![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নৌকায় উঠেছি ঘন্টা খানিক হবে, এখন বেলা প্রায় তিনটা। ইঞ্জিন চালিত নৌকাটা মেঘনার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। চারদিকে ঘোলা পানি ছাড়া দেখার কিছু নেই আর যা রোদের তেজ তাতে কিছু দেখতে চাওয়া থেকে চোখ দুটো খুলে পকেটে ভরে রাখা বরং ভালো। আমার অফিস বস মিজানুর রহমান নৌকায় ওঠার পর থেকেই একমনে সিগরেট টেনে যাচ্ছেন, তার চোখে সানগ্লাস। তিনি যে ভাবে দু আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটটা ধরে তীরের দিকে মুখ করে বসে আছেন তাতে চেহারা দেখে তার মনের ভাব বোঝার কোন উপায় নেই। তিনি কিছু দেখছেন বলেও মনে হয় না, কাঁদা পানি আর দুপাশের ঝাঁপসা বন বাদার দেখার কি আছে। তিনি আসলেই তাকিয়ে আছেন, কিছুই দেখছেন না দেখলে উজান থেকে ভেসে আসা কচুরিপানার জঞ্জালের সাথে ভেসে যাওয়া মরা গরুটার পিছে উড়তে থাকা কাকদুটো তার দৃষ্টি এড়াতো না। তবে মরা গরু কেন মরা হাতি ভেসে গেলেও তার মুখের ভাবে কোন পরিবর্তন যে হতো না তা আমি নিশ্চিত।
একে তো রোদে চান্দি ফেটে যাচ্ছে তারপর আবার পায়ে ধরেছে ঝিঁঝিঁ, পা টা যে ছড়িয়ে বসবো সে উপায় নেই। আমার সামনেই স্যার বসা। তিনি নিজ থেকে না বললে তার পাশে যেয়ে ছই এর ছায়ায় বসা ঠিক হবে না আবার তার দিকে পা ছড়িয়ে বসাটাও একরকম বেয়াদবি। গলুই এর উপর বসে রোদ খেয়ে মরি আর কি। একাউন্টেন আজিজুল আর স্যারের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বজলু হারামজাদা দুটোই নৌকায় উঠেই ছইয়ের মধ্যে ঢুঁকে পড়েছে। আজিজুল কে বুক পকেট থেকে রে ব্যান্ডের সানগ্লাস বার করতে দেখেই শার্টের ভেতর কাবাব হতে থাকা গা টা দ্বিগুণ তাপে জ্বলেগেল। আর এক হারামজাদা বজলু তো সেই প্রথম থেকেই স্যুট বুট পরে গ্যাংস্টার সেজে বসে আছে। সাথে সানগ্লাস না আনার জন্য নিজেকে এখন মনসুরের থেকেও মস্ত আহাম্মক মনে হচ্ছে। নৌকার অপর দিকে দু হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসে আছে মনসুর। তার পেছনেই বিকট শব্দ করছে নৌকার ডিজেল ইঞ্জিন টা যেখানে তার ঘাঁড়ের উপর যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে কিলার আজগর। আজগরের দৃষ্টি মনসুরের উপর নিবদ্ধ। লোকটার তাকানোর ভেতর একটা শকুন শকুন ভাব আছে। মনসুর কি জানে সেই কখন থেকে একটা বিরাট শকুন তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে, যেকোন সময় তার শিকার সে ছোঁ মেরে তুলে নেবে? মনসুর আর একটু আগে ভেসে যাওয়া মরা গরুটার নিয়তি বলতে গেলে একই। লোকটা কি আসলেই একটু বোকা?! মনসুরের জন্য আমার খারাপই লাগছে একবার মনে হলো তাকে নৌকার এপাশে এসে বসতে বলি পরক্ষণেই মনে হলো কি দরকার নিজেকে ঝামেলা থেকে যতটা পারা যায় দূরে রাখাই ভালো। মালিবাগ রেলক্রসিং থেকে মনসুর কে তুলে নেয়ার সময় থেকেই কারো মুখেই কথা নেই। বলারও কিছু নেই, যা বলার সব গত শুক্রবার রাতেই বলা হয়ে গেছে। মিজান স্যারই শুধু বলেছেন আমরা সম্মতি জানিয়েছি মাত্র। এর বেশি কিছু আমাদের করাও নেই। গত রাতে স্যার কিছুটা উত্তেজিত সাথে মদ্যপও ছিলেন। মদ্যপ হলেও মাতাল বা উত্তেজিত হতে তাকে আগে কখনো দেখিনি। তবে স্যারের মাথা সব সময় খুব পরিস্কার। এখন তাকে দেখে কে বলবে এই লোক গত রাতে আমাদের মতো বাইরের লোকের সামনেই নিজের স্ত্রীর দিকে মদের বোতল ছুঁড়ে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করেছেন?
