নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রহিমুদ্দিনের স্বপ্নভঙ্গ
নিয়ামুল বাসার
১.
"আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য দান করেন। দু-এক টাকা, যে যা পারেন। হে বান্দা মুমিন মুসলমান, আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য দান করেন... ইত্যাদি"। জয়দেবপুর চৌরাস্তার ব্যস্ত ফুটপাতের পাশে ছোট একটি মাইক নিয়ে রহিমুদ্দিন মসজিদ নির্মাণের কথা বলে টাকা ভিক্ষা করছেন।
ফোল্ডিং করা যায় এমন একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন রহিমুদ্দিন । তাঁর মাথায় ধবধবে সাদা পাগড়ী। চুল দেখা যাচ্ছে না। মুখ ভুর্তি সাদা-পাঁকা দাড়ি। চেহারা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। পরনে পরিস্কার সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। দেখে মনে হয় রহিমুদ্দিনের বয়স চল্লিশ-পয়তাল্লিশ হবে ।
রহিমুদ্দিন যেখানে বসে আছেন তার ঠিক সামনে একটুকরো লালসালু কাপড় চারকোনা চারটি চিকন কঞ্চিবাঁশের সাথে টানটান করে বাঁধা। লালশালু কাপড় চারকোনা শক্ত করে বাঁধার ফলে অনেকটা টেবিলের আকার ধারন করেছে। সেই কাপড়ের উপরে বেশ কিছু এক টাকা, দুই টাকা,পাঁচ টাকা, দশ টাকা, কিছু খুচরা কয়েন দেখা যাচ্ছে। খুচরা পয়সা ও টাকার মধ্যে দু একটি পঞ্চাশ-একশত টাকার নোটও উঁকিঝুঁকি মারছে।
লালশালু কাপড়ের নিচেই মাটির উপরে পুরনো আমলের ছোট একটি মাইক। চেয়ারের নিচে রাখা ব্যাটারীর সাথে মাইক ও মাইক্রোফোন সংযোগ দেওয়া। রহিমুদ্দিন সেই মাইক্রোফোন হাতে দরাজ গলায় অনবরত ঘোষণা দিয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য চলতি পথের মানুষের দেওয়া দান তুলছেন।
রহিমুদ্দিন মাইকে শুদ্ধ বাংলায় ঘোষনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু চেষ্টার পরও ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার টান কোনভাবেই এড়াতে পাড়ছেন না। দান করেনকে বলে ফেলছেন-দান করুইন। তবে রহিমুদ্দিনের গলা ভালো। ভাঙ্গা পুরনো মাইকেও শুনতে খারাপ লাগছে না। আরবী-বাংলা মিশিয়ে ভালোই ওয়াজ করছেন। সেই ওয়াজ শুনে চলতি পথের চলমান মানুষেরা মসজিদের জন্য দান করছেন। বিশেষ করে অল্প বয়েসী মেয়ে গার্মেন্টস কর্মীরা কেন যেন যাওয়ার পথে দৃই টাকা, পাঁচ টাকা কাপড়ের উপর ছুড়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দ্রæত পায়ে। সবারই সময়মতো গার্মেন্টসে পৌঁছানোর তাড়া আছে। রহিমুদ্দিন গার্মেন্টস কর্মীর দান করা টাকার দিকে তাকাচ্ছেন আর দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে দরাজ গলায় ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন। " আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য দান করুইন"।
কাপড়ের উপরের টাকা গুলো গুছিয়ে ঠিক করছে একটি বাচ্চা ছেলে। মাদ্রাসার ছেলেদের মতো জামা-কাপড় পরা। আকাশী রংয়ের পায়জামা, পাঞ্জাবী ও মাথায় সাদা টুপি। বয়স বছর নয়ের মতো হবে। এই বয়সের একজন ছেলের যেরকম হাসিখুশি ও চঞ্চল হওয়ার কথা বাচ্চাটি সেরকম নয়। কেমন যেন ধীর-স্থীর । চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য চলতি পথের মানুষের দান তুলতে রহিমুদ্দিনকে সহযোগিতা করছে।
রহিমুদ্দিন তাঁর ছেলেকেও ওয়াজ শিখিয়েছেন। বলা যায় প্রতি মুহুর্তেই শেখাচ্ছেন। তাঁর ছেলে মেধাবী। সবকিছু তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে। ইতোমধ্যেই আমপারার সবগুলো সূরা মুখস্ত তার। রহীমুদ্দিনের স্বপ্ন ছিল, তিনি কোরআনে-হাফেজ হবেন। পারিবারিক নানা ঝামেলার কারনে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন সেই স্বপ্ন যেভাবেই হোক এই ছোট ছেলেকে হাফেজ বানিয়ে পূরণ করতে হবে। তারপর নিজ গ্রামের বাড়ীতে একটি পাঁকা মসজিদ নির্মান করবেন। সেই মসজিদের ইমাম হবে তাঁর ছেলে।
সেজন্যই তিনি ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছেন এখানে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা হওয়ায় এখানে সারাদেশের মানুষের আনাগোনা। যখন গার্মেন্টস ছুটি হয় তখন পথে স্রোতের মতো মানুষের ঢল নামে। তাই রহিমুদ্দিন ও তাঁর ছেলে এখানে বস্তির একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে মসজিদের জন্য টাকা তুলছেন। ছেলের গলা তাঁর থেকেও ভালো। ছেলে যেদিন মাইকে ঘোষনা দিয়ে ওয়াজ করে, সেদিন বেশি টাকা দান পাওয়া যায়। কেন যেন চলতি পথের মানুষ বেশি-বেশি দান করে।
২.
