| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাহদী মুরাদ
আমি নামানুষ।।। প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসি।
বেশ তড়িঘড়ি করেই ব্যাগ গোছাচ্ছে বাপী তরফদার। গত দুদিনে জলপাইগুড়ির আকাশে সূর্যের দেখা মেলেনি একটুও। তবে টানা বর্ষণের পর আজ সকালেই রোদ উঠেছে। বায়ুমণ্ডলের সব ধুলাবালি যেন ধুয়েমুছে গেছে এ দুদিনের বৃষ্টিতে। সকালের কাঁচারোদে জলপাইগুড়িকে তাই সদ্য গোসল সেরে আসা এক রাজকুমারীর মতোই উজ্জ্বল লাগছে। বাপী তাড়াহুড়ো করছে এই ভেবে যে বৃষ্টি এসে আবার না আটকে দেয় ওকে।
ভোরের আলো ফোটবার আগেই রোজ বিছানা ছাড়ে বাপী। হাড় কাঁপানো শীতেও কখনো এই নিয়মের অন্যথা হয়না। বাইরে হাটাহাটি, ব্যায়াম, আর নিজহাতে নাস্তা তৈরি করে খাওয়ার মধ্য দিয়েই দিন শুরু হয় বাপীর। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং আজকে একটু তাড়াতাড়িই বিছানা ছেড়েছে সে। এর একমাত্র কারণ, বহুদিন বাদে আজ সে জলপাইগুড়ি ছেড়ে নিজদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। বারোবছর পরে আবার বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবে ভাবতেই বাপীর মনে এক অজানা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।
ব্যাগ গোছানোর ফাঁকে বাপী ফোন চেক করছে বারবার। নাহ! ঊর্মিলার কোনো কল বা মেসেজ এখনও আসেনি। "মেয়েটা কি তবে বিদায়বেলাতেও দেখা দিবেনা আমায়?" -আপন মনেই বলে উঠে সে। গোছগাছ শেষ করে বাপী ভিসা-পাসপোর্ট সহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো চোখের সামনে এনে রাখে, যাতে যাত্রার সময় কোনো কাগজ বাদ না পড়ে। পাসপোর্ট এর কভার পেজে থাকা সিংহগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে; অন্তত বাপীর কাছে এখন তাইই মনে হচ্ছে। আর তখনি তার চোখে ভেসে উঠে একটা সবুজ পাসপোর্ট এর ছবি। বাংলাদেশী পাসপোর্ট। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! যেখানে আজ তার কাছে সবুজ পাসপোর্ট থাকার কথা, সেখানে থাকছে অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভ সম্বলিত ভারতীয় পাসপোর্ট। এই দুঃখ বাপীর সারাজীবনের।
ঘর ছেড়ে পুবের বারান্দায় এসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বাপী। পাশের বেড়ার উপর নেতানো বাগানবিলাস গাছটা সকালের রোদে গাঝাড়া দিয়ে উঠছে। অজান্তেই কতকগুলো দুর্ভাবনা এসে ভীর করছে ওর মাথায়। মনের উপর কোনো জোড় খাটছেনা দেখে বাপীও হাল ছেড়ে দিয়েছে আজ। সবসময় সে চেষ্টা করে এসেছে পূর্বের স্মৃতিগুলো যেন চোখের সামনে না আসে। কিন্তু স্মৃতিরও যেন আজ বাঁধ ভেঙ্গেছে, তেড়েফুঁড়ে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে।