আজিজুলের সবখানে ফড়ফড় করা স্বভাব আছে যার জন্য গতরাতেই তাকে স্যারের হাতে ভয়ংকর ভাবে অপদস্ত হতে হয়েছে যা ভাবতেই এই বিশাল জলসমুদ্রের মাঝেও আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে অবশ্য আজিজুল ওসব কিছু মনেটনে করে না। সে একজন ধুলোমানুষ। ধুলোবালির মতো ঝেঁড়ে ফেলে দেয় সব। লোকটার আসলে মান অপমান বোধটাই নেই। সটান করে পা মেলেদিয়ে দিব্বি বজলুর সাথে বিড়ি ফুঁকে যাচ্ছে।
স্যার আগেই বলে দিয়েছিলেন শনিবার তার সাদা পাজেরো টা সোনারগাঁও হোটলের অপজিটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা ঠিক নটার ভেতর যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেখান থেকে সোজা মালিবাগ। আমাদের ভাগ্য প্রশন্ন যে অপেক্ষা করতে হয়নি বেশিক্ষণ। দশটার ভেতরই মনসুরের দেখা পাওয়া গেল ওর বাড়ির গলির সামনে। মনসুর আমাদের পাজেরোর দিকে তাকালোই না, পাশ দিয়ে চলে গেল। আমিতো ধরেই নিয়েছিলাম ধরা পড়ে গেছি, সে আমাদের দেখেই হয়তো উল্টো দিকে দেবে দৌড়। এমন কিছুই হয়নি। রেলক্রসিং এর কাছে এসে মনসুর একটা ফার্মেসিতে ঢুকে গেল আমাদের পাজেরোও তাকে ফলো করে পৌঁছে গেল সেখানে। ফার্মেসি থেকে ফেরার পথেই গাড়িটা দাড় করালেন মিজান স্যার, মনসুর গাড়ির কাছে আসতেই জানালার কাঁচ সরিয়ে স্যার হাসিমুখে মনসুরকে গাড়িতে উঠতে বললেন হতভম্ব মনসুর কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি আর বজলু ওর দুপাশে পুলিশ ব্যারিকেড এর মত দাঁড়িয়ে পড়লাম, ততক্ষণে ভেতর থেকে পেছনের দরজাটা খুলে দিয়েছে আজিজুল। দাঁতালো শুয়োরের মতো দু পাটি দাঁত বার করে হাসছে সে। আজিজুলের মুখের দিকে তাকাতেই জর্দাপানের রসে লাল হয়ে থাকা দাঁতগুলো দেখে গা টা ঘিনঘিন করে উঠলো। আমাদের সবার উদ্দেশ্য এক হলেও এই লোকটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। ব্যাটা শুয়োর ও ছাগলের মধ্যবর্তী একটা হাইব্রিড।
মনসুর চুপচাপই গাড়িতে উঠেছে কোথায় কেন এমন একটাও প্রশ্ন করেনি। মিজানুর স্যারের ব্যক্তিত্বের কাছে অবশ্য উপর তলার রাঘব বোয়ালও ঝিম মেরে যায় সেখানে মনসুর কোন বাল। সে শুধু মিনমিন করে একবার বলেছিল তার বাচ্চাটার খুব জ্বর এখনি ওষুধটা বাড়িতে পৌঁছানো দরকার। ঐটুকুই। আমি ভেতরে ভেতরে খুব চিন্তিত ছিলাম সে হয়তো সোজা কথায় গাড়িতে উঠবে না চিৎকার চেচামেচি করে লোকজড়ো করে ফেলবে, অবশ্য ঢাকার মানুষজন এখন আর আগের মতো অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় না, কে মরলো কে খুন হলো এতে কারো কিছু আসে যায় না। তবে মনসুর চেচামেচি করে কোন সিনক্রিয়েট করলে বড় ধরণেরই গন্ডগোল হতে পারতো, স্মার্ট ফোন এসে আজকাল সাহায্যের লোক না থাকলেও ফটোসাংবাদিকের অভাব নেই।
