নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

www.oputanvir.com

অপু তানভীর

আমার চোখে ঠোঁটে মুখে তুমি লেগে আছো

অপু তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইস্টার আইল্যান্ড রহস্যময় মোয়াই

০২ রা মে, ২০২৫ রাত ৮:৪৩



১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় নাবিকদের মাঝে একটা মিথ প্রচলিত ছিল। মিথটা হচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধে ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে বিশাল অঞ্চল জুড়ে একটা মহাদেশ রয়েছে। এটাকে তারা টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটা (অজানা দক্ষিণ মহাদেশ) নামে ডাকত। এডওয়ার্ড ডেভিস নামে একজন ইংরেজ জলদস্যু ১৬৮৭ সালে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে একটি ভূখণ্ড দেখেছিলেন বলে দাবি করেন। তার দাবী করা এই ভূখণ্ডটি পরে ডেভিস আইল্যান্ড বা ডেভিস ল্যান্ড নামে পরিচিত লাভ করে এবং এটাকে টেরা অস্ট্রালিসের অংশ বলে ধারণা করা হয়। ১৮শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি এই অজানা ভূখণ্ড খুঁজে বের করার জন্য অনেক অভিযান পাঠানোর পরিকল্পনা করে। সেগুলোর ভেতরেই একটা অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিল জ্যাকব রোগেভিন।

১৭২১ সালে জ্যাকব ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থায়নে তিনটি জাহাজ—আরেন্ড, থিয়েনহোভেন, এবং আফ্রিকান গ্যালি—নিয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অভিযান শুরু করেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ডেভিস আইল্যান্ড বা টেরা অস্ট্রালিস খুঁজে বের করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জ্যাকব সেই আইল্যান্ড আর খুজে বের করতে পারে নি। তবে সে অন্য আরেকটি আইল্যান্ড খুজে পায়।


১৭২২ সালের ৫ এপ্রিল, ইস্টার সানডের দিন রোগেভিন এবং তার দল প্রশান্ত মহাসাগরে ছোট এক দ্বীপে এসে পৌঁছান। তারা দ্বীপটির নাম রাখেন “ইস্টার আইল্যান্ড” কারণ তারা এটি ইস্টার দিনে আবিষ্কার করেছিলেন। তবে, সেই সময়ে রোগেভিন মনে হয়েছিল যে এটিই সেই ডেভিস আইল্যান্ড বা টেরা অস্ট্রালিসের অংশ হতে পারে। এমনটা মনে হওয়ার পেছনে তার মূল কারণ ছিল দ্বীপে সেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অদ্ভুত পাথরের মূর্তি। এই মূর্তিকে মোয়াই বলে।

প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত জ্যাকব রোগেভিনের আবিস্কার করা ইস্টার আইল্যান্ডের স্থানীয় রাপা নুই। বর্তমানে এই ইস্টার আইল্যান্ড চিলির মালিকানাধীন একটি দ্বীপ। বিশ্বের সবচেয়ে জনবিচ্ছিন্ন বসতিগুলোর মধ্যে এই দ্বীপটি অন্যতম। সবথেকে কাছের মানুষ্যবাস প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার দূরে। আগ্নেওগিরির অগ্নিৎপাত থেকে সৃষ্ট এই দ্বীপের আয়তন মাত্র ১৬৩.৬ বর্গকিলোমিটার। পাথরের মোয়াই ছাড়া এই দ্বীপে উল্লেখযোগ্য আর কিছুইই নেই। এই মোয়াই বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় এবং দৃষ্টিনন্দন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর একটি। এই বিশাল মূর্তিগুলো কীভাবে নির্মিত হয়েছিল, কেন নির্মিত হয়েছিল এবং কীভাবে পরিবহন করা হয়েছিল, তা আজও প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে গবেষণা ও বিতর্কের বিষয়। কেউ এর পেছনের সঠিক কারণ খুজে বের করতে পারে নি।

ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে ইস্টার আইল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম বিচ্ছিন্ন স্থান। দ্বীপটি দেখতে ত্রিভুজাকার। রানো কাও, পুনা পাও এবং রানো রারাকু নামের তিনটি প্রধান আগ্নেয়গিরি দ্বারা গঠিত। এই আগ্নেয়গিরিগুলো দ্বীপের ভূ-প্রকৃতি এবং মোয়াই নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রানো রারাকু আগ্নেওগিরিটাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এর ভেতরেই বেশিরভাগ মোয়াই তৈরি হয়েছিল।


