নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দিনে দিনে বাংলাদেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হচ্ছে । এখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নাই । প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ নিহত হচ্ছে এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেছে বিপুল সংখ্যক । সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কেউ বাদ যাচ্ছে না । সকল মৃত্যুই করুন, যন্ত্রনার এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে সকলের মৃত্যুই কাউকে না কাউকে নিভৃতে কাঁদায় কিন্তু সে মৃত্যুর অনেকটাই আমরা শুধু সচেতনতার অভাবে রোধ করতে পারছি না । এড়ানোর যোগ্য এ মৃত্যুর কারনে দেশ যেমন সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতার ছবিও প্রকটভাবে ফুটে ওঠে । গত ২০শে জুলাই নাটোরের বড়াই গ্রামের রাজ্জাক মোড়ে বিপরীতমুখী দুটি বাসের মুখোমূখী সংঘর্ষে আবারও এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ছবি চিত্রিত হয়েছে । এ দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে পৃথিবীর বুক থেকে অকালেই বিদায় নিয়েছে ৩৫টি তরতাজা প্রাণ এবং আহত হয়েছে আরও প্রায় অর্ধশতাধিক । আহতদের মধ্যে অনেকেই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে । চিকিৎসক এবং স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, আহতদের মধ্যে অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেছে । এ দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ছয় সহোদরসহ একই গ্রামের নয়জন নিহত হয়েছে । ঐ গ্রামবাসীদের মধ্যে অগ্রজরা জানিয়েছে, তাদের জন্মের পর কিংবা জন্মের পূর্বেও এ গ্রামে এতটা মারাত্মক বিপদ নেমে আসেনি । গ্রাম জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে এবং কেবলি কান্নার ধ্বনি । তাদেরকে স্বান্তনা দেয়ারমত কেউ অবশিষ্ট নাই । গ্রামের মহিলা এবং শিশুদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে রয়েছে । দুর্ঘটনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয় থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে তাদেরকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে । সরকার পক্ষের এ তৎপর কর্মকান্ডের জন্য তাদেরকে সাধুবাদ কিন্তু প্রশ্ন হল তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশগুলো আদৌ কোন কাজে আসবে কিংবা অতীতে এসেছে কি ? বিশ্বের সড়ক দুর্ঘটনাগ্রস্থ পাঁচটি উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । এদেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায় । গত বিশ বছরে এ বিষয় শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তাদের প্রদানকৃত রিপোর্টের তথ্য ও সুপারিষ আমলে নেয়া এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি । মাঝে মাঝে কিছু ব্যবস্থা গ্রহন করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় আদৌ যথেষ্ট ছিল কিনা সন্দেহ ? যদি এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ এবং সাবধনতা অবলম্বন করা হত এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেত না । সড়ক, লঞ্চ এবং রেল দূর্ঘটনার কারনে প্রতি বছর অসংখ্য বাবা-মাকে সন্তান হারা, স্ত্রীকে স্বামী হারা এবং সন্তানকে পিতা-মাতা হারা হতে হচ্ছে ।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার মত করে প্রতিদিন যানবাহন বাড়ছে । যানবাহন বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূর্ঘটনা । সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন লাশের মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন লাশ । গত কয়েক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যে সংখ্যক মানুষ মারা গেছে এত অধিক সংখ্যক মানুষ উন্নত বিশ্বের কোন কোন দেশে রোগাক্রান্ত হয়েও হাসপাতালে ভর্তি হয় কিনা সন্দেহ ? সম্প্রতি বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনার হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে । মহাসড়ক থেকে শুরু করে আঞ্চলিক সড়কেও দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন । ২০ অক্টোবরের মর্মান্তিক দূর্ঘটনার মাত্র ৮ দিন পূর্বে ১২ই অক্টোবর একদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩২ জন নিহত হয়েছে । ১২ই অক্টোবর ২১ জন এবং ১৭ই অক্টোবর ছুটির দিনেও ছয় জেলায় ১২ জনের মৃত্যু হয় । সংবাদপত্র কিংবা অন্য মিডিয়ায় দূর্ঘটনার সকল খবর না আসার কারনে দুর্ঘটনায় মৃত্যের প্রকৃত সংখ্যা অজানাই থেকে যায় । তবে বিভিন্ন বাঁধা উৎড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যের যে সংখ্যা জানতে পারি তাই আঁতকে উঠার জন্য যথেষ্ট । পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে, ১৫ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭০ হাজার মামলা হয়েছে । এসব দুর্ঘটনায় ৫৫ হাজার অর্থ্যাৎ বছরে প্রায় ৪ হাজার । বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়কে মৃত্যু হয় ১২ হাজার মানুষের । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৭ হজার ২৮৯ জনের । সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম । গত পাঁচ বছরে যানবহনের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়েছে । চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ২১ লাখ ৫ হাজার ১৪০টি । বেসরকারি সংস্থা ব্রাক ও পাওয়অর অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ২৮ ভাগ ঘটেছে মহাসড়কে গড়ে ওঠা বাজারে, ১৮% সড়কের মোড়ে । প্রতিবেদনে দুর্ঘনার জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালানো ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ট্রাফিক ব্যবস্থার দূর্বলতাসহ ৯ কারনকে এজন্য দায়ী করা হয়েছে । বিআরটিএর এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৯৪-২০১১ সাল পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছন ৫২ হাজার ৬৮৪ জন । দুর্ঘটনায় আহত কয়েক লাখ মানুষ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়েছে । এ হিসাব অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১০ জন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় । প্রকৃতপক্ষে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুন অর্থ্যাৎ ১৮-২০ জনের মৃত্যু ঘটে বলে এ বিষয়ে জ্ঞাতরা মনে করেন । বাংলাদেশ যাত্রী কল্যান সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৫৬টি । এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা চলতি ৩ হাজার ৭৭০ জন । এর মধ্যে পঙ্গু হয়েছে ৯২৩ জন । সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন ছাত্র, ৭০ জন শিক্ষক, ২৬ জন সাংবাদিক, ২৭ জন ডাক্তার, ১৭ জন আইনজীবী, ১৭ জন ইঞ্জিনিয়ার এবং ১৪৫ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১০৮ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ৭৭ জন সরকারি কর্মকর্তা, ১ হাজার ১৫৯ জন নারী এবং ৬৮৯ জন শিশু । বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনার শিকাড় হয়ে দেশের অনেক কৃতি সন্তান প্রাণ হারিয়েছেন । তাদের মধ্যে উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, ২০১১ সালের ১৩ই আগষ্ট মানিকগঞ্জে নিহত হন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীরসহ ৫ জন । সেই বছরই ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬ জন স্কুল শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয় । ২০১০ সালে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান জনপ্রশাসন বিভাগের দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা । ২০১২ সালে রাজধানীর কাকরাইলে বাসচাপায় নিহত হন সাংবাদিক দীনেশ দাস ।
এভাবে আর কত দিন ? আর কত জীবন অকালেই ঝড়ে যাবে অনাকাঙ্খিত সড়ক দুর্ঘটনায় ? এসকল দুর্ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় বলে ভাবার আদৌ সুযোগ আছে কি ? মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী দাবী করেছেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে এসেছে । এই কি তার আলামত ? কাজেই দায়িত্বশীলদের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত এবং তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক । সড়ক দুর্ঘটনা এমন কোন দুর্ঘটনা নয় যা এড়ানো সম্ভব নয় । চালক যদি যোগ্য-দক্ষ-অভিজ্ঞ হয় ও যানবাহন চালানোকালে শারীরীকভাবে ফিট থাকে, যানবাহনের যদি ফিটনেস থাকে, ও যান্ত্রিক দিক দিয়ে ত্রুটিমুক্ত থাকে, গতিবেগসহ সার্বিক বিষয়ে চালক ট্রাফিক বিধি-বিধান মেনে চলেন, সড়ক-মহাসড়ক যদি যানবাহন চলাচলের পূর্ণ উপযোগী থাকে তাহলে যানবাহনকে দুর্ঘটনা মুক্ত রাখা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুবই সম্ভব । যে চালক বেপরোয়া যানবাহন চালায়, ওভারটেক করে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যাত্রীদের প্রাণহানি ঘটায়, তাদের কিছু হয়না বলেই অদক্ষ ও বেপরোয়া চালকদের হাতে সাধারণ যাত্রীরা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছেন । এই পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হওয়া উচিত । সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করে যাত্রীদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব প্রথমত, যে সংস্থা যানবাহনের ফিটনেস সনদ ও চালকের লাইসেন্স প্রদান করে, দ্বিতীয়ত, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা-পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এবং তৃতীয়ত, যানবাহন মালিকদের । সুতরাং সংশ্লিষ্ট এই তিন মহলের সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতাই দেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে দ্রুত শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার দিকে নিয়ে যেতে পারে । চালক-যাত্রী এবং প্রশাসনের সচেতনতার মাধ্যমেই দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে । সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আর কোন জীবন যেন অকালেই ঝড়ে না যায় এবং আর কোন বাবা-মা-স্ত্রী-ভাই-বোন-সন্তান যেন আপনজন হারা না হয় ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.