রাত দশটার মতো বাজে। রাস্তায় এখনও মানুষের আনাগোনা আছে। ইন্ডাস্িিট্রয়াল এলাকা বলে এখানে অনেক রাত পর্যন্তমানুষের চলাফেরা থাকে। আজকে বেশ শীত পড়েছে। পাঞ্জাবীর উপরে একটি মাত্র চাদরে কাজ হচ্ছে না। বেশ শীত লাগছে রহিমুদ্দিনের।
রহিমুদ্দিন মাইকের ঘোষনা বন্ধ করলেন। প্রথমে প্লাস্টিকের ফোল্ডিং চেয়ারটা গোছালেন, লালশালু কাপড়ের উপরের টাকা পয়সাগুলো গোল করে একটা পুটলির মতো বাঁধলেন। তারপর ব্যাটারীসহ অন্যান্য জিনিসপত্র দড়ি দিয়ে বেধে ফেললেন। এরপর একটা রিক্সা ডেকে সবকিছু রিক্সাতে তুলে রওয়ানা হলেন বাবা ও ছেলে। কাছেই তাঁদের থাকার জায়গা। রেলের জায়গার উপড় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটা টিনসেড ঘরে ভাড়া থাকেন তাঁরা। ঘর ভাড়া মাসে দুই হাজার টাকা।
রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে তালা খুলে রহিমুদ্দিন ঘরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। অন্যসব জিনিসপত্র কাঠের চৌকির নীচে রেখে লালশালু কাপড়ের মধ্যে রাখা টাকা পয়সা গুনতে বসলেন। এক টাকা, দুই টাকা, পাঁচ টকা, দশ টাকা ,বিভিন্ন পয়সার কয়েন মিলিয়ে ছয়শত উনত্রিশ টাকা হয়েছে। তাকে সহযোগিতা করল ছেলে। রহিমুদ্দিন পাঁচশত টাকা রাখলেন একটা কাপড়ের থলের মধ্যে এবং পয়সাগুলো একটা কৌটার মধ্যে । বাকি একশত উনত্রিশ টাকা নিয়ে দরজা খুলে বের হলেন পাশের হোটেল থেকে রাতের খাবার কেনার জন্য। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসলেন রহিমুদ্দিন। ভাত, ব্রয়লার মুরগীর মাংশ ও ডাল। তাই দিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে রাতের খাবার শেষ করলেন রহিমুদ্দিন ও তাঁর ছেলে। খাওয়ার পরে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে ঘুমে। বাপ-বেটা দেরী না করে কোনরকমে বিছানা ঠিক করে পাশাপাশি শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়ার প্রায় সাথে-সাথেই নাক ডাকতে শুরু করলেন রহিমুদ্দিন। তাঁর পাশে কুকুরকুন্ডলি হয়ে ছেলেও ঘুমিয়ে পড়লো।
৩.
