নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন ভাল মানুষ বলেই নিজেকে দাবী করি। কারো দ্বিমত থাকলে সেটা তার সমস্যা।
প্রিয় অবন্তি,
কেমন আছো? মৃত্যুর পর মানুষ কেমন থাকে আমার জানা নেই। তুমি বেঁচে থাকলে আমার জীবনটা অন্যরকম হত। প্রতিটা মুহূর্ত তোমার জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়। তোমার জন্য আজ আমি একজন রবীন্দ্রগবেষক। রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস-কবিতা আর প্রবন্ধ সব জানা এবং পড়া হয়ে গেছে আমার। রাতে আমার ঘুম হয় না, বেলকনিতে বসে-বসে রবীন্দ্র সংগীত শুনি। তুমি রবি বাবুর লেখা অনেক ভালোবাসতে, আজ তুমি নেই। এখন, তোমার হয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে যাচ্ছি। হঠাত হঠাত তুমি রবীন্দ্রনাথের নানান বিষয় নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে, আমি তোমার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারতাম না। তোমাকে হারিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিই। আজ কেউ আমাকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রশ্ন করে আটকাতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, বিশেষ করে বাঙ্গালীরা শোকে-দুঃখে-সুখে-আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই।
অবন্তি ভোর হতে শুরু করেছে। মধ্যরাত থেকে কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। আজ তোমাকে শুধু রবীন্দ্রনাথের গল্প শুনাবো। মানুষের এমন কোনো মানবিক অনুভূতি নেই যা রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায় না। এখন আমি জানি রবীন্দ্রনাথের সব সাহিত্য এবং সংগীতের মূল যে একটি ভাবনা কাজ করত তা হলো মুক্তি। একেকজন একেকভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করেন। কারও কাছে 'শেষের কবিতা' ভালো মনে হবে, কারও কাছে চতুরঙ্গ। অবন্তি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে তুমি কি জানো রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখার প্রুফ নিজেই দেখতেন। তুমি যেমন তোমার ভালো লাগা মন্দ লাগা আমার কাছে স্পষ্ট করে বলতে, তেমনি রবীন্দ্রনাথও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন বঙ্কিমের উপন্যাস 'আনন্দমঠ' ভালো লাগেনি।
অবন্তি একটু অপেক্ষা করো, এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি। ...আজ আকাশে অনেক মেঘ। মনে হচ্ছে খুব বৃষ্টি হবে। মৃণালিনী দেবী ২৯ বছর বয়সে মারা যান। তারপর রবীন্দ্রনাথ আর বিয়ে করেননি। মৃণালিনী কিন্তু বাংলাদেশের মেয়ে। বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তের বছরের ছোট ছিলেন।ভেবে পাই না- দ্বারকানাথ মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ কেন ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ দলিলপত্র সব পুড়িয়ে দিলেন! রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নাটকে একটি সংলাপ আছে, 'এইবার ফসল খুব বেশি হয়েছে। না জানি কৃষকের ভাগ্যে কী দুর্গতি আছে।' আমার মনে হয় একশ'টি বাক্যে যা বলা যেত না, তিনি একটি মাত্র বাক্যে তা বলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনা করে মাসে ৩০০ টাকা পেতেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। সেই সময় জমিদারদের যেসব বাজে অভ্যাস থাকত- রবীন্দ্রনাথের তাঁর কোনোটিই ছিল না। তিনি ঘোড়ায় চড়তে জানতেন না, শিকার করতে পারতেন না, মদ খেতেন না এমন কি কোনোদিন বাঈজী নাচাতেন না। নোবেল প্রাইজের টাকা দিয়ে কৃষকদের জন্য ব্যাংক করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যা সাহিত্যে প্রকাশ করতে পারতেন না, তা প্রকাশ করতেন ছবিতে। ১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী হয়। আমার চিত্রকলা বোঝার সঙ্গতি ভারতীয়দের নেই, এই কথাটি রবীন্দ্রনাথ কেন বলেছেন আমি ভেবে পাই না। জীবনের শেষ ১৭টি বছর তিনি ছবি এঁকেছেন। বিশেষ বিশেষ দিনে রবীন্দ্রনাথ গান লিখতে কবিতা লিখতে কখনও ভুলতেন না। লেখালেখি ছাড়াও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যবসা করতেন। তাঁর কোম্পানীর নাম ছিল 'টেগর অ্যান্ড কোম্পানী'। পাট ও আখ মাড়াইয়ের ব্যবসা তারপর বিভিন্ন গ্রাম থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে কলকাতায় বিক্রি করতেন। এমনকি গোলাপ ফুলের ব্যবসা করার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ধনীর সন্তান ঠিকই কিন্তু তিনি নিজে ধনী ছিলেন না। প্রিয় অবন্তি আমার তুমি জেনে অবাক হবে, বিভিন্ন কারনে রবীন্দ্রনাথকে মাঝে মাঝে ঋণ নিতে হতো। ঋণের কারনে রবীন্দ্রনাথকে মাসিক সুদ দিতে হতো একশ পঁয়তাল্লিশ টাকা তের আনা চার পাই!