মনসুরকে জনগণের চোখের সামনে থেকে এভাবে তুলে নেয়া ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়নি, পরিচিত যে কারো দেখে ফেলার সম্ভবনা রয়েছে। আসলে রাগের মাথায় তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত টা নেয়া হয়েছে, তাছাড়া উপায়ও ছিলো না লোহা গরম থাকতেই আঘাত করতে হয়।
যায়হোক মনসুর কে গাড়িতে তুলেই পাজেরো টা ঝড়ের বেগে ছুঁটেছে উত্তরে সেখান থেকে কখনো পাঁকা কখনো আধা-পাঁকা কাঁচা রাস্তা অরাস্তা পেরিয়ে এই মেঘনার তীরে, যেখানে আগে থেকেই নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল আজগর। গাড়ির শব্দ শুনে নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসার আগে আজগর নামের এই লোকটিকে আমি আগে কখনো দেখিনি, তবে তার সাথে সামান্যই যে কথাবার্তা বজলুর হলো আজিজুলের প্রশস্ত হাসি আর স্যারের দেখে আজগরের কপালে হাত ঠুকে সালাম দেয়া দেখেই বুঝে গেছি আমি আর মনসুর বাদে বাকিদের সবারই আজগরের সাথে পূর্ব পরিচয় আছে। এই কঠিন রোদেও সে একটা তেলচিট চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে, গা মাথা থেকে সরিষার তেলের বিশ্রী গন্ধ। সাবানের ফেনা ধুয়ে চলে যায় তেল কামড়ে পড়ে থাকে বলে সাবান থেকে তেল মালিশ লাভজনক এমন কোন ব্যাপার আছে মনে হয় এর। লোকটার বয়স বোঝা কঠিন। ত্রিশ ও হতে পারে ষাট সত্তর ও হতে পারে। রোদে পোড়া চিমটা চামড়া মুখের হাড়ের উপর এমন ভাবে লেগে রয়েছে দেখে মনে হবে জ্যন্ত মমি। তবে চাদরের বাইরে যে হাতদুটো নৌকার গুলই ধরে আছে তা দেখেই বুঝেছি ওদুটো জন্তুর মতো শক্তি রাখে।
পুরোটা পথ স্যার ই ড্রাইভ কেরেছেন, স্যারের নিজস্ব ড্রাইভার থাকলেও তাকে নেয়া হয়নি এসব ঝামেলার কাজে যত কম লোক থাকে ততই ভালো। গাড়িতে স্যারকে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই মনে হয়েছে সাদার উপর হালকা নীল গোলাপি ছিটের হাওয়াইয়া শার্ট খাকি প্যান্টে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল হলিডেতে কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছেন, তার ভেতর গতরাতের রেশমাত্র নেই। ডেমরার ওদিকে পাজেরো র সিডি প্লেয়ারে কিছুক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বেজেছে আমি সামনে স্যারের পাশেই ছিলাম পেছনে মনসুরের দুপাশে আজিজুল আর বজলু। বজলু স্যুটেট ব্যুটেট হয়ে পুরোপথ সানগ্লাস পরে স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকলেও আজিজুল পুরোই অসহ্য। হেড়ে গলায় বন্যা মির্জার সাথে গলা মিলাচ্ছেতো পরক্ষণেই হেহে করে হাসছে যেন মনসুরকে বোঝাচ্ছে আমরা সারপ্রাইজ পিকনিকে বেড়িয়েছি। ব্যাটা রামছাগল। দিন দুপুরে নেশা টেঁসা করে বেড়িয়েছে কিনা কে জানে।
