নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একাত্তুরে দেশে স্বাধনীতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অভিযুক্ত অধ্যাপক গোলাম আযম ২৩শে অক্টোবর দিবাগত রাত ১০টা ১০মিনিটে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ৯২ বছর বয়স্ক গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল । সরকার পক্ষ গোলাম আযমের সর্বোচ্চ সাজার আর্জি জানিয়ে এবং গোলাম আযমের আইনজীবিরা তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবীতে রিভিউ আপিল করেছিল । যার শুনানি ডিসেম্বরের ২ তারিখ থেকে শুরু হওয়ার কথাও ছিল । কিন্তু গোলাম আযমের ফাঁসি কিংবা মুক্তির জন্য আর কাউকে অপেক্ষা করার সুযোগ না দিয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেন । গোলাম আযম স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন যা জামাআ’তে ইসলামের বহুনেতাকর্মীও স্বীকার করেছে । তবে তারা তৎকালীন সময়ে গোলাম আযমের কর্মকান্ড ভূল ছিল বলে জানিয়েছে । রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমের মৃত্যুর মাধ্যমে দেশের মানুষের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে । একটি নির্দিষ্ট সময়ের একজন মানবতা বিরোধী মানুষ হিসেবে গোলাম আযমের কর্মকান্ডের তীব্র বিরোধিতা করা এবং নিন্দা জানানো দেশপ্রেমী প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য । স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ ও অন্যান্য অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে গোলাম আযমকে আরও আগে বিচারের কাঠগোঁড়ায় দাঁড় করানো উচিত ছিল কিন্তু যারা সে সময় মানবতা বিরোধীদের বিচার করবে সেই তারাই এদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত ছিল । তখন বর্তমান শাসকশ্রেণী স্বার্থের মোহে অন্ধ হয়ে এই সকল কথিত মানবতা বিরোধীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিভিন্ন গোপন কুঠুরীতে আলোচনারত হয়েছিল । অনেক চড়াই-উৎড়াই পেড়িয়ে অবশেষে বাঙালির বহু দিনের আকাঙ্খিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়ে গতিশীল রয়েছে । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে ঘরে-বাইরে নানা সমালোচনা ও স্পষ্টতার অভাব থাকার পরেও স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে যারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে বাঙালীদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে এমনকি হত্যা কিংবা ধর্ষণ করেছে সেই ঘৃণিত ব্যক্তিদের বিচার চলছে এজন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে । স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে যাদের ব্যাপারে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগ ছিল তাদের মধ্যে গোলাম আযম অন্যতম । গোলাম আযমকে রাজাকার শিরোমিনও বলা হয় । সুতরাং তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে ৯০ বছর সাজা দেয়া হয়েছিল । এটাই শেষ নয় । সরকার পক্ষ যে আপিল রিভিও করেছিল তাতে তার ফাঁসিও হতে পারত কিন্তু তার সুযোগ থাকল দিল কই ?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গোলাম আযম এক চির-স্মরণীয় এবং উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম । ১৯৪৮-৪৯ সালে যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় রাজনৈতিক ছাত্রনেতা এবং ভিপি ছিলেন । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিনি সরব ছিলেন এবং সে সময়ে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য । ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ’৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থানে গোলাম আযম ছিল চরম আলোচিত নাম । পূর্ব পাকিস্তানের জামাআ’তে ইসলামীল নেতা হিসেবে গোলাম আযম ছিলেন সফল রাজনীতিবিদ । যদিও গোলাম আযমের দিক থেকে কাট্টা যুক্তির কারনে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের একান্ত সহযোগী ছিলেন এবং তিনি মনে প্রাণে চাইতেন পাকিস্তান যেন দ্বি-খন্ডিত না হয়ে যায় । তার যুক্তি ছিল- ‘পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম হলে সেটা ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে । যদি সরাসরি ভারতের অঙ্গরাজ্য নাও হয়ে তবুও ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর আঙুলের ইশারায় গোটা বাংলাদেশে পরিচালিত হবে । ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেয়েও বেশি বাংলাদেশকে শোষণ করবে এবং যথেচ্ছ ব্যবহার করবে’ । পশ্চিম-পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যে অন্যায় আচরণ পূর্ব-পাকিস্তানী জনগণের উপর শুরু করেছিল তাতে এ বঙ্গের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম করার বিকল্প অন্যকোন পথ খোলা ছিল না কিন্তু যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্ব উৎসর্গ করেছিল তার কতটুকু দীর্ঘ ৪৩ বছরে আমরা পূরণ করতে পেরেছি । প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যভাবে ভারতীয়দের কর্তৃত্বের কাছে আমরা বস্তুত জিম্মি হয়ে পড়েছি । বাংলাদেশের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে শুরু করে মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে বাজার একের পর এক বাজার দখল, ট্রানজিটের নামে এক তরফ স্বার্থ উদ্ধার, বিভিন্ন নদীতে ব্যারেজ দিয়ে বাংলাদেশেকে মরুভূমিকে পরিনত করাসহ নানাবিধ কর্তৃত্ববাদী শাসন চালিয়ে আমাদেরকে সর্বদা কোনঠাসা করে রেখেছে । এছাড়াও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের করুণ দশা চলছে তাতে কি আমরা খুব বেশি শান্তিতে আছি ?
