নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিমগ্ন নির্জন

নিমগ্ন নির্জন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধূসর গোধূলি

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৩০




যে বিকেলে গোধূলি বেলার লাল রঙে মিলেমিশে সোনাবৌয়ের প্রতিমার মতো রঙ সতীদাহের আগুনে পুড়ে কালচে কাঠ হয়ে গেল ,-তখনো খোল-করতাল-কাসর বাজছিলো উন্মাদের মতো, মৃত্যুযন্ত্রণা শব্দের তীব্রতায় ঢেকে দেবে বলে----
©
অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার অধীন নড়াইল সাবডিভিশনের লোহাগড়া-লক্ষ্মীপাশা-মল্লিকপুরে, তিনশো আটষট্টি ঘর গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ পরিবার একত্রে বাস করতেন। সারাদিন শাস্ত্র মেনে পূজোআর্চার সাথে হাজার রকম ধর্মীয় বিধান মানতে বাধ্য করা হতো সকলকে। মাঝেমধ্যেই খোল করতালের জান্তব আওয়াজের মধ্যে সতীদাহের আগুনে কালচে হয়ে উঠতো মল্লিকপুরের বাতাস। নিজেদের প্রয়োজনে একঘর করে ধোপা, নাপিত ও কাহারদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে।
ধোপা কাপড় কাচবে। নাপিত চুল দাড়ি কাটবে-। কাহাড় বিয়ে-পূজায় ঢোল বাজাবে আর বলিদেওয়া মৃত পশুর ছাল ছাড়াবে।
©
তিন মাসের বাচ্চা কমলা সুন্দরী র সাথে আটাত্তর বছরের বৃদ্ধ অবনীভূষণ মুকুজ্জের বিয়ে হয়ে গেল। পেতলের কাঁধাউচু খঞ্চেপোশ রেকাবির মধ্যে কাঁথায় মেয়েকে শুইয়ে মাথায় করে সাতপাক ঘুরলেন পাশের বাড়ির রমনীখুড়ো। বিয়ের মন্ত্রপাঠের মধ্যেই তিন মাসের কমলা কাঁথায় হিসি করে দিয়েছে। কী অলুক্ষণে মেয়েরে বাবা! এই শুভ মুহূর্তে কেউ হিসি করে ! এ তো সমাজের কালা নিয়মের মুখে 'মুত্রাঘাত' !