আগেই বলেছি যে এই উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নেই। প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। তবে এই দ্বীপে এক সময় ঘন বন ছিল বলে ধারণ করা হয়। এই বন থেকে আসা কাঠ দিয়ে মোয়াই নির্মাণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া আরেকটা ধারনা হচ্ছে অতিরিক্ত বন উজাড়ের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে এবং এর ফলেই রাপা নুই সভ্যতার পতন ঘটে।

এবার আসি মোয়াই প্রসঙ্গে। মোয়াই হল পাথরের মূর্তি। এই মূর্তিগুলো মানুষের মুখের আদলে তৈরি করা। তবে একেবারে হুবাহু মানুষের মুখের মত নয়। মোয়াইয়ের মাথা অতিরিক্ত বড়, চওড়া ও মোটা নাক, চোখের গর্ত থাকে গভীর কিন্তু সে তুলনায় শরীর ছোট। বেশিরভাগ মোয়াইয়ের হাত বুকের কাছে এক সাথে থাকে। মূর্তিগুলোর মুখের দিকে মনে হবে যেন তারা খুব গম্ভীর আর রেগে আছে। মূর্তিগুলোর গড় উচ্চতা প্রায় ৪ মিটার, তবে কিছু কিছু মোয়াই ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ওজনের দিক থেকে এগুলো ১০ থেকে ৮০ টন পর্যন্ত হতে পারে। সবচেয়ে বড় মোয়াইয়ের ওজন প্রায় ২৭০ টন। এটা এখনও রানো রারাকুতে রয়েছে। এই মূর্তিগুলো প্রধানত টাফ নামক ভলকানিক ছাই এবং ব্যাসল্ট পাথর দিয়ে তৈরি। কিছু মোয়াইয়ের মাথায় পুকাও নামক লাল পাথরের টুপি রয়েছে। এই পুকাওকে সম্ভবত মর্যাদা বা ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে ধরা হত। পুকাওগুলো পুনা পাও আগ্নেয়গিরি থেকে সংগ্রহ করা হতো এবং মোয়াইয়ের উপর স্থাপনের জন্য আলাদা ভাবে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হত। প্রাচীনকালে মোয়াইয়ের চোখের গর্তে প্রবাল বা অন্য উপাদান দিয়ে তৈরি চোখ বসানো হতো। ফলে এগুলো দেখতে অনেকটা জীবন্ত মনে হত।


মোয়াই নির্মাণের সঠিক সময়কাল নিয়ে কিছু মতভেদ থাকলেও, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে এগুলো সম্ভবত ১২০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এই সময়ে রাপা নুই সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করে। পুরো দ্বীপ জুড়ে মোট প্রায় ৮৮৭টি মোয়াই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এদের ভেতরে অনেকগুলো মোয়াই আহু নামক পাথরের প্ল্যাটফর্মের উপর স্থাপিত। আহুগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হত। একটা অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ মোয়াই সমুদ্রের দিকে মুখ করে নয় বরং দ্বীপের গ্রামের দিকে মুখ করে বসানো হয়েছে। এর থেকে ধারণা করা হয় যে মোয়াইগুলো গ্রামের রক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করত।

মোয়াই কেন তৈরি হয়েছিল এটা নিয়ে এখনও সঠিক ব্যাখ্যা নিশ্চিত করে জানা যায় নি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিভিন্ন তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। সবচেয়ে সাধারণ তত্ত্বটা হল, এই মোয়াই সেই সময়ে পূজার অংশ ছিল। রাপা নুই সমাজের মানুষদের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভাব রয়েছে। ধারনা করা হয় যে এই মোয়াইগুলো তাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা নেতাদের আদলে তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময়ে রাপা নই সমাজে বিশ্বাস ছিল যে এই মূর্তিগুলো তাদের পূর্ব পুরুষদের আত্মার শক্তি বা মানা ধরে রাখতে পারে। এই মানা হচ্ছে এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি। এটি রাপা নুই সমাজের শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির জন্য দরকারি বলে বিবেচিত হতো। এছাড়া, মোয়াই নির্মাণ করা সামাজিক প্রভাব প্রতিপ্রত্তি প্রদর্শনের একটি উপায় হিসাবেও বিবেচিত হত। বিভিন্ন গোষ্ঠী বা উপজাতি তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ দেখানোর জন্য বড় এবং জটিল মোয়াই তৈরি করত। কিছু গবেষক মনে করেন, মোয়াই নির্মাণে ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগুলো একে অন্যের সাথে একধরনের প্রতিযোগিতা লিপ্ত হত।

