নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবীতে এমন কোন জীব নেই যেটি আহার ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে । জীবের আকার অনুযায়ী তার আহারের মাত্রা নির্ধারিত হয় । একটি তিমি মাছের যেমন প্রতিদিন কয়েক মন খাদ্য দরকার তেমনি একটি পিঁপড়ার সামন্য কয়েক টুকরার । মানুষকে তার খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী দু’ই ভাগে ভাগ করা যায় । কেউ প্রয়োজন মত খায় আবার কেউবা মাত্রাতিরিক্ত । অনেক মনীষী বলেছেন, ‘তোমরা খাওয়ার জন্য বাঁচ আর আমি বাঁচার জন্য খাই’ । মনীষীদের এ বাক্যেই মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে । মানুষের জীবনে অনেক গুলো প্রেষণা থাকে । তার মধ্যে আহারকে জৈবিক প্রেষণা হিসেবে বিবেচনা করা হয় । মাত্রাতিরিক্ত না হোক অন্তত সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমান ক্যালরী গ্রহন করতে হয় । এ ক্যালরী আলাদাভাবে উৎপাদন কিংবা কিনতে না পাওয়ার কারনে বিভিন্ন খাবার থেকে আনুপাতিক হারে ক্যালরী গ্রহন করতে হয় । আর্থিকভাবে স্বচ্ছল স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ খাবারের ম্যানু তৈরি করে তার প্রয়োজনীয় ক্যালরী গ্রহন করার যেমন চেষ্টা করে তেমনি গরীবরাও তাদের শরীরকে কর্মঠ রাখার জন্য বিভিন্ন সস্তা খাবার গ্রহনের মাধ্যমে ক্যালরী গ্রহন করে । শুধু ভাত আর তরকারীর মধ্যে মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরী পাওয়া যায় না । বিভিন্ন মওসুমী ফল এবং বাইরের কিছু সুস্বাদু খাবারের মাধ্যমে মানুষ তার শরীরের চাহিদানুযায়ী ক্যালরী গ্রহনের চেষ্টা করে । উন্নত বিশ্বের মত বাংলাদেশের মানুষ অনেক টাকা ব্যয় করে শরীরের জন্য উপযোগী খাদ্য ভক্ষন করার সামর্থ রাখে না । বাংলাদেশের মানুষ তাদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যেমনি সামান্য ক্যালরী যুক্ত খাবার গ্রহন করে তেমনি অনেক খাবার গ্রহন করতে হয় নিছক উদার পূর্তি করার মানসে । যুগ-যুগান্তর জুড়ে বাংলাদেশের মানুষ তার খাদ্যাভ্যাস এমনি ভাবেই গড়ে তুলেছে । অতীতের বাঙালীকে “মাছে ভাতে বাঙালী’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও এখনকার বাঙালীর ভাত ঠিকই আছে কিন্তু মাছের বড় আকাল । বাঙালীর এমন খাদ্যাভাবের মধ্যে হঠাৎ যোগ হয়েছে খাদ্যে ভেজাল । যা স্বাভাবিকের মাত্রা অতিক্রম করে মহামারিতে রুপ নিয়েছে । আইন বা নৈতিকতা কোনটাই খাদ্যে ভেজাল মিশানোকে রোধ করতে পারছে না । বরং দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে এ সমস্যা বেড়েই চলছে ।
সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপণায় গড়ে তোলা দেশের সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধুনিক খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেশের ৪০% খাদ্যেই ভয়ংকর সব ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য উপস্থিতির প্রমান মিলেছে । অতীতে বাংলাদেশের খাদ্য পণ্যে ভেজাল, বিষ শিরোনামে কিছু খবর পাওয়া গেলেও তার প্রতি কারো তেমন ভ্রক্ষেপ ছিল না । কিন্তু জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ গবেষণায় প্রমান মিলেছে খাদ্যে এমন কিছু ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে যা ভোজন রসিক তো বটেই সকল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে । এ সকল ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিত্যদিনকার প্রয়োজনীয় খাদ্যেই বেশি রয়েছে বলে গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে । বিশেষ করে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ ও দুধজাত পণ্য থেকে শুরু করে চাল, হলুদের গুড়া এমনকি লবনে পর্যন্ত এ সকল ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক মিশ্রন করা হয় । যে সকল খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ধরা পড়েছে সে সকল খাদ্যে মিশ্রিত করা হচ্ছে নিষিদ্ধ ডিডিটি থেকে শুরু করে বেনজয়িক এসিড, অ্যালড্রিন ক্রোমিয়ম, আর্সেনিক সিসা, ফরমালিন ইত্যাদির মত ভয়ংকর উপাদান । ফাও এবং সরকারের যৌথ গবেষণার ফল