| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শ্রাবণধারা
" আমাদের মতো প্রতিভাহীন লোক ঘরে বসিয়া নানারূপ কল্পনা করে, অবশেষে কার্যক্ষেত্রে নামিয়া ঘাড়ে লাঙল বহিয়া পশ্চাৎ হইতে ল্যাজমলা খাইয়া নতশিরে সহিষ্ণুভাবে প্রাত্যহিক মাটি-ভাঙার কাজ করিয়া সন্ধ্যাবেলায় এক-পেট জাবনা খাইতে পাইলেই সন্তুষ্ট থাকে......."
গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও, ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শের বিপরীতে "গোরা" চরিত্রটি তৈরি করেন। গোরা খুব কট্টরপন্থী হিন্দু যুবক। হিন্দু পরিচয়ে বড় হলেও, আসলে সে আইরিশ দম্পতির সন্তান, কিন্তু এটা তার জানা নেই। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে ব্রিটিশ বিরোধিতা ও স্বদেশপ্রেমের ধারনাগুলো তুলে ধরতেই রবীন্দ্রনাথ গোরাকে গোঁড়া হিন্দুর ভূমিকায় দাঁড় করান। তবে গোরার গোঁড়ামি এবং গল্পের শেষে গোঁড়ামি মোচনের পেছনে ছিল রবীন্দ্রনাথের অসামান্য যুক্তিবোধ এবং বুদ্ধিবৃত্তি।
ইসলামপন্থীদের মধ্যে এরকম যুক্তিবুদ্ধির বালাই নেই। জামাতের পাকিস্তানপন্থি মতাদর্শ এত দুর্বল যে এগুলো আলোচনার যোগ্যই নয়। মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে তারা সলিমুল্লাহ খান বা বদরুদ্দিন উমরের নামে উদ্ধৃতি দেয়, যেগুলোর অধিকাংশই মিথ্যা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে জহির রায়হানের নামে গল্প বানায়। আবার ভারত বিরোধীতার নাম করে জগাখিচুড়ি মিলিয়ে কতগুলো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করে। যে ঘটনাগুলো ভারতীয় আধিপত্য হিসেবে আলোচনার কথা ছিল (যেমন: পানিবণ্টন চুক্তি, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের প্রত্যর্পণ, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্তে মাদক ব্যবসা এবং অসম বাণিজ্য চুক্তি ইত্যাদি), সেগুলো নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। ভারতকে বিরাট শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করে "গাজওয়াতুল হিন্দ" নামে আজগুবি গল্প বানিয়ে ধর্মান্ধ মানুষকে উত্তেজিত করাই তাদের উদ্দেশ্য।
এ প্রসঙ্গে জামাতের আমির ডা. তাহেরের অক্টোবর মাসে নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত ভাষণের কথা মনে করুন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে তারা গাজওয়াতুল হিন্দ-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাঁর দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধে অন্তত ৫০ লাখ যুবক অংশ নেবে, যারা গেরিলা কৌশলে এবং বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তার এই ধরনের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ভারতীয় আধিপত্য ঠেকাতে পাকিস্তান নামক একজন মুসলিম ত্রাণকর্তার দরকার হয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গক্রমে ইসলামপন্থিদের কিছু যুক্তি বা কৌশল এখানে আলোচনা করলাম। একটি যুক্তি হলো প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, উদীচী ও ছায়ানটের ওপর হামলাকে সাব-অল্টার্ন বা ক্ষমতাহীনদের জাগরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা। এই হামলা নাকি দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করা সেকুলার এলিটদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, যেটা বিস্ফোরিত হয়েছে। এই যুক্তি অনুযায়ী, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আওয়ামী লীগের সময়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছিল। যেমন, শাপলা চত্বরের মতো রাষ্ট্রীয় হত্যার ঘটনায় তারা নীরব ছিল।