গোলাম আযম স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং কয়েক বছর পর মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে তাকে দেখার জন্য দেশে ফিরে এসে আর ফিরে যাননি । অবশ্য তাকে এদেশের নাগরিকত্ব পেতে বেশ কাঠ-খড় পোহাতে হয়েছে । অনেক ঝামেলার পরে ১৯৯৪ সালে আদালতের নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান । স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ যখন ক্ষমতা আঁকড়ে জনগণের উপর চরম অবিচার চালাচ্ছিলেন তখন গোলাম আযমের পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনায় আওয়ামীলীগ এবং বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন অনেকগুলো দল ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরে এবং এরশাদের বিদায়ের মাধ্যমে এ আন্দোলনে সফলতা আসে । নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সূত্র দিয়ে গোলাম আযম দেশের রাজনীতিতে অমর হয়ে থাকবেন । গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কারনে গোলাম আযমকে ৫ বার বিভিন্ন মেয়াদে কারারুদ্ধ সময় কাটাতে হয়েছে তবুও তিনি তার যুক্তিকে অবিচল ছিলেন । অন্যদের মতে স্বার্থ রক্ষার জন্য মত কিংবা সিদ্ধান্ত পাল্টানোর মত দ্বি-মূখী আচরণ তার গোটা জীবনের কোন স্তরেই খুঁজে পাওয়া যায় না । বাংলাদেশ জামাআ’তে ইসলামীর সর্বোচ্চ নেতা থাকাকালীন সময়ে তিনি সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন । ২০০১ সাল পরবর্তী সময় থেকে জামাআ’তে ইসলামীর আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আমৃত্যু বিবেচিত ছিলেন । একজন সফল লেখক হিসেবে দেশে বিদেশে গোলাম আযমের ব্যাপক সুনাম-সুখ্যাতি রয়েছে । ‘জীবন্ত নামাযের’ মত বিখ্যাত গ্রন্থ লিখে তিনি মুসলমানের হৃদয়ে দীর্ঘদিন সম্মানের আসনে থাকবেন ।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় এদেশের অনেক নেতাই ক্ষমতায় কিংবা বিরোধীদলে থাকাকালীন সময়ে নানা ধরনের দুর্নীতির সাথে জড়িত হয়ে দেশের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন । অনেক দাপুটে নেতার জেল জরিমানা এমনই ইঙ্গিত দেয় । অনেকে আবার সুইস ব্যাংকে হিসাব চালুসহ উন্নত দেশে রাজকীয় বাসা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছে অথচ গোলাম আযম ! দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংগঠন গোলাম আযম অর্জিতহ একটি কালো টাকারও সন্ধান পাননি । বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতাশীনদের অন্যতম জোটবদ্ধ শরীক থাকার পরেও গোলাম আযম অন্যায়ভাবে অবৈধ পন্থায় যদি এক পয়সাও কামাই করত তবে জামাআ’তে ইসলামীর বর্তমানের প্রতিকূল সময়ে তা নিয়ে অবশ্যই বহু হৈ চৈ সৃষ্টি হত অথচ তার কিছুই হয়নি । গোলাম আযম রাজনৈতিক জীবনে যতটা সফল ছিলেন তার চেয়ে কোন অংশে পারিবারিকভাবে কম সফল ছিলেন না । তার ছয়টি ছেলেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে কাজ করছেন । বাংলাদেশের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষিত পরিবারের মধ্যে গোলাম আযমের পরিবার অন্যতম । গোলাম আযমের মৃত্যুর সংবাদে দেশ-বিদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে । বিশ্বের বহু দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে । এমনকি জাপানের মত দেশেও তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে । মুসলিম বিশ্বের অন্যতম স্কলাররা তার মৃত্যুতে গভীর শোকাহত হয়েছে । বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় তার গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে । শনিবার বায়তুল মোকাররমে তার জানাযা নামাযে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল । গোলাম আযমের ইচ্ছা ছিল তার জানাযা নামাযে মাওলানা মতিউর রহমান নিযামী কিংবা মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী ইমামতি করবেন । এ দু’জন নেতাই জেলে আটক থাকা এবং বিশেষ মহলের অনিচ্ছার কারনে সেটা আর সম্ভব হয়নি । অবশেষ তার ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান আযমী তার বাবার জানাযায় ইমামতি করেছেন । তবে সরকারের একজন মন্ত্রী এবং ইমরান এইচ সরকার গোলাম আযমের জানাযা নিয়ে মন্তব্য করায় কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে । মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, দেলওয়ার হোসেন সাইদী এবং মতিউর রহমান নিজামী দ্বারা জানাযা পড়ানোর দাবী অযৌক্তিক আবার ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, এ দাবী অবান্তর । প্রশ্ন হল- নিশ্চয় উক্তিকারী এ দু’জনের জানাযা পড়ানো যোগ্যতা নাই । অন্যদিকে গোলাম আযম একজন কথিত অপরাধী কাজেই তাকে যারা জানেন তারা এ দোষীর জানাযা পড়াতে রাজী হওয়ার কথা নয় । দেশের মানুষের কাছে মতিউর রহমান নিযামী ও দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদেরকেও মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার প্রমান পেশ করা হয়েছে । সুতরাং একজন অভিযুক্তের সাথে আরেকজন অভিযুক্ত সম্পর্কিত থাকবে এবং জানাযাও এদের দ্বারা পড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত ছিল ।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়টুকু বাদ দিলে গোলাম আযম একজন আপদমস্তক ভালো মানুষ । তারপরেও তার অপরাধ মোচন করার জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল । এই রকম একজন ঘৃণিত মানুষ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন এবং অন্যায়ের সাথে সন্ধি না করার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা আমরা ভালো মানুষ সেজেও কেন পারছি না ? কেন দিনে দিনে আমাদের অপকর্ম প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে । কিসে আমাদের শিক্ষা হবে ? কাজেই গোলাম আযমের জীবেনের বহু স্তরে আমাদের জন্য ইতিবাচক শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে । অনেক বিতর্কের পরেও গোলাম আযম তার আপন কর্মের কারনে কোটি মানুষের হৃদয়ে কোটি বছর বেঁচে থাকবেন ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.