একটা গাছ যখন বড় হয়, তখন অবশ্যই তার অবলম্বন এর দরকার পড়ে। এই বাগানবিলাস গাছটাই যেমন বেড়া আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছের মতো প্রতিটা মানুষেরই প্রয়োজন পড়ে একটা অবলম্বনের, যে অবলম্বন তাকে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। বাপী বাচ্চাকালে তেমনি একটা অবলম্বন হিসেবে তার ফুফুকে পেয়েছিল; কারণ ওর মা ওকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেছেন এই পৃথিবী থেকে। বিধবা ফুফু ভাইয়ের বাসাতে থাকতো বলে বাপীর দায়িত্ব নিতে কোনো সমস্যাই হয়নি তার। বাপীরা দুইভাই, বাঁধন ওর তিনবছরের বড়। ওদের দুজনের দেখাশোনা, রান্নাবান্না করা, সংসার সামলানোই ছিল ফুফুর কাজ।
বাবা মানে যে বটগাছ, তার প্রমাণ কখনো পায়নি বাপী। ওকে কখনো কোলেই নেননি ওর বাবা। সবসময় বাবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে হতো বাপীকে। কারণ, তিনি ওকে এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারতেন না। কাছে গেলেও দুরদুর করে তাড়িয়ে দিতেন, কিন্তু বাপী বুঝতো না তার কি দোষ। ওর মায়ের খুনি হিসেবে বাপীকেই দোষ দিতেন ওর বাবা। তাই বাপীর মুখ দেখতে চাইতেন না তিনি। তিনি ভাবতেন, "দুনিয়ায় আসার সময়েই ওর মাকে মেরেছে। না জানি, আরো কতো ক্ষতি করবে আমার! ওর মুখ দেখাও পাপ।" অন্যদিকে, বাঁধনকে তিনি অনেক আদর করতেন এবং ওকেও বাপীর কাছে ঘেষতে দিতেন না। বাবার কাছে যেতে না পেরে ততটা দুঃখ হতোনা বাপীর, যতটা দুঃখ ভাইয়ের সাথে খেলতে না পেরে হতো।
বাপী যখন ক্লাস সেভেনে, তখন ওর ফুফুও পৃথিবীর মায়া ছাড়ে। তারপরেই বাপী বুঝতে পারে, অবহেলা-নিপীড়ন কতটা ভয়াবহ আকারে ধেয়ে আসছে তার দিকে। বাবার মুখোমুখি কখনওই হতোনা সে, কথাবলা তো আরো দুরের ব্যাপার। খাওয়াদাওয়া সবার শেষে যেটুকু অবশিষ্ট থাকতো, তাইই জুটতো। শতকষ্টেও বাপী টিকে থাকার লড়াই করে গেছে। বাঁধনের পুরাতন বইখাতা দিয়েই গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেন পর্যন্ত উঠেছিল বাপী, কিন্তু ফর্ম পূরণের টাকা দেয়নি ওর বাবা। বলেছে, "খুনির আবার কিসের পড়ালেখা? দূর হয়ে যা তুই আমার সামনে থেকে।" সেদিনই বাপী ঠিক করেছে, সে আর ওই তল্লাটে থাকবেনা। যেখানে বেঁচে থাকাই ওর আজন্ম পাপ, সেখানে আর একমুহূর্তও থাকবেনা বাপী। দিনেরবেলা যখন বাড়িতে কেউ থাকেনা তখনি বাড়ি ছাড়ে বাপী, আর সেটা আরেকটু সহজ করে দিয়েছিল ওর ফুফু। ফুফুর পুঁটলিতে বেশকিছু টাকা জমানো ছিল, যেটা বাপী বা বাঁধন কেউই জানতো না। যাওয়ার আগের রাতে জিনিশপত্র গোছানোর সময়েই বাপী ওটার খোজ পেয়েছে। তাতেই সহজ হয়ে গিয়েছে ওর পালানো। সীমান্তে বেড়ে ওঠার কারণে বাপীর মাথায় প্রথমেই ভারতে পালানোর চিন্তা আসে, আর সেটাকেই সে বেছে নেয় নির্দ্বিধায়।