ছাপিয়ে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রকাশিত বুলেটিনে বের হয়ে এসেছে আরও মারাত্মক তথ্য । সেখানে বলা হয়েছে, দেশের ৪৯% খাদ্যে ভেজাল চিহ্নিত করা গেছে । জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানুষ যদি প্রতিনিয়ত এমন ভেজাল খাদ্য গ্রহন করতে থাকে তবে এসব খাদ্য গ্রহনের কিছুদিনের মধ্যেই তার কিডনি, লিভার ও ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে । কারন খাদ্যে যে সকল ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত করা হয় সেগুলো কিডনি, লিভার ও ক্যান্সার রোগের উপাদান বহন করে । ফাও এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ গবেষণায় বাংলাদেশের ৮২টি খাদ্য দ্রব্যের উপর গবেষণা চালিয়ে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে, ৪০% খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুন বেশি বিষাক্ত উপাদান রয়েছে । এই গবেষণার ফল আরও বলছে, ৩৫% ফল এবং ৫০% শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে । এ ছাড়াও আম ও মাছের ৬৬ টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন যা মানবদেহের জন্য চরম হুমকি । চালের ১৩ টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়াসম্পন্ন আর্সেনিক, ৫টি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম । হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় পাওয়া গেছে সিসা ও অন্যান্য ধাতু । লবনেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০ থেকে ৫০ গুন বেশি ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে । মুরগির মাংস ও মাছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে । এ ছাড়া চারটি প্যাকেটজাত জুসে পাওয়া গেছে বেনজয়িক এ্যাসিড । ফলের মধ্যে আপেল ও আঙুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে । এ ছাড়া আমসহ অন্য ফলেও রাসায়নিক মিলেছে । ব্রয়লার মুরগী ও চাষের মাছের মধ্যে রুই-কাতলজাতীয় মাছে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে । এ ছাড়া ফরমালিন মিলেছে বিভন্ন মাছে । শুঁটকি মাছেও পাওয়া গেছে বিষাক্ত রাসায়নিক । হলুদ লবনে সিসাসহ অন্য কিছু ধাতব উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলোকে চকচকে ও ভারী করা হয় । এ রিপোর্টের প্রকাশের আগে ২০১২ সালেও বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫ হাজার ৩১২টি খাবারের নমুনা পরীক্ষা করা হয় । এর মধ্যে ২ হাজার ৫৫৮ টি খাবারে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভেজাল উপাদান পাওয়া গেছে । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমানের মতে, ‘ডিডিটি, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা-এর সবগুলোই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর’ । বাংলাদেশ মৎস অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাছে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০% চরম বিষাক্ত, ৩০% একটু কম বিষাক্ত এবং মাত্র ১০% বিষাক্ত নয় । মাছে ধারন করা এ বিষাক্ত কনা যেমন পানিতে থাকা উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা ধ্বংস করে দিচ্ছে তেমনি মাছ ভক্ষনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে বিষ প্রবেশ করছে । কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর বৈধভাবেই ২৭ হাজার মেট্রিকটন কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে । তবে এ পরিমান আরও বেশি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন । গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৭% বেশি কৃষক তাদের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে । বিশেষজ্ঞদের মতে, গরু মোটাতাজা করনের জন্য যে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর । এ ছাড়া খাওয়ার পানিতেও আর্সেনিক ছাড়াও বিভিন্ন রাসায়নিকের উপস্থিতি রয়েছে ।