সেই সময়ে মোয়াই তৈরি করাটা কঠিন ছিল। বেশিরভাগ মূর্তি রানো রারাকু কোয়ারিতে খোদাই করা হতো। এই কোয়ারিতে প্রায় ৪০০টি অসম্পূর্ণ মোয়াই রয়েছে। ধারণা করা হয় যে নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে কোন কারণে এগুলো পরিত্যক্ত করা হয়েছিল। শ্রমিকরা পাথরের হাতুড়ি, ব্যাসল্টের ছেনি এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে মূর্তিগুলো খোদাই করত। একটি মোয়াই তৈরি করতে কয়েক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারত। খোদাইয়ের পর মূর্তিগুলো কোয়ারি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নির্ধারির স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু কিভাবে যে এই মোয়াইগুলো এতো দুরে পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হত সেটার কোন স্পষ্ট ধারনা আজও কেউ বের করতে পারে নি। সেই সভ্যতার সীমিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে এত ভারী পাথরের মূর্তিগুলো পরিবহন করা হত তা সত্যিই রহস্যময়। তবে এটা নিয়েও অনেক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে।

একটি জনপ্রিয় তত্ত্বটা হল, মোয়াইগুলো কাঠের লগ বা বেলন ব্যবহার করে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। এই পদ্ধতিতে প্রচুর কাঠের প্রয়োজন হতো। এটিকে দ্বীপের বনাঞ্চল ধ্বংসের একটি কারণ হিসাবে ধরা হয়। আরেকটা ধারণ হচ্ছে মূর্তিগুলোকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। কিভাবে হাটানো হত সেটার একটা ভিডিও নিচে দিলাম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির এই ভিডিওটাতে সব পদ্ধতি বেশ ভাল করে দেখানো হয়েছে। আপনারা দেখতে পারেন।

নিচের এই ভিডিওটা বাস্তবে দেখা যাবে কিভাবে মোয়াই হাটছে।


পরিবহনের পর মোয়াইগুলো আহু প্ল্যাটফর্মের উপরে স্থাপন করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় মূর্তিগুলোকে উল্লম্বভাবে দাঁড় করানো এবং পুকাও স্থাপন করা কঠিন একটা কাজ ছিল। কোন সন্দেহ নেয় সেই সময়ে তাদের কাছে যথেষ্ঠ কারিগরি জ্ঞান ছিল।

১৮শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা যখন এই দ্বীপে হাজির হয়, সেই সময়ে রাপা নুই সভ্যতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। ইউরোপীয়দের আগমন এবং এরপরে রোগ, দাস ব্যবসা এবং সাংস্কৃতিক ধ্বংসের কারণে রাপা নুই জনগোষ্ঠী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে দ্বীপের জনসংখ্যা কয়েকশ জনে নেমে আসে।


মোয়াইয়ের রহস্য এবং ইস্টার আইল্যান্ডের ইতিহাস ২০শ শতাব্দীতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নরওয়েজিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক থর হেয়ারডাল ১৯৫৫-৫৬ সালে দ্বীপে ব্যাপক গবেষণা পরিচালনা করেন। এর ফলেই মোয়াই এবং রাপা নুই সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানতে পারে। সেই সময়ে হেয়ারডাল একটা মোয়াই তার আগের জায়গায় স্থাপনের কাজে হাত দেয়। এতে করে এই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যায় যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় এই কাজ সম্ভব। পরবর্তী দশকগুলোতে আরও অনেক মোয়াই পুনরুদ্ধার করা হয় এবং তাদের আসল আহুতে পুনঃস্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় রাপা নুই জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্ত্বিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৫ সালে রাপা নুই ন্যাশনাল পার্ক ইউনেস্কো বিশ্ব হেরিটেইজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

বর্তমানে মোয়াই এবং ইস্টার আইল্যান্ড পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক দ্বীপে আসেন মোয়াই দেখতে এবং রাপা নুই সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে। তবে, অতিরিক্ত পর্যটন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মোয়াই এবং দ্বীপের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং তীব্র ঝড়ের কারণে উপকূলবর্তী আহুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।


তথ্যসুত্র:
ইস্টার আইল্যান্ড - রহস্যে ঘেরা এক দ্বিপ
ইস্টার আইল্যান্ডের ‘মোয়াই’ মূর্তি
ইস্টার আইল্যান্ডের ‘পাহারাদার’ পাথুরে ‘মোয়াই’ মূর্তি
History of Easter Island
grok.com


মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মে, ২০২৫ রাত ৯:৩৪

মহাজাগতিক চিন্তা বলেছেন: পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।

০২ রা মে, ২০২৫ রাত ৯:৪২

অপু তানভীর বলেছেন: মন্তব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.