আমরা উঠার পর সবার শেষে নৌকায় উঠেছিলো মনসুর, আমিই তাকে উঠতে সাহায্য করলাম। হাত টা ধরতেই ওর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ছেলেটার মুখ শুকিয়ে ছোট্ট এক্টুস খানি হয়ে গেছে ও আমাদের প্লান আঁচ করতে পেড়েছে বলে সন্দেহ হলো, পাড়াটাই স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় পড়লে আমি হলে কি করতাম ভাবতে পারলাম না। চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে প্রথমবারের মতো কেন যেন অপরাধী মনে হলো তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে এক হ্যাচকা টানে তুলে ফেললাম নৌকায়। মনসুর টাল সামলাতে মুহূর্তের জন্য আমাকে জড়িয়ে ধরল। মহসিন ভাই বলে আমাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মনসুর।
মনসুর বছর খানিক আমাদের অফিসে, এসময়ে সে আমাকে মহসিন ভাই বলে বহুবার ডেকেছে কিন্তু আজকের ডাকটি সম্পূর্ণ অন্য রকম, আজকের পরিবেশ পরিস্থিতিও অন্য রকম। লোকটা আসলেই আহাম্মক সুযোগ থাকতেই খেঁচে দৌড় দিলেও তো পারতো, স্যারের হাত পা ধরে মাফ ও চাচ্ছে না হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে গোজ হয়ে বসে আছে। ব্যাটা উটপাখিবংশীয় উজবুক কোথাকার।
নৌকা উজানের দিকে ছুটে চলেছে, তীরে জলা মাঠ জনবসতির চিহ্নও নেই হাওর টাওরের দিকে চলে এসেছি মনে হয়।
মিজান স্যার হঠাৎই পিছন ফিরে বললেন, মনসুর নদী কেমন দেখলে?
মনসুর হাঁটুর মাঝ থেকে মাথা তুলে বলল, ভালো।
সে স্যারের দিকে সরাসরি তাকিয়ে।
স্যার বললেন, মনসুর সাঁতার জানো
-জি না।
-জানো না?! তাহলেতো তোমার জীবনের ষোল আনাই মিছে গেল।
মনসুর এ কথার কোন উত্তর দিলো না।
স্যারের গলায় সামান্য উত্তাপ নেই! তাহলে কি মনসুর এযাত্রা বেঁচে গেল নেশায় বুদহয়ে রাগের মাথায় মনসুরকে শাস্তি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন তা থেকে কি সরে এসেছেন তবে?! ব্যাটা আজ যে ভয় পেয়েছে তাতে জন্মের মত শিক্ষা হয়ে যাওয়ার কথা। কালই অফিস গিয়ে দেখা যাবে নিজেই বদলি হওয়ার জন্য দৌড় ঝাঁপ শুরু করেছে কিংবা মিজান স্যারের জুতার তলা চাটতে লেগে পড়েছে।
মনসুরকে ছেড়ে দিলে আমাদের কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু সে যে রাতারাতি আজিজুল ছাগলটার মতো আমাদের, ঐমানে স্যারের পা চাটা কুত্তাতে কনভার্ট হয়ে যাবে তার কোন গ্যারান্টিই বা কি? আমাদের ক্ষমতা জানার পরও যে ডিজি স্যারের কাছে নালিশ করে দুদকে রিপোর্ট পাঠায় তার মতো আহাম্মকের এ পৃথিবীতে জন্মানোটাই অপরাধ।
মিজান স্যার মনসুরের দিকে সিগারেট প্যাকেট টা এগিয়ে দিয়ে বললেন, মনসুর সিগারেট নাও।
মনসুর যে ধুমপান করে না সেটা সে জানাতেই স্যার বললেন, এখানে সবাই স্মোকার সেখানে আমাদের মাঝে থেকে স্মোক করবে না তাতো হবে না, তুমি স্মোক করোনা সাঁতার জানো না কিন্তু সাঁতরে তো ঠিকই উপর তলায় চলে যাও...কি যাও না?
