![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জন্মদিন বিষয়টি আমার কাছে বরাবরই খুবই আনন্দের ও উৎসবের। পৃথিবীতে এই একটি মাত্র দিনকে আমি আমার জীবনে বিশেষ দিন বলেই জানি ও মানি। কারন এই দিনটি আমার জীবনে এসেছিল বলেই আমি এই পৃথিবীর সকল সুধারস পান করার সুযোগ পেয়েছি। এই পৃথিবীর রসাস্বাদন করার সুযোগ পাচ্ছি।
আমার জন্মদিনটি যেমন আমার কাছে মূল্যবান ঠিক তেমনি যে কোন মানুষেরই জন্মদিন আমার কাছে পরম মূল্যবান। হোক সে আমার চেনা জানা বা অচেনা। প্রতিটি প্রাণের ও প্রাণীর জীবনের মূল্য আমার কাছে গুরুত্ব পূর্ণ। আমার পরিচিত কেউ হয়ে থাকলে বা সেই ব্যক্তিটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবার সুযোগ থাকলে আমি কখোনোই এই বিশেষ দিনটিতে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুল করি না। কারন আমি সব সময়ই মনে করি ” সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব” হিসাবে এই সুন্দর পৃথিবীতে আমরা জন্মেছি বলেই ইহকালে কত কিছুই দেখার, জানার বোঝার সুযোগ পাচ্ছি। আর যি না জন্মাতাম তাহলে ? অথবা মানুষ হিসাবে না জন্মাতাম ? অবশ্য মনুষ্য শরীর নিয়ে জন্মালেই সকলেই মানুষ হয় না। কার প্রমান আমরা আমাদের চারপাশেই অহরহ দেখি । তখন নিজেকে মানুষ ভাবতেও ভীষণ লজ্জা করে।
গত বছর ২৪ এপ্রিল আমার জন্মদিনের ঠিক আগেই আমি একটি লেখা দিয়েছিলাম ঢাকা টাইমস২৪.কম এ । যার হেড লাইন ছিল - ”জন্মের ঋণ শোধ কর্ম দিয়ে ”। কারন এই শিক্ষাটিই জন্মের পর থেকে আমার মা শিখিয়েছিল। তাঁর কথা ছিল এমনই যে, আমরা জন্মেছি কেবল ভাল কাজ করার জন্য , ভাল কোন কিছু দেখার জন্য, শেখার জন্য । তাই আমার প্রতিটি দিনের একটি দূর্লভ প্রার্থণা থাকে , সারা দিনে যেন একটি অন্ত ভাল কাজ করতে পারি।
গত বছর কী নির্মম ভাবে আমার সেই লেখাটি বাস্তবরুপ দিয়েছিল ”রানা প্লাজা” । ঐদিনই রানা প্লাজা ধ্বংসের মাঝ দিয়ে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের জীবন দিয়ে আবারো ” জন্মের ঋণ শোধ” করে দিয়ে গেল ! কিন্তু আমি ঠিক এই ভাবে জন্মের ঋণ শোধ হোক- সেটি চাই নি। এটি কোন মানুষের চাওয়া হতে পারে না। কিন্তু তারপরও সেটিই ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় একবছর আগে। কী বেদনা দায়ক ! কী নির্মম !
