নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ক্যালেন্ডার থেকে চিরতরে বিদায় নিল আরও একটি বছর । এ বছরে কি অর্জন করতে পেরেছি এবং কি পারিনি তার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত অথচ প্রত্যাশা মাফিক কিছুই মিলছে না । দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই অর্জন করতে পারতাম কিন্তু তার বেশির ভাগ-ই হয়নি । বরং আপাত দৃষ্টিতে হারানোর পাল্লাটাই বেশি ভারী । যেভাবে হয়েছে তা না হয়ে ওল্টোও হতে পারত কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তা হয়নি । সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অর্জনের সাথে বর্জনের চিত্র মিলাতে চাইলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় । এমনটাই কি কাম্য ছিল ? দীর্ঘ ৩৬৫ দিনের পথ-পরিক্রমায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে বিশৃঙ্খলার চিত্র মারাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে । অর্জন যে একেবারেই নাই তা নয় বরং বর্জনের পাশে অর্জনকে দাঁড় করালে অর্জনকে খুব বেশি রোগা মনে হয় । কথিত আছে, যে দিনটা যায় সেটাই ভালো যায়, সামনে যে দিন আসে সেগুলোই খারাপ । এ কথাটি যদি সত্য হয় তবে প্রশ্ন জাগে-আগামী দিনগুলো কতটা খারাপ হতে পারে ? ’১৪ সাল জুড়েই ছিল চরম অস্থিরতা । প্রাকৃতিক দূর্ঘটনার চেয়ে মানবসৃষ্ট দূর্ঘটনার সংখ্যাই ছিল বেশি । প্রাকৃতিক দূর্ঘটনার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা অল্প দিনেই কেটে ওঠা সম্ভব কিন্তু মানবসৃষ্ট দূর্ঘটনার ক্ষতি তি কোন দিনই কাটিয়ে ওঠা যাবে ? রাজনৈতিক বাগ-বিতান্ডা থেকে শুরু করে সামাজিক অপরাধের উলঙ্গ মহড়া চলেছে গোটা বছর জুড়ে । মানুষ দু’বেলা খেতে পেরেছে ঠিক কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ঘুমুতে পারেনি । গুম, খুন ও মানবাধিকার লংঘনের বছর হিসেবে ২০১৪ কে ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থাকতে হবে । গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত, বাক-স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় অন্যায়ভাবে শৃঙ্খল পড়ানোর চেষ্টা ও দমন-পীড়নের বছর হিসেবেও ’১৪ সালকে ভূলে যাওয়া সহজ হবেনা । শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, গার্মেন্টস শিল্প ও অন্যান্য শিল্পে অস্থিতিশীলতা, জিএসপি সুবিধা বন্ধ এবং সড়ক ও নৌ দূর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষে অকালে প্রাণ হাড়ানোর জন্যও চিহ্নিত থাকবে বিদায়ী বছরটি । মাদক দ্রব্যের সয়লাব, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, চোরাকারবারীদের চরম দৌরাত্ম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা ও দেশব্যাপী বিদ্যুত বিপরর্যয়ের কথা খুব দ্রুত ভূলবার নয় । প্রতিবেশী ভারতের বিশ্বাস ঘাতকতা, বর্হিবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন ও দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবনমনেরে দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকবে । বিদায়ী বছরে দেশের বিশিষ্ট জনদের মধ্য থেকে কিছু বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিদায় দেশে মারত্মাক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে । বিদায়ী বছরে অর্জনও কম ছিল না । দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী বাজেট, জাতীয় সংসদের স্পীকার ও একজন সাংসদের দু’টি আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃত্ব্ পাওয়া কম কিসে । দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম চাল রফতানি করার স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনও দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে । মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিকভাবে আরও অনেকগুলো নতুন দিকপাল উম্মোচিত হয়েছে । বছরের প্রথম দিন দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে কোটি কোটি নতুন বই তুলে দেওয়ার কৃতিত্বও অর্জিত হয়েছে । তবে মন খারাপ করেই বলতে হয়, যোগ-বিয়োগ করে বর্জনের চেয়ে অর্জনের সংখ্যা একেবারেই কম ।
বিদায়ী বছরে পুরোটা জুড়ে সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা ছিল গুম ও খুন । অনেকগুলো খুনের ঘটনা ঘটলেও তার মধ্যে রর্য্যাবের হাতে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, রাজধানীর বিহারী পল্লিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১০ জন এবং সুন্দরবনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে । এ ছাড়াও রাজধানীতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকী, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা, রাজধানীর মগবাজারে তিন খুন ও কেরানীগঞ্জে চার খুনের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে । সড়ক ও নৌ দূর্ঘটনার মধ্যে নাটরের বড়াই গ্রামের দু’টো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এবং পিনাক-৬ নামক লঞ্চ ডুবিতে শত শত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা বছরজুড়েই বহুল আলোচিত ছিল । রাজধানীতে সড়ক দূর্ঘটনায় সাংবাদিক ও এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক জগলুল আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে । বিদায়ী বছরের শেষ মূহুর্তে রাজনধানীর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে ৬০০ ফুট গভীর পাইপের মধ্যে ৪ বছরের শিশু জিহাদ পড়ে যাওয়া এবং সরকারী উদ্ধারকর্মীদের বিফলতায় তার মৃত্যুও সম্ভবত দেশের সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা হয়ে থাকবে । এছাড়া সংখ্যালগুদের উপর হামলা ও নিরর্য্যাতনের ঘটনা ঘটেছে । দেশে গুমের সংস্কৃতি গত দু’বছর ধরে ব্যাপক আলোচিত হলেও ’১৪ সালে এবি সিদ্দীকির গুম এবং উদ্ধার হওয়ার ঘটনাই সর্বাধিক আলোচিত হয়েছে । এছাড়াও গুম বিরোধী আন্দোলনে গুম হওয়ার মানুষদেরকে ফেরত পাওয়ার দাবী বারবার উত্থাপিত হয়েছে । ডাক্তার ও চিকৎসকের সম্পর্কের অবনতিতেও ’১৪ সাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে । বিদায়ী বছরের সারা দেশব্যাপী ডাক্তাররা একাধিকবার ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালন করেছে । লোডশেডিংয়ের ভয়াবহ অবস্থা এবং ১লা নভেম্বর সারাদেশব্যাপী বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছিল । এছাড়াও ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে জনমনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে ।
