নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০০৮ সালে বিশ্বের বৃহৎ পরাশক্তি আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আমাদের দেশেও সে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলেছিল । তখন বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পত্রিকা আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে তাদের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে একটি জনপ্রিয় ফিচার প্রকাশ করেছিল । সে ফিচারটিতে আমেরিকার নির্বাচনে কিভাবে ভোটারদের কাছে প্রার্থীরা কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা প্রচার চালায় তা তুলে ধরা হয়েছিল । যদিও ফিচারটি কৌতুক নির্ভর ছিল তবুও পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । কারণ কৌতুকের মধ্যেও অনেক বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে । ফিচারটিতে বলা হয়েছিল, ডেমোক্র্যাটিক দলের একজন কর্মী একটি সিএনজিতে চড়ে কোথাও যাচ্ছিল । পথিমধ্যে তিনি ড্রাইভারের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করলেন এবং নেমে যাওয়ার সময় নির্ধারিত ভাড়ার সাথে ড্রাইভারকে কয়েক ডলার বখশিস দিল । বিদায় বেলায় যাত্রীটি ছোট্ট করে কেবল বলে গেল, তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলের সদস্য এবং প্রচারণা চালাচ্ছেন । অন্যদিন আরেকজন যাত্রী সেই সিএনজিতে চড়ে কোথায় যাচ্ছিল এবং গাড়ীর মধ্যেই সিগাড়েট ফুঁকে ড্রাঈভারের মুখে ধোঁয়া ছুড়ছিলেন । সাথে ড্রাইভারের সাথে খারাপ আচরণ এবং অশ্লীল ভাষার ব্যবহার তো ছিলই । সিএনজি থেকে নেমে যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে ভাড়া তো দিলই না বরং উল্টো গালি দিল এবং বিদায় বেলায় তিনিও নিজেকে ডেমোক্র্যাটিক দলের সদস্য বলে পরিচয় দিল । উপরে বর্ণিত দু’ব্যক্তিই ডেমোক্র্যাটিক দলের কর্মী বলে পরিচয় দিলেও প্রথম জনের দ্বারা ডেমোক্র্যাটিক দলটির উপকার হয়েছিল এবং সিএনজি ড্রাইভার প্রথম যাত্রীর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার ভোটটিও ডেমোক্র্যাটিক মনোনীত প্রার্থীকেই দিতে চেয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় যাত্রী যে কাজ করল তাতে ডোমোক্র্যাটিক পার্টির ভাবমূর্তির উন্নতি হল না ক্ষুন্ন হল সেটা পাঠকের বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম । উন্নত কিংবা সভ্য দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও কথা চালাচালি হয় তবে সেটা যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে । তবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কিংবা কর্মী সমর্থকরা একে অপরকে যে ভাষায় সম্মোধন করে কিংবা তুলোধুনো করে তা অন্যদেশের জনগণ কিংবা নেতা-নেত্রীরা যদি শুনত তবে বোধহয় কিছুটা লজ্জা পেত । পরিবেশের কারণে আমাদের কান এবং মানসিকতায় সইয়ে যাওয়ায় এমন অকথ্য-কুকথ্য শব্দ কিংবা ভাষা এখন আমাদেরকে বোধ হয় বিস্মিত করতে পারে না । শুঁটকিশালায় যারা কাজ করে তারা যেমন শুঁটকি থেকে উঁৎক বিশ্রী কোন গন্ধ পায়না ঠিক তেমনি আমরাও অশ্রাব্য-অশালীন ভাষার মধ্যেও দোষের কিছু দেখি না কিংবা আমাদের কর্ণও মস্তিষ্কের কাছে কোন বার্তা পাঠায় না !
