নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

সমুদ্দুর যতকাল

২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৩০

“আচ্ছা বাবা, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আর নীলপরীর কি বিয়ে হয়েছিল?” সহজ জিজ্ঞেস করল।
“তা তো জানি না। ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও। ওদের গল্প আপাতত শেষ।“ হাই তুললাম। ঘুম পাচ্ছে। অরোরা ইতোমধ্যেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেছে। চিতপটাং হয়ে হাত পা ছড়িয়ে হা করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে ছোট্ট পেটটা ওঠানামা করছে। কারেন্ট এসেছে। এই রুমের বাতি নেভানো। বসার ঘরের বাতি জ্বলছে দেখে এইঘরে যৎসামান্য আলো আসছে। এই ঘোর বৃষ্টির দিনে ট্রান্সফর্মার কে ঠিক করে দিল বুঝতে পারলাম না। নাকি ট্রান্সফর্মার যায়নি?
“বাবা আরেকটা গল্প বলো প্লিজ। মাত্র এগারোটা বাজে। পুরো রাত বাকি!” আরীবা আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে, করুণ সুরে মিনতি করতে থাকে।
নোভার দিকে তাকালাম, “আমার গল্পের স্টক তো খুবই সীমিত। একটা গল্প যে কোনোমতে টেনে টুনে শেষ করেছি- এটাই অনেক। আবার আরেকটা গল্প? তোদের মায়ের থেকে শোন, আমি পারবো না।”
নোভা চোখ মটকালো, “কেন! আমি লেখক নাকি? আমি বড়জোর তোমার গল্পের জোগানদাত্রী হতে পারি। কিংবা প্রুফ রিডারের মত প্রুফ অডিয়েন্স। বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে বলে দিবো যে বড়দের গল্প হয়ে যাচ্ছে। এর বেশি পারবো না।“ সাফ মানা করে দিল।
জেগে থাকা জিহান, সহজ আর আরীবা আরেক দফা জেঁকে বসলো এবার, “বাবা, প্লিজ আরেকটা গল্প শোনাও না?”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলাম। “বলবো। কিন্তু গল্পের মাঝে ডিস্টার্ব করা যাবে না। আর এবারে যে গল্পটা বলবো, এটা বড়দের আবার ছোটদের- দুই দলেরই গল্প। অতএব, মাঝপথে বিরক্ত করে বলা যাবে না যে বাবা গল্পটা তো বড়দের হয়ে যাচ্ছে।“
সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। তবে কারো আপত্তি নেই। নোভারও না।
আমি গল্প বলা শুরু করলাম।

“কয়েক শো বছর আগে, যখন জ্বালানী তেলের আবিষ্কার হয়নি। হলেও এখনকার মত সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পরেনি সেই তেল উত্তোলনের পদ্ধতি- তখন সাধারণত মানুষ মাছের তেল দিয়ে জ্বালানীর কাজ করত। মানে রাতের হ্যাজাক বাতি কিংবা হারিক্যান, আগুণ জ্বালানোর চুলার রসদ- এসব জায়গায় ব্যবহার করা হত মাছের তেল। আরো ভাল করে বললে, তিমি মাছের পেটের চর্বি। সেই চর্বি থেকে বের হওয়া তেল দিয়ে এসব কাজ হত। তো তিমি মাছের পেটের চর্বি তো আর এমনি এমনি বাজারে আসবে না। কাউকে সমুদ্রে গিয়ে তিমি মাছ শিকার করে সেই তিমি মাছের তেল নিয়ে আসতে হবে? সেই যুগে রাজারা বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা সেরা নাবিক, খুব ভাল সারেং আর তিমি শিকারী নিয়ে দল তৈরি করে দিত, জাহাজ পাঠাতো গভীর সমুদ্রে। তিমি শিকার করার জন্য। সেই তিমি শিকারীরা গভীর সমুদ্রে গিয়ে হারপুণ দিয়ে তিমি মাছ শিকার করত। হারপুণ হচ্ছে অনেক বড় ধরণের তীর জাতীয় জিনিস। এগুলো দিয়ে গোট আস্ত তিমি মাছকে চতুর্দিক হতে বিঁধে ফেলা হত। জাহাজের সাথে তিমিকে বেঁধে ফেলতো এই হারপুণ দিয়ে। তারপর একটা দল তিমির পিঠে নেমে ছুরি, কুঠার দিয়ে পিঠ কেটে পেটে নামত। বালতি বালতি করে তিমির পেটের দেয়াল থেকে চর্বি কেটে কেটে তুলে এনে জাহাজের নিচের স্টোর রুমে জমা করতে থাকতো। বড় বড় ড্রাম বা কাঠের পিপে থাকতো সেই সব স্টোরে। চর্বি ভরে ভরে সেই সব পিপে মুখ বন্ধ করে রাখতো অন্ধকারে ঠাণ্ডার মাঝে। যাতে চর্বি গলে না যায়।
তোমরা তিমি শিকার দেখেছো টিভিতে?” আমি বাচ্চাদের দিকে তাকাই।
মাথা নাড়ে তিনজনই। কেউ দেখেনি। “ সমস্যা নেই, অবশ্য সিনেমা ছাড়া এখন এসব দেখার কথাও না। আগে তেল না থাকায় তিমির চর্বির পেছনে বড় বড় দল সাগর অভিযানে যেত। এখন তো সেই ঝামেলা নেই। কারেন্ট আছে। উইন্ড টার্বাইন আছে, ওয়াটার টার্বাইন আছে, সোলার প্যানেল আছে! কত কি! তো সেই যুগে প্রতিটা জাহাজ তিমি শিকার করতে করতে অনেক গভীর সমুদ্রে চলে যেত। যতক্ষণ না স্টোর রুমের সব ক’টা পিপে ভরে যাচ্ছে, তিমি শিকার চলতেই থাকতো। এজন্য সমুদ্রের অনেক দ্বীপের তীরে মরা তিমি আটকে থাকতো। ভাসতে ভাসতে মাঝেমাঝে লোকালয়েও চলে আসতো মরা তিমি। এত বড় মাছ তো খাওয়া সম্ভব না। যদিও সাগরে রাক্ষুসে মাছের অভাব নেই। কিন্তু এত এত তিমি মারা হত সেই যুগে যে তিমি খাবার মত রাক্ষুসে মাছও কম পরে যেত। রাজারা তাদের একেক জাহাজে করে লক্ষ কোটি স্বর্ণমূদ্রার তিমির চর্বি নিয়ে এসে বিরাট ব্যাবসা করতো দেশে বিদেশে। এমনকি সেই তেল থেকে বিস্ফোরকও নাকি বানানো শুরু হয়েছিল। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে সমুদ্রে আগের মত তিমিই পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। সমুদ্রের আরো আরো গভীরে গিয়েও অনেক শিকারী জাহাজ খালি হাতে ফিরে আসছিল। তিমিরা যেন সমুদ্র থেকে অজানা কোথাও হারিয়ে গেছে।
এরকমই এক সময়ের গল্প এটা

