নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার নাম- রাজীব নূর খান। ভালো লাগে পড়তে- লিখতে আর বুদ্ধিমান লোকদের সাথে আড্ডা দিতে। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। নিজের দেশটাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষদের শ্রদ্ধা করি।

রাজীব নুর

আমি একজন ভাল মানুষ বলেই নিজেকে দাবী করি। কারো দ্বিমত থাকলে সেটা তার সমস্যা।

রাজীব নুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনের গল্প- ৮২

১৮ ই জুন, ২০২৩ রাত ১১:৫৮

ছবিঃ আমার তোলা।

পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় ও অভাগা ব্যক্তি হচ্ছি আমি।
আমার বাবা যে পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আমি ভালো ছিলাম। আব্বা করোনাতে হঠাত মারা গেলো। তারপর আমার জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। আমরা দুই ভাই, এক বোন। আমি সবার বড়। আমার বাবা বেঁচে থাকতেই আমাদের তিন ভাইবোনের বিয়ে হয়েছে। আমার বিয়ের সময় আব্বা অনেক ধুমধাম করেছেন। আব্বা আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে আমাকেই বেশি ভালোবাসতেন। আমার স্ত্রীর নাম- নীলা। নীলা সহজ সরল একটা মেয়ে। আমাদের একটা ছেলে হলো। এখন আমার ছেলের বয়স প্রায় তিন বছর। আজ দেড় বছর ধরে আমি আমার ছেলেকে দেখি না। কোলে নিতে পারি না। স্ত্রীকে দেখি না। আমি ফোন দিলেও আমার স্ত্রী আমার সাথে কথা বলে না। হয়তো আমার শ্বশুর আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে মানা করে দিয়েছেন।

আমার ভাই বড় চাকরি করে। অনেক টাকা সেলারি।
ভাইয়ের নিজের গাড়ি আছে। আমার ভাই তার বউ বাচ্চা নিয়ে প্রতি বছর লন্ডন, আমেরিকা অথবা অস্টেলিয়া বেড়াতে যায়। আব্বা মারা যাওয়ার সতের দিন পর আমার ভাবী আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। তখন আমি ভাবীকে বললাম, চারিদিকে করোনা। চলছে লকডাউন। এখন আমি বউ বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবো? তাছাড়া করোনার কারনে হঠাত আমার চাকরি চলে গেলো। ভাবী বললেন, প্রয়োজন হলে কিছু টাকা দিচ্ছি নিয়ে যাও। অবশ্য আমার কাছে বেশি টাকা নেই। সাত/আটশ' টাকা হবে। যাইহোক, একটা সস্তা এক ররুমের বাসা ভাড়া নিলাম যাত্রাবাড়ির দিকে। খুবই গিঞ্চি এলাকা। চাপকল আছে কিন্তু চাপকলে পানি থাকে না। একটা বাথরুম। কমপক্ষে চল্লিশ জন মানুষ। এরকম পরিবেশে আমি ও আমার স্ত্রী কোনদিন ছিলাম না। আমার মাথা কাজ করছিলো না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি যেন। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হয় খুব। বুকের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে যায়।

এক রুমের বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আমি আমার বোনের কাছে গিয়েছিলাম।
বোন ঝিগাতলা থাকে। তাদের নিজেদের বাড়ি। বোনের স্বামী সরকারি চাকরি করে। বেশ বড় পদে আছে। বোনকে সব বুঝিয়ে বললাম, আমার চাকরি নেই, জমানো টাকা নেই, আব্বা মারা গেছে, চারিদিকেন করোনা। বাচ্চার বয়স দেড় বছর। যদিও বোনকে বুঝিয়ে বলার কিছু নাই। সে সবই জানে। বোন আমাকে বলল- স্যরি আমার কিছু করার নাই। বোন আমার হাতে পাঁচশ' টাকা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। অথচ আমার বোনকে আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। বোনের জন্মের সময় থেকেই মা অসুস্থ হয়ে যায়। আমি বোনকে গোসল করিয়ে দিতাম। খাইয়ে দিতাম। ঘুম পাড়িয়ে দিতাম। সে বোনের কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়ে আমি অনেক কষ্ট পেলাম। অসুস্থ মা থাকে ভাইয়ের সাথে। মা কোনো কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে। আমি আজন্ম একজন ব্যর্থ মানুষ। বাবা-মা, স্ত্রী, পুত্র কারো জন্যই কিছু করতে পারলাম না। যেহেতু আমি ব্যর্থ, অসহায় ও দরিদ্র আর এরকম মানুষের সাথে কেউ সম্পর্ক রাখে না। কেউ যোগাযোগ রাখে না।

