্তি' হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাঁরা অথরাইজড লেটার দিয়ে লাইসেন্সধারীদের পক্ষে পেথিডিন ও মরফিন তুলে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে আসছেন বছরের পর বছর। এ ব্যাপারে একজন মাদক পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সারা দেশে প্রায় ৫০০ ডিডি লাইসেন্সধারীর মধ্যে অর্ধসংখ্যক লাইসেন্সধারীই তাঁদের উত্তোলন করা পেথিডিন ও মরফিন অবৈধভাবে মিটফোর্ডের পাইকারি বাজারে বিক্রি করে দেন। কারণ অধিকাংশ স্থানে ডিডি লাইসেন্স দেওয়া হলেও সেখানে পেথিডিন ও মরফিনের কোনো ব্যবহার নেই। পাঁচ হাজার অ্যাম্পুল লাইসেন্সধারী বছরে কালোবাজারে তা বিক্রি করে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা এবং তিন হাজার কোটার লাইসেন্সধারী ছয় লাখ টাকা লাভবান হয়ে থাকেন।

কালের কণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা যায়, মুমূর্ষু রোগীদের অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত ইনজেকশন পেথিডিন ও মরফিস যাতে নেশার কাজে ব্যবহৃত না হতে পারে, এর জন্য এটির নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে। প্রতিটি ডিডি লাইসেন্সধারীর রেজিস্টার তদারকি এবং ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে পেথিডিন ও মরফিন বিক্রি করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করার দায়িত্ব তাদের। নিয়ম হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট মাদক পরিদর্শকরা লাইসেন্সধারীর রেজিস্টার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন যথাযথ ব্যক্তির কাছে তা বিক্রি করা হয়েছে কি না। একই সঙ্গে এর অপব্যবহার রোধ করার জন্য মাদক আইনে কঠোর আইন এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। তবে নজরদারি এবং শাস্তির দুটিরই তেমন নজির নেই।

তা ছাড়া নগরীর কিছু মাদক মাফিয়াকে পেথিডিনের লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে, যারা পেথিডিন ও মরফিন বিক্রির লাইসেন্সের আড়ালে মূলত ভারতে তৈরি লাখ লাখ অ্যাম্পুল নেশাজাতীয় ইনজেকশন বিক্রি করে থাকে। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারতে তৈরি দুটি কম দামি নেশার ইনজেকশন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এসব ইনজেকশন সরকারি লাইসেন্সের আড়ালে বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মগবাজার মোড়ে অবস্থিত পেথিডিন ও মরফিনের লাইসেন্সধারী আলী রেজাকে পুলিশ ও মাদক কর্মকর্তারা ভারতীয় নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ একাধিকবার গ্রেপ্তার করেছেন। এর সত্যতা রমনা মাদক সার্কেল সূত্র নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে এসব মামলার কারণে তাঁর লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে বলেও মাদক সার্কেল সূত্রে জানা গেছে। তা ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে অবস্থিত ওষুধের দোকান থেকেও একাধিকবার অবৈধ পেথিডিন ও মরফিন উদ্ধার এবং আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মাদক কর্মকর্তারা জানান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নামে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজার পেথিডিন ও মরফিন কোটা থাকলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে তা তুলছে না। হাসপাতাল দুটি সরকারিভাবে এসেনশিয়াল ড্রাগ থেকে উৎপাদিত পেথিডিন ও মরফিন পেয়ে থাকে। কিন্তু সেসব ইনজেকশনের অধিকাংশই চোরাই পথে মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে পাচার হওয়া পেথিডিনের হাট বসতে প্রকাশ্যে দেখা যায়। এ ব্যাপারে মাদক কর্মকর্তারা জানান, পাচার হওয়া পেথিডিন ও মরফিন মেডিক্যালের পাশে অবস্থিত ওষুধের দোকানে বিক্রি হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকারি অনুমতি নিয়ে দেশেই এ ধরনের চেতনানাশক ওষুধ তৈরি করা হয়। দেশে গণস্বাস্থ্য ফার্মার তৈরি পেথিডিন ও মরফিনের একক বাজার ধরে রেখেছে। তারা বছরে প্রায় ১০০ কেজি পরিমাণ পেথিডিন ও মরফিন উৎপাদন করছে। কয়েক বছর ধরে এ ডেঞ্জারার্স ড্রাগস উৎপাদন করছে পপুলার ফার্মা নামের একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা ১০ কেজি পরিমাণ পেথিডিন ও মরফিন উৎপাদন করছে বলে জানা গেছে। তা ছাড়া এমবি ও রেনেটা নামের দুটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অচিরেই ডেঞ্জারার্স ড্রাগস উৎপাদন করবে বলে মাদকের ঢাকা মেট্রো অঞ্চল সূত্রে জানা গেছে। মাদক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এভাবে বিভিন্ন ওষুধ কম্পানি পেথিডিন ও মরফিন উৎপাদনে গেলে এর অপব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে। নেশার জগতে পেথিডিন ও মরফিন আরো সহজলভ্য হয়ে উঠবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.