নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অযান্ত্রিক সুরেরা

আমি কোথা হতে এলেম আমার ছায়াতলে! আবার কখন কোথায় মিলিয়ে যাবো আপন হতে..

রাজঋষী

লেখার মত অনেক কিছু আছে। কিন্তু লিখব না।

রাজঋষী › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্তর্ষি এবং একটা যুদ্ধ

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:০৯

ফোন পেলাম আমাদের আর একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। মা'র কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ছুটে গেলাম ঢাকা থেকে টাংগাইল ক্লিনিকে। পৌছে দেখলাম আমার স্ত্রী সুস্থ আছে কিন্তু ডাক্তার আমাদের বাচ্চাকে নিয়ে যুদ্ধ করছে, নির্ধারিত সময়ের আগেই সে ভূমিষ্ট হয়েছে, প্রিম্যাচিউরড! ওর ফুসফুস এতটাই অপরিপক্ক যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিতে পারছে না এবং প্রসেস করে শরীরে ব্লাড সার্কুলেট করতে পারছে না।হাপরের মত বুক ওঠা-নামা করছে কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছে না। রাত ১১টার সময় ডাক্তার এসে বললো তাদের সাধ্যের বাইরে, বাচ্চাকে তারাতারি ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। কি করবো হঠাৎ জ্ঞানশুন্য বোধ করলাম। আমার স্ত্রী, রুনা'র দিকে তাকালাম, সে অবশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত আমার সব মুরুব্বীগন, শ্বশুর, শ্বাশুরী'র মুখ দেখে বুঝলাম আমার কি করা উচিত! রুনা'র বড় ভাই এবং ভাবী কে সাথে করে রওনা হলাম ঢাকার দিকে, জানিনা নব্য শিশুটির ভাগ্যে কি আছে! সে ভাবীর কোলে নিঃশ্বব্দ, নিঃশ্চুপ। এ্যম্বুলেন্সটি বিদীর্ন চিৎকার করে অন্ধকার মফস্বল চিড়ে ছুটে যাচ্ছে।প্রায় ২০কি.মি. হঠাৎ ভাবী চিৎকার করে কান্না করে বললো কমল, বাবু নীল হয়ে গেছে, নড়ছে না। তখনও আমি আমার বাচ্চাকে একবারও ছুঁয়ে দেখিনি, উদভ্রান্ত হয়ে বাচ্চা'র দিকে তাকালাম, নীল হয়ে আছে! আমি ওর কপালে হাত রাখলাম, আমার মনে হলো শিশুটির অপূর্নতা আমাদের ক্ষমতার অনেক উর্ধ্যে তবুও আমি আমার সমস্ত মনযোগ এক করে তাকে ছুঁয়েছিলাম এবং পরম করুনাময়ের ইচ্ছায় আমার সাহসী ছেলেটি জীবন যুদ্ধে আবারও নিজেকে সমর্পন করলো। আমরা বুঝলাম এ্যম্বুলেন্স এ যে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাবুকে অক্সিজেন দিচ্ছিলো সেটা এ্যাক্টিভেট করা হয়নি, কোনো অক্সিজেনই সে আসলে পাচ্ছে না।কি করবো! আমাদের কারোরই এটা জানার কথা নয়, ক্লিনিক-এর নিজস্ব এ্যম্বুলেন্স, ডাক্তার এবং নার্স সব রেডী করে দেবার পরই আমরা রওনা দিলাম কিন্তু এখন কি হবে! আমরাও জানিনা এটা কিভাবে এ্যাক্টিভেট করতে হয়! আবার পিছিয়ে গেলাম ২০কি.মি. ফিরে গিয়ে আবার ক্লিনিক থেকে অক্সিজেন এ্যাক্টিভেট করে আবার রওনা দিলাম। রাত ২টার সময় ঢাকা পৌছলাম। এখন আমাদের খুজে বের করতে হবে একটা ভালো শিশু হাসপাতাল যেখানে ইনকিউবিটর আছে। ধানমন্ডী'র কয়েকটা ক্লিনিক ঘুরে শেষে বিডিআর গেটের বিপরীত দিকের লেকের পাশে 'নবজাতক' খুঁজে পেলাম। ইনকিউবিটর অনেকেরই আছে কিন্তু খালি নাই।আমি ঠিক করলাম এখানেই ভর্তি করবো বাবুটাকে। প্রতিদিন ৭৫০০টাকা করে ক্লিনিকের চার্জ, ঔষধের খরচ আলাদা। আমি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে কপর্দকশুন্য মিউজিশিয়ান, সংগীত শিল্পী যার কি না অনেক পুরষ্কার, প্রত্যয়ন আছে কিন্তু নিজের বাচ্চাকে চিকিৎসা করার টাকা নাই।আমার বাবাকে ফোন করলাম, বাবা বললেন আগে ভর্তি করো তারপর এইসব চিন্তা। ভর্তি করে ফেললাম। কাগজ পত্র করে সবকিছু ঠিকঠাক করে নার্স বাবু কে আইসিইউ-এ নিয়ে গেল। বাইরে অন্ধকার সরে গিয়ে নতুন আলোকে জায়গা করে দিচ্ছে, আকাশটা রক্তাক্ত। আমি ক্লিনিকের বাইরে লেক-এর পাশে এসে বসলাম, সমস্ত শরীর ভেংগে কান্না শুরু হলো, যে কান্নার শ্রোতকে আমি থামতে দেইনি, কান্নার যে এত বড় বড় ঢেউ থাকে আমার জানা ছিলোনা। আকাশের বুক থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে, সূর্যের আলোয় ধিরে ধিরে স্পষ্ট হচ্ছে পথের রেখা

