নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দিনটা ছিল ২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর । বৃহস্পতিবার । জীবনে এমন কিছু স্মরণীয় দিন কিংবা ঘটনা থাকে যা কোনদিন ভূলবার নয় । এমন একটি দুঃস্মরণীয় দূখের রাত ১৫ নভেম্বর ২০০৭ । যে দিন ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশেকে তছনছ করে দিয়েছিল । কেড়ে নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ । সেদিনের সে ঘটনার পর আরও কত মানুষের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি । প্রায় প্রতিটি মানুষকে করেছিল সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব । বিদ্যুত, খাদ্য এবং আশ্রয়শূণ্য করে দিয়েছিল গোটা জনপদকে ও এর অধিবাসীদেরকে । যোগাযোগ ব্যবস্থাও হয়েছিল বিচ্ছিন্ন । একদিকে দেশে চলছিল স্বৈরশাসন অন্যদিকে প্রকৃতির প্রলয় । সেদিন মানুষ জ্ঞানশূন্য হয়ে দিক-বেদিক ছুটেছিল । কেউ কেউ তাণ্ডবের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও বাঁচাতে পারেনি নিকট আত্মীয় স্বজনকে । কারো কারো মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও বহু মৃতদেহ রয়ে গেছে নিঁখোজ । সেদিনের সে মহাপ্রলয় আজও স্মৃতির মানসপটে দুঃস্বপ্নের মত ভেসে ওঠে । আজও কাঁদায় এবং ভয়ে শিউরে উঠি । সে দিনের সে ভয়াবহতা কি কোনদিন স্মৃতি থেকে মূছে দিত পারব ? ঘূর্ণিঝড় সিডর (অতি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় সিড্র, ইংরেজীতে (Very severe Cyclonic storm Sidr) হচ্ছে ২০০৭ সালে বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড় । ২০০৭ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে এটি চতুর্থ নামকৃত ঘূর্ণিঝড় । এটির আরেকটি নাম ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ০৬বি (Tropical Cyclone 06B) । শ্রীলংকান শব্দ ‘সিডর’ বা ‘চোখ’ এর নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল । ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একটি দূের্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় । ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় সামান্য দূের্যোগের আভাস পাওয়া যায়, এবং পরের দিন তা ঘূর্ণিঝড় সিডর-এ পরিণত হয় । বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাংলাদেশে একটি দূের্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে । ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে আকাশ ছিল মেঘলা এবং সাথে অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল । কোন বাতাস ছিল না । প্রকৃতি ছিল অত্যন্ত ঘোমট । ১৪ নভেম্বর আবহাওয়াবিদরা প্রথমে ৫ নম্বর সংকেত দিতে থাকেন ]এবং তা রাত অবধি ৮নং বিপদ সংকেতে গিঁয়ে পৌঁছে । ১৫ নভেম্বর সকালে ঘোষণা করা হয়, সিডর নামের ঘূর্ণিঝড় ধীরে ধীরে বাংলাদেশ উপকূলে এগিয়ে আসছে । দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে । মুহুর্তেই ১০ নম্বর বিপদ সংকেত ঘোষণা করা হল । রেডিও কিংবা টেলিভিশনে কয়েক মিনিটি পরপর আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন ঘোষণা হতে থাকল । অবশেষে ১৫ নভেম্বর রাত ৯টায় এটি বাংলাদেশে আঘাত হানে । উল্লেখ্য যে, ১৫ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত বাতাসের বেগ ছিল ঘন্টায় ২৬০কি.মি/ঘন্টা এবং ৩০৫কি.