| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জানিনা হঠাৎ কেন জানি লেখালেখিটাকে বেছে নিলাম। রাত ১১.০৫। শীতের রাত তাই মাঝ রাতই বলা চলে। সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন। আস্তে আস্তে চারদিক অনেকটা নিরব। অনেক আগে থেকেই মনের মধ্যে ঘটনাটা সাজানো ছিল। লিখব, কিন্তু সময় হয়ে উঠছিল না। লেখতে বসে ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে সাজানো সব ভুলে যেতে লাগলাম। মনে পরতে লাগল, তাড়াতাড়ি শোয়া দরকার, অফিস যেতে সকাল সকাল উঠতে হবে, এমনিতেই গত রাতে ভাল ঘুম হয়নি বলে সারাটা দিন অস্বস্তিতে কেটেছে, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। লেখার লোভে নিজেকে সামলাতে না পেরে শুরু করে দিলাম। আমি, আমার কম্পিউটার মেশিন, কী-বোর্ড এবং ২৪ ওয়াটের এনার্জি সেভিং বাতিটা একযোগে। ইদানিং ভুলে যাওয়ার অভ্যেসটাও বেশ তৎপর, একেবারে মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। লিখতে লিখতে মনের ভেতর আরেকটা লেখা ওয়েটিং কলের মত এসে ঠুকে নাড়া দিচ্ছে। মনে মনে অবশ্য নাম ঠিক করে ফেলেছি “স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পরীক্ষার ফলাফল বিড়ম্বনা”। কে জানে, হয়ত লেখা শেষ হলে শিরোনামটাই পালটে দেব।
যাই হোক তখন সবে মাত্র নতুন দশম শ্রেণিতে উঠেছি। বলে রাখা ভাল স্কুলে আমাদের ব্যাচটি সেরা ব্যাচগুলোর একটি। প্রতিদিন ক্লাস শুরুর প্রারম্ভে এসেম্বলি হত। আজও তার ব্যতিক্রম নেই। ক্রীড়া শিক্ষক ফরিদ স্যার (ছদ্ম নাম) এবং হাবীব স্যার (ছদ্ম নাম) এসেম্বলি পরিচালনা করতেন। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত একেক ব্যাচের একেক দিন এসেম্বলি পরিচালনার দ্বায়িত্ব পরত। অন্তত সপ্তাহে একদিন। এসেম্বলিতে কোরআন তেলাওয়াত, শারিরিক ব্যায়াম, শপথ বাক্য পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকত। তখন জাতীয় সঙ্গীতের মাহাত্য বুঝতাম না বলে কত যে বিকৃত করে গেয়েছি তার ইয়াত্ত্বা নেই। প্রতিদিন এসেম্বলিতে ১ম থেকে ১০ম শ্রেনি পর্যন্ত যেখানে ১০ টা সারি হবার কথা সেখানে সারি হত ৯ টা। অর্থাৎ ১০ম শ্রেনির কোন সারি হত না। টিনএজ বলে মেয়েদের সামনা-সামনি দাড়াতে হবে বলে লজ্জায় সারির সামনে কেউ দাড়াতে চাইত না। তাই সারি হত না। ১০ম শ্রেণির ছাত্ররা সব অন্য শ্রেণির সারিতে। প্রতিদিন শ্রদ্ধেয় ফরিদ স্যার তার সোয়া ২ হাত বেত দিয়ে গরুর মত পিটিয়ে অন্য সারি থেকে এনে ১০ম শ্রেণির সারিতে দাড় করাতেন। তাছাড়া যেদিন ১০ম শ্রেণির এসেম্বলি পরিচালনার দায়িত্ব থাকত সেদিন কেউ পরিচালনা করতে যেত না। স্যাররাও পেটাতেন। সুষ্ঠুভাবে এসেম্বলি পরিচালনা ছিল বীরত্বের ব্যাপার।