আজ থেকে বারোবছর আগে কনকনে এক শীতের রাতে ভারতের দূর্গাবাড়ী সীমান্তে প্রবেশ করে বাপী নামের এক বাঙালি কিশোর। না, সে বৈধ পন্থানুসরণ করে ভারতে যায়নি। সে গিয়েছে এক দালালের মাধ্যমে, যার কাজ এদেশ থেকে ওদেশে মানুষ পাঠানো। দূর্গাবাড়ী সীমান্ত থেকে ধীরেধীরে ভারতের মূল ভূখণ্ডে জায়গা করে নেয়ার যুদ্ধটা বাপীর পরদিনই শুরু হয়। একে তো অপরিচিত জায়গা, তার উপর এমনভাবে চলতে হবে যাতে কেউ বাংলাদেশী ভেবে সন্দেহ না করে। তবে বাপী বাংলাদেশী দালালকে অনেক অনুরোধ করে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেবার মতো লোকের খোজ নিয়েছে। সেই লোক থাকে জলপাইগুড়িতে। দূর্গাবাড়ী থেকে পানিসালা, বালাসান, ময়নাগুড়ি হয়ে জলপাইগুড়ি। সেখানে গিয়েই থিতু হয় বাপী। খেয়ে না খেয়ে দালালের পিছে লাগাতার ধরনা দেয়ার পরেই ভারতের নাগরিকত্ব পায় সে। জীবন কতটা কষ্টের হতে পারে, তা ওই দেড়বছরেই বুঝে গেছে বাপী। প্রতিটা দিন শুধু একটা কথাই মনে হতো ওর, "বেঁচে থাকাই যেন আমার আজন্ম পাপ।"
সৃষ্টিকর্তা অবশেষে বাপীর দিকে মুখ তুলে চায়। জলপাইগুড়ির এক অখ্যাত স্কুলে সে আবারো ভর্তি হয় ক্লাস টেনে। প্রথমদিকে বাপী একটা চায়ের দোকানে কাজ করে পেট চালাতো। ছাত্র হিসেবে তুখোড় হওয়াতে অল্পদিনেই ইংরেজি শিক্ষক সুজিতবাবুর নেকনজরে আসে বাপী। সুজিতবাবু খোঁজখবর নিয়ে যখন জানতে পারলেন বাপীর কেউ নেই, চায়ের দোকানে কাজ করে, তখন তিনি নিজের বাড়িতেই ওকে নিয়ে গেলেন। সেখানেই থাকাখাওয়া চলবে, বিনিময়ে মাস্টারমশাই এর ছোট বাচ্চা দুটোকে একটু শিখিয়ে দিতে হবে রোজ। বাপীও সুযোগটা লুফে নেয়। ছেলে দুটো অনেক ভালোভদ্র, বড়জন ক্লাস সেভেন, ছোটজন ক্লাস ফাইভে। দিন ফিরে আসে বাপীর। পরের বছর দুটি ছাত্রই ফার্স্ট হয় নিজেদের ক্লাসে। বাপীও এসএসসি পাশ করে ফার্স্টক্লাস নিয়ে।
জলপাইগুড়ির এক কলেজ থেকে বাপী এইচএসসিও শেষ করে ফার্স্টক্লাস নিয়ে। কিন্তু টাকার অভাবে অনার্স না করে বিএসসি করে সে। মাস্টারমশাই এর বাড়িতে দুইবছর থাকার পরে বাপী নিজেই সেখান থেকে চলে আসে তাদের অভাব দেখে। তবে বাচ্চা দুটোকে পড়ানো বন্ধ করেনি ও। কারণ, মাস্টারমশাই এর কারণেই তো সে এতদূর পর্যন্ত যেতে পারছে। টিউশনি করিয়েই বাপী বিএসসি শেষ করেছে, তারপর এক প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকরি পেয়েছে যার পোস্টিং জলপাইগুড়িতেই। বর্তমানে বেশ ভালো একটা অবস্থানেই আছে বাপী।
বিএসসিতে থাকাবস্থায় বাপীর সাথে পরিচয় হয় ঊর্মিলা নামের মেয়েটার। বাপীর এক ছাত্রের বড়বোন ঊর্মিলা। বাপীর দুবছরের জুনিয়র। প্রথমদিকে বাপী ঊর্মিলার দিকে খেয়াল না করলেও ধীরেধীরে দুজনের কথাবার্তা শুরু হয় এবং একটা সময়ে ভালো সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায় একই কলেজে পড়ালেখার সুবাদে। বাপী নিজেকে এতটাই একা করে ফেলেছিল যে ওর কোনো বন্ধু নেই এই সমগ্র তল্লাটে। কিন্তু ঊর্মিলা এটা ভেঙ্গেছে। মেয়েটার মধ্যে কি এক জাদু আছে যেটা বাপী কাটাতে পারেনি। মেয়েটার সেই জাদুতে আটকা পড়েছে সে। কিন্তু ফুফুকে হারানোর পরে কাউকে আপন করে পাবার আশা বাপী অনেক আগেই মন থেকে মুছে ফেলেছে। তাই প্রেম- ভালোবাসার জগতে এখনো প্রবেশ করা হয়নি তার। তবে ঊর্মিলার সাথে পরিচয় হবার পরে ধীরেধীরে বাপীর মনের মধ্যে এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়ে যায়। একপক্ষ বলে আপন করে নিতে, আরেকপক্ষ আবার বাধা দেয় তাতে। তাই বাপী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, "অনেকদিন তো জলপাইগুড়িতে থাকা হলো, এবারে একটু নাড়ীছেড়া স্থানটা ঘুরে আসা যাক। তাতে যদি মনের ভেতরের এ যুদ্ধ কোনো মিমাংসাতে আসতে পারে।" আর সেই সিদ্ধান্ত থেকেই বাপী আজ বাংলাদেশের পথে।
