নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পিনাকীর ব্লগ

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য

পিনাকী ভট্টাচার্য

চিকিৎসক, লেখক। কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, আমাদের অর্থনীতি।

পিনাকী ভট্টাচার্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্লদ লেভি স্ট্রসের স্ট্রাকচারালিজম অনুপ্রাণিত অস্পৃশ্যতার উন্মোচনঃ আইজুয় যুক্তির মিথলজিক ভুত

২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:১৪

কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে, ব্লগে ইমরান খানের সাথে আমার একটা ছবি নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। ঠিক বিতর্ক বললে ভুল হবে, যেটা হচ্ছে সেটা একতরফা আক্রমণ। ছবিটা দেখে বোধ হয় সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছেন বাংলা ব্লগের কিংবদন্তি ডাক্তার আইজু। ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, বাংলাদেশে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের যুক্তির এক ধরণের সরল কাঠামো আছে, এই আক্রমণটা সেই কাঠামোর বাইরে নয়। আপনারা দেখবেন হাসানুল হক ইনুর সাথে নিজামির করমর্দনের ছবি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় জাসদের সাথে জামাতের মৈত্রী ছিল। ইনু সাহেব ও সেই ছবিটা নিয়ে যারপর নাই বিব্রত। কিছুদিন আগে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর সাথে টিক্কা খান আর গোলাম আজমের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু-টিক্কা খান বা গোলাম আজমকে এন্ডোর্স করছেন। যুক্তির এই সরল স্ট্রাকচার আমাদের মনোজগতে যেভাবে প্রোথিত হয়ে আছে সেটার প্রকৃতি নিয়ে আমাদের জানা বোঝার এবং ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেই আমার মনে হয়।



আদর্শিক সংঘাত এক জিনিস কিন্তু সেই আদর্শের ভিন্নতা সকল মানবিক যোগাযোগের মাঝে দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে দেয়া আরেক জিনিস। খেয়াল করলে দেখা যাবে ঠিক একই সংস্কৃতি আমাদের রাজনৈতিক চর্চাকেও দুষিত করে তুলেছে। মুল দল দুটোর নেত্রী পরস্পরের মুখ দর্শন করেন না। তাঁদের সমর্থকরাও সেই পথে হাঁটেন। তৈরি হয় আওয়ামী লীগ গ্রাম আর বি এন পি গ্রাম। তারা দুই ভিন্ন সেতুতে খাল পার হন। পরস্পরের ছোঁয়া বাচিয়ে চলেন সতর্কভাবে। এই আদর্শিক ভাবে বিরোধী মতের লোকদের মুখ না দেখাদেখির সংস্কৃতির মুল কোথায়?





এই অনুসন্ধানে আমরা সাহায্য নেবো ক্লদ লেভি স্ট্রসের এবং তার স্ট্রাকচার প্রত্যাশী নৃতাত্ত্বিক কাব্যের। ক্লদ লেভি স্ট্রস বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে প্রচলিত পৌরাণিক মিথ, লোকজ গল্পগাথা, যুগের পর যুগ চলে আসা নির্দিষ্ট অভ্যাস অথবা ভঙ্গী নিয়ে কাজ করে উনার স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদের তত্ত্ব হাজির করেছেন। প্রায় তিন দশক ধরে আমাজনের ইন্ডিয়ানদের জীবনাচরন ব্যাখা বিশ্লেষন করে দুনিয়ার যাবতীয় পৌরানিক কাহিনীগুলোর মধ্যে একটা সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য বা প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছেন। পৌরানিক মিথ ও প্রথার মৌলিক ধারনাকে তিনি বিশ্লেষন করে আবিস্কার করেছেন তার অন্তর্নিহিত বিন্যাস, তার অভ্যন্তরীন প্যাটার্ণ। যুক্তি দিয়ে বোঝা লোককল্প। ফলে নির্দ্বিধায় তিনি দাবী করেন যে কোন জাতিসত্ত্বার নিজস্ব চিন্তা সংস্কৃতি ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে তার ভাবনা মিথ বা কল্পকথা দিয়ে প্রকাশ করে।





আমরাও আমাদের মনোজগতে প্রোথিত যুগ যুগের অস্পৃশ্যবাদের প্রভাবেই এই সরল যুক্তির স্ট্রাকচারকে অবলীলায় যুক্তিগ্রাহ্য ডিসকোর্স হিসেবে গ্রহণ করি। বিশেষ করে এই ধরণের ছবি দিয়ে যুক্তি উত্থাপনের স্ট্রাকচারে। এই অস্পৃশ্যবাদ কী?