অল্প কিছুক্ষন পরে দুইজন দুইরকমের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। রহিমুদ্দিন স্বপ্ন দেখছেন, তাঁর গ্রামের বাড়ীতে ফিরে গেছেন। তিনি এখন অনেক ধনী। বিশাল বড় বাড়ী তাঁর। বাড়ী সংলগ্ন বিশাল বড় পুকুর। পুকুরের চারপাশ ঘিরে বড় বড় নারিকেল গাছ। বাড়ী থেকে পুকুরের পাড় ঘেষে রাস্তাা চলে গেছে প্রধান সড়কের দিকে। সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে, পুকুরের ঐপাড়ে খোলা ফাঁকা জায়গা। সেই খোলা জায়গায় প্রধান সড়কের পাশে বিশাল বড় একটি মসজিদ তৈরি করেছেন রহিমুদ্দিন। কী সুন্দর দেখতে মসজিদটি। কত সুন্দর ভেতরটা। সব আরবী হরফের কারুকাজ করা। গ্রামের লোকজন দেখতে এসেছে মসজিদটি। সবাই খুব প্রশংসা করছেন। প্রশংসা শুনে রহিমুদ্দিনের খুব ভালো লাগছে। দলে দলে মুসুল্লিরা আসছেন রহিমুদ্দিনের মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য। সবাই নামাজপড়ার জন্য দাড়িয়েছেন। ইকামত দিয়ে নামাজ শুরু হলো। ইমাম সূরা পড়তে শুরু করলেন। সূরা পড়ার গলাটা তাঁর খুব পরিচিত মনে হলো। অনেকটা তাঁর ছোট ছেলের মতো।
অন্যদিকে রহিমুদ্দিনের ছেলে স্বপ্ন দেখছে অন্যরকম। সে দেখছে, পাঁকা রাস্তার পাশে, সে তাঁর বাবার সাথে ওয়াজ করছে। বাবার শেখানো ওয়াজমতো সে সবার কাছে মসজিদের জন্য সবাইকে দান করার জন্য অনুরোধ করছে। তার ওয়াজ শুনে চলতি পথের মানুষ চলাচল বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে তার ওয়াজ শুনছে। ওয়াজ শুনে সকল মানুষ কেন যেন কান্না শুরু করল। সবাই হাউমাউ করে কাঁদছে। সেই কান্না শুনে ছেলেটার খুব ভয় করছে। ভয়ে ছেলেটা ওয়াজ থামিয়ে দিল। ওয়াজ থামিয়ে দেখে, লোকগুলো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পয়সা দান করার পরিবর্তে সবাই তাকে ইট ছুড়ে মারছে। একেকটা ইট তার গায়ে লাগছে। আর খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। সে কি ব্যাথা। সে সবাইকে অনুরোধ করছে তাকে না মারার জন্য। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। ইটের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ থেতেলে যাচ্ছে। সে বাঁচার জন্য প্রানপনে দৌড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু দৌড়াতে পাড়ছেন না।
স্বপ্ন শেষ হওয়ার আগেই রহিমুদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙ্গে দেখে তাঁর ছেলেটি ঘুমের মধ্যে শব্দ করে কাঁদছে। রহিমুদ্দিন তাঁর ছেলেকে ডাকলেন। ইয়াকুব, ইয়াকুব। সেই ডাকে ইয়াকুবের ঘুম ভাঙ্গলো না। রহিমুদ্দিন এবার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে লাগলেন। ইয়াকুব, ইয়াকুব। গায়ে হাত দিয়ে দেখেন ছেলের শরীরে জ্বর। জ্বরে ছেলের শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
রহিমুদ্দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বলা যায় স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তবে সময় থেমে থাকেনি। সময়ের নিয়মে সময় বয়ে চলেছে।
রাস্তায় মানুষের চলাফেরা কমেনি। বরং বেড়েছে। ধুলো বেড়েছে। উন্নয়ন কর্মকান্ড বেড়েছে। দূষন বেড়েছে। নতুন নতুন গার্মেন্টস হয়েছে। নতুন নতুন গার্মেন্টস কর্মীর আবির্ভাব হয়েছে।
রহিমুদ্দিন যেখানে মাইক নিয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য অনুদান তুলতেন, সেখানে এখন অন্য লোক অন্য ব্যবসা করছে। তাকে সেই পথে মাইক নিয়ে বসে মসজিদের জন্য অনুদান তুলতে আর দেখা যায়নি। তবে লোকমুখে শোনা যায়, রহিমুদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব আলী নাকি জ্বরের সাথে বেশকিছুদিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেছে। আর রহিমুদ্দিন এখন অর্ধ উলঙ্গভাবে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ান।
(ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত ছোট কাগজ “সাঁতার” এর তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত।)
১৪ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৫:৩১
নিয়ামুলবাসার বলেছেন: হাহ...হাহ... ভালো বলেছেন...ক্রিকেটার সাকিব তার গ্রামের বাড়িতে একটা মসজিদ করে দিয়েছে।
সাকিবের অনুদানে রহিমুদ্দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে...
২| ১৫ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৩৭
রাজীব নুর বলেছেন: সাকিব কি কোনো দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন পূরন করেছে?
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই মার্চ, ২০২১ বিকাল ৩:২৫
রাজীব নুর বলেছেন: ক্রিকেটার সাকিব তার গ্রামের বাড়িতে একটা মসজিদ করে দিয়েছে।