ক্যাপ্টেন টমাস নামের এক তিমি শিকারীর গল্প। টমাস যে দেশের রাজার নৌবাহিনীতে কাজ করতো সেই রাজা ছিলেন বিশাল ধনী। তিমির চর্বি বিক্রি করে করে এত এত সম্পদ গড়েছিল যে গোটা পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ কিনে ফেলা সম্ভব ছিল সেই রাজার। কিন্তু তাতেও তার তৃপ্তি হত না। তার আরো আরো সম্পদ দরকার। তাই একের পর এক তিমি শিকারে সমুদ্র অভিযানে সেই রাজা জাহাজ পাঠাতেন। ক্যাপ্টেন টমাস ছিলেন সেই যুগের বিখ্যাত তিমি শিকারী। রাজা ক্যাপ্টেন টমাস বলতেই গদ গদ হয়ে যেতেন। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মত ছিল তার কাছে ক্যাপ্টেন টমাস। প্রতিবার জাহাজ বোঝাই করে তিমির চর্বি নিয়ে এলেও রাজা তাকে খুব কমই বিশ্রাম করতে দিতেন। তোষামোদি করে, ভাল করে খাইয়ে দাইয়ে আবার সমুদ্রে পাঠিয়ে দিতেন দুই দিন যেতে না যেতেই। ক্যাপ্টেন টমাসও আস্তে আস্তে বিরক্ত হয়ে উঠছিল রাজার কাজ কারবারে। এত করে যার জন্য, তার দেখি কোনো শুকরিয়াই নেই!
এভাবেই চলছিল ক্যাপ্টেন টমাসের জীবন।
হঠাৎ একদিন রাজার খুব আদরের রাজকন্যার ভীষণ অসুখ হয়। রাজা যেমন হাড়কিপ্টে আর স্বার্থপর ছিল, রাজকন্যা ছিল ঠিক রাজার উল্টোটা। অনেক বড় মনের মানুষ ছিল রাজকন্যা। রাজাকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাজ্যের সব গরীব প্রজাদের খাবার আর স্বর্ণমূদ্রা দান করতো রাজকন্যা। এজন্য রাজকন্যাকে সবাই অনেক ভালবাসতো। আবার সবার খুব দুশ্চিন্তাও হতো, “রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেলে তো সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। কে দেখবে তখন আমাদের? লোভী রাজা তো আমাদের দিকে ফিরেও চায় না!”
রাজকন্যার ভীষণ অসুখ। রাজবৈদ্যর কোনো অসুধেই রোগ সারছে না। সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকতে হয় রাজকন্যাকে। এতই অসুখ যে নিজের পায়ে ভাল করে হেঁটেও বেড়াতে পারে না। দেশ বিদেশ থেকে রাজবৈদ্যের অন্যান্য বন্ধুরাও চলে আসে চিকিৎসা করতে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না।
রাজা বিরাট দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। দিন যতই যায়, রাজকন্যা শুঁকিয়ে যেতে থাকে। দেখতে দেখতে রাজকন্যা পাখির মত হালকা হয়ে যায়। সবাই আশা ছেড়ে দেয়। রাজকন্যা হয়ত মারা যাবে। রাণী নেই। রাজকন্যার বয়স যখন আট, রাণী একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান। রাজা এরপর আর বিয়ে থা করেননি। এখন রাজকন্যাও যদি মরে যায়, এত এত সম্পদ কার জন্য রেখে যাবেন রাজা?
রাজা দিশেহারা পাগলের মত হয়ে যান। লোকে বলাবলি করতে থাকে, রাজার অধিক লোভই রাজকন্যার এই অসুখের আসল কারণ। রাজ্যের মানুষের সেবা না করে রাজা দিনের পর দিন কেবল টাকার পাহাড় বানিয়েছে। রাজ্যের মানুষ অনাহারে থেকেছে রাজার কারণে। নিশ্চয় কারো অভিশাপ লেগেছে রাজকন্যার ওপর এই কারণে।
বহুদূর দেশ থেকে অনেক বয়স্ক এক হাকিম আসেন শেষ দিকে। ধবধবে সাদা চুল দাঁড়ি। ভ্রু পর্যন্ত পেঁকে গেছে। শাদা বিশাল জোব্বা পরণে। তিনি এসে রাজকন্যার হাতের পালস টিপে, চোখের পাতা টেনে নীবির ভাবে পরীক্ষা করলেন। সব দেখে শুনে কেবল বললেন, “হুম!”
রাজা সামনেই অস্থির ভঙ্গীতে পায়চারি করছিলেন। হাকিমকে ‘হুম’ বলতে শুনে সাথে সাথে জিজ্ঞাস করলেন আশান্বিত মুখে, “হাকিম সাহেব? কিছু আঁচ করতে পারলেন? আমার মেয়েটার কি হয়েছে? ওকে বাঁচানোর জন্য যা চাইবেন, তাই হাজির করে দিব আপনাকে। শুধু আমার কলিজার টুকরাটাকে বাঁচান!”
হাকিম সাহেব রাজকন্যার ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরের রাতের আকাশ দেখলেন। গম্ভীর গলায় এরপর বললেন, “রাজকন্যার অসুখটা অনেক কঠিন অসুখ মহারাজ। আমি সামান্য হাকিম মানুষ কি করতে পারবো জানি না। তবে একটা উপায় বাতলে দিতে পারি। খুব অসম্ভব একটা কাজ। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।"
“কি উপায়। যেটা বলবেন, সেটাই করবো।" রাজা কাকুতি মিনতি ভরা গলায় বলেন।
হাকিম সাহেব ঘুরে রাজকন্যার দিকে তাকালেন। ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট পরীর মত মানুষটা। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি শুনেছি অনেক গভীর সমুদ্রে যেখানে কখনো মানুষের জাহাজ পৌঁছায়নি, যেখান থেকে আকাশ এত পরিষ্কার যে মঙ্গল, শনি, বৃহস্পতি গ্রহ পর্যন্ত শেষ রাতের আকাশে দেখা যায়। সেখানে মা তিমি বেড়াতে আসে হঠাৎ হঠাৎ। সাগরের অনেক নিচ থেকে উঠে আসে সেই গ্রহের দৃশ্য দেখার জন্য। মা তিমি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিমি মাছ। শাদা ধব ধবে সেই তিমি নাকি গোটা একটা শহরের চাইতেও অনেক বড়। মা তিমির গায়ের সাথে গা ঘেষে রাজকন্যা যদি সমুদ্রে কয়েকদিন সাঁতার কাটতে পারে। আপনা আপনি সুস্থ হয়ে যাবে।“
সাথে সাথে রাজা বলে উঠলেন, “এ আর এমনকি কঠিন কাজ! আমি আজকেই আমার সবচেয়ে সাহসী ক্যাপ্টেনকে সাগরে পাঠাবো সেই তিমি ধরে আনতে।"
“মহারাজ, আপনি বোধহয় বুঝতে পারেননি। আমি জীবিত মা তিমির কথা বলেছি। বলেছি তার সাথে সাঁতার কাটতে হবে রাজকন্যাকে। যেখান থেকে শেষ রাতের আকাশে মহাবিশ্বের সব গ্রহ নক্ষত্র দেখা যায়। আমি তিমি শিকার করতে বলিনি।"
“অ! তারমানে রাজকন্যা মামণিকে সমুদ্র অভিযানে পাঠাতে বলছেন?”
“ঠিক তাই। আর তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এমন জাহাজ পাঠাতে হবে যেই জাহাজে তিমির চর্বি তোলা হয়নি কোনোদিন। তিমি শিকারের অস্ত্রও থাকবে না। এমনকি পুরো জাহাজে যদি মানুষ একজন রাখা সম্ভব, সেটাই রাখতে হবে।“
রাজা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন হাকিমের দিকে। রসিকতা করছেন কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাকিমের মুখে বিন্দুমাত্র রসিকতার রেশ নেই। “মা তিমি লক্ষ লক্ষ মাইল দূর থেকেও তিমি মাছের চর্বির গন্ধ পায়। যে সব হাতিয়ারে তিমি হত্যা করা হয়, সেগুলো ধুয়ে ফেললেও গন্ধ দূর হয় না। তারচেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, মা তিমি মানুষ সহ পৃথিবীর সব কিছুর হৃদস্পন্দন টের পায়। যার কারণে জাহাজে যত কম মানুষ দেয়া যাবে, ততই মঙ্গল। নয়ত সে সমুদ্রের ওপর পৃষ্ঠে নাও উঠে আসতে পারে।“
রাজা এই পর্যায়ে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। এতক্ষণ যতটা সহজ ভাবছিলেন বিষয়টা, এখন ততই কঠিন মনে হচ্ছে। “আচ্ছা, ধরলাম আমি রাজকন্যা মামণিকে একজন নাবিক দিয়েই পাঠালাম। কিন্তু সাঁতারের ব্যাপারটা কি হবে? ও তো ঠিকমত হাঁটতেই পারছে না। উঠে দাঁড়াতে গেলেই পড়ে যাচ্ছে। পানিতে নামলে যদি ডুবে যায়?”
“যাবে না মহারাজ। মা তিমি অনেক মমতাময়ী। সে কাউকে ডুবে যেতে দেয় না। আমি এমনটাই শুনেছি।“ হাকিম মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন।
“বেশ। তাহলে সেটাই হবে। আমি আমার বিশ্বস্ত ক্যাপ্টেন টমাসকে পাঠাবো রাজকন্যা মামণির সাথে। আর কেউ যাবে না। নতুন জাহাজ বানিয়ে সাগরে ভাসাবো দুই দিনের মধ্যে। কোনো তিমির চর্বির গন্ধ থাকবে না। মোম ভরে ভরে দিয়ে দিবো। খাবার রসদ দিয়ে দিবো অনেক দিনের জন্য। কিন্তু আমার মেয়েটার জীবন রক্ষা পাক।“ রাজকন্যার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।
এদিক ওদিক তাকাতেই নিঃশব্দে প্রধান মন্ত্রী এগিয়ে এলো একপাশ থেকে। রাজা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “নতুন দুটো জাহাজ বানাতে বলে দাও তো কারখানার ইঞ্জিনিয়ারদের। যত লোক লাগে লাগুক। দুই তিন দিনের ভেতর আমার জাহাজ তৈরি চাই। আর টমাস ফিরেছে কিনা দেখো? বলে দাও টমাস ফিরলেই যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।“
“মাত্র দুই তিন দিনে জাহাজ বানাবে!” চোখ কপালে উঠে যায় প্রধান মন্ত্রীর। কিন্তু রাজার কড়া চাহুনি দেখা মাত্র প্রশ্নটা ঢেকে দেয় আরেকটা প্রশ্ন দিয়ে, “ইয়ে, দুইটা জাহাজ কেন মহারাজ?”
“একটা যদি কোনো কারণে ঝামেলাও করে, আরেকটা রেডি থাকবে। এত কথা না বাড়িয়ে কাজে লেগে যাও।“ হাত নেড়ে বিদায় করলেন প্রধান মন্ত্রীকে।