সকাল, আমি অস্থির হয়ে আছি কখন শিশু বিশেষজ্ঞ আসবেন। উনি এসে আমার বাবুটাকে দেখে কি বলবেন সেটাই ভাবছি। আমার বাবা মা এলেন, আইসিইউ তে গিয়ে বাবুকে দেখলেন, আমাকে স্বান্তনা দিলেন।শিশু বিশেষজ্ঞ আসলেন। উনি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ,ডঃ প্রফেসর আজাদ চৌধুরী। উনি গাড়ী থেকে নামতেই হাতজোড় করে বললাম স্যার আমার সন্তানকে আপনার বাঁচাতে হবে যেভাবে হোক! উনি আমাকে আস্বস্ত করলেন এবং স্বান্তনা দিলেন। ইতিমদ্ধে আমার প্রা্য় সব বন্ধুরা চলে এসেছে আমাকে কিভাবে স্বান্তনা দিবে খুজছে! আমার প্রানটাতো আটকে আছে ইনকিউবিটরে আমার বাচ্চার সাথে। কোনোভাবেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।ডক্টর সাহেব ফিরে এসে আমাকে বললেন, তিনি তার যথাসাদ্ধ্য করবেন বাকিটা আল্লাহ্ জানেন! আমার বাচ্চাকে কৃত্তিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের বাইরে আমি আমার সব বন্ধুরা অপেক্ষা করছি।



এভাবে চলছে চিকিৎসা।১৫ দিন হয়ে গেছে। পুরো হাসপাতালের সব রোগীর এটেনডেন্ট এবং সিনিয়র জুনিয়র সব ডাক্তার নার্স সিস্টার রা আমাকে গত কয়েকদিনে চিনে নিয়েছে।একে তো আমার বাচ্চার এই হাসপাতালে সবচেয়ে সংকটপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা চলছে আবার প্রতিদিন আমাকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য যে পরিমান শুভাকাংখী আমার কাছে আসে সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে শুভ মনে হয়না। যখনই আমার বাচ্চাকে দেখার জন্য প্রফেসর সাহেব আসেন বা ফিরে যান, আমার বন্ধু-বান্ধব'রা তাকে রীতিমত ছেঁকে ধরেন। প্রফেসর সাহেবও যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন বলে সবাইকে স্বন্তুষ্ট করতে পারেন।ইতিমদ্ধ্যে বাবুর কিছুটা উন্নতি হলেও বিপদমুক্ত নয়।আমি পাথরের মতই আছি, শুধু আল্লাহ্ কে ডাকি! আমার বাবা আমাকে স্বান্তনা দেয়।



