নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নিত্য-নৈমিত্তিক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে । প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে এক বা একাধিক সড়ক দূর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ নিহত ও শত শত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে । কোন প্রচেষ্টা সড়ক দূর্ঘটনা রোধে কার্যকরী কোন প্রতিকারে আসছে না । বরং সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানী ও সম্পদহানীর পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েই চলছে । ছোট ছোট দূর্ঘটনাগুলোর খবর দেশের সকল মানুষের কাছে না পৌঁছার কারণে সকল দূর্ঘটনা নিয়ে আহামরি কোন আলোচনা কিংবা এগুলো বন্ধে তেমনভাবে সক্রিয় কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতেও দেখা যায়না । তবে প্রতি বছর এমন কিছু সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যার ভয়াবহ চিত্র শুধু দেশের মানুষকেই মর্মাহত করেনা বরং দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ এমন দূর্ঘটনার ভয়াল খবর শুনে কিংবা ফুটেজ দেখে থমকে দাঁড়ায় । সড়ক দূর্ঘটনা প্রাকৃতিক কোন কারণ নয় বরং মানব সৃ্ষ্ট । সুতরাং সড়ক দূর্ঘটনায় যারা নিহত হয় তাদেরকে পরোক্ষভাবে হত্যা করা হয় । বাংলাদেশে এতদিন সড়ক দূর্ঘনার কারণে গাড়ীর চালক কিংবা গাড়ীতে অবস্থানরত কর্মচারদের দায়ী করা হলেও বর্তমানে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ীর মালিকদেরকেও শাস্তির আওতায় আনার আইন প্রনয়ণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে । সরকারের এ সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও সড়ক দূর্ঘটনা রোধে সহায়ক হবে । গত ২২ অক্টোবর নাটোরের বড়াই গ্রামে বিপরীতমুখী দু’টো বাসের সংঘর্ষে ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটার পর পুরো প্রশাসন সড়ক দূর্ঘটনা রোধ করার জন্য নড়েচড়ে বসেছে । বড়াই গ্রামের দূর্ঘটনাসহ অতীতে ঘটে যাওয়া মারাত্মক দূর্ঘটনাগুলোর প্রকৃত কারণ উদ্ভাবনের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রদত্ত রিপোটের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং সুপারিষের আলোকে সড়ক দূর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য নানামূখী বাস্তবিক কর্মকান্ড ইতোমধ্যে বাস্তবায়ণ করা শুরু হয়েছে । যার মধ্যে লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন অবৈধ গাড়ী এবং গাড়ীর চালকদের গাড়ী চালনা নিষিদ্ধ করা । কিংবা যারা ট্রাফিক আইন অমান্য করবে তাদেরকে ভ্রাম্যমান আদালতে মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ শাস্তির ব্যবস্থা এবং পাঠ্যক্রমে ট্রাফিক নীতিমালার অধ্যায় সংযুক্তিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহন শুরু হয়েছে । তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লাইসেন্সবিহীন গাড়ী ও অদক্ষ চালকদের উৎখাত কল্পে যে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে তা মানুষের ভোগান্তি রোধে কতটুকু সহায়তা করবে ?
বাংলাদেশের জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যক্তিগত কিংবা গণপরিবহনের সংখ্যা । এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে তাদের যাত্রায় পৌঁছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত যানবাহনগুলোর মধ্যে বৈধের চেয়ে অবৈধের সংখ্যাই বেশি । কোথাও বৈধ চালক দিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো হচ্ছে আবার কোথাও বৈধ গাড়ী চালানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ চালক । আবার কোথাও কোথাও গাড়ী কিংবা চালকের কোনটারই বৈধতা নাই । শুধু যে ফিটনেসবিহীন গাড়ী কিংবা লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়ী দূর্ঘটনা কবলিত হয় তা নয় বরং গাড়ী ও চালক-উভয়ের বৈধতা থাকার পরেও দূর্ঘটনায় পতিত হয় । তবে বৈধ চালক ও ফিট গাড়ীর চেয়ে অবৈধ চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ীর দূর্ঘটনায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা হাজার গুন বেশি । সুতরাং দুর্ঘটনার কবল থেকে দেশের মানুষ ও সম্পদকে রক্ষা করার জন্য যতগুলো পদক্ষেপ আছে তা গ্রহন করা জরুরী তবে সে সকল পদক্ষেপের কারণে অন্য কিছু বিপদ সংকুল ঝুঁকির তীব্রতা যদি বেড়ে যায় তবে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন করাই উত্তম । যে ব্যবস্থার মাধ্যমে অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনাও কমে আসবে এবং দেশবাসী অন্যসকল ঝুঁকির কবল থেকেও রক্ষা পাবে । বড়াইগ্রামে দূর্ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় পর্যন্ত সকল স্তরেই লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ীসহ আরও কয়েকশ্রেণীর বিশেষ গাড়ীর বিরুদ্ধে ১০ নভেম্বর থেকে পালাক্রমে অভিযান চালানো হচ্ছে । হঠাৎ করে চালানো এ অভিযানের কারণে গণপরিবহনে চলাচল করা যাত্রীরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছেন । অন্যদিকে কিছু কিছু স্থানে তারিখ দিয়ে অভিযান চালানোর কারনে নির্দিষ্ট দিনে বিপুল সংখ্যক ফিটনেসবিহীন গাড়ী ও অসংখ্য লাইসেন্সবিহীন চালকরা রাস্তায় না