মালাবদল হল অবনী খুড়োর সাথে নতুন জামাইয়ের। শ্বশুরের থেকে জামাই মাত্র ঊনচল্লিশ বছরের বড়। বিয়ের পরদিন সব পাওনাগন্ডা বুঝে নতুন বর অবনী মুকুজ্জে বাপের ঘরে কনে রেখে চললেন পরবর্তী বিবাহ আসরে। বয়স একটু বেশিই, তবু মেয়ে তো কুলীন বর পেলো ! এমন ভাগ্য কজনের জোটে---ভগবান !!
©
ফুটফুটে বাচ্চা বড় হচ্ছে। সবে হাঁটতে শিখেছে এক পা-- দু পা!মুখে বুলি ফুটেছে দু একটা করে।তেরো মাস বয়সে আদর করে টলমলে পায়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে নতুন গজানো মুক্তোদাঁতে। এরই মধ্যে বাইশ ক্রোশ দুর থেকে খবর এলো দেহ রেখেছেন অবনীভূষণ মুকুজ্জে। সদ্য বিধবা কমলাকে সতী হতে হবে। সব যেন প্রস্তুত থাকে! কান্নার রোল ওঠে বাড়িজুড়ে। অবুঝ কমলা তখন একমনে উঠোনে বসে ধুলোমাটি মেখেই যাচ্ছে।
©
সন্ধ্যার পর পরই কমলাকে ঝোলা ব্যাগে পুরে, লুকিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বনগাঁর দুরসম্পর্কের দিদির বাড়িতে। এদিকে পরদিন সতীদাহের তোড়জোড় শুরু হবে। কিন্তু অবুঝ সতী উধাও। এই ভয়ঙ্কর পাপের ফলস্বরূপ কমলার মা-বাবাকে মোটা গাছের সাথে বেঁধে অকথ্য অত্যাচার হলেও খুঁজে পাওয়া গেলনা---সতীকে। একটা সময় বিরক্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলো ধর্মীয় পুজারীরা। বেঁচে রইল কমলা। আট বছর পর, বনগাঁর দিদির বাড়ি থেকে কমলা ফেরৎ এলো নিজের বাবার বাড়িতে। ততদিনে রাজা রামমোহনের মহান চেষ্টায় সতীদাহ রোধ হয়েছে দেশ জুড়ে। তবুও কোনো কোনো জায়গায় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দু একটা সতীর দেহ তবু জ্বলছে কোথাও কোথাও।
©
বাবা,- নাপিত ডেকে মেয়ের মাথার ঘন চুল,- এবরো খেবড়ো করে প্রায় নেড়া করে কাটিয়ে দিলেন, যাতে গ্রামের যুবক ছেলেদের কুনজর না পড়ে যুবতী কমলাসুন্দরীর দিকে । মাটির বারান্দায় ছোট গর্ত খুঁচে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তাতে ঘি লেপে তার মধ্যে নিরামিষ ডাল-ভাত দেওয়া হতো। বিধবা মেয়ের জন্য কোনো থালা বরাদ্দ নয়। একাদশীতে সারাদিনে কোনো আগুনের তৈরী খাবার খাওয়া যাবেনা। সারাদিনে বরাদ্দ সাতটা বাতাসা আর দু'ঘটি জল। মা কেঁদে মরে গেলেও নিয়মের অন্যথা হবার যো নেই। কর্তা বাড়ি থেকে বেরনোর সময় ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতেন তাকে।
মনে পড়ে মুকুন্দরামে'র সেই কবিতা--
"ওই আমানি খাবার গর্ত দ্যাখো বিদ্যমান ".....
আমানি খাবার (পান্তাভাত আর জল )ওই মাটির গর্ত থেকে পেঁপের ডাঁটি'র সাহায্যে সুড়ুৎ করে টেনে খেতে হতো।
©
ওই ঘন মেঘের মতো কালো চুল এবরো খেবড়ো করে কাটতে এসে যুবক অমল শীল প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। কমলালেবুর কোয়ার মতো বড়োবড়ো দুচোখ বেয়ে নীরবজলে ভেসে যাচ্ছিল কমলাসুন্দরী'র দু'গাল। বাবার কড়া নির্দেশ ছিলো নিয়ম করে দু'মাস অন্তর এভাবেই চুল কেটে দিতে হবে। চলছিলোও তাই।
এমন ই এক শ্রাবনের অঝোর ধারার মধ্যে ঐ অমল নাপিতের হাত ধরে চিরদিনের জন্য বদ্ধ খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যায় রক্ষণশীল ব্রাক্ষ্মন পরিবারের অষ্টাদশী বিধবা কন্যা।
©
মুক্তি-মুক্তি---মুক্তির বেপরোয়া ঝোড়ো বাতাসে সওয়ার হয়ে বেহিসেবী দুলতে দুলতে শিয়ালদা -হাওড়া হয়ে সোজা মধ্যপ্রদেশের এক নির্জন পাহাড় ঘেরা ছোট্ট জনপদে পৌছয় তারা। এখানে কেউ কাউকে চেনে না। কবিরাজিটা টুকটাক জানা ছিলো, তার সাথে নিখুঁত ক্ষুর চালিয়ে ফোড়া-পাইলস্-অশ্বের অপারেশন। ধীরে ধীরে নামি চাঁদসি ডাক্তার অমলেন্দু সেন। নাম পদবীর প্রয়োজনীয় ছোট্ট বদল। তারপর উড়ে যাওয়া দুই স্বাধীন পাখি নিয়ম করে নিজেদের দুই বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে মাঝেমধ্যেই,- কিন্তু ঠিকানা জানায়নি কোনদিনই। অমল-কমল এর সুখের সংসার ভরে উঠেছে অদৃশ্য আশীষে। তিন ছেলেমেয়ের ভরা সংসার সামলে ডাক্তার স্বামীর কম্পাউন্ডারী সামলেছে কমলা।দুই ছেলের একজন দাঁতের ডাক্তার একজন--সরকারী চাকুরে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভালো পাত্রে। আর কোনোদিন ওই ঘন মেঘকালো চুল কাটতে দেয়নি অমলেন্দু। এখন সেই কাঁচাপাকা চুল উড়ে মাঝেমধ্যেই হাঁটু ছুঁয়ে যায় কমলার ।
দু'জনের খুব ইচ্ছে করে, মল্লিকপুরের ব্রাক্ষ্মণ পাড়ার জন্মভিটেতে কদিন ছুঁয়ে যায় অতীতের হাসিকান্না-! প্রেতাত্মার মতো এতদিন পরেও জাত্যাভিমান--সমাজক্রোধ আড়াল থেকে ভয় দেখায় দুজনকেই---
এজন্মে আর কোনোদিনই ছোঁয়া হবেনা জন্মভূমির মাটি-----

পরজন্মে, যদি আবার ফিরিয়ে আনো বিধি--/--ওই মধুমতী তীরেই আমায় ছুঁইয়ে দিও হৃদি.......

মন্তব্য ২৪ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (২৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৪৪

চাঁদগাজী বলেছেন:



কিসব বেকুবেরা ধর্ম বানায়েছিলো, মানুষের বুদ্ধি কত কম ছিলো, ধর্ম তার সাক্ষী হয়ে আছে।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৭

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: সে এক ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন কালো দিন-----
যে দিন আমাদের দেখতে হয়নি----

কিছুটা ফিরে এসেছে অন্য মোড়কে------

২| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৪

চাঁদগাজী বলেছেন:



লেখক বলেছেন, " সে এক ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন কালো দিন----- যে দিন আমাদের দেখতে হয়নি----কিছুটা ফিরে এসেছে অন্য মোড়কে------ "

-কোন মোড়কে?