একসময় সাধারণ পৌর শহরগুলোতেই কিছু কিছু ভ্রাম্যমান নারী-পুরুষ দেখা যেত যাদের কোমরে অনিবার্যভাবে বাঁধা থাকতো একটি ঝাড়ু, আর গলায় বা কোমরে ঝুলানো থাকতো একটি টিনের মগ জাতিয় পাত্র। ঝাড়ুটি হলো তার পেশাগত প্রতীক বা পরিচয়। তাদের কাজ লোকালয়ের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে শহরটিকে পরিচ্ছন্ন রাখা। পেশাগতভাবে এরা পৌর-কর্তৃপক্ষের শুধু যে বেতনভুক কর্মচারী তা-ই নয়, সম্প্রদায়গতভাবেও এদের পেশাটা তা-ই। সামাজিক শ্রমবিন্যাস অনুযায়ী তাদের জন্য অন্য পেশা বরাদ্দ ছিলো না। তাই জন্মগতভাবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এ পেশাই তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। আর সাথের মগটি ছিলো তাদের সামাজিক অবস্থানের এক ভয়াবহ অস্পৃশ্যতার প্রতীক। অর্থাৎ সব ধরনের ছোঁয়াছুয়ির উর্ধ্বে থেকে অন্য কাউকে যাতে কোনরূপ অশূচি হবার বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্যেই এ ব্যবস্থা। পানির তেষ্টা পেলে কোন হোটেল বা চা-দোকানের বাইরে থেকে মগটা বাড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দোকানের কেউ হয়তো নিরাপদ অবস্থান থেকে ওই মগটিতে পানি ঢেলে দিতো। এমনকি কোন পাবলিক টিউবওয়েলে ছোঁয়ার ঝুঁকি না নিয়ে এরা অপেক্ষায় থাকতো দয়া করে কেউ যদি টিউবওয়েল চেপে কিছুটা পানি ঐ মগে ঢেলে দেয়। কিংবা টাকা দিয়ে দোকান থেকে চা খেতে চাইলেও চায়ের কাপ স্পর্শ করার অধিকার নেই বলে গরম চা ওই মগেই ঢেলে দেয়া হতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্য লোকজনের সাথে এক কাতারে বসার তো প্রশ্নই উঠে না! নিরাপদ দূরত্ব বাঁচিয়ে মাটিতে বসে পড়াটাই তাদের জন্য অনুমোদিত ব্যবস্থা। তারপরও তাদের ছোঁয়ায় ঐ স্থানটা নোংরা হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল থাকতো সবসময়। এরা হলো ধাঙড়, মেথর বা সুইপার। তাদের বসবাসের ব্যবস্থাও সেরকমই। ভদ্রপাড়া থেকে দূরে স্বতন্ত্র কোন বস্তি বা পল্লীতে এদের গোষ্ঠিগত বসবাস। এদের সংস্কৃতি ভিন্ন, জীবনধারা ভিন্ন, উৎসব-উদযাপন সবই ভিন্ন এবং অনিবার্যভাবে গোষ্ঠিগত।



এই অস্পৃশ্য শ্রেণীর উদ্ভব কিন্তু বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। এই শ্রেণীর উদ্ভবের সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতার রাজনীতি আর পরাজিতের দীর্ঘশ্বাস। এর মুল খুঁজতে হলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে ভারতে বহিরাগত আর্য আক্রমনের সময়ে। প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিলো না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও চালিয়েছিলো ব্যাপক আক্রমণ। আর এই আক্রমণেই ধ্বংস হয়ে যায় এসব আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যতা। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিকে দাসে পরিণত করার লক্ষে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠলো মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। এর মাধ্যমে যে সমাজ-কাঠামোর নির্মাণ যজ্ঞ চলতে থাকলো তার ভিত্তি এক আমানবিক চতুর্বর্ণ প্রথা। যেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইলো, এদেরকেই সুকৌশলে করা হলো অছ্যুৎ, দস্যু, সমাজচ্যুত বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়।



