নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা, নানা জল্পনা-কল্পনা, নাটকের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দীর্ঘ ২৩ ঘন্টা পর উদ্ধার হল জিয়াদের নিথর দেহ । রাজনধীনার শাজাহানপুরে রেলওয়ে কলোনীর নাসির-খাদিজা দম্পতির ৪ বছরের শিশুপুত্র শুক্রবার বিকালে পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে সেখানে রেলের পরিত্যক্ত অরক্ষিত ৬০০ ফুটেরও বেশি একটি গভীর পাইপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল জিয়াদ । জিয়াদ এ পাইপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার সময় তাকে প্রত্যক্ষভাবে কোন চোখ দেখেতে না পাওয়ায় ব্যাপারটি নিয়ে সন্দেহ দানাবাঁধে । অবশ্য তার লেখারসাথীদের মধ্যে পুষ্পিতা নামক একটি মেয়ে ফেদারের কর্ক কুঁড়াতে গিয়ে পাইপের ভিতর থেকে মা-মা বলে কান্নার ধ্বনি শুনতে পায় । তখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি মূলত পাইপের মধ্যে কে পড়ে গেছে । অনেক খোঁজাখূঁজির পর যখন জিয়াদের মা-বাবা জিয়াদকে পাচ্ছিল না তখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায় জিয়াদের করুণ পরিণতির কথা । প্রথমদিকে জিয়াদের নাম নিয়েও ভিন্ন মত মিডিয়ায় আসতে থাকে । প্রথমদিকে রুবেল, কিছু পর জিয়া, জিহাদ কিংবা জিয়াদেই ঘুরতে ফিরতে থাকে শিশুটির নাম । তবে অবশেষে নিশ্চিত হওয়া গেছে নাম যতগুলোই উচ্চারিত হোক সেগুলো এক ব্যক্তিরই নাম । জিয়াদ বিকাল পৌণে চারটার দিকে পাইপের মধ্যে পতিত হলেও সন্ধ্যা সাতটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট এবং স্থানীয় পুলিশ, র্যাবসহ সকল শ্রেণীর পেশাজীবি এবং এলাকাবাসী শিশু জিয়াদের উদ্ধার কাজে তৎপর হয় । শুধু উপস্থিতরাই নয় জিয়াদের জন্য প্রার্থনারত হয় গোটা দেশবাসী এমনকি বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীসহ অনেক জাতি সারারাত টিভির সামনে বসেছিল । শুক্রবার সারা রাত ধরে চলতে থাকে উদ্ধার অভিযানের কাজ । প্রথমেই অক্সিজেন এবং জুসসহ কিছু খাবার দিয়ে জিয়াদের প্রাণ রক্ষা করার চেষ্টা করা হয় । যদিও উদ্ধারকর্মীরা দাবি করেছিল, জিয়াদ জুস খেয়েছে কিন্তু ৬০০ ফিট উপর থেকে পতিত হওয়া ৪ বছরের একটি শিশু সেখানে কোন অবস্থায় ছিল তা ধারণার বাইরে নিশ্চিত করে বলা যায়না । দমকলবাহীনির প্রশিক্ষিত কর্মীরা প্রথম দিকে দড়ি দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয । কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি । যদিও উদ্ধারকর্মীরা বারবার দাবী করেছে, শিশুটি উপর থেকে ফেলা দড়ি ধরেছিল এবং কিছুটা উঠার পর আবার ছেড়ে দিয়েছে । এভাবে ধারাবাহিকভাবে চটের বস্তা, পাটের বস্তা ফেলে উদ্ধারের নানা মহড়া প্রদর্শন করা হয়েছে । পরবর্তীতে ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের মধ্যে দিয়ে ২ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের যে পাইপটিতে পাম্প লাগিয়ে পানি তোলা হত সেটা কেটে উঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এবং ক্রেনের সাহায্যে সেটা তুলে ফেলা হয় । এরপর ওয়াসার ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা পাইপের মধ্যে নামিয়ে শিশুটির অবস্থান জানার চেষ্টা করা হলেও মানবদেহের কোন উপস্থিতি দেখা যায়নি । তবে পাইপের নিচে টিকটিকি, ব্যাঙ, কাগজ এমনকি কাগজের লেখাও স্পষ্ট দেখা গেছে । ক্যামেরা নামানোর পূর্বে পাইপের মধ্যে নেমে জিয়াদকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল সাহসী যুবক বশির । সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের পরে উদ্ধার অভিযানে এই বশিরের ভূমিকা ছিল অনস্বীকারর্য্য । শেষ পর্যন্ত পাইপের মধ্যে বশিরের নামার অনুমতি মেলেনি । কেননা একটা জীবন বাঁচাতে গিয়ে আরেকটি জীবন হুমকিতে ফেলে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় । অবশেষে পাইপের মধ্য থেকে রাত ২ টা ৪৭ মিনিটে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্যামেরাটিকে জিয়াদের অস্তিত্ব নির্ধারণ ব্যতীতই তুলে আনা হয় । রাত ২ টা ৪৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আলি আহমেদ জানান, পাইপের তলদেশে যেসব বস্তু দেখা যাচ্ছে তা গ্রিপার দিয়ে তুলে আবারও ক্যামেরা পাঠিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে । তবে ন্যাশনাল সিকিউরিটিজ ইন্টেলিজেন্সের একজন যুগ্ম পরিচালক পুরোবিষয়টিকে গুজব বলে আখ্যা দেন । পরবর্তীতে অবশ্য শনিবার বেলা দুইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসসহ সকল উদ্ধারকারী দল থেকেও একই ধরণের ব্যাখ্যা করা হয় অর্থ্যাৎ তাদের মতে, পাইপের মধ্যে কোন শিশু পতিত হয়নি ! আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণার ২০-৩০ মিনিট পরেই নাটকীয়তার শুরু । স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠনের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী যুবক তাদের উদ্ভাবিত সাদামাটা একটি লোহার যন্ত্র দিয়ে নিথর জিয়াদের দেহ উদ্ধার করে । তরুণদের সাফল্যে প্রশ্ন জাগে প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারীদের দক্ষতা নিয়ে । তরুণদের সাফল্যের পরেও দেশবাসীকে শোক সায়রে ভাসিয়ে জিয়াদ সত্যিই দ্বিতীয়বারে স্থায়ীভাবে পৃথিবীল বৃন্ত থেকে জড়ে পড়ল ।
উদ্ধারকারী প্রশিক্ষিত দল কর্তৃক পাইপের মধ্যে কোন মানবদেহের অস্তিত্ব না থাকার দাবী করে তাদের উদ্ধার অভিযান সমাপ্তি ঘোষণা করার মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই স্থানীয়দরে উদ্যোগে জিয়াদ উদ্ধারের পর অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছে । প্রথমতঃ পাইপের মধ্যে যদি কোন শিশুর অস্তিত্ব না থাকে তবে জুস খেয়েছে বলে যে দাবী করা হয়েছিল সেটা কিভাবে সম্ভব ছিল ? দ্বিতীয়তঃ কান্নার আওয়াজ এল কোথা থেকে ? তৃতীয়তঃ হ্যান্ড মাইক দিয়ে কথা বলা হয়েছিল কার সাথে ? স্বভাবতই সরকার ও প্রশাসনের কাছেও কতগুলো প্রশ্ন থাকছে । প্রথমতঃ পরিত্যক্ত পাইটি অরক্ষিত ছিল কেন ? দ্বিতীয়তঃ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেয়ার দায়িত্ব কার ? তৃতীয়তঃ কোনটা জরুরী-মরনগাতী অস্ত্র ক্রয় করা নাকি জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম জোগাড় করা ? শিশু জিয়াদের অভিভাবক এবং শাহজানহানপুরের রেল কলোনীর অধিবাসীদের কাছেও কয়েকটি প্রশ্ন জাগে । প্রথমতঃ আপনাদের মাত্র চার বছরের সন্তান বাসা থেকে এভাবে একাকি বেড়িয়ে গেল অথচ তাতে আপনাদের কোনে উদ্ধেগ ছিল না কেন ? দ্বিতীয়তঃ যেহেতু কলোনীবাসীদের সন্তানেরা যে মাঠে খেলাধূলা করে সে মাঠের পাশে এমন একটি বিপজ্জনক মরনকূপ থাকার পরেও আপনারা কেন সেটাকে ঢেকে রাখেননি ?