এরপর তিন দিনের মাথায় অনেক জ্বর গায়ে ক্যাপ্টেন টমাস জাহাজ নিয়ে বন্দরে ফেরে। ফেরা মাত্র রাজার জরুরী তলব। জ্বর নিয়ে রাজার প্রাসাদে হাজির হয় টমাস। রাজা তাকে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠেন, “বন্ধু টমাস! কেমন আছো? তোমার জন্য আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। তোমাকে আজকেই রাজকন্যা রোজমেরীকে নিয়ে রওনা দিতে হবে গভীর সমুদ্রে। নতুন জাহাজ, কিন্তু কোনো নাবিক পাবে না। একাই। রোজমেরীকে সুস্থ করতে হবে।“

“বাবা? রোজমেরী? এটা কেমন নাম?” আরীবা বাঁধা দিয়ে ওঠে।
“নাম তো নামই। কেমন হবে আবার?” আমি চোখ পাকালাম।
“এত মিষ্টি স্বভাবের রাজকন্যার নাম আরো সুন্দর দিতে হবে। উম্মম, ওর নাম দাও এলসা।“
“তোর মাথায় এনিমেশনের ক্যারেক্টারের নাম ছাড়া আর কিছু আসে না? শুনলেই তো খইলসা মাছের নাম মাথায় আসে আগে।”
“ছিঃ বাবা! তুমি তো একটাও সিরিজ দেখোনি। দেখলে বুঝতে এলসার মত রাজকন্যাই হয় না।” আরীবা প্রতিবাদ জানায়। “নাম এলসা’ই রাখা লাগবে।“
“লেখকের বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ!” ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। “আচ্ছা ঠিক আছে। রোজমেরী বাদ। শ্রোতাদের অনুরোধে আকিকা করে রাজকন্যার নাম রাখা হল ‘এলসা’। গল্পে ফিরে আসি।
রাজা টমাসকে নতুন অভিযানের কথা বলা মাত্র ক্যাপ্টেন টমাস আকাশ থেকে পড়ে।
“মহারাজ, আমি জ্বর নিয়ে মাত্র ফিরেছি। এখনই আবার রাজকন্যাকে নিয়ে সমুদ্র অভিযানে যেতে বলছেন? তাও আবার কোনো ক্রু ছাড়াই! কি বলছেন এসব”
“যা বলছি সেটাই করতে হবে। হাকিম সাহেব বলেছেন গভীর সমুদ্রে যেতে হবে, যেখানে এখনো কোনো জাহাজ পৌঁছায়নি। সেখানে এমন এক জায়গা আছে যেখানে শেষ রাতে আকাশে মহাবিশ্বের সব গ্রহ নক্ষত্রেরা ফুটে ওঠে। সেখানে মা তিমি সমুদ্রের ভেতর থেকে উঠে আসবে। তার সাথে রাজকন্যা এলসা গা ঘেষে সাঁতার কাটলে কয়েকদিন- সুস্থ হয়ে যাবে।“
টমাস জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় রেগে বলে ফেলল, “হাকিমের মাথা নষ্ট হয়েছে মহারাজ। সমুদ্রে এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে সব গ্রহ নক্ষত্র দেখা যায়। আমার এত বছরের নাবিক জীবনে আমি এমন কোনো জায়গার সন্ধান পাইনি। হাকিম মিথ্যা বলেছে।”
“চোপ!” ধমকে উঠলেন রাজা। “কত বড় সাহস তোমার! বন্ধু বলে সম্বোধন করছি বলে মাথায় উঠে যাচ্ছ! আজই যদি রাজকন্যাকে নিয়ে সমুদ্রে রওনা না হও তো আজ রাতেই তোমাকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে দিব। কোনো মাফ নাই। দূর হও এখন চোখের সামনে থেকে। আমি দ্বিতীয়বার বলার আগেই যেন দেখি নতুন জাহাজ নিয়ে তুমি তৈরি আছো।“
ক্যাপ্টেন টমাস রাগে গজ গজ করতে করতে দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছু করার নেই। রাজা আর হাকিমের এই উদ্ভট চিকিৎসার জন্য তাকে সাগরে যাওয়াই লাগবে। নইলে মরতে হবে। ঘরে বৌ বাচ্চা নেই যে তাদের জন্য চিন্তা করা লাগবে। বিয়ে থা করেনি। কিন্তু তাই বলে নিজের প্রাণের মায়া থাকবে না, সেটাও না। জ্বর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নতুন জাহাজ কোথায় নোঙ্গর ফেলে রেখেছে দেখতে গেল।

কোনো রকম কাল বিলম্ব না করেই সেই বিকেলেই ক্যাপ্টেন টমাস অসুস্থ রাজকন্যা এলসাকে নিয়ে গভীর সমুদ্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়। পুরো শহরের মানুষ তাদের বিদায় জানাতে এগিয়ে আসে জাহাজের জেটিতে। রাজকন্যা দূর্বল হাতে হাত নাড়ায় সবার উদ্দেশ্যে। কে জানে, আর কখনো ফেরা হবে কিনা। মলিন হাসি হেসে সবার জন্য বলে, “আমাকে মনে রেখো সবাই। আমি তোমাদের ভীষণ ভালবাসি।”
দেশের মানুষ এলসার এই কথায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। তারাও বুঝতে পারে, হয়ত এটাই শেষ দেখা রাজকন্যাকে।
জাহাজের রেলিং’এ পাশে দাঁড়ানো ক্যাপ্টেন টমাস জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে কেবল রাজকন্যাকে বলে, “একটু সরে দাঁড়াবেন রেলিং থেকে। ঝাঁকির চোটে উলটে পড়ে যেতে পারেন পানিতে। আপনার জাহাজের অভ্যাস নেই তো, তাই।“
এলসা তার কথা মেনে সরে আসে রেলিং থেকে। নিজের কেবিনে ফিরে যায়। জাহাজের পাল ফুলে ওঠে। নাক ঘুরে সমুদ্রের দিকে সোজা হয়। দ্রুত নোঙ্গর উঠে যায়। যেহেতু অন্য নাবিক নেই। রাজা সংক্রিয় ভাবে বেশ কিছু জিনিস তৈরি করে দিয়েছেন এই জাহাজে। কারো সাহায্য ছাড়াই নোঙ্গর উঠিয়ে ফেলা যায়। পাল তোলা নামা করা যায়। আরো অনেক কিছু।
দেখতে দেখতে সবার চোখের আড়ালে হারিয়ে যায় ডুবন্ত সূর্যের দিকে এলসাদের জাহাজটা।

সবার অলক্ষ্যে সেই একই জেটি থেকে কয়েক ঘণ্টা পর রওনা দেয় আরেকটা একই রকম জাহাজ নিঃশব্দে, রাতের অন্ধকারে।