টাকা!!! চিকিৎসা খরচ!!! প্রতিদিন ৭৫০০টাকা হিসেবে ঔষধসহ সপ্তাহে প্রায় ৬০০০০টাকা লাগছে। আগেই বলেছি আমি ছন্নছাড়া একজন গায়ক। ২০০৭ এর এই ঘটনার কিছুদিন আগে আমি বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে তিন কবির গানে শ্রেষ্ঠ্যত্ব পেয়েছি কিন্তু আমি টাকার মানে এখন ভিক্ষুক। যারা আমার শুভাকাংখি, যারা পারছে কিছু সাহায্য করছে। আমার অতি আপনজনেরা আমার কাছে কখনও জানতেও চায়নি কিংবা দেখতেও আসেনি আমি কেমন করে আমার বাচ্চাটিকে বাঁচাবার আপ্রান চেষ্টা করছি। আমার মনে হত আমার কেউ নেই এবং তখন আল্লাহ কে বলতাম, তুমি এগুলি মনে রাখবা! আমি মনে রাখবো না! তোমার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টদের তুমিই মনে রেখ! আমার সন্তানের কিছু হলে তোমাকেও আমি ছেড়ে দেবোনা।আমি সবাইকে দেখে নেবো।



গত একমাসে বাবুকে ৩ বার কৃত্বিম শ্বাস দেয়া হয়েছে। তৃতীয়বার ভেন্টিলেশন দেবার আগে ডাক্তার আমার থেকে বন্ডে স্বাক্ষর নিয়েছে, যাতে বাচ্চার কিছু হলে ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের দায় না আসে।সবাই মানা করেছে, তৃতীয়বার ভেন্টিলেশন দিলে নাকি বাচ্চা'র মানসিক ও শারিরিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। আমি সবার কথা না শুনে ডাক্তারদের অনুমতি দিয়েছি। ইনশ্আল্লাহ, বাবুর উন্নতি হয়েছে।



বাবুর মা একটু সুস্থ্য হয়েই ছুটে এসেছে রাজর্ষিকে সাথে নিয়ে। রাজর্ষি আমার বড় ছেলে, তৃতীয় শ্রেনীতে পরছে ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুলে। আমার এখন কষ্ট টা একটু কম। রুনা আসার পর ও প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে বাবুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে, বাবু তার মা'কে ফিরে পেয়েছে। ওর হাত, পা ছোরার ভাবেরই পরিবর্তন হয়ে গেছে। শিশু'র জন্য, মা' এর কোন বিকল্প নেই। আমার এখন একটু ঘুম হয়, রাতে হাসপাতালের সামনে লেকের শ্যাওলা পানির মত কুলকুল করে জেগে থাকি না। একটু একটু হাসতে পারি। রুনা আসতেই আমি যেন শক্তি পাচ্ছি।



সবকিছু যদি ঠিক থাকে তবে বাবুকে হাসপাতাল আগামি সপ্তাহে রিলিজ করবে।৪৫ দিন পর সে এখন মোটামুটি ভালো আছে কিন্ত এরপরও তাকে একমাস অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হবে। বাবুর ৫ বছর না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তার বলেছে সাবধান থাকতে।



৫২ দিন শেষ হলো। আগামীকাল বাবুকে রিলিজ দেয়া হবে। আমার মা, বাবুর নাম দিয়েছে অন্তর্ষি। রাজর্ষি, অন্তর্ষি দুই ভাই, আমার পরিবারের দুই দেবদূত।



অনেকের কাছে টাকা চাইলেও শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন রুনা'র বাবা, আমার শ্বশুর সাহেব। টাকা অনেকের কাছেই আছে, থাকতে পারে কিন্তু বিপদের সময় কয়জন মানুষ এরকম বড় হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসে! অন্তত একটা শিশুকে বাঁচানোর জন্য, আমার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর জনাব মীর মোশাররফ হোসেন সাহেবের জন্য আমার অন্তঃস্থল থেকে পরম করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা করি উনি দীর্ঘজীবি হোন।



অন্তর্ষি আমাদের ঘরে এলো জন্মের দীর্ঘ ৫৩ দিন পরে একটা অসম্ভব যুদ্ধকে জয় করে। এখন ওর বয়স ৫ বছর। অসম্ভব দুষ্ট এবং প্রাণ শক্তিতে ভরা একজন পুরুষ।



পরম করুনাময়ের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.