মি/ঘন্টা বেগে দমকা হাওয়া বইছিলো । একারণে সাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী সিডরকে ক্যাটেগরি-৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আখ্যা দেয়া হয় । ঘূর্ণিঝড় সিডর সর্বপ্রথম আঘাত হানে দুবলারচরে । পর্যায়ক্রমে এটি আঘাত হানে বরিশালের সকল উপকূলে । পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, লক্ষীপুর, ঝালকাঠীসহ বাংলাদেশের প্রায় ৩১টি জেলায় । সিডরের প্রচন্ড আঘাতে তুলার মত উড়তে থাকে সবকিছু । অবশেষে ১৫ নভেম্বরের গোটা রাত তান্ডব চালিয়ে শেষ রাতে উপকূল অতিক্রম করে ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে । ঘূর্ণিঝড় সিডরের প্রবল আঘাত সহ্য করে যারা প্রাণে বেঁচে ছিল তার ১৬ নভেম্বর তাদের চেনা এলাকাকে আর চিনতে পারছিল না । এমনকি নিজ বাড়ীটিকেও চিনতে কষ্ট হচ্ছিল । সকাল থেকেই আর্তনাদের বেদনাবিধুর বিলাপ ভেঁসে আসতে থাকে । ঘূর্ণিঝড়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে । আধা পাকা, কাচা এমনকি পাকা বাড়িও ঝড়ের কবলে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে । যে দৃশ্য আসলে নিজ চোখে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানে প্রায় অসম্ভব ।
সিডরের আঘাতে যে অঞ্চলগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল সেই অঞ্চলসমূহের একটি মঠবাড়ীয়া উপজেলার বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা । সিডরের রাত্রিতেও ভাগ্যক্রমে গ্রামে ছিলাম ! কোন একটা উপলক্ষে আমাদের বাড়ীতে ভাই-বোনসহ পরিবারের সকল সদস্যরা উপস্থিত ছিল । অতীতে বন্যার কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় তেমন ভয়ানক কিছুই আঁচ করতে পারছিলাম না বরং এক ধরনের উত্তেজনায় ভূগছিলাম । পরিবারের বায়োজেষ্ঠ্যদের মধ্যে চিন্তার স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠলেও আমার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি । সে রাতে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল এবং আমি শুয়ে শুয়ে তা দেখছিলাম । হঠাৎ টেলিভিশনের নিচে শিরোনামে ভেসে আসল, দু’ঘন্টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর বলেশ্বর নদী দিয়ে অতিক্রম করবে । এ সংবাদ দেখার পরেও ব্যক্তিগতভাবে ভাবান্তর হয়নি । বাবাকে খুব বিষন্ন দেখছিলাম এবং তিনি কিছু সময় পরপর টেলিভিশন এবং রেডিওতে খবর শোনার চেষ্টা করছিলেন এবং যতক্ষন মোবাইলে নেটওয়ার্ক ছিল ততক্ষন বিভিন্ন যায়গায় মোবাইল করে সেখানের অবস্থা জানছিলেন । বলেশ্বর নদী থেকে সিডর অতিক্রম করার সংবাদ দেখে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেন কারন তার ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল রাত্রের অভিজ্ঞতা রয়েছে । উল্লেখ্য যে, আমাদের বাড়িটি টিনশেট এবং অনেকদিনের পুরানো । বাবা ভরসা পেলেন না । তার মনে কোন এক অজানা আতঙ্ক যা স্পষ্টই তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল । আমাকে নির্দেশ দিলেন, পরিবারের সকলকে পাশের গ্রামে বোনের পাকা বাড়ীতে রেখে আসার জন্য । সবাই বোনের বাড়ীতে যেতে রাজী হলেও মা অনড় । তিনি বাবা এবং ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না । তখন বাহিরে তুমুল বাতাস বইছিল । ছোট ছোট ভাইপো-ভাগনীদের কোলে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রওয়ানা দিলাম এবং মিনিট বিশের সংগ্রামের পরে তাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিতেও সক্ষম হলাম । যাওয়ার পথে রাস্তায় কেবল দু’এটি গাছ পড়ে থাকতে দেখিছিলাম কিন্তু তাতে যাত্রাপথে খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করেনি । বিপত্তিটা বাঁধল আমার ফেরার পথে । সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে প্রবল বাতাসকে পাশ কাটিয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসার জন্য এক প্রকার জেঁদ চেপেছিল । হাতে পাঁচ বেটারির চার্জার লাইট এবং সৃষ্টিকর্তা সৃষ্ট বিজলীর চমক তো আছেই । অনেক সাহস করে রাওয়ানা দিয়েছিলাম । কিছু পথ মাড়িয়ে বড় রাস্তায় ওঠার পর বুঝলাম ফেরার সিদ্ধান্তে ভূল ছিল কেননা রাস্তায় গাছ পড়ে আটকে আছে । পিছনে আর ফিরতে ইচ্ছা করল না । বাতাসের বিপরীতে প্রাণপনে ছুটছি কিন্তু পথ এগুচ্ছে না । একদিকে গাছ পড়ার শব্দ অন্যদিকে প্রবল বাতাস । ভয়ে গোটা দেহে শিহরণ খেলছিল । গাছের বাঁধ পেরিয়ে ফাঁকা পেলেই ছুট কিন্তু সে ছোটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না । কারন রাস্তজুড়ে পতিত গাছে সাড়ি । মিনিট চল্লিশের চেষ্টায় প্রায় মাঝ পথ পাড় হয়ে হিন্দু এলাকার সামনের রাস্তার পাশে শতাব্দী প্রাচীন বিশাল এক তেঁতুল গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম । অনেকটা ক্লান্ত এবং বাতাসের তীব্রতায় সকল শক্তি প্রয়োগ করেও আর সামনে এঁগুতে পারছিলাম না । সম্ভবত মিনিট পাঁচেক তেঁতুল তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম । সেই পাঁচ মিনিটের অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকে মৃত্যুর পূর্বে মিইয়ে দেয়া যাবে না । বই-পুস্তকে কিংবা গুরুজনদের কাছে আসন্ন কেয়ামতের দিন কি ভয়াবহ অবস্থা হবে তার ভাবী আলামতের কথা শুনেছি কিন্তু সিডরের রাতে যা দেখেছি তার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আর কি কিছু হতে পারে ? প্রতিটি বিজলীর চমকে আকাশ-ভূমির মধ্যকার ফাঁকা স্থান যখন আলোকিত হচ্ছিল তখন গোটা এলাকার তছনছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা দেখেছি । মনে হচ্ছিল-এখনি বোধহয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে । আমার মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল এবং ভাবছিলাম এটাই মনে হয় জীবনের সর্বশেষ মূহুর্ত । বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারব তা একবারের জন্যও মনে হয়নি । বাবা-মায়ের কোলে ফিরবার জন্য শেষ চেষ্টা করতে লাগলাম । তেঁতুল তলা ছেড়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে ছুটলাম । তেঁতুল গাছটা ছেড়ে বিশ সেকেন্ডর পথ এগুনোর পরে চর-চর করে বিকট শব্দ শুনলাম । সম্মূখে গতি রেখেই পিছন ফিরে লাইট মেরে দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম শতবর্ষী তেঁতুল গাছটা সে দিকেই উপুড় হয়ে পড়ছে । মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারাচ্ছি কিন্তু শেষ অবধি মনের জোড়ে শরীরে অনেক ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বাড়ীতে পৌঁছলাম । বাড়ীতে পৌঁছার পর বাতাসের গতি আরও বেড়ে গেল । মনে হচ্ছিল, সবকিছুকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করে যাবে । কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না । বাতাসের তীব্র বেগে বাড়ীর অসংখ্য নারীকেল-সুপারিগাছসহ সবকিছু ভেঙ্গে কিংবা উপড়ে যাচ্ছিল । সে দিকে আমার কোন খেয়াল নেই । যেন চেতনাশূণ্য হয়ে রয়েছি । রাস্তার তিক্ত অভিজ্ঞতা, তেঁতুল গাছটি উপরে পড়ার দৃশ্য এবং তেঁতুল তলায় আমার দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থান কেবল স্মৃতিপটে ভাসছিল । পরবর্তীতে কি হচ্ছিল সে দিকে আর খেয়াল নেই । ভয়াল সে রাত্রির বাতাসের তেজ একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । মায়ের ডাকে খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর যখন বাহিরে বের হয়েছিলাম তখন আমার চির চেনা বাড়ীটিকে আর পরিচিত মনে হয়নি । গ্রামের বিভিন্ন দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি ওটা আমার গ্রাম । মনে হচ্ছিল, দুঃস্বপ্নের মধ্যে সময় পাড় হচ্ছে । যেদিকে তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই কেবল ধ্বংসের ছাপ । ভাগ্যিস আমাদের উপজেলাকে রক্ষাকারী বলেশ্বর তীরবর্তী বেড়িবাঁধটি থাকায় আমরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছি । সমতল থেকে প্রায় ৩০-৩৫ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধটি লাখ লাখ মানুষকে প্রাণে রক্ষা করেছিল । সিডরের পরের দিন সকালে বেড়িবাঁধে গিয়ে ৩০-৩৫ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধটির উপর দিয়ে পানি গড়ানোর ছাপ দেখেছি । বাতাসের চাপ যদি আর সামান্য কিছু সময় দীর্ঘ হত তবে বেড়িবাঁধ গড়িয়ে আমাদের আবাসভূমিতে পানি প্রবেশ করত এবং আমাদের ঘরের টিনের উপর দিয়ে সে পানি প্রবাহিত হত । ভাবা যায়, তখন আমাদের কি অবস্থা হত ? সিডর পরবর্তী কয়েকদিন অনেক কাজ করতে হয়েছে । গ্রামে কোন কাজের মানুষ পাওয়া যাচ্ছিল না । সবাই তার নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত । অনেক গাছ কাটতে হয়েছিল । আর কিছু না হোক অন্তত চলাচলের জন্য রাস্তা পরিস্কার করা দরকার । কুঠার, করাতের ব্যবহারে হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল ।