ক্যাপ্টেন টমাস আর এলসার শুরু হয় এক অনন্ত যাত্রা। সেই যাত্রার কোনো শেষ নেই। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। দেখতে দেখতে চার মার হয়ে যায়। এলসা দিন দিন আরো শুকিয়ে যেতে যেতে প্রায় হাড্ডিসার হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন টমাস ওর শুশ্রূষা করতে থাকে সাধ্যমত, পাশাপাশি নাবিকের বইয়ে নেভিগেশন লিখে রাখতে থাকে তারার অবস্থা দেখে দেখে। রোদ ওঠে, নীল আকাশে পেঁজা তুলার মত মেঘ ওড়ে। বড় বড় এলবাট্রস সঙ্গী হয় কদিনের জন্য। এলসা সেই সময় ডেকে উঠে এসে পাখিদের দেখতে থাকে ক্লান্ত মুখে। রাত হলে আবার কেবিনে ফিরে যায়। তারপর ঝড় ওঠে একদিন। প্রচণ্ড ঝড়। সেই ঝড়ে জাহাজের একটা মাস্তুল ভেঙে পড়ে। খাবারের পানির অনেকগুলো পিপে নষ্ট হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন একা হাতে সবকিছু রক্ষা করার চেষ্টায় লড়ে যায়। সমুদ্রের পানিতে ভিজে খাবার সব নোনা হয়ে যায়। মুখে দেয়া যায় না এমন।

আবার রোদ ওঠে। বৃষ্টিও হয়। খাবার পানি নষ্ট হলেও, ক্যাপ্টেন টমাস খুব যত্ন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে বেঁচে থাকা কিছু পিপেতে। এরপর জাল দিয়ে মাছ ধরে রান্না করে এলসার জন্য। সামুদ্রিক লতা তুলে এনে স্যুপ রান্না করে খাওয়ায়।
ক্যাপ্টেন এইদিনগুলোতে এলসার সাথে অনেক কিছু নিয়ে গল্প করেছে। এমনকি সাগরের মাছ কীভাবে রান্না করতে হয়, সেটাও শিখেয়েছে এক সন্ধ্যায়।
“ক্যাপ্টেন, তোমার বাড়িতে কে কে আছে? ওদের কথা তো কখনো বলোনি।” এলসা এক সময় জিজ্ঞেস করে।
“একটা ঘোড়া আছে, গোরু আছে দুটো, ভেড়া তিনটা। সাথে আছে একটা স্টোর রুম ভর্তি হরেক পদের মজার মজার পানীয়।“
“ওমা! আমি তো ভাবলাম তোমার পরিবার আছে, ছেলে মেয়ে আছে!” এলসা চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকায়।
হা হা করে হাসতে থাকে টমাস, “আমি সারাজীবন জাহাজে জাহাজেই কাটিয়েছি। বিয়ে করিনি। সময় মত বিয়ে করলে আমার আপনার সমান একটা মেয়ে থাকতো। আমার চুল দাঁড়ির রঙ দেখে বয়স কম ভাবার কারণ নেই। এই ডিসেম্বরে পঞ্চাশে পা দিবো।“ ক্যাপ্টেনকে দেখতে পয়ত্রিশ বা খুব বেশি হলে চল্লিশ বছরের মনে হয়। পেটানো শরীরের কারণে বয়স বোঝার কোনো উপায় নেই। এলসার হতবাক চোখ দেখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন, “সংসারের প্রতি আগ্রহ ছিল না আমার। সমুদ্র টেনেছে সব সময়। ডাঙার চেয়ে সাগরেই নিরাপদ লাগে এখন। এখানেই আমার সংসার।“
এলসা দুঃখী মুখে তাকায় মানুষটার দিকে। হুইল চেপে ধরে বহুদূর অন্ধকার দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যাপ্টেন টমাস। এলসার হঠাৎ খুব কষ্ট লাগতে থাকে কেন জানি এই নিঃসঙ্গ নাবিকের জন্য।

এভাবেই যাচ্ছিল দিন। ঝড় বৃষ্টির মাঝ দিয়ে। আর ক্যাপ্টেন সব চেষ্টা করে যাচ্ছিল এলসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
কিন্তু প্রকৃতির হয়ত অন্য ইচ্ছা ছিল। এলসা ক্রমশ মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে। একেবারে বিছানায় পড়ে যায় একদিন মেয়েটা। প্রায় সারাক্ষণই ঘুমিয়ে থাকে। আসার সময় হাকিম অনেক ধরণের ওষুধ দিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে।
গভীর রাতে এলসার ঘুম ভেঙে যায়। কেবিন থেকেই শুনতে পায় গলুইয়ের দিক থেকে ক্যাপ্টেন টমাসের মন খারাপ করা একটা গান ভেসে আসছে। খুব কঠিন আর সাহসী একজন মানুষ। এই দীর্ঘ কয়েক মাসে এলসা তাকে কোনোদিন দূর্বল হতে দেখেনি। শোনেওনি। কিন্তু আজকের গলাটা খুব অন্যরকম লাগলো। মনে হল মানুষটা অনেক কষ্ট নিয়ে গান গাইছে থেমে থেমে।
“একটা ছোট ঘুমপরী আর প্রৌঢ় নাবিক নায়,
খুঁজতে গেল অচিনদেশের শুভ্র তিমির মা’য়।
যায় না পাওয়া সেই তিমি, তবু কত্ত খুঁজে যাই,
ঘুমপরীটার ঘুম ভাঙাতে শুভ্র তিমিই চাই।
হয়ত পরী ঘুমিয়ে যাবে, দেখা পাবার আগে
আরেকটুক্ষণ জাইগো পরী, সফল হবো লাগে।
নাবিক একা নায়ে, কথা বলার যে কেউ নাই,
ঘুমপরীটা জাগতো যদি, আশায় বাঁচি তাই…”

ক্যাপ্টেন টমাসের গলায় গানটা শুনে এলসা শুয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে। সে জানে ক্যাপ্টেন টমাস অনেক একা একজন মানুষ। তার কথা বলার কেউ নেই। এলসা জেগে থাকলে এসে কেবিনে এসে অনেক অনেক মজার গল্প করে। কিন্তু এলসা যখন ঘুমিয়ে থাকে, সে চুপচাপ জাহাজের ডেকে হেঁটে বেড়ায়। কাজ করে। একা একা গান করে। কিন্তু সে খুব চায় তার চারপাশে অনেক মানুষ থাকুক। মানুষ একা থাকতে পারে না।

মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে, হাত জোর করে বুকের কাছে মুঠি করে থাকে,“হায় স্রষ্টা, আমাকে বাঁচিয়ে রাখো। আমি মরে গেলে ক্যাপ্টেন টমাস একা হয়ে যাবে।“এলসা সে রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়।

পরদিন বিশাল ঝড় হল। ঝড়ে ওদের জাহাজের আরেকটা মাস্তুলও ভেঙে পড়ল। অবশিষ্ট একটা মাস্তুল থাকাও যা, না থাকাও তা। ক্যাপ্টেন টমাস ঝড়ের মধ্যে যেন জাহাজ উলটে না যায়, সেজন্য কুঠার এনে কোমরে দড়ি পেঁচিয়ে ভাঙা মাস্তুলের গোড়াটা কাটতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে মাস্তুলের গোড়ায় কুঠার মারতে থাকে। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টির চোটে উড়ে যেতে চাইছে খরখুটোর মত। এমনকি জাহাজটাও উলটে যেতে চাইছে। বিশাল বিশাল পাহাড়ের সমান ঢেউ এসে গুড়িয়ে যাচ্ছে ডেকের ওপর। আছড়ে পড়ছে ভীষণ শব্দে। ক্যাপ্টেন টমাস এতকিছুর মধ্যেও লক্ষ করল তাদের জাহাজটা এরমধ্যেই উলটে যাবার কথা ছিল। কিন্তু উল্টাচ্ছে না। শুধু তাইনা, বিদ্যুৎ চমকানোর সময় মনে হচ্ছে জাহাজের যে দিকটা ঝুঁকে রয়েছে সাগরের দিকে। সেই দিকে বিশাল শাদাটে কিছু একটা সাগরের নিচ থেকে উঠে এসে ঠেলে ধরে রেখেছে জাহাজটাকে। সত্যি দেখছে কিনা বুঝতে পারছে না ক্যাপ্টেন টমাস। কিন্তু এতদিনের তিমি চেনার চোখ ভুল করতে পারে না। এই জীবনে যতগুলো তিমি দেখেছে, এটা সবচেয়ে বড় তিমি! সেই তিমি মাছটা ওদের জাহাজটাকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে একপাশ থেকে ঠেলে আগলে রেখেছে। কি আশ্চর্য!
ক্যাপ্টেন আরো দ্রুত হাতে কুঠার মেরে ভাঙা মাস্তুলটা কেটে আলাদা করে ফেলতে থাকে। ঝড়ের মধ্যেই তিমি মাছটার হুইসেলের মত শব্দ পাওয়া যায়। ঝড় এতই বাড়ছে যে তিমি মিলেও সম্ভবত শেষ রক্ষা করা যাবে না। ক্যাপ্টেন তাড়াতাড়ি ছুটে যায় এলসার কেবিনের দিকে। এর মাঝেই ঝড়ের তাণ্ডবে জাহাজ উলটে গেল। কোমরের দড়ির কারণে খোলা সাগরে ছিটকে না গেলেও ডেকের ওপর খুব খারাপ ভাবে আছাড় খেল টমাস। মাথা ফেটে জ্ঞান হারালো কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। কিন্তু জ্ঞান হারাতে হারাতে দেখলো বিশালাকায় তিমিটা সহ আরো অসংখ্য তিমি ঘিরে ফেলেছে ওদের জাহাজটাকে। উলটে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দূর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে আটকে রেখেছে জাহাজটাকে…