শিশু জিয়াদ আর কোনদিন ফিরে আসবে না তবে শিশুটির মৃত্যু আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিয়ে গেল । গতানুগতিকভাবেই হয়ত এ থেকে কিছুই শিখব না কেননা আমরা এমনই ! অতীতের বহু দূর্ঘটনায় আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সচেতন হইনি । যে কারণে বার বার আমাদেরকেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়েছে । রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের প্রতি অবহেলার কারণেই শিশু জিয়াদকে জীবন দিতে হয়েছে অথচ এখনও সে অর্থে দায়িত্বশীলদেরকে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি । একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে । শুধু কি কর্মকর্তাই দায়ী ? কর্মচারী থেকে শুরু করে উপরস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া আবশ্যক । শুধু সাময়িক বরখাস্ত করলেই হবে না বরং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে । দেশবাসী স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারিন্টি চায় । মৃ্ত্যুকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে কিন্তু জিয়াদের এ মৃত্যু কি মানা সম্ভব ? জিয়াদের মৃত্যু পুরো দেশবাসীকে যেভাবে শোকাহত করেছে অন্যান্য অস্বাভাবিক মৃত্যু যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, হত্যার কারণে যে মৃত্যু হয় তাও কি আমাদের এভাবে শোকাহত করে ? অথচ অস্বাভাবিক প্রতিটি মৃত্যুর রোধে কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে । শনিবার বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বললেন, জিয়াদকে উদ্ধার করতে যে ধরণের আধুনিক সরঞ্জাম দরকার তা তাদের নাই । কেন থাকবে না ? যে দেশ শত কোটি টাকার মরণগাতী অস্ত্র কিনতে পারে সে দেশ কেন কয়েক কোটি টাকার জীবনরক্ষাকারী আধুনিক সরঞ্জাম কিনবে না ? প্রশ্ন করলে প্রশ্ন জন্মাতেই থাকবে কিন্তু কে দেবে উত্তর কিংবা এসব প্রশ্নের উত্তর কি ?
শিশু জিয়াদের প্রাণনাশের ক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যতটা দায়ী তার চেয়ে তার বাবা-মা কম দায়ী নয় । মাত্র ৪ বছরের একটি শিশু দুপুর বেলা কাদের সাথে বের হয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে এ খবর রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয় । পরিবারের শিশু সদস্যের প্রতি এমন উদাসীনতা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয় । শিশু জিয়াদ যদি গভীর পাইপের মধ্যে না পড়ে পানিতে পরে মারা যেত তবে হয়ত রেলওয়ে কলোনীর বাইরে সে খবর পৌঁছত না । কাজেই এ ঘটনা থেকে সকল অভিভাবককে শিক্ষা নিতে হবে । সন্তানদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে । শিশু জিয়াদের মৃত্যু গোটা দেশবাসীকে শোকে মুহ্যমান করেছে কিন্তু অন্য কোন শিশুর মৃত্যু হয়ত গোটা দেশবাসীকে এভাবে ভাবাবে না কিন্তু একটি পরিবারের জন্য সে পরিবারের সদস্যের মৃত্যু তো জগদ্দল পাথরের মত বোঝা । সরকারি প্রশিক্ষিত কর্মীরা যেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ্য হল সেখানে কয়েকজন যুবক সাদামাটা প্রচেষ্টায় সফল হয়ে গোটা দেশবাসীকে আবারও জানিয়ে দিল তারুণ্যের শক্তি । সুতরাং সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, তরুণদেরকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তুলুন । এই তরুণরাই পারবে দেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে । সমাজ, রাষ্ট্র যদি তরুণদেরকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয় তবে রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য এ তরুনরাই যথেষ্ট হবে ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৩৬
সত্যকা বলেছেন: নিশ্চিতভাবে জানি এরপরেও আমাদের শিক্ষা হবে না । কারণা আমরা তো নির্লজ্জ !!!
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:২৮
বংশী নদীর পাড়ে বলেছেন: তবুও যদি আমাদের শিক্ষা হয়।