মনসুরের ক্ষীণস্বর শুনতে পেলাম, "আমার ভুল হয়ে গেছে... "
হঠাৎই প্রচন্ড আক্রশে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো আজিজুল, " শুয়োরের বাচ্চা তুই আমাদের নামে রিপোর্ট করিস...তোর এত্তোবড় সাহস, ডিজি তোর বাপ লাগে খানকির পুঁত কি ভেবেছিলি তোর কথায় আমাদের কিছু হবে......" আজিজুল মনসুরের বুকের উপর বসে একহাতে গলা চেপে ধরেছে ওর, অন্য হাতে ঘুষি বসিয়ে যাচ্ছে নাকে মুখে। বজলু ও থেমে নেই মুহূর্তের ভেতর দাঁড়িয়ে উঠেই একের পর এক লাথি চালাচ্ছে পেটের দিকে। ঘটনাটা এতো আকস্মিক ঘটলো যে নৌকাটা ভয়ংকর ভাবে দুলে উঠায় একটু হলেই নৌকা থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। স্যার আগের মতোই সামনের দিকে ফিরে সিগারেট টানার দিকে মন দিলেন, পেছনে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে যেন তার কোন আগ্রহ নেই।
আজিজুল যে ভাবে মনসুর কে পেড়ে ফেলেছে তাতে তার ছাড়া পাওয়ার কোন উপায় নেই, তার পা দুটো কাঠের পাটার উপর ডাঙায় তোলা মাছের মতো লাফাচ্ছে যা ক্রমশ্য নিস্তেজ হয়ে আসছে। মনসুরের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মিজানুর স্যার পেছনে না তাকিয়েই বললেন, এনাফ।
বজলু আজিজুল সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল কিন্তু মনসুরের জীবন শক্তি ততক্ষণে প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। মনসুর নিজেকে টেনে বসানোর চেষ্টা করলো। তার সারা শার্ট রক্তে মাখামাখি, আজিজুলের হাতের কারিশমায় মুখের দিকে তাকানোর মতো না। মনসুর নিজের দেহটা টেনে পেছনের দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে এই দশ ফুটি নৌকায় আমাদের থেকে কতটা দূরে সে যেতে পারবে? তার পেছনে শকুনচোখা কিলার আজগর। এতোকিছু হয়ে গেল আজগরের চোখের সামনে এতক্ষণ সে এক একচুলও নড়েনি। তার চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছে। রক্তদেখে খুনীদের চোখ খুনের নেশায় জ্বলে ওঠে, আজগরের ও কি একই অবস্থা!
আকস্মিকই মিজানুর স্যার উঠে দাঁড়ালেন সিগারেটের ফিল্টারে একটা টান দিয়ে ফেলে দিলেন পানিতে। একপাশে রাখা বৈঠাটা আজগরের হাতে চলে গেল মুহূর্তে, সে যেন এতোসময় এমন একটা স্যিগনালের অপেক্ষাতেই ছিলো, বৈঠাটা তীরের বেগে আঘাত করলো মনসুরের ঠিক ডান কানের নিচে, সাথে সাথেই মনসুরের দেহটা বিনা প্রতিবাদেই লুটিয়ে পড়লো। সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা বজলু দূর হ হারামজাদা বলে বসালো এক লাথি চোখের নিমিষে মনসুরের দেহটা অদৃশ্য হল মেঘনার জলে।
মিজানুর স্যার আজগরকে নৌকা ঘোরাতে বললেন।
নৌকার মুখ এখন দক্ষিণমুখী। আজগর কে এখন বেশ খুশিখুশি মনে হচ্ছে। হাড্ডি সর্বস্ব মুখেই একটা বিকট তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। আজিজুল বজলু দুজন ই এখন শান্ত। আজিজুল অনেকক্ষন থেকে মোবাইলের পেছনে থাবা দিয়ে নেটওয়ার্ক পাওয়ার চেষ্টা করছে, এলোকটা বুদ্ধিতেও স্থূল। টাকার গন্ধ পেলে শুধু বুদ্ধি গজায় বোধ হয়।