প্রথমত, এখানে হেফাজতকে সাব-অল্টার্ন বা ক্ষমতাহীন মানুষের রাজনীতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই তত্ত্বের প্রবক্তা বোধহয় ফরহাদ মজহার। তিনি বিভিন্নভাবে হেফাজতের রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এমনকি হেফাজতের উত্থানের সময় তাদের ১৩ দফার কোন কোনটি তার লেখা, এমনটা মনে করা হয়।
সাব-অল্টার্ন বলতে বোঝানো হয় সেই প্রান্তিক মানুষদের যারা খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী। যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই এবং যাদের কোন কথা দাবী দাওয়া বা রাষ্ট্রের কানে পৌঁছায় না। রাষ্ট্রের কোনো পরিকল্পনা বা আলোচনায় এই মানুষদের কখনো রাখা হয়না।
বাংলাদেশে কারা ক্ষমতাহীন মানুষ? দিনমজুর, রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী, কৃষক নাকি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত যারা তারা। যে মানুষেরা দানের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ও নেটওয়ার্কের অংশ তারা ক্ষমতাহীন নাকি তাদের চেয়েও নীচে আরও একটি শ্রেণি আছে? তারা কি বাস্তবে শ্রমিকের চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী নয়? আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করুন, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা হয়তো সত্যিই প্রান্তিক গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যখনই তারা রাজনীতির অংশ হয়ে গেল, তখনই তারা আর ক্ষমতাহীন মানুষের দলে থাকল না। শাহবাগ অন্দোলনের মুখোমুখি তাদের দাঁড় করানো কি অভিজাত বনাম প্রান্তিক মানুষের সম্পদ ও ক্ষমতা বণ্টনের লড়াই, নাকি মিথ্যা তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে শাহবাগকে নাস্তিকদের আন্দোলন বানিয়ে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মস্তিষ্ক প্রসূত আস্তিক-নাস্তিকের কাল্পনিক দ্বন্দ?
শাপলা চত্বরের ঘটনা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের অপরাধ। কিন্তু সেই ব্যর্থতাকে ব্যবহার করে পরবর্তী সব জঙ্গি সহিংসতাকে রাষ্ট্রীয় নাটক বলা, একটি ঘৃণ্য রাজনৈতিক কৌশল। একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিচার না হওয়া মানে, একে ঘিরে পরবর্তীতে তৈরি হওয়া কোন সহিংসতা বৈধ হয়ে যাওয়া নয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে জঙ্গি দমন নাটকের অংশ হিসেবে দেখানো ইসলামপন্থি শক্তিগুলোকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কৌশল। শুধু তাই নয়, এটা সংবাদপত্রগুলোকে ভয় দেখানো যে, এ ধরনের রিপোর্ট করলে তোমাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। জঙ্গি ঘটনাগুলো আছে বলেই মিডিয়া এই নিয়ে খবর প্রচার করে। এখন মিডিয়াকে জঙ্গি ঘটনার কারণ বানানো মানে কারণ ও ফলাফল উল্টে দেওয়া।
গত কয়েক বছরে পিনাকী গং ইসলামপন্থিদের বুঝিয়েছে যে, ছায়ানট ও উদীচী হলো আওয়ামী সেকুলারিজম-এর প্রতীক। রবীন্দ্রসংগীত, পহেলা বৈশাখ পালন - এই সবকিছুই তাদের দৃষ্টিতে অপরাধ।
একইভাবে সহিংস ইসলামপন্থার সমালোচনাকে ইসলামবিদ্বেষ বা ওয়ার অন টেররের দোসর বলে চিহ্নিত করাও কারণ ও ফলাফলকে উল্টে দেওয়াই হলো। ওয়ার অন টেররের নামে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বোমাবর্ষণ ও সামরিক হামলা চালিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পরিচালিত, এবং তারা সারা বিশ্বেই নৃশংসতা, আগ্রাসন ও দমনমূলক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে। এখন মার্কিনি আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে জঙ্গিবাদ এবং ইসলামের নামে সহিংসতাকে সমর্থন করা বা অস্বীকার করা যায় না। এই সমালোচনাকে ইসলামবিদ্বেষ বলা মানে ধর্মকে ঢাল বানিয়ে সহিংস রাজনীতিকে রক্ষা করা, যেটা উগ্রপন্থি জঙ্গিগোষ্ঠিগুলো করতে গিয়ে, সাধারন ধর্মপরায়ন মুসলিমদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
©somewhere in net ltd.