নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পৃথিবীতে কেউ তো বেওয়ারিশ হয়ে জন্মায় না, তাহলে মানুষকে মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ হতে হবে কেন ? মা-বাবার হাত ধরে সন্তানের ধরণীতে আগমন ঘটে । এখানে এসে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষ যেমন কারো তত্ত্বাবধানে থাকে তেমনি পরিণত বয়সে তার ওয়ারিশ হিসেবে কাউকে না কাউকে ধরায় আনে । এভাবেই যুগ যুগ ধরে চক্রাকারে মানুষের বংশগতি রক্ষা হয়েছে । ধরণী থেকে কারো বিদায়ের মাধ্যমেই তার সম্পূর্ণ পরিচয় মুছে যায় না বরং মানুষের কর্ম এবং সৃষ্টির মাধ্যমে হাজার হাজার বছর মৃত মানুষও জীবিত মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে । যারা পৃথিবীতে মানুষের কল্যান সাধন করে খ্যাত হয়েছেন তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ জীবিত মানুষেরা এ সকল মানুষের মৃত্যুর হাজার বছর পরেও তাদের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করে কিংবা বিভিন্ন সভা সেমিনারে তাদের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারণ করা হয় । শুধু যে ইতিবাচকভাবে স্মরণ করতে হবে এরকম কোন কথা নেই বরং যুগে যুগে বিশ্বের কিছু ঘৃণিত মানুষের নামও উচ্চারণ করা হচ্ছে । এসকল ব্যক্তিরা তাদের জীবদ্দশায় মানবকল্যানে কোন কাজ করেনি কিংবা বিশ্ববাসীর জন্য এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছে যা গোটা বিশ্ব কিংবা রাষ্ট্রকে ক্ষতির কিংবা হুমকির সম্মূখীন করেছে । তবুও তাদেরকে স্মরণ করা হয় কারন ইতিহাস বলে একটা অধ্যায় আছে । আর ইতিহাস থেকেই মানুষ অতীতের সাথে পরিচিত হয় কিংবা শিক্ষা গ্রহন করে । পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নাই যিনি কোন না কোন দিকের বিবেচনায় মূল্যহীন । হতে পারে পৃথিবীতে কারো প্রয়োজন অনেক আবার কারও অতি সামান্য । তবুও সবাই অতি নগন্য হলেও মূল্যবান । আবার এমনও ব্যক্তি আছে যিনি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বহীন কিন্তু তার নিজস্ব পরিমন্ডল অর্থ্যাৎ তার পরিবার কিংবা বিশেষ কারো কাছে সবকিছু । মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা জীবিত থাকার সময় যতটুকু প্রকাশ না পায় সে মৃত্যু বরণ করলে তার সবটাই প্রকাশ পায় । সাধারণত মাত্র কয়েক বছরের জন্য মানুষ এক দেশ থেকে অন্যদেশে পাড়ি জমালে তাতেই আত্মীয় স্বজনের কষ্টের সীমা থাকে না । কাজেই যদি চিরতরে কেউ পৃথিবীর সকল মায়া ছিন্ন করে চলে যায় কিংবা যেতে বাধ্য করা হয় তারপরেও তার প্রতি মায়া থেকেই যায় । মৃত্যুর পরে কখনো কখনো মায়ার বন্ধন আরও দৃঢ় হয় । মানুষের মৃত্যু বরণে তার শুণ্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি অনুধাবন করা যায় যতটা তার জীবদ্দশায় অনুধাবিত হয়নি । এভাবেই এ জগত সংসার চলছে । কারো পিতামাতা, সন্তান কিংবা অন্যকোন আত্মীয় স্বজন মৃত্যু বরণ করলে তার স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে মালিকানাধীন কিংবা রাষ্ট্র কৃর্তৃক নির্ধারিত স্থানে সমাহিত করে তাকে হৃদয়পটে বাঁচিয়ে রাখতে চায় । আত্মীয় স্বজনের লাশ সবার কাছেই বোঝা কারন আপন জনের প্রস্থান অন্তরের গভীরে আঘাত করে কিন্তু এতটা বোঝ নয়, যে বোঝার ভার বহন করতে মানুষ অস্বীকার করবে । পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশ্বায়ণের পূর্ণ প্রভাব ছোঁয়া দিলেও বাংলাদেশে এখনও ততোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি । যে কারনে বাংলাদেশের মানুষ সবাইকে আপন ভাবতে পারে এবং একজনের ব্যথায় অন্যজন এখনও ব্যাথিত হয় । আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারনেই এ অঞ্চলের মানুষ অনেকটা আবেগপ্রবন যে কারনে সবাই সবাইকে আপন ভাবে, ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে । তবে মানুষের ভালো তো আর চিরকাল থাকে না । একটি স্থির ও শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের প্রভাব ইতোমধ্যেই আঁচ ফেলেছে । যে কারনে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয় প্রকট আকার ধারণ করেছে । যে কারনে প্রত্যহ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেওয়ারিশ অসংখ্য লাশ পাওয়া যাচ্ছে । এ সকল লাশের কোন পরিচয় পাওয়া না যাওয়ার কারনে এর পিছনে কারা দায়ী তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না । তবে প্রশাসন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারনা মতে, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অবৈধ সম্পর্ক, ভয়াবহ দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারনে দিনে দিনে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । তবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশেষ করে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মতে, তারা যে সকল বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে তার অধিকাংশ রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার ।
অতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক বেওয়ারিশ লাশের যে হিসাব প্রদান করা হয়েছে তা স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষকে অবশ্যই চিন্তিত করে তুলবে । একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার থাকার পরে এত অধিক বেওয়ারিশ লাশের খবর মিলেছে, যে লক্ষন আদৌ সুবিধার নয় । অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বেওয়ারিশ লাশের যে পরিসংখ্যান এসেছে তা আঁৎকে ওঠার জন্য যথেষ্ট । আমাদের চিন্তা-চেতনার অধঃপতনের কারনে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীন আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেই । যা আপাত দৃষ্টিতে আমাদের অবস্থানকে মজবুত করলেও এজন্য নিকট ভবিষ্যতে যে বিশাল খেসারত দিতে হবে তাতে বিন্দু মাত্র ভূল নাই । আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মতে, প্রতিবছর শুধু রাজধানীতেই গড়ে দেড় হাজার বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যায় । এ সংস্থাটিকে প্রতিদিন গড়ে ৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে হয় অর্থ্যাৎ মাসে প্রায় ১২৫টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করতে হয় । দেশের সর্বত্র মিলছে লাশ । প্রতিনিয়ত খাল, বিল, নদী, রেললাইনের কাছে, জঙ্গলে পাওয়া যাচ্ছে অসংখ্য মৃতদেহ । আবাসিক ভবন, রাস্তা, ড্রেন, গর্তসহ কোথাও যেন লাশের কমতি নাই । শুধু এ সকল লাশের নাম-পরিচয় মিলছে না । পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে ২০০৬ সালে ২ হাজার ৯৯ টি, ২০০৭ সালে ২ হাজার ২৫৯টি, ২০০৮ সালে ১ হাজার ৮৬৭টি, ২০০৯ সালে ১ হাজার ৯৮১টি, ২০১০ সালে ১ হাজার ২০৪টি, ২০১১ সালে ১ হাজার ১৯২টি, ২০১২ সালে ১ হাজার ২৪৭টি, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৪৩০টি এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর অর্থ্যাৎ মাত্র নয় মাসে প্রায় ১ হাজার বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে ।
যে সকল লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তার অধিকাংশই হত্যাকাণ্ডের শিকার । এ হত্যাকাণ্ড হতে পারে রাজনৈতিক কিংবা অন্যকোন প্রকারের । কিছু সংখ্যক মৃত্যুবরণ করছে ট্রেনে কাটা পড়ে অথবা সড়ক দুর্ঘটনায় । অন্যদিকে লক্ষণীয়, হত্যার পর মৃত ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলায় কিংবা এসিড়ি ঝলসে দেয়ায় বেশির ভাগ লাশেরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না । বেওয়ারিশ লাশ তৈরিতে কারা দায়ী ? যদি কেবল ২০১৩ সালের কথাই বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে এ সময়টাতে প্রায় দেড় সহস্র বেওয়ারিশ লাশ কবরস্থ করা হয়েছে । মানুষ মারা যেতে পারে এবং সেটা স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভিবিক উভয়ই হতে পারে কিন্তু তার পরিচয় থাকবে না কেন ? কেন বেওয়ারিশ হবে ? ২০১৩ সালে দেশে কোন গ্রহযুদ্ধ ছিল না । বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক আসন পেয়ে একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক সরকারই দেশ চালিয়েছে । অথচ এত সংখ্যক বেওয়ারিশ লাশ ! বলা বাহুল্য, শনাক্তকৃত লাশের সংখ্যা এই বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যার সাথে যোগ করলে লাশের অংকটি কত বিশাল হবে, তা ভাবা যায় ! কেন এই হত্যাকাণ্ড ? কোন উদ্দেশ্যে দেশে এগুলো ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে ? এই সমাজ কি তাহলে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে ? দেশে এত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থাকা সত্ত্বেও এত লাশ কেন এ জাতি উপহার পাচ্ছে ! ওয়ারিশ কিংবা বেওয়ারিশ লাশের দীর্ঘ মিছিল কমিয়ে আনতে সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে । আরও বেশি তৎপর হতে হবে র্যাব-পুলিশসহ সব গোয়েন্দা সংস্থাকে । ঘাতকদেরকে দ্রুত সনাক্ত করে তাদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে । তা না হলে বেওয়ারিশ লাশের সাথে চিহ্নিত লাশের সারিও দিনে দিনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই থাকবে । বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পুলিশকে আরও তৎপর এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নির্ভর হতে হবে । বেওয়ারিশ লাশের দায়ভার সরকারও এড়াতে পারে না সুতরাং বিতর্ক এড়াতে এবং ঘটনাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারকে অচিরেই পুলিশ ও গোয়েন্দাদের পৃথক ইউনিট গঠন করে তাদের দায়িত্ব দিতে হবে । যারা জনগণের জীবনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা অন্তত মৃত্যুর পরে স্বজনের কাছে লাশকে ফিরিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তা বিধান করুক ! দায়িত্বশীলরা সব দায়িত্ব তো এড়িয়ে যেতে পারে না ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.