সিডরের আঘাতে যোগাযোগ মাধ্যমে মহাপিরর্যয় নেমে আসে । আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানতে পারিনি । বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানীর নেটওয়ার্কের টাওয়ার একটাও দাঁড়ানো ছিল না । অন্যদিকে দেশব্যাপী বিদ্যুত বিপরর্যয় । সিডরে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছিল রায়েন্দা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নে । শুধু বেড়িবাঁধের অভাবে পানিতে প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল । সিডরের চারদিন পর, গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মিলে সাউথখালীর অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম । সাথে ছিল কয়েক বোতল পানি ও কয়েক প্যাকেট বিস্কুট । ট্রলারে যখন বলেশ্বর নদী পাড়ি দিচ্ছিলাম তখন মাঝের চর ঘেঁষে সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা মৃত হরিনসহ বিভিন্ন প্রাণীর মরদেহ স্তুপ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি । সাউথখালী প্রবেশ করে সেটা অনাবাদী অঞ্চল বলে মনে হচ্ছিল । কোথাও কিছু নেই । একটি ঘরও দাঁড়িয়ে নেই । যা দু’একজন মানুষ চোখে পড়ছিল তাদেরকে খুব ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিল । রাস্তার পাশে কবেল গণকবরের সাঁড়ি দেখেছিলাম । আমাদেরকে পূর্ণ পোশাক পরিহিত দেখে গ্রাম্য অর্ধপোষাক কিংবা কেবল লজ্জাস্থান আবৃত পোষাকে আবৃত মানুষ ছুটে আসছিল আমাদের কাছে কিছু খাবার পাওয়ার আশায় । তখন নিজেরা নিজেদেরকে কেবল অসহায় মনে করিনি বরং কিছুটা বেওকুফও মনে করেছিলাম । সামান্য যে বিস্কুট ও পানি আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম তা শুধু আমাদের জন্য । আমরা একবারের জন্যও ভাবতে পারিনি ঐ জনপদের অবস্থা এমন বেহাল হয়েছে । অনেকক্ষন হেঁটে পরিচিত একজনের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে বসে আছে । ব্যাগ থেকে তাদেরকে বিস্কুট এবং পানি দিলাম তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় মোটেই যথেষ্ট ছিল না । সে বাড়ীর এক বয়স্কা মহিলা আমাদেরকে তাদের বাগান-বাড়ির ধ্বংসস্তুপ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল আর হাপিত্যেশ করছিল । হঠাৎ চোখে পড়ল এক মহিলার মরদেহ । সিডরের চারদিন অতিবাহিত হলেও কেউ জানে না কোথা থেকে সে ভেসে এসেছে । যে ডোবাটিতে মহিলার মরদেহ ভাসছিল তার পাশেই সুন্দর একটি পুতুলের মত কিছু একটা ভাসছিল । খুব কাছে গিয়ে দেখলাম, পুতুল নয় বরং সদ্য জন্ম নেয়া একটি ফুটফুটে বাচ্চার নিথর দেহ । আমরা নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না । সাথে থাকা মহিলাটি জানাল, গত বিকালেও শুধু মহিলার লাশ ছিল । তখন বুঝলাম, রাতের কোন এক সময়ে এ বাচ্চাটি পৃথিবীতে এসেছে । আজও চোখ বুজলে সে বাচ্চাটির ছবি ভেসে ওঠে । শুনেছি, স্রষ্টা ধরাবাসীর পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে বিপদ দিয়ে শাস্তি দিয়ে থাকেন । কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না, সদ্য জন্ম নেয়া পুতুলের চেয়েও সুন্দর বাচ্চাটির দোষটা কোথায় ? ওই দিন বন্ধুরা মিলে অনেক পথ হেঁটে ছিলাম আর মানুষের করুন অবস্থার স্বাক্ষী হয়েছিলাম । আজও আঁৎকে উঠি যখন ১৫ নভেম্বর এবং তৎপরবর্তী দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করি ।