ক্যাপ্টেন টমাসের জ্ঞান ফিরলো প্রায় দশ ঘণ্টা পর। মাথার একটা শিরা অসম্ভব ব্যথায় দপ দপ করছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। কোমরের দড়িটাও খোলা। জাহাজের ডেকেই আছে সে, তবে ছায়ায় ঢাকা একপাশে একটা চাদর দিয়ে কেউ ঢেকে রেখেছে তাকে। তার জাহাজটা কোনো একটা সবুজ পাহাড় ঘেরা দ্বীপের পাশে এসে আটকে আছে কাঁত হয়ে। ওপরে নীল চকচকে আকাশ। পেঁজা তুলার মত শ্বের শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে। জাহাজটা নীল টলটলে পানির একটা ল্যাগুনের প্রবালে আটকে রয়েছে। পানির ঢেউয়ের ধাক্কার শব্দ পাওয়া যায় জাহাজের খোলের মধ্যে।
কোথায় আছে, কি করছে এখানে ভাবতেই রাজকন্যা এলসার কথা মনে এলো। মনে পড়া মাত্রই তড়িঘড়ি করে টলতে টলতে এলসার কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। কেবিনের দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে এলসা নেই। ধক্ করে উঠল বুকটা ক্যাপ্টেন টমাসের। এলসা কি তবে মারা গেছে? সাগরে পড়ে গিয়ে ডুবে গেছে মেয়েটা? অদ্ভুত শূন্যতায় ভেতরটা দুমরে মুচরে আসতে চায় টমাসের।
কেবিন থেকে বেরিয়ে পাগলের মত অন্য সব কেবিন আর স্টোর রুম দেখতে থাকে। কিন্তু এলসার কোনো চিহ্ন নেই। পুরো জাহাজের কোথাও নেই মেয়েটা।

হঠাৎ সাগরের দিক থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। চমকে ফিরে তাকায় টমাস। দৌড়ে উঠে আসে গলুইয়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটায়। কপালের ওপর হাত রেখে ছাউনির মত করে তাকায় দূরের সাগরে। অনেক দূরে বিশাল সাইজের কিছু ডলফিল কিংবা ছোট তিমি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সেখানে কোনো একটা মেয়ে হেসে হেসে সাঁতার কাটছে। খিলখিল করে হাসছে। শুরু তাই না, ডলফিনগুলো সেই মেয়েটাকে মাঝে মাঝে পিঠে চড়িয়ে আরো ভেতরের সমুদ্রের দিক থেকে টান দিয়ে ঘুরিয়ে আনছে! কি বিস্ময়কর দৃশ্য! টমাস তার দীর্ঘ জীবনে এই দৃশ্য আর কোনোদিন দেখেনি। মেয়েটাকে এত দূর থেকেও দেখে চিনতে পারছে সে। রাজকন্যা এলসা। সেই রুগ্নশরীরের মেয়েটা এত অল্প সময়ে কীভাবে এত সতেজ আর সজীব হয়ে উঠল ভেবে বিস্মিত হল ক্যাপ্টেন টমাস।
তাড়াতাড়ি জাহাজ থেকে নেমে ল্যাগুন পেড়িয়ে সাগরে ঝাপ দিলো। ডলফিনগুলো ক্যাপ্টেনকে এগিয়ে আসতে দেখেও সরলো না। মেয়েটাকে ঘিরে খেলতে থাকলো। টমাস দ্রুতই পৌঁছে গেল সেখানে। মেয়েটা সত্যিই এলসা। কিন্তু কোথায় সেই হাড্ডিসার রুগ্ন মেয়েটি? যার চোখগুলো কোটরের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল? হাঁটতেই পারতো না ঠিকমত? এযে রীতিমত বলিষ্ট জলকন্যা! কি সুন্দর তেল চকচকে চামড়া, তীক্ষ্ম কিন্তু হাসিমাখা চোখের দৃষ্টি, উজ্জ্বল মুখ! মাত্র কিছু ঘণ্টা আগের এলসাকে চেনার জো নেই!

সাঁতরে আসা ক্যাপ্টেন টমাসকে দেখে ডলফিনের পিঠে সওয়ার হওয়া এলসা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “তুমি উঠে গেছো? দেখেছো? সত্যি সত্যি মা তিমির সেই অজানা জায়গায় আমরা এসেছি। আকাশের দিকে দেখো? নীল আকাশ ছাড়াও আবছা ভাবে গ্রহগুলো দেখতে পাবে!”
টমাস পানিতে স্বাভাবিক হতে হতে আকাশের দিকে তাকায়। আসলেই, সে খেয়াল করেনি নীল আকাশের মাঝে আবছা ভাবে ফুটে আছে একে একে মঙ্গল, শনি, বৃহস্পতি! কি আশ্চর্য আর বিস্ময়কর দৃশ্য এটা! শেষ রাতের দিকে এই গ্রহগুলো পরিষ্কার দেখা যাবার কথা। তার মানে হাকিম সাহেব সত্যি বলেছিলেন! মা তিমির রাজ্য এটা?
কিন্তু সেই মা তিমি কোথায়? এদিক ওদিক তাকালো। এলসা ফিক করে হেসে দিল, “কাকে খুঁজছ তুমি? শ্বেত তিমিকে?”
টমাস বিহ্বলের মত মাথা নাড়ায়। এলসা হেসে হাত তুলে নিচের দিকে তাক করে দেখায়। টমাস ভাসতে ভাসতে নিচের দিকে তাকানো মাত্র জমে যায়।
অন্যান্য দ্বীপের মত এই দ্বীপটার তলদেশ সাগরের সাথে ঢালু ভাবে নেমে যায়নি। একেবারে খাঁড়া পর্বতের মত নেমে গেছে নিচে। যার কারণে সৈকত থেকে মাত্র শ’খানেক মিটার দূরেই গভীর খাদ পানির নিচে। বোঝা যাচ্ছে এই দ্বীপটা কোনো এক সময় উঁচু পর্বতের মত ছিল। কালের বিবর্তনে সমুদ্রে ডুবে গেছে। মাথার ওপরের খাঁড়া সূর্যের আলো সোজা নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। সেই আলোতে ক্যাপ্টেন টমার দেখতে পেল- ওদের থেকে খুব বেশি হলে পঞ্চাশ-ষাট ফিট নিচে আবছা নীল অন্ধকারের মাঝে বিরাটাকায় শাদা মা তিমি মাছটা ডুবে আছে চুপচাপ। নড়ছে না একদমই। শুধু পানির নিচথেকে বিচিত্র গুমগুম করে হুইসেলের মত শব্দ হল। মিশে গেল পানিতে।
খিলখিল করে হাসতে হাসতে এলসা বলল, “ও কি বলেছে জানো?”
“ন-নাহ। আপনি ওর কথা বুঝতে পারছেন?”
“হ্যাঁ। সেদিন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই সব বুঝতে পারছি। জেগে দেখি আমি সমুদ্রে ভাসছি। আমার গা ঘেষে এই বিশাল মা তিমিটা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। আমাকে একটা ডানার ওপর শুইয়ে রেখেছে। না পানিতে ছাড়ছে, না একেবারে বাতাসে তুলে দিচ্ছে। ঠিক মানুষের মতই কথা বলছে।“
ক্যাপ্টেন টমাস হকচকিয়ে তাকালো, “সেদিন মানে? আমরা কখন থেকে এখানে আছি?”
“তুমি পাক্কা আড়াই দিনের বেশি ঘুমিয়েছো জাহাজের ডেকে। আমি ইচ্ছে করে জাগাইনি। ভাবলাম সুস্থ হও। আমাকে নিয়ে মা তিমি সাগরের অনেক গভীরে গিয়েছিল। কত্ত কি সে দেখে এলাম। লক্ষ কোটি মাছ, সামুদ্রিক জীব। আমি জানতামই না যে সাগরের নিচে এতকিছু থাকতে পারে!” এলসা হাত দিয়ে একটা ডলফিনকে ইশারা করা মাত্র সেটা গিয়ে টমাসের নিচ থেকে ভেসে উঠল। টমাস ওটার পিচ্ছিল পিঠে তাল সামলাতে সামলাতে বেশ খানিকক্ষণ কসরত করল।
“মা তিমিটা কি বলেছে আপনাকে?”
“আমাকে কিছু বলেনি এখন। জিজ্ঞেস করেছে তুমি সুস্থ হয়েছো কিনা? মাথায় ব্যথা আছে কিনা?” এলসা সহজ গলায় বলল।
ক্যাপ্টেন টমাস অদ্ভুত দৃষ্টিতে ডলফিনের পাশ থেকে গলা বাড়িয়ে নিচের বিরাটাকায় তিমির ছায়াটার দিকে তাকালো। “আসলেই এটা জিজ্ঞেস করেছে?” যেন এলসার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।
“হ্যাঁ। সত্যি বলছি। আমি ওইদিন ঘুম ভাঙার পর থেকে সবার সব কথা বুঝতে পারছি।“ এলসা হাসতে থাকে। “প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভাবলাম মানুষ নাই, কে কথা বলে! মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি আমার। পরে বুঝলাম। অন্য ব্যাপার। মা তিমিটা আমাকে সত্যি বাঁচাতেই এসেছে। স্রষ্টা আমার প্রার্থনা শুনেছেন।“
টমাস নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এলসা হাত বাড়িয়ে আরেকটা ডলফিনের পিঠে হাত রেখে বলল, “টুনু, সাগরের নিচ থেকে আমার আর ক্যাপ্টেন টমার জন্য দুটো ফুল তুলে আনবে?”
সঙ্গে সঙ্গে সেই ডলফিনটা মাথা ডুবিয়ে পানির নিচে হারিয়ে গেল। ফিরল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই। সত্যি সত্যি মুখের মধ্যে দুটো লাইকেনের মত কিছু ফুলের গাছ তুলে নিয়ে এসেছে! টমাসের দিকে সেগুলোর একটা তুলে বাড়িয়ে দিল এলসা। বিহ্বল টমাস হাত বাড়িয়ে নিল।


