নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সল্পপ্রাণ পাওয়া কবি সুকান্ত রায় বলেছেন , ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকে কাছে এ আমার দৃঢ়-অঙ্গীকার’ । শিশুর আগমনের পূর্বে পৃথিবীকে সে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা মানুষের দায়িত্ব । যে দায়িত্ব পূর্ববর্তীদের পক্ষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছে । প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে তারা পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলেছে । তাদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের । আগামী প্রজন্মের আগমনের পূর্বে এ পৃথিবীকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা, সকল সমস্যার সমাধান করা বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব । সে দায়িত্বের কতটুকু বর্তমান প্রজন্ম পালন করতে পারছে ? তারা কি সাজানোর দায়িত্ব পালন করছে নাকি অগোছালো করে পৃথিবীর বাসযোগ্যতা বিলীন করছে । নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বর্তমান প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের কল্যানে তো কিছুই করছেনা বরং নিজেদের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে । জ্ঞানীরা সব সময় হতাশ না হওয়ার উপদেশ দেন । সকল সমস্যাকে জয় করাই নাকি মানুষের দায়িত্ব । কিন্তু সে সমস্যার সীমা কতটুকু । মানুষের ক্ষমতার তো সীমারেখা আছে । কিছু মানুষ সমাজের ক্ষতি করলে সমাজের অন্যান্য মানুষেরা তা গুছিয়ে রাখতে পারে । সমাজের সব মানুষই যদি উল্টোরথে উল্টোপথে চলে তবে সে সমাজের মেরামতের দায়িত্ব কে পালন করবে ? নিজেদের নিরাপত্তা দিতেই যারা ব্যর্থ তারা পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তা দিবে সে আশা করা নিতান্তই বোকামী । আমাদের পূর্বসূরীরা আমাদের নিয়ে ভাবলেও আমরা আমাদের উত্তরসূরীদের নিয়ে কতটুকু ভাবছি ? তাদের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত কতটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ করছি ? তাদের কল্যানে কোন কাজ না করে বরং তাদের অস্তিত্ব যাতে হুমকির মূখে পড়ে তার সকল পথ উম্মুক্ত করে দিয়ে যাচ্ছি । আমাদের এ কর্মকান্ডের কি বিশেষণ দেয়া যায় ? অবশ্যই স্বার্থপরতা বলা যায় না । যদি স্বার্থপরতা হত তাহলে অন্তত নিজেদের ভালোর জন্য কাজ করে যেতাম । আমাদের প্রতিটি কাজ আমাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে । তবে আমাদের এ কাজকে বোকামী বলা যেতে পারে । জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগেও আমরা মূর্খের মত কাজ করে যাচ্ছি । যে কাজ আমাদের কোন কল্যান তো করছেই না বরং ধ্বংসের সকল রাস্তা খুলে দিচ্ছে ।
পৃথিবীতে একটি শিশুর আগমন ঘটার পর বেঁচে থাকার জন্য তার প্রয়োজন হয় অক্সিজেন । শুধু মানুষ নয় বরং প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্যই অক্সিজেন চাই। কিন্তু শিশু কোথায় পাবে নির্মল অক্সিজেন । আমাদের কর্মকান্ডের ফলে সীসা ভরা অক্সিজেন শিশুকে পৃথিবীতে স্বাগতম জানাচ্ছে । পর্যাপ্ত বৃক্ষ নাই । সব উজাড় করে ফেলেছি । যা বাকী আছে তাও ধ্বংস করার দ্বারপ্রান্তে । যে গাছ অবশিষ্ট আছে তা শিশুর জন্য অতিপ্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারছে না । ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইডও শুষে নিচ্ছে না । সুতরাং একজন শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকলাঙ্গ হওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তা সে সহজেই পেয়ে যাচ্ছে । অথচ যা প্রয়োজন তা পাওয়ার কোন উপায় আমরা রাখিনি । যে শিশুরা মায়ের দুধ খেতে পারে তারা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে ভাগ্যবান । কেননা মাত্র ছয়মাস একটি শিশু কেবল নির্ভেজাল খাদ্য খেতে পারে । ছয়মাস পরেই শিশুর শারীরিক চাহিদা বেড়ে যায় । মায়ের বুকের দুধের সাথে বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় । বাহিরের খাবার গ্রহনের সাথেই শুরু হয় ভেজালের দুনিয়ায় পথচলা । মানুষের জীবনতুল্য পানি থেকে শুরু করে এমন কোন খাদ্য নেই যা নির্ভেজাল । ভেজালের দুনিয়ায় নির্ভেজাল কিছুই নেই । মাছ, মাংস, সব্জি, ফলমূলসহ সব কিছুই দেখতে তাজা অথচ বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে ওগুলো বিষ করে রাখা হয়েছে । প্রাকৃতিক স্বাদ নেই । বর্তমানে ফরমালিনের বিস্তার ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে । এমন কোন খাদ্য দ্রব্য নাই যা ফরমালিনের ছোঁয়া থেকে মুক্তি পাচ্ছে । অন্যান্য উচুমাত্রার বিষের মিশ্রন তো আছেই । বাঁচার তাগিদে যে সকল খাদ্য খাওয়া হচ্ছে তা মৃত্যুকে কাছে টানছে । অতীতে যে রোগের নাম কেউ জানত না সেই ধরনের শত শত রোগের আবির্ভাব ঘটেছে । মানুষ রোগাক্রান্ত হলে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবে তারও উপায় নাই । সকল ওষুধে ভেজাল । জরিপ বলছে, বাংলাদেশের ৬০% ওষুধ খেলে রোগ তো সারবেই না বরং আরও অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এ ভেজাল ওষুধ উৎপাদনে শুধু আটা এবং পানি ছাড়া অন্য কিছুই ব্যবহার করা হয় না ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশুর বয়স পাঁচ বছর হলেই তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় । শিশুকে জ্ঞানী করে তোলার মানসে একটি শিশুর শরীরের ওজনের তুলনায় বেশি ওজনের একটি বইয়ের ব্যাগ তার কাঁধে তুলে দেওয়া হয় । এ বইতে যে জ্ঞান আছে তা শিশু ধারন করতে পারবে কি পারবে না সেটা পরের কথা । ব্যাগ ও বইয়ের ওজন শিশুর বহন করার সামর্থ আছে কিনা সে দিকে কারো খেয়াল নেই । উঠতে-বসতে, খাইতে-খেলতে সবসময় শিশুর মধ্যে জ্ঞান প্রবেশ করাতে দেখা যাচ্ছে । মা-বাবা বিশেষ করে মায়েরা এ কাজে বেশি পরাঙ্গমতা প্রদর্শন করছে । স্কুল শেষে এ কোচিং ও কোচিংয়ের দ্বারস্থ হতে হতে শিশুর জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত । তবুও হার মানার সুযোগ নাই । সবার মধ্যে প্রতিযোগীতার মানসিকতা । শিশু আস্তে আস্তে বালকে তারপরে তরুনে পরিনত হয় । শিক্ষা ব্যবস্থায় এ সকল ছাত্রদের জন্য বেশ উন্নত পদ্ধতি চালু করে রেখে যাচ্ছি ! পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়ে তাদেরকে মেরুদন্ডহীন করে দেওয়ার কাজটুকু খুব যত্ন সহকারেই পালন করছি । শিক্ষার্থীরাও এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে । সারাক্ষন কু-চিন্তায় ব্যস্ত থাকলেও তাদের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কোন কারন নাই । ছাত্রজীবন শেষ করার পরে চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে সৎভাবে চাকরি লাভ করবে তারও কোন উপায় নাই । এখানেও প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোটা পদ্ধতির বিন্যাস কিংবা ঘুষের টাকায় চাকরি হবে । যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ভালো কিন্তু বাকী যোগ্যতা নাই তাদের কপালে চাকরি জুটবে না । অন্যায় অবিচারের জাল এমনভাবে বিস্তৃত করে যাচ্ছি যার মায়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়া আদৌ সম্ভব নয় । শিক্ষা যেমন মানুষের মেধা বিকাশে সহায়তা করে তেমনি খেলাধুলাও । বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা খেলাধুলা বলতে কেবল কম্পিউটার গেমস কিংবা ভিডিও গেমসকে বুঝে । পাড়ায় কিংবা স্কুল-কলেজে খেলার মাঠ নাই । সব দখলদারীদের করায়ত্বে চলে গেছে । শিশু ইচ্ছা করলেই দিগন্তে ছুটতে পারবে না কিংবা হা-ডু-ডু অথবা বৌছি-ও খেলতে পারবে না । অতীতে এ ধরনের খেলার অস্তিত্ব ছিল তা তাদের বিশ্বাস করানোই দায় হয়ে পড়বে ।
সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন । বর্তমানে সংস্কৃতিতে ধ্বস নেমেছে । এ প্রজন্ম সংস্কৃত বলতে কেবল ভারতীয় ধারবাহিক নাটকগুলোর বেলাল্লাপণা, পরকীয়ায় ট্রেনিং, মিথ্যা বলার চর্চা কিংবা পরনিন্দাকেই বুঝে । পরবর্তী প্রজন্মের সময় সংস্কৃতির আরও অধঃপতন হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায় । দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা এখন জাদুঘরে স্থান পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে । কালেভদ্রে যা দু’একবার চর্চা হয় তাতে দর্শকদের আগ্রহ দেখা যায় না । পশ্চিমা অপসংস্কৃতি এবং ভারতের বস্তাপঁচা সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের মানসিকতাকে এমনভাবে দখল করেছে যা থেকে পরিত্রান পাওয়া দুঃসাধ্য । এ সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়েছে । যার কারনে সমাজে একেরপর এক অপরাধ বেড়েই চলছে । যার লাগাম টানা প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়েছে । সংস্কৃতির এ ভঙ্গুর দশা চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম বিকৃত মানসিতার অধিকারী হয়ে বেড়ে ওঠবে তাতে কোন সন্দেহ নাই । পরবর্তী প্রজন্মের এ পদস্খলনের বীজ আমরাই রোপন করে যাচ্ছি । দেশে রাজনীতির চর্চার বদলে গালাগালি চর্চা হচ্ছে । কে কাকে কতটা হেয় করতে পারে তার প্রতিযোগীতা চলছে । এ প্রতিযোগীতায় কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই । মিথ্যা আশ্বাস দিতে দিতে তাদের সত্যকথাও এখন মানুষ মিথ্যা ভাবতে শুরু করেছে । তবুও তাদের হুঁশ ফিরছে না । ক্ষমতারমোহে তারা নৈতিকতা-অনৈতিকতার পার্থক্য ভূলে যাচ্ছে । নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, অবিচার চালিয়েই যাচ্ছে । রাষ্ট্রের উন্নতির চেয়ে অবনতির দিকেই বেশি টেনে নিচ্ছে । জ্ঞানীদের চেয়ে গলাবাজদের বেশি মর্যাদা দিচ্ছে । রাজনীতির এহেন চর্চা চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম রাজনীতি থেকে শিখবে কি ? তারা দেশপ্রেমিক হওয়ার বদলে যদি দেশদ্রোহী হয় তবে এর দায়ভার কে নেবে ?
সময় এসেছে বদলাবার । নিজেদের কল্যাণে না হোক অন্তত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য । আমাদের পূর্ববর্তীরা আমাদের কল্যানে যে দায়িত্ব পালন করে গেছেন সে দায়িত্ব ধারাবাহিক করা আমাদের কর্তব্য । কবি সুকান্তের মত আমাদেরকেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে । শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আমরাও যেন আগামীর শিশুদের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে দিয়ে যেতে পারি । শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত সকল অধিকার যেন নিশ্চিত করতে পারি । আমাদের অবহেলার কারনে শিশুরা যেন আমাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলতে না পারে, ‘আমাদের এ পরিনতির জন্য আমাদের পূর্বসূরীরা দায়ী’ । বিবেকের কাছে জবাবদিহী করে যে কর্মকান্ডগুলো আমাদের জন্য এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো সর্বদা যেন সে কর্মকান্ডের সাথে থাকতে পারি এবং এটাই যেন হয় আমাদের সকলের শপথ ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
©somewhere in net ltd.