এইভাবে আদার বা অস্পৃশ্য করে ফেলার একটা রাজনৈতিক সুবিধা আছে। এর ফলে আদারের সমস্ত মানবিক সত্ত্বা কে মুছে ফেলা যায়, তখন তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার একটা নৈতিক বৈধতা তৈরি করা যায়। তাই বিজয়ী আর্যদের তৈরি করা আমাদের মনোজগতের স্ট্রাকচারে ভিন্ন মত মানেই আদার, অস্পৃশ্য।

ছবি দিয়ে দেয়া যুক্তিতেও সেই একই স্ট্রাকচার।



যার সমালোচনা কর >>সে মন্দ লোক>> সে অস্পৃশ্য>> তুমি তার সাথে ছবি তুলেছ>> তোমার জাত গেছে।



ইমরান খানের সাথে ছবির যুক্তিও একই স্ট্রাকচারের। ক্লদ লেভি স্ট্রস যেমন বলেন, যে কোন জাতিসত্ত্বার নিজস্ব চিন্তা সংস্কৃতি ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে তার ভাবনা মিথ বা কল্পকথা দিয়ে প্রকাশ করে। ঠিক একইভাবে আমাদের যুক্তির স্ট্রাকচারে সেই অস্পৃশ্যতার মিথলজিক ভুত। কিন্তু সেই অস্পৃশ্য বাদের স্ট্রাকচারে যুক্তি নির্মাণের সময় আমরা ভুলে যাই, আমাদের লড়াই হয়েছিলো পাকিস্থানের শাসক গোষ্ঠীর সাথে জনগনের সাথে নয়। পাকিস্থানের জনগণ আমাদের শত্রু নয়। বাঙ্গালীরা শাসকদের সাথে লড়াইটা করে জিতে গিয়েছিল, বালুচরা পারেনি। তবে পাকিস্তানের জনগণকে আদার বানিয়ে রাখতে পারলে দুদিকের শাসকের সুবিধাই। ভুল শত্রুর পিছনে শক্তিক্ষয় হলে তো আসল শত্রুই শক্তিশালী হয়।



ক্লদ লেভি স্ট্রসের এখানেই কৃতিত্ব, লোকজ স্থানীয় মিথ নিয়ে কাজ করার সময় ক্লদ লেভি স্ট্রসের মিথলজি হয়ে যায় মিথলজিক। আমাদের লজিক রূপ নেয় আমাদের ইতিহাসের মিথলজিক হাত ধরে। যেই মিথলজিক ইতিহাস বঞ্চনা আর পরাজয়ের এক মর্মস্পর্শী শোকগাথা। ছবি দিয়ে দেয়া সেই মিথলজিক যুক্তি যেখান থেকে উত্তরনের কোন পথের সন্ধান জানেনা।



কৃতজ্ঞতা ঃ ফরহাদ মজাহার, ক্লদ লেভি স্ট্রস, স্ট্রাকচার প্রত্যাশী নৃতাত্ত্বিক কাব্য।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২১

আগুনে পাখি বলেছেন: ব্লগের হেডিং পড়তে গিয়েই আমার দাঁত ভেঙে গেল :/

২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৫

পিনাকী ভট্টাচার্য বলেছেন: হেডিং টাই খটোমটো ভিতরে কিন্তু নয়, আগুনে পাখি।

২| ২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩৩

আগুনে পাখি বলেছেন: আপনার লেখা বেশ তথ্যবহুল... পড়ে আনন্দ পেলাম :)

২৩ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০২

পিনাকী ভট্টাচার্য বলেছেন: ধন্যবাদ আগুনে পাখি

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.