দেখতে দেখতে টমাস এবং এলসা সেই সবুজ দ্বীপে বেশ কিছুদিন খুব আনন্দে কাটিয়ে দিল। দ্বীপের মিষ্টি ফল, পাখির ডিম আর সাগরের গভীরের খুব সুস্বাদু উদ্ভিদ খেয়ে ভালই দিন যাচ্ছিল। সাধারণত তিমিরা গভীর সমুদ্রের মাছ। দ্বীপের আশেপাশে খুব একটা আসে না। তবে এই দ্বীপটার ভৌগলিক অবস্থান আর গড়ন অন্যান্য দ্বীপ থেকে আলাদা। ডাঙার অংশটা বাদ দিলে দ্বীপটার চারপাশ খুব অল্প দূরত্বেই অনেক বেশি গভীর। যার কারণে মা তিমি সহ বাকি তিমিরা এই এলাকাতে এসে ঘুরে বেড়ায়। ক্যাপ্টেন টমাস লক্ষ করেছে এখানে কেবল মা তিমিটাই সব সময় থাকে। বাকি বাচ্চা তিমিগুলো সমুদ্রের নানান দিকে ছড়িয়ে থাকে।

হঠাৎ হঠাৎ মা তিমিটাকে দেখতে আসে। ডলফিনের অভাব নেই। তাদের কাছে ক্যাপ্টেন টমাসও বন্ধুর মত হয়ে গেছে এই কয়েকদিনে। আর এলসা তো প্রায়ই মা তিমির সাথে গভীর রাতে বেরিয়ে পড়ে বহুদূরের অজানা এলাকায় ঢুঁ মারতে। কত শত জিনিস যে ওর শেখা হয়েছে বলার বাইরে। মা তিমি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে এলসার সাথে। মাঝে মাঝে রসিকতাও করে। এলসা হাসতে হাসতে পানিতে পড়ে যায়।
“আচ্ছা মা, তোমার ছানাপোনা কত্তগুলো?” এলসা জিজ্ঞেস করে।
“হিসাব তো করিনি। এই ধরো হাজার খানেক?” সাঁতার কাটতে কাটতে বলে মা তিমি।
“এত্তগুলো! সবার নাম মনে আছে তোমার?”
“আমাদের তো নাম রাখার নিয়ম নেই। আমরা গন্ধ আর সুর দিয়ে মনে রাখি সবাইকে।“
“তুমি গান জানো?”
“অনেক!”
“কি গান জানো?”
“জলের নিচে গানের জাহাজ, সুরেই বাঁধি সব,
হাজার ছানা আমার যত করছে কলরব!
ডিগবাজি দেয়, খেলতে থাকে, নীল ফোয়ারায় ডাকে,
এত্ত ছানা সাগর জুড়ে, সবকি মনে থাকে!”

“বাহ! তোমার গানের গলা তো ভীষণ সুন্দর! ইশ আমিও যদি তোমার মত এত সুন্দর করে গাইতে পারতাম।” এলসা আফসোস করে বলে।
মা তিমিও হাসির শব্দ করে সাঁতার কাটতে থাকে এলসাকে নিয়ে। দেখতে দেখতে এলসা সাঁতারে অনেক দক্ষ হয়ে ওঠে। শ্বাস না নিয়েও পানির নিচে অনেকক্ষণ ডুবে থাকতে পারে। এমনকি টমাসের মত ঘাঁঘু সাঁতারুও এলসার সাথে আর সাঁতারে পেরে ওঠে না। মেয়েটা যতই দিন যেতে থাকে, আশ্চর্যজনক ভাবে ডাঙ্গা আর পানিতে একই ভাবে থাকা শুরু করে। পানির নিচে শ্বাস নেয়া নিয়ে যেন চিন্তাই নেই। সাগরের গভীর থেকে গভীর তলদেশে ডুব দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর মণি মুক্তা তুলে আনে এলসা।
ক্যাপ্টেন টমাস ডাঙ্গায় তার জাহাজ মেরামত করতে থাকে দিনের পর দিন। দেখতে দেখতে জাহাজটাও দাঁড়িয়ে যেতে থাকে। এলসা ঝড়ের সময় ভেঙে পড়া মাস্তুল সহ অন্যান্য অনেক দরকারী জিনিস সাগরের নিচ থেকে তুলে এনে এনে জড়ো করতে থাকে টমাসের জন্য। অবশ্যই অন্যান্য জলজ প্রাণিদের সাহায্য নিয়ে।
ধীরে ধীরে দিন এগিয়ে আসতে থাকে, দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দেবার। ক্যাপ্টেন টমাস রাজকন্যা এলসাকে এক সন্ধ্যায় বলল, “আমরা আবহাওয়া দেখে কাল পরশু কিংবা দুই দিন পর রওনা দিতে পারি দেশের উদ্দেশ্যে। আপনি তো এখন অনেক সুস্থ। কি বলেন? ফেরা যাক?”

