নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হত্যা আর আত্মহত্যার মধ্যে অনেক পার্থক্য মনে হলেও আমি সে অর্থে খুব বেশি পার্থক্য দেখি না । দু’টোই খুন । একটি অপরের দ্বারা এবং অন্যটি নিজের দ্বারা নিজেকে খুন করা । অপরের দ্বারা খুন হওয়ার ক্ষেত্রে হত্যাকারীকে শাস্তি পেতে হয় অপরদিকে আত্মহত্যাকারীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার বাহ্য জগতের সকল হিসাব মিটে যায় । সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধ বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তিন প্রকার আত্মহত্যার সন্ধান দিয়েছেন । আত্মহত্যার প্রকারগুলো আত্মবাদী, পরার্থবাদী এবং জঞ্জালবাদী নামেই পরিচিত । বিশ্বের মধ্যে পরার্থবাদী আত্মহত্যার পরিমান কিছুটা কম দেখা গেলেও আত্মবাদী এবং জঞ্জালবাদী আত্মহত্যার পরিমান খুব বেশি । আমাদের দেশের মানুষ ভৌগলিক প্রভাবেই আবেগ প্রবণ । এদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মানুষকে আবেগ প্রবণ হতে বাধ্য করে । বাংলাদেশের মানুষের আবেগ প্রবণতার পিছনে সভ্যতা এবং বিশ্বায়ণের পূর্ণ ছোঁয়াও বহুলাংশে দায়ী । আবেগের বাহুল্যতায় যেমন উপকারীতা আছে তেমনি অপকারীতাও কম নেই । যাদের আবেগের শক্তি বেশি তারা বিবেকের প্রধান্য ভূলে গিয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে পড়েন । যার ফলে বিবেকের নিস্ক্রিয়তায় জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই ভূল পথে পরিচালিত করে । আবেগ প্রবণরা যখন আনন্দ পান তখন যেমনি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি খুশি হন তেমনি কোন ব্যাপারে আঘাত পেলে তাদের দুঃখের গভীরতাও অনেক বেশি হয় । সামান্য আঘাত কিংবা হতাশাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন অবস্থায় দাঁড় করায় যেখানে এসে তাদের জীবনের ভবিষ্যত স্থবির হয়ে যায় । সব কিছু ঘোর অমানিষায় ছেয়ে যায় । এখান থেকে উত্তরণের কোন পথই যেন তারা খুঁজে পায় না । আর তখনই আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের দিকে পা বাড়ায় । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, সব বয়সের মানুষই আত্মহত্যা প্রবণ । তবে উঠতি বয়সের তরুন-তরুনীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্মক বেশি । জীবনের চরম পরিনতি আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও একটি আবেগ প্রবণ সিদ্ধান্ত । যে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিবেকের বাধা দেয়ার ক্ষমতা থাকলেও আবেগের উচ্চ শক্তি তাকে দমিয়ে রাখে । অনেকে আত্মহত্যার মধ্যে জীবনের সমাধান খোঁজেন । তাদের মতে, আত্মহত্যা সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান । তবে যারা আত্মহত্যার সংকল্প করে ভাগ্যগুনে বেঁচে ফিরেছেন কিংবা মুহুর্তের জন্য বিবেকে চঞ্চল করতে পেরেছেন তাদের প্রত্যেকেরসহ সারা বিশ্ববাসী এক বাক্যে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন, নিশ্চয়ই আত্মহত্যা সমাধানের কোন পথ নয় বরং এটা সমস্যা শুরুর প্রথম ধাপ মাত্র । বিশ্বের স্বীকৃত এবং নির্ভরযোগ্য কোন ধর্ম ব্যবস্থাই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না বরং সকলে এটাকে ঘৃণা করে । বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে উল্লেখ করেছে এবং আত্মহত্যকারী বিনা বিচারে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং চিরন্তন শাস্তি ভোগ করবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে ।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যার পরিসংখ্যান দেখলে রীতিমত আতঙ্কিত হতে হয় । জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে বাংলাদেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছে । শুধু ২০১৩ সালে ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজার ১২৯ জন । পরিসংখ্যান আরও বলেছে, যারা আত্মহত্যা করেছে বা চেষ্টা করেছে তাদের বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে । শুধু বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি নয় বরং গোটা বিশ্বই আত্মহত্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্ধেগজনক অবস্থায় রয়েছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর তিনটি প্রধান কারনের মধ্যে আত্মহত্যা একটি । গত বছর ডব্লিউএইচও আশঙ্কা প্রকাশ করে ভবিষ্যত বানী করেছে, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি বছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন । আত্মহত্যার চেষ্টা করবেন আরও ১০ থেকে ২০ গুন মানুষ । বিশ্বের প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর সবচেয়ে কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল বয়সে বহু মানুষ আত্মহত্যা করলেও সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই । এ সমস্যার পরিসর যে এতটা, তা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যাথা নেই নীতিনির্ধারকদের । আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের প্রবল তাদের চিকিৎসা সেবার আওতায় আনার সুযোগও অপর্যাপ্ত । আত্মহত্যা এক সময় উন্নত দেশের মাথা ব্যথার কারন হলেও, এখন মধ্যম আয় এবং উন্নয়ণশীল দেশগুলোতও আত্মহত্যার প্রবণতা ও সংখ্যা বেড়েছে । গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত বিশ্বে প্রধানত নিঃসঙ্গতা থেকে বৃদ্ধরা এবং বিশেষত পুরুষেরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় । বাংলাদেশের মানুষের আত্মহত্যার কারন এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পের্কে মত দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক এম এম আকাশ বলেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ২১-৩০ বছর