আমার স্ত্রী ধনীর কন্যা না হলেও তাদের আর্থিক অবস্থা নাজুক ছিলো না।
কিন্তু আমার স্ত্রী নীলা বলে দিয়েছে- আমি চাই না আমার বাবার বাড়ির কেউ আমাদের সাহায্য করুক। আমি ওদের কাছ থেকে হাত পেতে সাহায্য নিতে পারবো না। আমার পরিবারের কেউ তোমার সাথে বিয়েতে রাজী ছিলো না। আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। এদিকে আমার ছোট ছেলেটা অসুস্থ। তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। বাচ্চার জন্য দুধ কেনার টাকা আমার কাছে নেই। কোথায় যাবো? কে সাহায্য করবে? চারিদিকে করোনা। চলছে লকডাউন। তিন মাস খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে পার করে করলাম। এলাকার মুদি দোকান আর বাকি দেয় না। বাড়িওলার ভাড়া জমে গেছে তিন মাসের। বাড়িওলা খারাপ ব্যবহার করে। এদিকে আমার বউ এরকম নোংরা পরিবেশে এসে অসুস্থ হয়ে গেছে। একদিন আমার শ্বশুর এসে উপস্থিত হয়। সে এরকম অবস্থা দেখে- তার মেয়ে ও নাতীকে নিয়ে যায়।

আমি একটা সস্তার মেসে উঠি। সেই মেসে আমি এখনও আছি।
মেসটা ভালো না। খুবই নোংরা পরিবেশ। মেসের সদস্যরা হকার। ফুটপাতে অথবা ভ্যানগাড়িতে করে সবজি বিক্রি করে। মেসের ভাড়া অনেক জমে গেছে। তবে মেসের ম্যানেজার ভালো মানুষ। সে আমাকে মেস থেকে বের করে দেয়নি এবং আমার মিল বন্ধ করে দেয়নি। তবে আমাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে হয়। এদিকে আমার শ্বশুর তার কন্যাকে বলেছে, আমাকে তালাক দিতে। আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবাসে। সে জানে আমি মন্দ মানুষ নই। স্ত্রী ডির্ভোস দিতে চায় না। আজ দুই বছর হয়ে গেলো আমি আমার স্ত্রীকে দেখি না, ছেলেকে দেখি না। মাঝে মাঝে আমি ভাইয়ের বাসায় মাকে দেখতে যাই। মা কথা বলে না, শুধু চেয়ে থাকে। মাকে দেখে ভীষন কষ্ট হয়। বুঝতে পারি মা ভালো নেই। আমার চাকরি হলে আমি মাকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। আমার ভাইয়ের বউ জিজ্ঞেস করে আমি কেমন আছি? আমি চুপ করে থাকি। সে আমাকে আমার ভাইয়ের পুরোনো জামা কাপড় দেয়। ফ্রিজ থেকে বাসী খাবার বের করে দেয়। আমি সেই ঠান্ডা ও বাসী খাবার হাসি মুখে খেয়ে নিই। মনে মনে ভাবি- ভালো হতো খাবারটা যদি ওভেনে গরম করে দিতো। গরম করে দিতে বলতে সাহস পাই না।