সিডর আমাদের থেকে কম কিছু কেঁড়ে নেয়নি । সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান মতে, সিডর কেড়ে নিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০ মানুষের জীবন । কিন্তু রেড ক্রসের মতে, মৃত্যের সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক । সিডর আঘাত হেনেছিল ১ হাজার ৮১১ টি ইউনিয়নে । প্রায় ৮০ লাখ মানুষ সিডরের কবলে পড়ে । এতে প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয় । কৃষি মন্ত্রনালয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় সিডরে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে । ৩১টি জেলার ২১০টি উপজেলায় ২০ লাখ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল । সিডরের আঘাতে প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ গবাদি পশু মারা যায় । ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয় । সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪৫ কোটি ডলার বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা । যা পূরণ করা বাংলাদেশের জন্য আসলেই কষ্ট সাধ্য । ‘মানুষ মানুষে জন্য’ এই মন্ত্রে দিক্ষীত হয়ে ঝড় শেষ হওয়ার পড়েই বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ৫টি জাহাজ খাদ্য, ত্রাণ সামগ্রীসহ সর্বাধিক ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় পৌঁছে । ইউরোপীয় কমিশন তড়িতভাবে ১.৫ মিলিয়ণ ইউরো অর্থ্যাৎ প্রায় ২.৪ মিলিয়ণ ইউএস ডলার সমপরিমান ত্রাণ সামগ্রি বাংলাদেশের আক্রান্ত মানুষের কাছে পাঠায় । যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেট নেভী প্রায় ৩৫০০ নৌ সেনা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার সহায়তার জন্য বাংলাদেশে আসে । অন্যান্য অনেক সংস্থাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল । যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, সৌদি আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশ সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য অর্থ সাহায্য এবং লোকবল পাঠিয়েছিল কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের, এ সাহায্যের দ্বারা সিডর আক্রান্ত মানুষের চেয়েও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অনেকেই বেশি উপকৃত হয়েছেন । বাংলাদেমের প্রেক্ষাপটে অবশ্য সম্পদ বন্টরে এ দৃশ্য দেখে অন্যসময় অবাক হওয়ার উপায় না থাকলেও সিডরের ভুখা, আশ্রয়হীন মানুষের জন্য প্রেরিত বিদেশী সাহায্যের টাকা আত্মসাৎ করতে দেখে অনেকের মত আমিও অবাক হয়েছিলাম । দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র থেকে যে পরিমান অর্থ সাহায্য এসেছিল তাতে সিডর আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারে আবারও স্বচ্ছলতা ফিরে আসত যদি সঠিক ভাবে তা বন্টন করা হত । কিন্তু তা হয়নি । আজও সিডর আক্রান্ত মানুষের ক্ষত মোছেনি । সিডরের সেই ধ্বংসযজ্ঞ আজ রয়ে গেছে । ব্রিজ, সুইসগেট, কালভার্ট, সাইক্লোন শেল্টারে যে ক্ষতি হয়েছিল আজও তার অধিকাংশ সংস্কার করা হয়নি অথচ আজ সিডরের ৬ বছর পূর্তি হল । সেদিনে সে ভয়াবহতা আজও শরীর ও মনে কাঁপন সৃষ্টি করে । সুতরাং যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেন ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতের ভয়াবহতা ও ক্ষতি থেকে মানুষ কিছুটা লাঘব পেতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে এবং বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে । আমরা গাছ রোপন না করে কেবল বনভূমি ধ্বংস করছি । বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের দক্ষিনে যদি সুন্দরবন না থাকত তবে কেবল সিডরের আঘাতে গোটা দেশ জনমানবশূণ্য মরুভূমিতে পরিণত হত ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৫
সত্যকা বলেছেন: ভাই এ দিন তো ভোলার নয় ।
২| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২৯
ফারদীন নিশ্চিন্ত বলেছেন: মনে পড়লে এখন বুক কাপে। সুন্দর পোস্ট।
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৭
নিষ্কর্মা বলেছেন: আমারও মনে থাকবে অনেক দিন।