যাত্রাপথে বাপীর মনে প্রশ্ন জাগে, "আচ্ছা, বাবা নামের মানুষটা এখন কেমন আছেন? কতদিন হয় দেখিনা তারে। উনি কি সেই আগের মতোই রাগী ব্যক্তিত্বের মানুষ রয়ে গেছেন, নাকি বয়সের ভারে ন্যুব্জে পড়েছেন এতদিনে? এখনো কি আমাকে দেখে তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়বেন, নাকি দুচোখ দিয়ে একবার হলেও তাকাবেন ভালোকরে? ভাইয়াটাই বা এখন কি করছে, কে জানে! এতদিনে হয়ত বিয়ে করে ঘর-সংসার করছেন। আমার কথা কি মনে আছে ওদের? সামনে গেলে কি ওরা আমাকে চিনতে পারবে? চিনলে চিনবে, না চিনলে নাই! আমি নিজে থেকে বলতে যাবোনা কাউকে। দূর থেকেই দেখে আসবো নাহয়।"
জলপাইগুড়ি থেকে তেত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা ভেঙ্গে বাপী যখন বুড়িমারী স্থলবন্দরে পৌঁছায়, তখন হঠাৎ তার চোখে পড়ে চেকপোস্ট এর পাশে বসে আছে ঊর্মিলা। বাপীকে দেখে দ্রুত ওর সামনে এসে বলে, "এতক্ষণ লাগে আপনার আসতে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। এখন তাড়াতাড়ি চলেন, আর এই যে নিন আমার ভিসা-পাসপোর্ট। চেকপোস্ট এ শো করান গিয়ে।" বাপী থতমত খেয়ে যায় এমন অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা ঘটতে দেখে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে ঊর্মিলাকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি এখানে আসছোই বা কখন? আর তোমার ভিসা-পাসপোর্টই বা শো করাতে হবে কেন? ঊর্মিলা মুখ ঘুরিয়ে নিচুস্বরে বলে উঠে, "আপনাকে ছাড়া আমি একমুহূর্ত থাকতে পারবোনা, তাই আমিও আপনার সাথে বাংলাদেশে যাবো। আপনাকে আগে বললে রাজি হবেননা ভেবে একাই সব করেছি আর সেই সুবাদে আপনাকে একটা সারপ্রাইজ ও দেয়া হয়ে গেলো আমার।"
বাপী বুঝতে পারছে ঊর্মিলাকে আর কখনওই মন থেকে সরানো যাবেনা। এই মনে সে তার খুটি গেড়ে ফেলেছে অলরেডি। তাই তার সরল স্বীকারোক্তি, "পাগলী একটা। এতকিছু না করে আমাকে আগে বললেই পারতে। আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে, এখন চলো বাংলাদেশ।"
বাপী বাংলাদেশে প্রবেশ করছে আর ভাবছে, "বারোবছর আগে রাতের আধারে এক আনাড়ি কিশোর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলো, আর আজ সেই ছেলেই পরদেশী হয়ে প্রবেশ করছে নিজ জন্মভূমিতে।"
২|
২৬ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৩৩
মাহদী মুরাদ বলেছেন: কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা নিরন্তর ভাই♥♥♥
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৩০
কাওসার চৌধুরী বলেছেন: চমৎকার লেখা। ব্লগে স্বাগতম। শুভ কামনা আপনার জন্য।