এসেম্বলি শেষে আমরা সবাই সারিবদ্ধভাবে যার যার ক্লাসে প্রবেশ করতাম। সব স্যাররাও চলে যেতেন যার যার ক্লাসে। আর দুই ক্রীড়া শিক্ষক স্কুলের প্রধান ফটকে অবস্থান নিতেন। তাদের দায়িত্ব ছিল এসেম্বলির পর যারা দেরি করে স্কুলে আসছে তাদের পিটিয়ে ক্লাসে পাঠানো। সেদিন কাওছার (ছদ্ম নাম) এবং সাখাওয়াত (ছদ্ম নাম) দেরিতে আসল। যথারীতি স্যারদের বেত ওদের পিঠে। শুধু বেত দিয়ে পেটানোই নয়, ওদেরকে প্রচন্ড রোদে বিশাল স্কুল মাঠটা ৭ চক্কর দেয়ালেন। ওরা যখন ক্লাসে প্রবেশ করল ওদের যেন মুমূর্ষু অবস্থা। চেহারাগুলো এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট। সজোড়ে শ্বাস নিচ্ছে, খুব হাপাচ্ছে, কচি মুখদুটো ঘেমে একাকার, রোদে রক্তবর্ণ। আমরা সবাই প্রচন্ড রেগে গেলাম। এর একটা বিহিত করতেই হবে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল আমরা প্রধান শিক্ষকের কাছে নালিশ করব। আমাদের প্রধান শিক্ষক শাহাদাত স্যার (ছদ্ম নাম)। সবাই একসাথে প্রধান শিক্ষকের রুমের সামনে যেতেই ভয়ে পিছপা হলাম। কে যাবে ভেতরে ভয়ংকর চেহারার মানুষটার সামনে বিচার নিয়ে। কেউ যেতে সাহস করল না। অবশেষে আমি ও শাহীন (ছদ্ম নাম) সাহস নিয়ে প্রবেশ করলাম। সালাম করতেই স্যার আমাদের ওনার কাছে ডাকলেন। ওনার সামনেই চেয়ারে ক্রীড়া শিক্ষকরা বসা।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে তোদের? ভয়ে ভয়ে পুরো ঘটনা বললাম। ঘটনা শোনামাত্র তিনি তার সম্মুখে বসে থাকা শিক্ষকদের বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারা এইমাত্র সবার সম্মুখে ঘটে যাওয়া চরম সত্যটা অস্বীকার করলেন। স্যার রেগে গিয়ে বললেন, কই এবার হল তো।
আমি পরক্ষণেই সাহস করে স্যারের চোখে চোখ রেখে বলে ফেললাম, “স্যার প্রিন্স তো প্রতিদিন দেরি করে আসে, ওকে কেন মারা হয় না?”। সরকারী শায়ত্বশাসিত সংস্থার তত্ত্বাবধায়নে মফস্বলে স্কুলটা একটা মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। সরকারী সায়ত্বশাসিত সংস্থার এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ছেলে প্রিন্স। তাই ওকে মারা হয় না। স্যার রেগে গিয়ে আমাকে বললেন, “ওকে কখনই মারা হবে না, ওর বাবার নিষেধ”। আমি বলে ফেললাম, “একই স্কুলে সবার জন্য একই নিয়ম মানতে হবে” । স্যার বললেন, “তুই তোর বাবাকে আমাকে এসে বলতে বলিস, তোকে না মারতে তাহলে আমি তোকেও মারব না।”। আমি কাঁদতে শুরু করলাম। স্যার বললেন, “কিরে তুই কাদিস কেন?” আমি বললাম, “স্যার আমার বাবা সুস্থ মানুষ, উনি পাগল নন যে, আপনার কাছে এসে অনিয়ম চাইবেন”। স্যার বললেন, “তাহলে তো তুই বুঝেছিস”। সেদিন থেকে শিক্ষক সম্পর্কে যে একটা ভাল ধারণা বদ্ধমুল ছিল তা উঠে গেল। এবং মনের ভেতর শিক্ষক মানুষটির অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেল। জানিনা তাদের কখনও ক্ষমা করতে পারব কিনা। তবে প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনে নিজে কখনও শিক্ষক হলে তাদের মত না হয়ে মহানুভব, আদর্শ শিক্ষক হতে না পারলেও চেষ্টা করব। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন তাদের ক্ষমা করারা শক্তি আমায় দেন, কোন শিক্ষার্থীর জীবনে যেন এমন কোন শিক্ষক (ফরিদ স্যার, হাবীব স্যার, শাহাদাত স্যার) না আসে এবং জীবনের যে কোন সময়ে হলেও তাদের মধ্যে যেন ভুল ও অনুশোচনার বোধদয় হয়।
©somewhere in net ltd.