পদ্মা নদীতে রবীন্দ্রনাথের একটি বজরা নৌকা ছিল। এই বজরার ছাদে বসে বসে রবীন্দ্রনাথ অনেক বই পড়েছেন। তুমি শুনলে অবাক হবে- ডব্লিউ এইচ হাডসনের লেখা 'গ্রিন ম্যানসন্স' বইটি একবসায় পড়ে শেষ করেছিলেন। চিত্রা নামে তাঁর আরও একটি বোট ছিল। শান্তি নিকেতনে এক নির্জন রাতে তাঁর বুক থেকে উৎসারিত হলো অন্যরকম গান- 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। ১৯৭১ সালে ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন রবীন্দ্র-ভাবনার মানুষ। অবন্তি তুমি বলেছিলে, রবীন্দ্রসাহিত্য বারবার পাঠ, উপভোগ ও উপলদ্ধি ছাড়া বাংলা সাহিত্যে কারো পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়। তোমার এই কথাটি আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা হতে পারে না। তরুন লেখদের তিনি সব সময় পছন্দ করতেন।
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন। এই বন্ধুর লেখাপড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজ রাধাকিশোরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বন্ধুকে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক চিঠি লিখতেন। সবার চিঠির জবাব দিতেন। ৪০৯৭ টি বাংলায় লেখা চিঠি পাওয়া গেছে। আমিও ঠিক করেছি তোমাকে ৪০৯৭টি চিঠি লিখব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন মাত্র ১৫ টি চিঠি। আমার ভাবতে অবাক লাগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে বিয়ে দিয়েছিলেন বিধবা প্রতিমা দেবীর সাথে। প্রতিমা দেবীর কোনো সন্তান হয়নি বলে তারা একটি গুজরাতি শিশু কন্যাকে দত্তক নেন। তাঁর নাম দেয়া হয় পুপে। অবন্তি তোমার টাপুর-টুপুর এর অবহেলা আমি হতে দিব না। রবীন্দ্রনাথের কথা মেনে নিয়েই শিশু বয়স থেকেই ওদের শিক্ষার সাথে আনন্দ যোগ করে দিয়েছি। জানো, ওরা দুজন তোমার মতো গালে হাত দিয়ে ঘুমোয়। কি যে মায়া লাগে! আমি যতবাত তাকাই ততবার আমার চোখ ভিজে উঠে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে একটি পার্কে বড় আকারে একটি বৈশাখী উৎসব হয়। সেখানে প্রায় দশ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিল। পার্কটির চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল শুধু একটি মাত্র প্রবেশের রাস্তা ছিল। হঠাৎ জেনারেল ডায়ার তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে এসে সেই প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়। বদমাশ জেনারেল ডায়ার হুকুম দিলেন গুলি চালাও। নিরীহ সাধারন মানুষের দল, নারী-পুরুষ শিশুসহ গুলি খেয়ে মড়তে লাগল। শতশত মানুষ নিহত ও আহত হলেন। প্রবেশ পথ ছোট বলে কামান আনা যায়নি। বন্ধুকের গুলি ফুরিয়ে গেল বলে সকলকে শেষ করা গেল না। আমাদের রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনা জেনে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। অনেকের সাথে দেখা করলেন আলোচনা করলেন। কিন্তু আলোচনায় কোনো লাভ হলো না। তখন তিনি ইংরেজ সরকারের দেওয়া 'নাইটহুড' খেতাব ফিরিয়ে দেন প্রতিবাদ স্বরুপ।