দেশের প্রতি ত্যাগের বিবেচনায় বিশ্বের প্রতিটি দেশে এক কিংবা একাধিক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে আসন দেয়া হয় । রাজনৈতিক বিবাদের বাইরে অবস্থান করে এসকল মহৎ ব্যক্তিদেরকে সকল সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হয় । আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মহাত্মা গান্ধী কিংবা জওহরলাল নেহেরু, পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আমিরকায় জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা আব্রাহাম লিংকন, দক্ষিন আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলাসহ বিভিন্ন দেশে এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে । এসকল মহৎ ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিজীবনে কোন দলের সমর্থক ছিল তা ভূল ক্রমেও উচ্চারণ করা হয়না কিন্তু তাদের কর্মকান্ড এবং তা থেকে প্রজন্মের শিক্ষা প্রতিনিয়তই আলোচনা হয় । জাতি হিসেবে আমাদের অনেক বেশি সম্পদ না থাকলেও আমাদের দেশের মহৎ কিছু নেতার জন্ম হয়েছিল । যারা দেশের গন্ডী পেরিয়ে তাদের সফলতার দ্যুতি সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিল এবং সুনাম কুঁড়িয়েছিল । মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা জিয়াউর রহমান এমন বড় মাপের সম্মানিত ব্যক্তি । যাদের উত্তরসূরী হতে পেরে আমাদের গর্ববোধ করা উচিত ছিল । কিন্তু বাস্তবতা খুব লজ্জার । রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে তাদের মূল্যায়ণ করতে পারিনি । আমাদের কার্যকলাপ দেখে মনে হয় যেন পণ করেছি, কাউকে সম্মান দেবনা । এমনটা তো হওয়া উচিত ছিল না । দেশ ও জাতীর জাতিয় স্বার্থেই এদেরকে সকল বিতর্কমুক্ত রাখা উচিত ছিল । তবে আমরা সেটা না করে তাদের এমনভাবে উপস্থাপন করছি যার কারনে, কখনও খলনায়ক নায়ক হচ্ছে আবার কখনো নায়ক খলনায়কে রুপান্তরিত হচ্ছে । অথচ যারা সত্যিকারার্থে সর্বযুগের নায়ক তাদেরকে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে । ’৭১-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কিংবা তার পূর্বেও যারা দেশের মঙ্গলের চিন্তায় কাজ করেছে তার সংখ্যা কোন বিচারেই এক নয় বরং তা একাধিক । তবে অন্তত দূর্ভাগ্যের হলেও সত্য নব্বইয়ের দশকের পর যারা পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে তারা প্রত্যেকেই নিজ স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে । তাদের এ কার্যক্রম উদারনৈতিক মনোভাবের অভাবেও হতে পারে আবার ইতিহাস বিকৃত করার মানসিকতায়ও হতে পারে । দেশের জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকার করেছে তাদেরকে যদি দেশের বৃহৎ দু’টো রাজনৈতিক দল ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে তাদের প্রাপ্য মরর্য্যাদা ফিরিয়ে না দেয় এবং তাদেরকে বিতর্কমুক্ত না রাখে তবে বাহিরের মানুষের এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার খুব বেশি সুযোগ নাই । তবে ভূলে গেলে ভূল হবে, ক্ষমতার মোহে যদি এক দল সিংহাসনে থাকার সময় অন্যদল মনোভাবাপন্ন ত্যাগীদের অসম্মান করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাতে ক্ষমতার পালাবদলে ক্ষতিটা সবারই সমান হবে ।