নামার কারণে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় প্রশাসনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে না । অন্যদিকে ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব অবহেলা এবং প্রচন্ডভাবে ঘুষ বাণিজ্য করায় ফিটনেসবিহীন গাড়ী ও লাইসেন্সবিহীন চালকরা পূর্বের মতোই তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে । ‘সর্ষে ভূত’ থাকার কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সকল অন্তরায় দূর করে সড়ক দূর্ঘটনা রোধে আকাঙ্খিত সাফল্য অর্জিত তো হচ্ছেই না বরং একটি মহল বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ আয়ের উৎস পেয়েছে । সুতরাং যে অধিদপ্তর থেকে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার সনদ এবং চালকদের গাড়ী চালনার স্বীকৃতি দেয়া হয় সে বিভাগসমূহ যতদিন পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত না হবে ততদিন সড়ক দূর্ঘটনা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার উপায় আছে বলে ধারণা হচ্ছে না ।
লাইসেন্সবিহীন চালকদের এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ীর মালিকদের সময় ও নির্দিষ্ট নীতিমালা না দিয়ে হঠাৎ তাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চালানোয় কয়েকভাবে ঝুঁকি রয়েছে । আইনের বিচারে তারা লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালক এবং গাড়ীগুলো ফিটনেসবিহীন হলেও এই অদক্ষ ব্যক্তিদের যোগ্যতা এবং লক্কার ঝক্কার গাড়িগুলোই ছিল তাদের এবং তাদের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর রুটি রুজির একমাত্র অবলম্বন । হঠাৎ তারা কর্মহীন হয়ে পড়ায় তারা যেমন সমস্যায় পড়েছে তার চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে তাদের পরিবার-পরিজন । গাড়ি চালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা হঠাৎ করে অন্য কোন পেশায় নিজেদেরকে মানিয়ে আয় রোজগার করে তা দিয়ে তাদের উপর নির্ভরশীল সবার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করবে এটা ধারণা করা প্রায় অসম্ভব । কাজেই এ সকল মানুষেরা তাদের পরিবারের সদস্যদের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন পেশায় ছুটবে । কিছু কিছু মানুষ তাদের পূর্ব স্বভাব সিদ্ধ অবৈধ পন্থায় খুব সহজে জীবিকা অর্জন করার চেষ্টা চালাবে । এতে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির সাথে সাথে সমাজবদ্ধ বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে । সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি কিংবা লুটপাটসহ আরও অনেক অপরাধ বেড়ে যাবে বলে অনুমেয় হচ্ছে । একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরও অনেক সমস্যার জন্ম দেয়া খুব বেশি অর্থবহ নয় বরং একটি সমস্যাকে কিভাবে জীবনের তরে নির্মূল করা যায় সে প্রচেষ্টা করাই বেহেতের ।
সকল যুক্তি-তর্ক কিংবা আলোচনা-সমালোচনার পরেও সরকার যেভাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ী ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং আরও নতুন কৌশল অবলম্বন করে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে । তবে বর্তমানে যেভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে তাতে পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে । দেশে এমনিতেই কর্মঠ বেকারের সংখ্যা প্রায় কোটির কাছাকাছি এবং এ বিপুল সংখ্যক বেকারের ভরণপোষণসহ বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত দেশের অগ্রযাত্রা শুধু ব্যাহত হচ্ছে না বরং বিপুল পরিমান সম্পদের গচ্ছাও যাচ্ছে । সেই বেকারদের দীর্ঘ সারির সাথে কর্মজীবি আরও অসংখ্য মানুষকে বেকার বানিয়ে না রেখে বরং অন্যকোন পথে সমাধানের খোঁজা উচিত । ফিটনেস বিহীন গাড়ীগুলোর হয়ত ফিটনেস ফিরিয়ে দেয়া যাবে না কিন্তু লাইসেন্সহীন চালকদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদেরকে দক্ষ ও নিবন্ধিত করে সার্বিক ভারসাম্যতা রক্ষার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে । সকল ক্ষেত্রের দুর্নীতি দূর করতে না পারলে কখনোই সড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ী উচ্ছেদ এবং অদক্ষদের লাইসেন্সপ্রাপ্তির সম্ভাবনার বাইরে রাখা যাবে না । স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহীতার স্থানকে আরও শক্তিশালী করতে হবে । সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন প্রচেষ্টাই ততক্ষন পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখবে না যতক্ষন গণমানুষকে সে আন্দোলনে শরীক কারা যাবে না । কর্তৃপক্ষের সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের স্বচ্ছ অবস্থান এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতার মাধ্যমেই কেবল সকল অন্যায়-অপরাধ থেকে দেশকে মুক্ত রাখা এবং সড়ক দূর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব । দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকদের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে তেমনি লাইসেন্সপ্রাপ্ত দক্ষ চালকদেরকেও বিধি-নিষেধের আওতায় আনতে হবে ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.