ফরমালিন আগ্রাসন ও খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল মিশ্রনের জন্য ’১৪ সালকে ভূলে যাওয়ার উপায় নাই । ফরমালিন নামক নিষিদ্ধ বিষ মিশিয়ে সব ধরনের খাদ্য দ্রব্যকে মানুষের জীবনের জন্য হুমকির মাধ্যম বানানো হয়েছিল । প্রশাসনের চেষ্টাও ফরমালিনের আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না । এছাড়াও বাজারে ভেজাল ওষুধে সয়লাব হয়েছে । বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং শিক্ষার মান কমে যাওয়ার চিত্র বার বার উম্মোচিত হয়েছে । তবুও প্রশাসন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি । পাশের হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন । বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রির কথা বেশ গুরুত্ব নিয়েই আলোচিত হয়েছে । দেশের কতিপয় গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিদেরকে নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করায় সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক । দোষারোপের রাজনীতির বলি হতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশকে । মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সকল বিদেশীরা বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে তাদেরকে আমন্ত্রন করে পদক দেয়া হয়েছে । তবে লজ্জার কথা, তাদেরকে যে পদক দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই ভেজাল । স্বর্ণের নামে তামা দিয়েই গড়া হয়েছিল সে পদক । খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার কয়েকজনকে রাজাকার সম্মোধন করা হয়েছে । বঙ্গুবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা জিয়াউর রহমানের মত সর্বজন গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিদেরকে বিরুদ্ধবাদীরা নানা অযৌক্তিক বক্তব্য দিয়ে পরস্পরের প্রতি নতুন প্রজন্মের খারাপ ধারনা সৃষ্টির পায়তাঁরা করা হয়েছে । বিভিন্ন মন্ত্রীদের উদ্ভট কথাবর্তায় সারা বছর জুড়েই ছিল চরম বিতর্ক । ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার জন্যও বিদায়ী বছরকে মনে রাখতে হবে । ধর্ম নিয়ে সাবেকমন্ত্রী লতিফ সিদ্দীকির কটুক্তি মুসলিম জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে আঘাত দিযেছে । বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছু নামকাওয়াস্তের মুসলিম শিক্ষক-শিক্ষিকা ইসলাম ও এর পালনীয় বিধি-বিধান নিয়ে কটুক্তি করেছে । ’১৪ সাল জুড়েই শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজমান ছিল । বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র আন্দোলন, নিজেদের মধ্যে কোন্দল, শিক্ষার্থী হত্যা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার । বিদেশী সংস্কৃতি বিশেষ করে ভারতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশীয় সংস্কৃতির প্রায় বিদায় হয়েছে বিদায়ী বছরে । সে সকল অপসংস্কৃতির প্রভাবে আত্মহত্যা এবং বিচ্ছেদের মত ঘটনাও ঘটেছে । সারা বছর জুড়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে অনেক পণ্যই সাধারণ মানুষে ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল । বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন । দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ দল নির্বাচনে অংশগ্রহন না করলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে । দেশের মোট সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩ টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্ধন্ধীতায় সংসদ সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ! দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক অনাকাঙ্খিত ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ঘটেছে । বিরোধী মতকে দমনের নগ্ন পদচারণাও হয়েছে বিদায়ী বছরে ।
বিদায়ী বছরের বিদায়ের সাথে অপ্রাপ্তি, হতাশা কিংবা ক্ষোভের পুরোটাই দেশবাসী ভূলে যেতে চায় । নতুন স্বপ্ন বুনতে চায় নতুন বছরকে ঘিরে । ২০১৪ সালে যা হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি জাতি আর দেখতে চায়না । সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমেই শুরু হোক ’১৫ । দূর হোক সকল অপ্রাপ্তির হতাশা । পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তির পরশ লাগুক । সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরপাধ মুক্ত একটি বাংলাদেশের ছবি অঙ্কিত হোক আগামী দিনের জন্য । শিক্ষাক্ষেত্রের নৈরাজ্যও দূর করা হোক । দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় আত্মনিয়োগ করা প্রত্যেকের দায়িত্ব হোক । গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিদেরকে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা হোক । রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতিকে চিরতরে বিদায় করার উদ্যোগ নেয়া জরুরী । সর্বোপরি রাজনৈতি স্থিতিশীলতা না আসলে কোন উন্নয়ণ ধারাবাহিক করা সম্ভব নয় । কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানাই । নতুন বছরটি যেন আমাদেরকে নিরাশ না করে তার জন্য সকলের সচেতনতা জরুরী ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
[email protected]
©somewhere in net ltd.