যাদের বিদায় হয়েছে তাদের নিয়ে তাদের স্বজনরা ভাবতে চাইলে আপত্তি নাই কিন্তু যারা আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা যা শুরু করেছে তার পরিণতি কী ? ছোট-বড় ভেদাভেদ না করে যখন তখন যার তার নাম বিকৃত করে উচ্চারণ করা হচ্ছে । যাদের নাম উচ্চারণ করা হচ্ছে এবং যারা উচ্চারণ করছে তাদের দু’পক্ষেরই তাতে কোন সমস্যার সৃষ্টি করছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে না । তবে লজ্জা হচ্ছে আমাদের । বিশ্ব মিডিয়ায় যখন ঢালাওভাবে এমন অসম্মানজনক শব্দ দ্বারা পরস্পরকে সম্মোধন করার খবর প্রকাশ পায় তখন ঐতিহ্যবাহী জাতি হিসেবে অন্য জাতির কাছে লজ্জায় আমাদের মাথা নুইয়ে আসে । ভিন্ন মতাদর্শিক দলের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া কিংবা গালি-গালাজ নয় বরং প্রকাশ্য গালি দিচ্ছে নিজ দলের নেতা সমর্থকদের । যে সকল গালি দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে ‘বেয়াদব’ সবচেয়ে ভদ্র শব্দ ! গালির তালিকায় আরও কত ভারী ভারী শব্দ আছে যা বড় বেশি ভারী । পাগল, কুলাঙ্গার, বেজন্মা, অর্বাচীনসহ বাকী শব্দগুলোর কথা নাইবা উল্লেখ করলাম । বর্তমানে যা শুরু হয়েছে তাতে আপাতত এ ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বন্ধ হবে বলে লক্ষণও নাই । খুব বেশি দুশ্চিন্তা হয় আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে । যারা জনগণের নিরাপত্তা দিবে তারাই যদি পরস্পর কাঁদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ না করে তবে জাতির নিরাপত্তা আসবে কোন পথে ? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্থান তুল্য পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত সংসদেও ব্যবহার হচ্ছে ‘চটি গল্পে’ ব্যবহার যোগ্য শব্দ । আবার বিধি মোতাবেক সে সকল শব্দের বৈধতাও দেয়া হচ্ছে । যাদের কাছে সকল ক্ষমতা তারা বৈধকে মূহুর্তেই অবৈধ আবার অবৈধকে বৈধ ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা রাখে । তবে এমন কিছু বিষয় আছে যা আইনের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া যায় কিন্তু এর পরিণাম মঙ্গলের হয়না ।
কার কাছে দাবী জানালে এ দশা থেকে মুক্তি পাব জানিনা তবে মুক্তি আবশ্যক । গুরুজনদের কাছে সেই ছোটবেলায় শিখেছি, ‘সম্মান পেতে চাইলে সম্মান দিও’ । এ বাক্য এখন কেবল নীতিবাক্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে । সম্পদ, ক্ষমতা এবং চোখ রাঙানির মাধ্যমেই যেন সম্মান পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে । যার যতদিন পৌষ মাস সে ততদিন সবকিছু ইচ্ছামত ব্যবহার করছে । তাতে কার স্বার্থ রক্ষা পাচ্ছে কিংবা কার অধিকার হরণ হচ্ছে তাতে কারো যেন কিছু যায়-আসে না । বাকযুদ্ধের চেয়ে বুদ্ধির যুদ্ধ কার্যকর জেনেও আমরা কথার শক্তি দিয়ে জিততে চাচ্ছি । এ প্রথা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাফল্য আনলেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বেশি । আইন করে সব জিনিস হয় না, হওয়ার আশাও করিনা । কারো কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া বাকস্বাধীনতা হরণও বটে । তাই বলে বাকস্বাধীনতার নামে এমন কোন কথা বলা উচিত নয় যা শ্রোতাদের কাছে বক্তার মর্যাদা লোপের কারণ হয় । সুতরাং এ সমস্যা থেকে সমাধান লাভের জন্য ব্যক্তি পর্যায় থেকে দেশের সর্বোচ্চ আসনধারী ব্যক্তিবর্গের সচেতনতাই সর্বাগ্রে জরুরী । আসুন, সম্মান দিলে সম্মান পাব-এ বাণীকে মানদন্ড রেখে আমাদের রসনাকে ব্যবহার করা চেষ্টা করি । এতে সফলতা পেলে আমাদের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব যেমন কমে আসবে তেমনি দেশের হারানো শান্তি ফিরে আসবে । কে কোনটা চায় সেটা ব্যক্তিগতভাবেই তার নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু পার্শ্ববর্তী মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয়া এবং সঠিক ইতিহাস জানতে দেয়াও এক ধরনের সৎকর্ম ও মহৎকর্ম । এ কর্মে যারা নিজেকে জড়াতে পারবে তারাও মহৎ ব্যক্তিতে পরিণত হবে ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.