এলসা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল ক্যাপ্টেন টমাসের এই কথায়। কিন্তু কিছু বলল না। নিজের কেবিনে ফিরে গেল। ক্যাপ্টেন টমাসও নিজের রুমে চলে এলো। গভীর রাতে টমাস শুনতে পেল এলসা কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে। ঘুরতে বেরিয়েছে মা তিমিকে নিয়ে।


অবশেষে সেই দিন চলে এলো। জাহাজে উঠে দ্বীপের সামনে থেকে ক্যাপ্টেন টমাস এবং রাজকন্যা এলসা বিদায় নিল। দেশে ফিরতে হবে। অশ্রুশিক্ত চোখে এলসা জাহাজের ডেক থেকে বিদায় জানালো সাগরের সব ডলফিন, তিমি আর জলজ প্রাণিদের। কাঁদতে কাঁদতে হাত নেড়ে বলল, “আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমাদেরকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু আমি সারাজীবন তোমাদের মনে রাখবো। যদি পারি, আমি অবশ্যই ফিরে আসবো। আমাকে ভুলে যেও না।“
টমাস টের পেলেন সাগরের চারপাশে ঘিরে থাকা সব মাছগুলো করুণ সুরে শব্দ করছে, পাখনা ঝাপ্টাচ্ছে। বিশেষ করে ডলফিনগুলো শব্দ করছে, শিস দিচ্ছে করুণ ভাবে।
পাল তুলে দিলো টমাস। নোঙ্গর তুলে জাহাজের নাক ঘুরিয়ে রওনা দিল দেশের উদ্দেশ্যে। কে জানে কতদিন লাগে। দ্বীপ থেকে যা পেরেছে মিষ্টি পানি, ফল আর শস্য তুলে নিয়ে এসেছে। রাস্তার রসদ এগুলোই। বড় ঝড়ে না পরলে হয়।
সকাল বেলা জাহাজ ছেড়ে দ্বীপটা ফেলে চলে আসার সময় ক্যাপ্টেন টমাস দূরবীণে একটা নতুন ধরণের জাহাজ দেখতে পেল। দিগন্তের একেবারে কিনার ঘেষে জাহাজটা যাচ্ছে। পতাকাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে চেনা চেনা মনে হল। ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করল, এই জাহাজটা কাদের? দেখতে তো ব্যবসায়ী পণ্যবাহী জাহাজের মত লাগছে না। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা নিয়ে আর ভাবলো না। হুইল হাউসে গিয়ে জাহাজের নাক ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ভুলে গেল সেই জাহাজটার কথা।

রাত নামার পর ভাল জায়গা দেখে নোঙ্গর ফেলে ক্যাপ্টেন টমাস আর এলসা ঘুমিয়ে গেল যার যার কেবিনে।
গভীর রাতে এলসা ঘুমের মাঝে চিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে। পাশের রুম থেকে টমাস ছুটে আসে ওর কেবিনে।
“কি হয়েছে রাজকন্যা? ভয় পেয়েছেন স্বপ্ন দেখে?”

এলসা উন্মাদের মত দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে আসে গলুইয়ের দিকে। অন্ধকার দিগন্তের একটা দিকে আলোকিত হয়ে আছে। কি ঘটেছে বোঝা যাচ্ছে না। এলসা টমাসের দিকে তাকিয়ে কান্না ভাঙা গলায় বলে, “ওদের মেরে ফেলছে! ওদের মেরে ফেলছে!”
ক্যাপ্টেন টমাস স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে দিগন্তের দিকে। দীর্ঘদিনের তিমি শিকারীর নজর ভুল হতে পারে না। বারুদের ফ্ল্যাশ ফায়ার করা হচ্ছে অনবরত দিগন্তের ঐদিকটায়। হারপুণ দিয়ে তিমি শিকার করার সময় এভাবে রাতের আকাশে আতস বাজির মত লাল ফ্ল্যাশ ফায়ার করে চারদিক আলো করে ফেলা হয় যেন তিমি শিকার করতে সুবিধা হয়। মা তিমির দ্বীপটার দিক থেকেই আলোটা ক্ষিণভাবে ভেসে আসছে…
সকালের সেই জাহাজটা তাহলে তিমি শিকারী জাহাজ ছিল। আর পতাকাটাও এখন বুঝতে পারছে; তাদের রাজার পতাকা। রাজা নিজেই পাঠিয়েছে সবচেয়ে বড় তিমিকে মারার জন্য। টমাস কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলসা পানিতে ঝাঁপ দিল। আবছা অন্ধকারের মাঝেও দেখা গেল দুটো ডলফিন এসে দাঁড়িয়ে আছে ওদের জাহাজের গোড়া ঘেষে। একটার পিঠে এলসা উঠে বসেছে। ক্যাপ্টেন টমাস দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। চট করে নিজের কেবিনে ফিরে দুটো পিস্তল আর পানি নিরোধক বারুদের বাক্স নিয়ে নিলো। দৌড়ে এসে সেও পানিতে ঝাঁপ দিলো। এই এক মাসের অভ্যাসে ডলফিনের পিঠে চড়াটা আয়ত্ব করে ফেলেছে। ডলফিনের ওপর ওঠা মাত্র নিঃশব্দে টান দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটতে থাকলো ওরা। জাহাজের চেয়েও অনেক অনেক দ্রুত সেই দ্বীপের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

এলসা যতক্ষণে দ্বীপের দিকে এগিয়েছে বিশাল জাহাজ আর অনেকগুলো ছোট ছোট বোট থেকে হারপুণ মেরে গেঁথে ফেলা হয়েছে মা তিমিকে। ও চিৎকার করে পানিতে ঝাঁপ দেয় ডলফিনের ওপর থেকে।

টমাস দ্রুত হাতে পিস্তল বের করে বোটে দাঁড়িয়ে হারপুণ ছুঁড়তে থাকা নাবিকগুলোর দিকে গুলি করতে থাকে। দ্বীপ এখান থেকেও অনেক দূরে। মা তিমি গভীর পানির দিকে থাকতো। এখানেই এসে হারপুণ ছুঁড়েছে সবাই। পানির ওপর ভাসিয়ে তুলেছে মা তিমিকে। ব্যথায় ছটফট করে লেজ দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে চারদিকে মা তিমি। কিন্তু কয়েকশো হারপুণ এর মধ্যেই গেঁথে ফেলেছে। জাহাজ আসলে একটা না। আরো তিনটা জাহাজ এসে হাজির হয়েছে চারদিক থেকে। এই তিনটার প্রতিটা জাহাজই খুব ভাল করে চেনা ক্যাপ্টেন টমাসের। সবগুলোই তার জাহাজ। রাজা পাঠিয়েছে মা তিমিকে মেরে নিয়ে যেতে। শুধু নতুন জাহাজটা চেনা ছিল না। সম্ভবত এই এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠিয়েছিল। এরপর খবর পাঠিয়ে বাকি জাহাজগুলো ডেকেছে।
ক্যাপ্টেন টমাস চিৎকার করে নিজের ক্রুদের ডাকতে থাকে, “এলভিন, রবিন? তোমরা হারপুণ মারা থামাও! মা তিমিকে মেরো না! ও রাজকন্যাকে বাঁচিয়েছে…”
কিন্তু নিজের এতদিনের ক্রু কেউই তার কোনো কথা শুনছে না। বাধ্য হয়ে গুলি করতে থাকে টমাস। প্রত্যুত্তরে নিজেও আচমকা গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। বুকের বা দিকে গুলিটা লেগেছে। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিল। কিন্তু ফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ার সাথে সাথে কাশতে কাশতে জেগে উঠল। চারদিক থেকে মা তিমির গায়ে উঠে যাচ্ছে বিশ ত্রিশজন পোঁচার। লম্বা লম্বা ধারালো ছুরি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই পেটের একপাশে চিড়ে ফেলতে শুরু করলো। রাতের অন্ধকারে লেজের বাড়ি দিয়ে কয়েকটা বোট খরখুটোর মত উড়িয়ে দিল মা তিমি। কিন্তু নিস্তেজ হয়ে আসছে দ্রুত। এত এত হারপুণ উপেক্ষা করার শক্তি নেই তার।
টমাস পাগলের মত এদিক ওদিক এলসাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু দেখতে পায় না। বুকের গুলিটা প্রায় নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে। দূর্বল হয়ে আসছে ক্রমশ। টমাস সাঁতরেও ভেসে থাকতে পারছে না। পানিতে ডুবে যাচ্ছে বার বার। কিন্তু ভাসতে ভাসতে মা তিমির গায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পানি ভরে গেছে মা তিমির রক্ত দিয়ে। সেই রক্ত ভেসে এসে টমাসের গায়ে লাগছে।
টমাস আচমকা শুনতে পেল মা তিমিটা ওর দিকেই তাকিয়ে বলছে, “এদিকে এসো না। তুমি পালাও। তোমাকেও মেরে ফেলবে। রাজকন্যাকে নিয়ে পালাও।"
টমাস নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। কে বলেছে বোঝার জন্য। কিন্তু এই অন্ধকারেও টের পায়, হারপুনে গাঁথা মা তিমিটার চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। সেই চোখে অনেক কিছু রয়েছে। মমতা, করুণা, হতাশা…

