![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রথমে একবার নয় একাধিকবার মিস কল দিতাম। একটুপরই ওই প্রান্তের নম্বর থেকে কল ব্যাক করতো। একটু কথা বলে আমি বলতাম ‘রং নাম্বার’। ইচ্ছা করেই লাইন কেটে দিতাম। আবারও মিস কল দিতাম ঘণ্টাখানেক পর। কল ব্যাক করলে আবার কথা বলতাম। অপর প্রান্তের লোক এমনিতেই কথা বলতো মেয়ের গলা পেয়ে। এভাবেই শুরু হতো ফোনালাপ। তারপর একদিন না উনিই (ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি) আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতো। প্রথম প্রথম দেখা করতে চাইতাম না। পরে রাজি হয়ে যেতাম। প্রথমে দেখা করতাম কোন একটি রেস্টুরেন্টে। পরে আমি নিজেই তার সঙ্গে ফোনে এডাল্ট কথা বলতাম। কখনও কক্সবাজার বা অন্য কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইতো। এরপর উনিই আমাকে কোন ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে চাইতো। আমি বলতাম, আমার খালার বাসা ফাঁকা। সেখানে আসেন। বাসা ফাঁকা শুনে সহজেই রাজি হয়ে যেতেন তিনি। এভাবে ফ্ল্যাট পর্যন্ত এনে দেয়া ছিল আমার দায়িত্ব। আর তার পরের কাজ অন্যকারো।
এভাবে প্রেমিকা সেজে বিত্তশালী বিভিন্ন লোকজনকে নিজের ফ্ল্যাটে ডেকে এনে ব্ল্যাকমেইল এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় চক্রের সদস্য দোলা আক্তার বলছিল এসব কথা।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গত মঙ্গলবার দোলা ও তার পাঁচ সহযোগীকে মিরপুর এলাকার মধ্য পাইকপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দোলার আপন খালা সালমা বেগম ও চাচা আবু তালেবও রয়েছে। তারা বিবাহিত দম্পতি। ভাগ্নি দোলাকে ব্যবহার করে তারা এই অভিনব প্রেম-প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
গ্রেপ্তারের পর এই চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং কিভাবে প্রেম-প্রতারণা করতো তা খুলে বলে দোলা।
দোলা জানায়, তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার রাজপাট এলাকায়। তার পিতা আবু দাউদ শিকদার ছিলেন গার্মেন্ট কর্মকর্তা। সে থাকতো মিরপুরে, সঙ্গে বাবা-মা। কিন্তু তার বাবা বছর চারেক আগে এক মেয়েকে বিয়ে করে। তার পর সে তাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যান। এরপরই তাদের পরিবারে নেমে আসে অর্থনৈতিক দুর্যোগ। মা কোন রকমে সংসার চালাতেন ছোট একটি চাকরি করে। কিন্তু তা দিয়ে চলতে না পেরে তার মা শেষে পর্যন্ত ছোট ভাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান।
দোলা বলেন, সে মিরপুরের একটি স্কুল থেকে গত বছর এসএসসি পাস করেছে। শেওড়াপাড়ায় মামার বাসায় থেকে এখন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে বছরখানেক ধরে নেমে পড়ে অনৈতিক কাজে। জড়িয়ে পড়ে আপন চাচা ও খালার প্রেম-প্রতারণা করে অর্থ আদায় চক্রের সঙ্গে।
আজহার নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয় তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে। আজহারের সঙ্গে তার চাচা ও খালারও পরিচয় ছিল। আজহারই তাকে এই পথে নামতে উৎসাহিত করে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ জেনে সে বিপুল টাকার লোভ দেখায়। সেই লোভে পড়েই সে এই চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।
দোলা জানায়, তার চাচা আবু তালেব ও আজহার বিভিন্ন ব্যক্তিদের ফোন নাম্বার এনে দিতো। তার কাজ ছিল শুধু ওইসব ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের নিজের ফ্ল্যাটে এনে দিলেই তার কাজ শেষ। মধ্য পাইকপাড়ার ৩৬/২ নম্বর বাসার পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় আজহার। দুই বেডরুম ও ড্রয়িং-ডাইনিংয়ের ওই বাসায় তার খালা, চাচাসহ সে নিজেও মাঝে মধ্যে থাকতো। ওই বাসায় নেয়ার পরই বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি ও ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতো তারা।
দোলা বলেন, সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যেই সে একটি লোককে পটিয়ে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারতো। এমনকি সে এক রাজনীতিককে পটিয়ে বাসায় আনার কথা স্বীকার করে সে। এর আগে এক প্রকৌশলীকেও একই কায়দায় পটিয়ে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আনে। এর পরের কাজটা করতো তার চাচা আবু তালেব, চক্রের নেতা আজহার। তাদের কাজ ছিলো টাকা আদায় করা। আজহার নিজেই টাকা আদায়ের বিষয়টি দেখভাল করতো। এই দুই ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করলেও তাকে দুই লাখ ও আড়াই লাখ টাকার কথা বলেছে। তার কাজের জন্য তাকে ৪০ হাজার টাকা দেয়। টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল বলেও জানায় দোলা।
কয়েকজন লোককে এভাবে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বাসায় এনে দিতে পারলে তাকে এককালীন ১০ লাখ টাকা দেবে বলেছে আজহার। দোলা বলেন, ১০ লাখ টাকার কথা শুনে সে আর লোভ সামলাতে পারে নি। মনে মনে চিন্তা করে সে এই টাকা একসঙ্গে মায়ের হাতে তুলে দিলে তাদের আর কোন অভাব থাকবে না। এজন্যই অর্থনৈতিক কষ্ট ও লোভে পড়ে এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হয় সে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্রটি। প্রতারক চক্রের পুরুষ সদস্যরা প্রথমে বিত্তশালী লোকজনের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে নাম্বারটি দোলাকে দেয়া হতো। দোলা প্রেমের অভিনয় করে লোক পটিয়ে ওই ব্যক্তিকে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতো। ব্যক্তি ফ্ল্যাটে ঢোকার পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে আবু তালেব, আজহার, মোস্তফা ও শামিম শিকদাররা ফ্ল্যাটে ঢুকে চলে আসত। তাদের হাতে থাকতো খেলনা পিস্তল, হ্যান্ডকাফ ও ওয়্যারলেস সেট। শামীম শিকদার নিজেকে ফটোসাংবাদিক ও অন্যরা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল ও ভয়ভীতি দেখাতো। অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি পরিবারকে জানিয়ে দেয়া ও গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে বিপুল অর্থ আদায় করতো তারা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এই চক্রটি গত ২৬ই আগস্ট লন্ডন প্রবাসী এক ব্যবসায়ীকে এভাবে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে ২৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। চলতি বছরের ২০শে ফেব্র“য়ারি সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে একই কায়দায় ১৭ লাখ টাকা আদায় করে। সর্বশেষ এই চক্রের প্রেম-প্রতারণার ফাঁদে পড়েন রংপুরের এক রাজনীতিক। তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলে তিনি পুলিশকে বিষয়টি জানান। পরে পুলিশ চক্রটি শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তার করে।
গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রহমত উল্লাহ চৌধুরী জানান, প্রেম-প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এই চক্রটি অনেকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপও নিতে চায় না এই ফাঁদে পা দেয়া ব্যক্তিরা সাধারণত। প্রতারক চক্রটি এই সুযোগই কাজে লাগিয়েছে। চক্রটির সদস্যদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সূত্র: প্রথমবার্তা
©somewhere in net ltd.