একজন অর্থলোভী মানুষ সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন ভাবে তৈরী করেছিল ”রানা প্লাজা” যা কিছুদিন আগেও ছিল ময়লা ফেলার ভাগাড়। আর একদল অর্থ পিশাচ সেখানে তাদের ব্যবসা বানিজ্য করার উদ্দ্যেশ্যে রমরমাভাবে জাকিয়ে কসলো। নরম ময়লার স্তুুপকেই শক্ত মাটি হিসেবে চালিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা ”রানা প্লাজা ” আমার প্রিয় শ্রমিক ভাই বোনদের ”স্বপ্নময় তরতাজা ” জীবন কেড়ে নিল। তারা তো কেউই মার্সিডিজ গাড়ী চড়তে চেয়েছিল না , না কেউ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বাস করার ও স্বপ্ন দেখতো। তাঁরা কেউই পাঁচ তারকা হোটেল বলে কিছু ভবন আছে বা সেটা কী খায় না মাথায় রাখে – এই সব কিছুই জানতো না বা জানার দরকারও ছিল না। তাঁেদর কেবল ধ্যান- জ্ঞান – স্বপ্ন- সাধনা ছিল উদয়াস্ত পরিশ্রম করে স্বাধীন ভাবে আয় উপার্জন করে অন্তত ডাল ভাত খাবে। এই তো – এতটুকুই চাওয়া । তার জন্যেই তো দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম। এই পরিশ্রমের সুফল পুরো দেশ বাসী ভোগ করছে। জাতি ভোগ করছে। রাষ্ট্র ভোগ করছে। আর শ্রমিকের জীবন হয়ে উঠছে চরম নিরাপত্তাহীন।
আই এল ও কনভেনশনে স্বাক্ষর করে আমরা গার্মেন্টস খাত থেকে ”শিশু শ্রমিক ” নিয়োগ ও শিশুদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে নিরসন ” করার জন্য চুক্তিবদ্ধ । প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। কিন্তু আর্ন্তজাতিক মাপকাঠিতে ১৮ বছর এর শিশু আর আমাদের দেশের মতো একটি দেশের ১৮ বছরের শিশু (?)র পার্খক্যটা চোখে পড়ার মতো বৈকি! যে বা যারা আমাদের গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছে তাঁরা আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন না আশাকরি। আমি একজন সৌভাগ্যবান কর্মী যে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব লেবার ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে ” পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা” এবং ”ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে ” বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠান ও তদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়েছি। তারই বাস্তবতার আলোকে আমার এই লেখা। আসলেই আমরা এই সকল প্রতিষ্ঠানকে কতটুকু ”শিশুশ্রম মুক্ত ও পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা” বলয়ে আবৃত করতে পেরেছি ?! আমার এই লেখার বাস্তব প্রমান ”সাদাকালো” মিলবে যদি আমরা আমাদের অর্ন্তদৃষ্টি টি বন্দ না করি।
অনেক চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয় নি গত বছরের ২৪ এপ্রিল ঘটে দূর্ঘটনার খলনায়ক রানা প্লাজার মালিক- রানা’র । তাকেও জন্মের ঋণ শোধ করে যেতে হচ্ছে এবং সামনে আরো করতে হবে। দিন তো পড়েই আছে। কিন্তু কেবল তার বিচারের মাধ্যমেই তো আর এতগুলি প্রাণ ফিরে আসবে না বা প্রাণ এর বিনিময়ে প্রাণ ফিরেও পাওয়া যাবে না। তারপরও একজন মানুষ হিসাবে আমি চাই এই সকল অর্থলোভীদের বিচার হোক, যারা ভবন টি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তৈরী করেন, ভাড়া দেন, ব্যবসা পরিচালনা করেন । যারা ইমারত নির্মাণ নীতিমালা মানেন না। যারা ” কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ ” করে এই বিশ্বকে মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। তাঁদেরকে যে যত বড় ”সালাম বা সেলামী দিক ” আমি নিজে তাদেরকে মানুষ বলতে বা ভাবতেও নারাজ।
আর তাই আবারো আমার জন্মদিনে আমি সেই প্রার্থণাই করি, জন্মের ঋণ শোধ হোক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাঝ দিয়ে। কেবল অর্থ দিয়েই বা ক্ষতিপূরণ দিয়েই এর বিচার হয় না বা অর্থই কেবল মাপকাঠি হতে পারে না। মানুষের মনুষত্ব বিকশিত হোক। মানবতা হোক সর্বজনীন। কেবল একক নয়। কেবল ধনীর প্রাণই প্রাণ নয় । সকল প্রানীর প্রানই একেকটি অমূল্য প্রাণ। সকল জীবনেরই মূল্য এক ও অভিন্ন। আমাদের যাত্রার পথ ভিন্ন হলেও আমরা সকলেই যাচ্ছি একসাথে না হলেও একই মোহনায় ।
রানা প্লাজা বা তাজরীন গার্মেন্টস বা এই রকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন ,যারা আমাদের অবহেলায় তাঁদেও মূল্যবান জীবন দান করে গিয়েছেন – তাঁদের সকলের আত্মা শান্তিতে ঘুমাক। আর আমরা যারা বেঁচে আছি তারা দেখে যেতে চাই দেশে ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আর কোন জন্মদিন বা আর কারো জন্মদিনই যেন শোকের দিন দিন হিসাবে ইহিতাসের পাতায় লেখা না হয়।
দিলরুবা সরমিন
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
প্রধান সম্পাদক , প্রথমবার্তা ডটকম
©somewhere in net ltd.