এলসাকে দেখতে পায় টমাস, পানির নিচ থেকে পুরো সাগরের সব ডলফিন, তিমি, হাঙ্গর, ইল, স্কুইডের দল নিয়ে বিস্ফোরণের মত উঠে আসছে গভীর তলদেশ থেকে। টমাস সরে যাবার সুযোগ পেল না, মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার সামুদ্রিক প্রাণি লাফ দিয়ে জাহাজের পাল, মাস্তুল আর জাহাজের খোল সব ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। চোখের পলকে সব নাবিক হারিয়ে গেল পানির ভেতর। হাঙর এসে পা কামড়ে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল পানির নিচে।
সবকিছু ঘটল যেন মাত্র সেকেণ্ডের মধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চার চারটা বিরাট জাহাজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে গেল। ডুবে যেতে থাকে সব বোট আর জাহাজ। একটা নাবিকও আস্ত থাকলো না। শেষ মুহূর্তেও অনেকগুলো গোলাগুলির আওয়াজ হল। শেষ চেষ্টা দিয়ে রুখে দিতে চেয়েছিল বোধহয় এই সামুদ্রিক জীবের ঝড়টাকে। কিন্তু লাভ হল না।
টমাস ঝাপসা চোখে এলসাকে খুঁজতে থাকে পানিতে। আগুন জ্বলছে আধো ডুবন্ত জাহাজের গায়ে। সেই লালচে আলোতে শুধু মা তিমিকে ঘিরে সব প্রাণিগুলোর জড়ো হওয়া চোখে পরে। এলসাকে দেখা গেল। একটা ভাঙা বোটের খোলে দাঁড়িয়ে মা তিমিটার গায়ের সাথে গাল মিলিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। টমাস চোখে ভুল দেখছে কিনা বুঝতে পারলো না, এলসার পিঠের জামা ভিজে তিনটা বড় বড় রক্তের ধারা নেমে আসছে… গুলি খেয়েছে ও। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করছে।
শত শত হারপুনে গেঁথে থাকা মা তিমিটা ধীরে ধীরে পানির নিচে হারিয়ে যেতে থাকে। ওর পেট চিড়ে ফেলেছিল অনেকটাই ঐটুকু সময়ে। রক্তে সাগরের ঐ অংশ পুরোটা লাল হয়ে উঠেছে। এলসা মা তিমির গায়ে বেঁধা একটা হারপুণ ধরে ঘুরে ফিরে তাকায় ক্যাপ্টেন টমাসের দিকে। “পৃথিবীর মানুষদের জানিও, মানুষ খুব অকৃতজ্ঞ আর লোভী প্রাণি। আমি এমন পৃথিবীতে ফিরতে চাই না যেখানে স্বার্থলোভী মানুষে ভরে আছে। বিদায় ক্যাপ্টেন… আমি আপনাকে মনে রাখবো একজন ভাল মানুষ হিসেবে।” মা তিমির সঙ্গে সঙ্গে হারপুনের মাথা ধরে এলসাও ডুবে গেল সাগরের মাঝে।
টমাস কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। চোখ বন্ধ হয়ে যায় তার।“

“এরপর কি হল বাবা? ক্যাপ্টেন টমাস কি মারা গেলো?” আরীবা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল।
“এরপরের অংশটা খুব ঘোলাটে একটা গল্প। শোনা যায়, অনেক আগে মধ্যবয়েসী একজন অবসর প্রাপ্ত নেভীর ক্যাপ্টেন ছিল যে কিনা তার দেশের অত্যাচারী রাজাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিল রাজ্যের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু নিজে কোনোদিন সিংহাসনে বসেনি। বাকি জীবন ছোট ছোট বাচ্চাদের সাঁতার শেখানো আর নৌকা বানানোর কাজ করে কাটিয়েছে। তিমি হত্যা থামানোর জন্য পাহাড় খুঁড়ে কয়লা খুঁজে বের করা ধরেছিল যেন জ্বালানীর অভাব না হয়। সেটা যে ক্যাপ্টেন টমাস, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার হতেও পারে।

তারও কয়েকশো বছর পরের এক ঘটনা। আটলান্টিক মহাসাগরের কোনো একটা জায়গায় ঝড়ের মাঝে গভীর রাতে এক যাত্রীবাহী জাহাজ বিপদে পড়ে। বরফের চাঁইয়ে ধাক্কা খেয়ে উলটে যেতে নিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে বিশাল এক শাদা তিমি পানির নিচ থেকে উঠে এসে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে জাহাজটাকে সোজা করে ফেলেছিল। ওয়াচ টাওয়ারের ফ্লাড লাইটের আলোয় অনেকেই নাকি দেখেছে সেই তিমির পিঠে একটা সবুজ, জলজ পোশাক পরা তরুণী দাঁড়িয়ে রয়েছে। মারমেইড না, পা আছে ঠিক মানুষের মত, জটলা পাকানো চুলে রঙিন জলজ ফুল দিয়ে সাজানো। খুব অল্প সময়ের জন্যই তিমিটা মেয়েটাকে নিয়ে ভেসে উঠেছিল। পরক্ষণেই ডুবে যায় গভীর অন্ধকার সমুদ্দুরের ভেতর।" একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিন ছেলেমেয়ের দিকে তাকালাম। জিহান হা করে ঘুমে যোগ দিয়েছে অরোরার সাথে। সহজ আর আরীবা কাঁদছে।
“ওমা! কাঁদছিস কেন তোরা? ইন্ডিং তো স্যাড না। একটু ঘোলাটে রেখেছি আরকি। নিজের মত করে বুঝে নিবি।”
“মানুষ আসলেই অনেক লোভী। খারাপ।“ সহজ বলল।
“সব মানুষ খারাপ না। পৃথিবীতে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি। খারাপ মানুষের সংখ্যা কম। নাহলে পৃথিবী এতকাল টিকে থাকতো না।“
“কই? ভাল মানুষের কথা তো শুনি না বাবা। এত ভাল মানুষ যদি থাকে, মানুষ এত কষ্টে কেন থাকবে?" আরীবা আবার চোখ মুছে বলল।
আমি হাসতে থাকি। “মানুষ কষ্টে থাকলেও একে অন্যকে সাহায্য করে সেই কষ্ট কাটিয়ে ওঠে। দুঃখ ভাগ করে নিতে হয়। ভাল মানুষেরা দুঃখ ভাগ করে নিতে জানে বলেই পৃথিবীটা চলছে। প্রতিদিন সকাল হয়, সূর্য ওঠে, রাত্রী নামে। চাঁদ ওঠে। জ্যোৎস্না হয়… তোরা এখনো ছোট তো, তাই এরকম মন খারাপ লাগছে তোদের। বেশি গম্ভীর গল্প বলে ফেলেছি। এখন কান্নাকাটি বন্ধ। কাল সকালে স্কুল আছে না? ঘুম দে এখন।”
“কিন্তু বাবা আমাদের গল্প শুনতে ভাল লাগছে। তুমি আরো একটা গল্প শোনাও না?” আরীবা মিনতির সুরে বলল।
“উহু। ঘড়ি দ্যাখ। রাত হয়েছে অনেক। যদি ঠিক ঠাক কাল সকালে উঠে স্কুলে যাস তোরা, তাহলে কাল রাতে আবার গল্প শোনাবো।“
নোভা পাশ থেকে টিপ্পনি কেটে উঠল, “বাব্বা! ছেলে মেয়েদের জন্য আরব্য রজনীর হাজার কেসসা! এত গল্পের স্টক আছে তোমার?”
“কালকে সারাদিন তো সময় থাকবে চিন্তা করে বের করার যে কি গল্প বলা যায়।“ হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলাম নোভার কথা। সহজ আর আরীবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আজকে ঘুম দিলে কাল আবার গল্প হবে। ওকে?”
আরীবা সাথে সাথে বলে উঠল, “ওকে বাবা! কাল কিন্তু অবশ্যই গল্প শোনাবে। ভুলে গেলে চলবে না।“
হাসলাম। “ভুলে গেলে মনে করিয়ে দিবি।"
সহজ আর আরীবা শুয়ে পড়ল বাকি দুটোর সাথে। ওদের মশারি গুঁজে দিয়ে আজকের মত নোভাকে নিয়ে চলে এলাম নিজেদের ঘরে।

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:৫৩

মহাজাগতিক চিন্তা বলেছেন: পড়ে শেষ করলে অনেকটা সময় কাটবে। আমি আপাতত দেখে শেষ করলাম।

২৯ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৮

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: ধন্যবাদ। পড়ে জানালে সত্যি আনন্দিত হব। শুভেচ্ছা।

২| ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:১১

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।
পড়তে মজা।

৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১৬

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই। ঈদের শুভেচ্ছা রইল। ঈদ মোবারাক।

৩| ৩১ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:২২

নকল কাক বলেছেন: খুব সুন্দর গল্প।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.