অবন্তি তোমার এবং রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ফুল হচ্ছে বকুল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় বকুল ফুলের কথা বলেছেন ৪৩ বার। মানে বকুল নিয়ে ৪৩টি পঙক্তি রচনা করেছেন। ও... অবন্তি ভুলে যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নিই, মনে আছে বিয়ের পর নেপাল এয়ারপোর্টে তুমি তোমার পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছিলে? রবীন্দ্রনাথও একবার কানাডা থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে পাসপোর্ট হারিয়ে অনেক ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিদ্বেষীরা বলেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করে ছিলেন। খুবই হাস্যকর কথা। বিশ্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাত পাঁচ বছর পর- ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। কিছু মানুষ আছে বিভ্রান্তি ছড়াতেই তাদের আনন্দ। তবে এটা সত্য ভালো মানুষদের সমালোচকের অভাব হয় না। আর কিছু মানুষ ভুলের অধীনেই জীবন পার করে দেয়। এটা আজকাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরোধিতা করা, সমালোচনা করা।
অবন্তি আমি তোমাকে প্রায়ই স্বামী বিবেকানন্দের বানী শুনাতাম। রবীন্দ্রনাথ আর স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু একই যুগের মানুষ। এমন কি তারা একই এলাকায় জন্মেছিলেন। অবন্তি তুমি তো জানো আমার সব লেখাই বিশ্রীরকম অগোছালো। এচিঠি শুধু তোমার জন্য। আশা করি, তুমি আমার সব ভুল যেমন ক্ষমা করে দিতে, চিঠিটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার জন্যও ক্ষমা করে দিবে। তোমার কাছে ক্ষমা পেয়ে পেয়ে আমার লোভ খুব বেশি বেড়ে গেছে। যাই হোক, এচিঠিতে কাদম্বরী দেবীর কথা কিছু বলব না। শুধু আজ এটুকু বলি কাদম্বরী দেবী একজন অসুখী মহিলা। মানুষের সাথে মানুষের অনেক ধরনের সম্পর্ক থাকে। কাদম্বরীর সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল স্বচ্ছ পবিত্র এবং সহজ সরল সম্পর্ক। তবে রবীন্দ্রনাথকে অনেকে মেয়ে ভালোবাসতো। বিশেষ করে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।
অবন্তি তুমি একবার বলেছিলে কিছু দুষ্টলোক সব জাগায়ই থাকে। কথাটা কিন্তু খুব সত্য বলেছো। কিছু দুষ্টলোক রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করতেন না। অবন্তি আজ এখানেই শেষ করছি। টাপুর টুপুরকে নাস্তা খাইয়ে এখন স্কুলে নিয়ে যাব। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত শিল্পকর্ম দিয়ে একটি কথাই যেন বলতে চেয়েছেন- জীবন সুন্দর। কিন্তু তুমি ছাড়া আমার জীবন কিছুতেই সুন্দর না। হুম, আমি জানি- রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী কন্যা ছেলে হারিয়েও তিনি সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে গেছেন। অবন্তি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। টাপুর টুপুরের জন্য কোনো চিন্তা করো না। আমি তো আছি। আরও অনেক কথা জমা হয়ে আছে। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাকে বলব? তোমার কলাপে একটা চুমু।
১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৩০
রাজীব নুর বলেছেন: আমি চেষ্টা করেছি এক চিঠিতে পুরো রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরতে।
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১:১৬
সোবুজ বলেছেন: রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা হলো।এক সময় মনে হয় লবনের ব্যবসাও করে ছিলেন এবং লোকশান দিয়ে ছিলেন।কোন ব্যবসাতেই সফল হতে পারেন নি।ভাবুক মানুষ ব্যবসায়ী হতে পারে না।