কথা ছিলো মনসুরকে হাত পা বেঁধে একটা বস্তায় ভরা হবে আর একটা বস্তায় ইট ভরে দুটো বস্তা একসাথে বেঁধে ফেলে দেয়া হবে নদীতে। সেটা বোধ হয় সবাই ভুলে গেছে, আমারই সেটা মনে করিয়ে দেয়া উচিত ছিলো। কে জানে সপ্তাহ খানিক পর হয়তো দেখা যাবে মনসুরের বডি চাঁদপুরে ভুঁস করে ভেসে উঠেছে, ডেড বডি ঘিরে মাছির মতো শয়ে শয়ে সাংবাদিক, চ্যানেলে চ্যানেলে মনসুরকে নিয়ে টকশো, পথেপথে মানব বন্ধন, আমরণ অনশন, মন্ত্রিদের জুসের প্যাকেট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। এ উজবুকের দেশে সবই সম্ভব। এদেশে মরেও শান্তি নেই।
দূর, আমি একটু বেশি ই চিন্তা করছি। সে রকম কিছু যদি ঘটেও আমার কিছু হবার কথা না। আমি কি করেছি? মনসুরের গায়ে ফুলের টোকাটা পর্যন্ত আমি দিইনি। কিছু হলে ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে বজলু আর আজিজা। মরুক হারামজাদা দুটো। দড়ির দু মাথায় দুটোরে ঝুলিয়ে দিক। খুনের মাস্টার মাইন্ড মিজানুর স্যার হলেও উপর মহলে স্যারের যা লাইন তাতে তার কিছু হওয়ার কথা না। এদেশে টাকায় কথা বলে। নাহ্ আমি বেশিই চিন্তা করছি। উপরে ওঠার কোন সহজ পথ নেই। পৃথিবী চাই না মানুষ সত পথে উপরে উঠুক। উপরে উঠতে হলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, এর ভেতর মানুষিক দুর্বলতাও একটা। যা হবার হয়ে গেছে। চাঁদপুর তো চাঁদপুর মেঘনাঘাট পর্যন্ত ভেসে যাওয়ার আগেই একবার এদিককার শেয়াল কুকুর নাগালে পেলেই পুরো সাবাড় হয়ে যাবে মনসুর।
একটু আগের তেজি রোদ টা হঠাৎ ই বিদায় নিয়েছে। অক্টোবরের শেষ, দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে আসছে। সূর্যটা নদীর বুকে কোন রং না ছড়িয়েই হারিয়ে গেল এরই মধ্য কুয়াশা দখল নিতে শুরু করেছে দূরের সবুজ। আলো কমে আসছে, ঘড়িতে ছ'টাও বাজেনি নীল ধূসর পুব আকাশে জায়গা করে নিয়েছে চাঁদ। পুরো দৃশ্যটা এককথায় অপার্থীব কিছু। দুপুরের দিকে একটু বাতাস ও ছিলো না কিন্তু এখন অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টো। নৌকার সামনের গলুইতে বসে মনে হচ্ছে এই ভেসে যাওয়ার বুঝি শেষ নেই! শেষ হতে নেই! আজকের এই দিনটি আমি ভুলে যেতে চাই। অন্যরা ইতমধ্যে সব ভুলে গেছেও বোধহয়। আজিজুল নৌকার ছাওনির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে, বজলু মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, আজগর আর মিজানুর স্যার যে যার জায়গায় আগের মতোই। পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত!
টেনশনে থাকলে মানুষ ঘনঘন সিগারেট ধরায় কথা টা ভুল, আজ সকাল থেকে এ পর্যন্ত একটা সিগারেট ও আমি ধরাইনি অন্য সময় হলে পুরো প্যাকেট খালি হয়ে যেত । পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে মাঝেমধ্যে দূরে দু একটা বাজারের আলো, জেলে নৌকা দেখা যাচ্ছে। একটা সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে লাইটারের জন্য প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকাতেই লাইটারের সাথে হাতে উঠে এলো একটা ভাঁজ করা কাগজ। ভাঁজখুলে দেখি একটা প্রেসক্রিপশন। রোগীর বয়স বার দিন নামের জায়গাটা খালি, বাবা-মা এখনো নাম নিয়ে মতানৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি বোধ হয়। সন্ধ্যার এই ম্রিয়মাণ আলোয় প্রেসক্রিপশন টা হাতে নৌকার গলুইতে বসে আছি হু হু করে ঝড়ো বাতাস দিচ্ছে। কেউ যেন ডাকলো, "মহসিন ভাই...." চমকে পিছনে তাকালাম
পূর্ব আকাশটা আলো করে আছে চাঁদ, নিচে সমুদ্রগামী বিস্তৃত জলরাশি।
©somewhere in net ltd.