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একমাত্র জাতি যারা দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্র পণ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মেশায় । অন্য কোন বর্বর জাতিও বোধ হয় এমন আত্মগাতী সিদ্ধান্ত নেয় না । সামান্য কয়েকটি টাকার লোভে বাঙালীরা নিজেদের সাথে গাদ্দারী করে । গত দু’ই বছরর আগে দিনাজপুরে লিচু খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে । এ মৃত্যুর পিছনে লিচুতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারকে কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । দেশে প্রচুর গরম পড়ছে । তীব্র তাপদাহের কারনে মানুষ পিপাষার্ত হচ্ছে । এ তীব্র পিপাষার পানি শূণ্যতা কাটানোর জন্য গরম কালের মওসুমী ফল তরমুজের বিকল্প আর কিংবা হতে পারে ? সেই তরমুজ খেয়ে দু’জনের মৃত্যু এবং শত শত শিশু হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে । খাদ্যে কিছু বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রয়োগে কিছু মানুষ সাথে সাথে মৃত্যু বরণ করলেও যার আপাত দৃষ্টিতে বেঁচে যাচ্ছেন তার মৃত্যুর জীবানু শরীরে নিয়ে ঘুরছে । সময়ের ব্যবধানে সকলের একই পরিণতি নিশ্চিত । আমাদের দেশে রোগী দেখতে যাওয়ার সময় আপেল অথবা আঙুর নিয়ে যাওয়ার প্রচলন আছে এবং এটাই স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় । সেই রোগীকে সবল করার জন্য যে পুষ্টিকর আপেল এবং আঙুর খাওয়ানো হয় সেই আপেল এবং আঙুরেই যদি বিষাক্ত উপাদান থাকে তবে সে রোগী সবল হবে না দূর্বল হয়ে মারা যাবে তা জানার জন্য নিশ্চয়ই মহাপন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না । মানুষের নৈতিকতার কতটা অবক্ষয় হলে মানুষ খাদ্য দ্রব্যের মত একটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে বিষ মিশাতে পারে ? মানুষের ভাবা উচিত সে সামাজিক জীব । একতাবদ্ধতার সূত্রের এক জনকে আরেক জনের উপর নির্ভর করতে হয় । এক পেশাজীবিকে অন্য পেশাজীবির উৎপাদিত দ্রব্যের উপর নির্ভর করতে হয় । এক ব্যবসায়ীকে অন্য ব্যবসায়ীর পণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে খাদ্যঘাটতি পূরণ করতে হয় । সেই পেশাজীবিরা, ব্যবসায়ীরা যদি খাদ্যে ভেজালের মাধ্যমে অন্যকে বিপদে ফেলেন তবে কি নিজের পরিবারের সদস্যদের বিপদ মূক্ত রাখতে পারেন ? যিনি খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত করেন তিনিও কি বিপদের উর্ধ্বে থাকেন ?
সময় এসেছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু একটা করার । পরবর্তী পজন্মকে পঙ্গুত্বের কবল থেকে রক্ষা করার । সুস্থ স্বাভাবিক একটি জাতি গঠনে সচেষ্ট হওয়ার । তাইতো সবাইকে সচেতন হতে হবে । বিশেষ করে ফাও এবং সরকারের গবেষণালব্ধ ফলাফলের আলোকে কালবিলম্ব না করে সরকারের উচিত খাদ্যে বিষ প্রয়োগ বন্ধে সর্ব্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহন করা । খাদ্যে বিষ প্রয়োগ বন্ধ করতে না পারলে এসব বিষাক্ত উপাদান থেকে দেশের মানুষের দেহে বেশ কিছু দূরারোগ্য রোগের মহামারি পরিস্থিতি দেখা দেবে । সুতরাং ২০১৩ সালে প্রণীত ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ অনুযায়ী বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডসহ খাদ্যে ভেজাল এবং বিষ প্রয়োগের অপরাধে ১৪ বছরের কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ডের যে বিধান রাখা হয়েছে তা বিধি আকারে কার্যকরী করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে । সরকার যদি খাদ্য নিরাপত্তায় এখন কঠোর না হয় তবে আশু দেশের স্বাস্থ্যগত মহাবিপর্যয় নেমে আসবে যা কাটিয়ে ওঠার মত সামর্থ দেশের নাই । কাজেই খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মিশ্রনের বিরুদ্ধে সরকারকে যেমন দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে তেমনি জনতাকেও তাদের নিজস্ব স্বার্থে জন-স্বার্থবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে । এটাই সকলের প্রত্যাশা এবং প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত । আমরা যা খাচ্ছি তা খাদ্য, বিষ নয়-জনগণ এবং সরকারের যৌধ উদ্যোগে এটা নিশ্চিত করতে হবে ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.