বয়সী গোষ্ঠী সবচেয়ে সক্রিয় অংশ । এ বয়সীদের আত্মহত্যার অর্থ হলো, দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে কর্মক্ষম মানুষগুলোর সেবা থেকে বঞ্চিত হলো । বাংলাদেশে যারা আত্মহত্যা করছে তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি । বাংলাদেশের পুলিশের হিসেবে, ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে । এর বাইরে, ঘুমের ওষুধ খাওয়া, ছাদ থেকে লাফ দেওয়া কিংবা ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দেওয়া তো আছেই । তবে কতজন, কীভাবে আত্মহত্যা করেছে, তার আলাদা হিসাব পরিসংখ্যানে উল্লেখ নাই । পরিসংখ্যান মতে, দেশের বড় হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগে যত রোগী ভর্তি হয় তার ২০% আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকজন । প্রথম আলোয় প্রকাশিত ২০ টি আত্মহত্যার কেস স্ট্যাডি করে দেখা গেছে, যৌতুকের কারনে নারী আত্মহত্যা করেছেন, স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ার কারনে সন্তানকে হত্যা করে মা আত্মঘাতী হয়েছেন । স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে । আবার কেউ কেউ রোগের অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে । পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেয়ে, কাঙ্খিত রেজাল্ট না করতে পেরে কিংবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তো আছেই । পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী, চলতি বছর এইচএচসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনই আত্মহত্যার চেষ্টা করে ২৭ জন শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় । এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানে আরও শতাধিক আত্মহত্যার চেষ্টা হয়েছে এবং কেউ কেউ সফলও হয়েছে । গত ১৯শে আগষ্ট ‘প্রথম আলোয়’ প্রকাশিত খবরে জানা যায় ‘রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় গত সাত মাসে আত্মহত্যা করেছে ১২ জন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ৯৮ জন’ । গত ৯ই সেপ্টেম্বর ‘দৈনিক যুগান্তরে’ প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ‘গত এক বছরে শুধু যশোরে আত্মহত্যা করেছে ৮৬ জন, যার মধ্যে ৬৫ জন নারী’ । পরিসংখ্যান বলছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি । ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২০০৮-০৯ সালে ৯৭০টি ময়নাতদন্তের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন বেড়েছে, ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে ব্যাপকভাবে । অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন । অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া কিংবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গর্ভধারণের কারনে অনেকে আত্মহত্যা করেন ।
‘মরিতে চাইনা আমি সুন্দর ভূবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’ কবির এ সৃষ্টি মানুষের বেঁচে থাকার সার্বজনীন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ । সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যা প্রবণতা এক দিকে সামাজিক নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিশেষ করে ইসলামিক মূল্যবোধের ও অনুশাসনের বিচ্যুতিও ফুঠে ওঠে । পারিবারিক কলহ, যৌতুক, প্রথার শিকার, পথে-ঘাটে ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়া, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হওয়া বাংলাদেশে নারীর আত্মহত্যার অন্যতম কারন । সুতরাং ধর্মীয় প্রথাসহ নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং শাসনের দ্বারা মানুষের মধ্যে বিচারপ্রাপ্তির প্রত্যাশা নিশ্চিত করার মাধ্যমেও আত্মহত্যার মত গুরুতর সিদ্ধান্ত থেকে অগণন মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব । এ সমস্যার সমাধানে আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ নির্লিপ্ত থাকতে পারে না । তরুন-তরুনীদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়, সন্ত্রাস ও মাদকে আসক্তির পাশাপাশি পশ্চিমা আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ভারতীয় অপসংস্কৃতির ঢালাও প্রভাব, ব্লু ফিল্ম, পপকালচার ও ডিপ্রেশনের শিকার হওয়ার মত বিষয়গুলো পারিবারিক পর্যায়ে রোধ করতে হবে । ইন্টারনেট ও স্যোশাল মিডিয়ার সুবাধে আমরা হয়ত পশ্চিমা সংস্কৃতির অনেক কিছুই নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করতে পারব না তবে পারিবারিক স্নেহ ও অনুশাসনের মাধ্যমে তাদেরকে বিপথগামীতা থেকে ফিরিয়ে রাখা অসম্ভব নয় । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা চালু, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা এবং জীবনের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে আরো স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তুলতে হবে । আত্মহত্যা রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সদিচ্ছা অনেক বেশি প্রয়োজন । সরকার যদি দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগ ও উপসর্গের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থা করেন তবে আত্মহত্যার সংখ্যা অবশ্যই কমে আসবে । আত্মহত্যার মানসিকতা সৃষ্টি হওয়াদের অন্তত জীবনের শেষবারের জন্য একবার হলেও ভাবা উচিত, আত্মহত্যা কোন সমাধানের পথ্ নয় বরং এটা আরও অনেক সমস্যার স্রষ্টা । সকল সমস্যার উপর সংগ্রাম করে বিজয়ী হওয়ার নামই জীবন । কাপুরুষের মত জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের স্বভাব হতে পারে না ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ও সাংবাদিক ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.