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:১৮

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: আমি বলতে চেয়েছি----কিছুটা হলেও সেই ভয়ঙ্কর দিন আমরা পেরিয়ে এসেছি----

সামনে আরো নিত্যনতুন ভয়ঙ্কর পথ আমাদের পেরোতে হবে----

৩| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: কি ভয়ংকর সেই ধর্মীয় নিয়ম কানুন। যাক অবশেষে সুখ নামক শব্দে সমৃদ্ধি হয়েছে

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:১৯

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: অবশ্যই----সকল কালো রাতের পরে আলোমাখা সকাল অপেক্ষায় থাকে--

এবং সে ভোর----অবসম্ভাবী------

৪| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:১৩

মুজিব রহমান বলেছেন: এভাবেই বিদ্রোহের আগুনে ছাড়খার হবে ধর্ম ও ধর্মান্ধ মূর্খরা। জয় হোক মানবতার।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:১৫

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: অন্য পথে হলেও-------জয় হয়েছে মানবতার

৫| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:০১

নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: সব ধর্মগুলোই মানুষের জন্য অধর্ম।যত তাড়াতাড়ি মানুষ এই চাই থেকে বের হয়ে আসবে ততই মানুষের জন্য মঙ্গল।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২৫

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: ঠিক বলেছেন----


সাথে থাকবেন------সুজন-----

৬| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: ধর্ম থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:৪৬

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: ঠিক ই বলেছেন----
যে ধর্ম মানুষের ক্ষতি সাধন করে----সেটা সত্যি ই ভয়ঙ্কর------

৭| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১:৫৪

কল্পদ্রুম বলেছেন: সতীদাহ প্রথা উপমহাদেশে শুরু হয়েছিলো কবে? এটা কি কেবল বাংলাতেই চালু ছিলো?
চমৎকার গল্প৷রামমোহন রায় হিন্দু বিধবা মেয়েদের নতুন জীবন দিয়েছিলেন।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২১

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: এটা শুধু বাংলাতে নয়----সমগ্র উপমহাদেশেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চালু ছিল---

৮| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:০৬

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: এটা গল্প না ইতিহাসের অজানা অধ্যায়।++++++

কি ভংঙ্কর তথ্য।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২২

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: এটা ইতিহাস এর অন্যতম জানা অধ্যায়----

এটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা-----

৯| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:২৯

রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ঠিক ই বলেছেন----
যে ধর্ম মানুষের ক্ষতি সাধন করে----সেটা সত্যি ই ভয়ঙ্কর------

ধর্ম নিয়ে হানাহানি কম হয় নি।
দেশভাগ হলো ধর্মের কারনে। ভারত থেকে বাঙ্গালী মুসলমানদের বিতাড়িত করা হলো। বাবরি মসজিদ নিয়ে লংকাকান্ডের কথা তো সারা বিশ্বই জানে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের করুন অবস্থা এই 'ধর্মের' কারনেই।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২৪

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: একদমই ঠিক কথা বলেছেন----
সেই অমানবিক ধারা এখনো চলছে------অন্য মোড়কে---অন্য ধারায়----

১০| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২৬

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: একদমই ঠিক কথা বলেছেন----
সেই অমানবিক ধারা এখনো চলছে------অন্য মোড়কে---অন্য ধারায়----

১১| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৩৩

তারেক ফাহিম বলেছেন: আহ মানবতা, ধর্মের কাছে অন্ধ!

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:০২

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: একদমই তাই-----যথার্থ বলেছেন-----সুহৃদ-----

১২| ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০৩

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে তবে আপনি খুব আবেগময় করে লিখেছেন।পড়তে ভালো লেগেছে। পোস্টে পঞ্চম লাইক।
শুভেচ্ছা জানবেন।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:০৪

নিমগ্ন নির্জন বলেছেন: খুব ভালো থাকবেন----
কী সুন্দর ভাবে মন্তব্য টুকু করেছেন-----
ধন্যবাদ অপরিচিতেষু----

১৩| ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ২:৩১

স্বামী বিশুদ্ধানন্দ বলেছেন: কি পরিমান যন্ত্রণাদায়ক নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতা ছিল একজন মানুষকে জীবন্ত দাহ করার মধ্যে সেটা বর্বর সমাজ উপলব্ধি করতে পারতো না !!!!
আমরা অনেক অনেক ভাগ্যবান যে সেই চরম অন্ধকার থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
আপনি ঠিকই বলেছেন - "কিছুটা ফিরে এসেছে অন্য মোড়কে"।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.