চাকরির চেষ্টা অনেক করেছি। পাইনি।
আমি বুঝে গেছি আমার আর চাকরি বাকরি হবে না। তাছাড়া আমি একজন অযোগ্য ও অদক্ষ লোক। কোনো স্কিল নেই আমার। তবুও আমার পরিচিত যারা আছেন, তাদের সকলের কাছেই গিয়েছি। তাঁরা আমাকে চাকরি দেয়নি। বন্ধুদের অফিসে গেলে বন্ধু পিয়ন দিয়ে খবর পাঠায়- সে অফিসে নেই অথবা মিটিং এ ব্যস্ত। মিটিং শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আমি দেখেছি, বন্ধু অফিসেই আছে এবং মিটিং এ ব্যস্ত না। সে তার টেবিলেই বসে আছে। চারিপাশ থেকে অপ্র্যাশিত আঘাত, অপমান আর অবহেলা পেয়ে পেয়ে একবার ভাবলাম আত্মহত্যা করি। আবার ভাবলাম দেখি না ভাগ্য আমাকে নিয়ে আর কি কি খেলে। কত দূর যায়। আব্বা করোনায় মরে গিয়ে এবং করোনা আমার জীবনটা তছনছ করে দিলো। আব্বা মারা যাওয়ার পর গ্রামের জমিজমাও কিছু পাইনি। চাচা বলেছেন, আব্বা নাকি বেঁচে থাকতেই সব কিছু তার কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। চাচা আব্বার সিগনেচারও দেখালেন। আমি কারো উপর রাগ করি না। আমার ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন, শ্বশুর। আমার সমস্ত রাগ আল্লাহর উপর। উনার ইচ্ছাতেই তো সব হচ্ছে।

এখন আমি মেসের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
শুধু স্ত্রী আর ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ে। কতদিন আমার ছেলেটাকে দেখি না। কোলে নিই না। দুঃখ কষ্ট গুলো বুকের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। এই মেসে আমরা সতের জন থাকি। আমি সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। পকেটে টাকা থাকলে রাস্তার পাশের দোকান থেকে কেক আর চা কিনে খাই। টাকা না থাকলে খালি পেটে ঘুরি। অবশ্য আল্লাহ আমাকে না খাইয়ে রাখেন না। কোনো না কোনো ভাবে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়-ই। কোনো না কোনো মসজিদে মিলাদ হয়। মিলাদে কেউ মিষ্টির বাক্স দেয়, কেউ দেয় তেহারি। আমি বেশির ভাগ সময় ঢাকা শহরের মসজিদ গুলোতেই থাকি। মসজিদে এসি আছে। আরাম লাগে। মেসে আমার বিছানার পাশেই চুলা। দুটা চুলা সারাদিন জ্বলতেই থাকে। গরমে সিদ্ধ হয়ে যাই। সমস্যা হলো নামাজের পরে মসজিদের এসি বন্ধ করে দেয়। আমার মেসের সদস্যদের কাজে আমি সহযোগিতা করি। ভোর পাঁচ টায় কাওরান বাজারে যাই সবজি কিনতে। মাঝে মাঝে ভ্যানে করে আমি সবজি বিক্রি করি। বিনিময়ে ওরা আমাকে মেসে থাকতে দেয়। দুপুরে ও রাতে খেতে দেয়। আজকাল আমার খুব ক্ষুধা পায়।

আল্লাহ আছেন। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন।
আমি জানি, আমার খারাপ সময় কেটে যাবে। কারন, আমি একজন সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। আমি কোনোদিন কারো ক্ষতি করি নাই। আমার ভালো একটা চাকরি হবে। সুন্দর একটা বাসা ভাড়া করবো। বাসাটা নীলা তার মনের মতো করে সাজাবে। আমার স্ত্রী ও পুত্র আমরা একসাথে থাকবো। আমি ছেলেকে খাইয়ে দিবো। ঘুম পাড়িয়ে দেবো। গোছল করিয়ে দেব। নীলা আর আমি ব্যলকনিতে বসে গল্প করবো। চা খাবো। ছুটির দিনে নীলা আর ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে যাবো। নীলাকে অবাক করে দিয়ে তাকে একটা চুন্ডি শাড়ি কনে দেবো। রাতে বড় রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাসায় ফিরবো। নীলা রেস্টুরেন্টে খেতে খুব পছন্দ করে। যেদিন অফিস বন্ধ থাকবে, সেদিন আমরা সবাই মিলে- 'লাইফ ইজ বিউটিফুল' অথবা 'দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন' মুভিটা দেখবো। আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে আমার ভালোই লাগে। আমি জানি, আমার হাতে সময় আছে। কবি বলেছেন, দেরী হোক যায়নি সময়। একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.