নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বে দিনে দিনে মানুষ যান্ত্রিক মানবে পরিণত হচ্ছে । ব্যস্ততা মানবজীবনকে এমনভাবে ঘিরেছে যেন দম ফেলার সামান্যতম ফুসরৎ নাই । কর্মঘন্টার কোন এক ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিতে গেলেই যেন চলমান প্রতিযোগীতা থেকে মানুষ অনেক পিছিয়ে পড়ছে । তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মানুষ মুক্ত জীবনে ফিরে যেতে পারছে না । তবুও মানুষ মূহুর্তের জন্য হলেও একটু বিশ্রাম খোঁজে । মানব দেহ তো আর যন্ত্র না যে সেটা মেশিনের মত অনবরত কাজ করতে পারবে । কাজ করতে করতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দেহ-মন অবসাদে আক্রান্ত হয় । শুধু পেটপুরে খেয়েই তো আর সুস্থ থাকা যায়না । দেহ-মনকে সুস্থ রাখার জন্য আনুষঙ্গীক আরও অনেক কিছুই দরকার । মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য গ্রহন আবশ্যক তেমনি মনকে প্রফুল্ল রাখার জন্য প্রয়োজন চিত্তবিনোদনের । মনের সুস্থতা ছাড়া মানুষ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে না । মন সুস্থ থাকলে দেহ এমনিতেই সুস্থ থাকে । কর্মক্ষম থাকার জন্য মনটাকে সতেজ রাখা জরুরী । মনকে সতেজ রাখতে অনেকগুলো শর্ত পূরণ করতে হয় । সুস্থ বিনোদন মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে । বিনোদনের কথা উঠলে তার মধ্যে অনেক কিছুই এসে যায় । শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধুলা থেকে শুরু করে গান-বাজনাসহ আরও কত কী । মানুষের সুষ্ঠু স্বাভাবিক বিকাশের জন্যও চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন । বিশ্বায়ণের যুগে চিত্তবিনোদের সংজ্ঞা পাল্টিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির সাথে বহু আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি যোগ হয়েছে । বিদেশী সেসব সংস্কৃতির মধ্যে কতগুলো আমাদের দেশের মানুষের জন্য উপকারী হলেও এমন কযেক ধরণের সংস্কৃতিও যোগ হয়েছে যা অনুসরণ করলে নৈতিক অধঃপতন ভিন্ন উন্নতির কোন সম্ভাবনা নাই । চিত্তবিনোদনের উপকরণের মধ্যে নাটক সিনেমার ভূমিকা অনবদ্য । আমাদের দেশের সাংস্কৃতির অঙ্গন নাটক-সিনেমায় অনেক সমৃদ্ধ । মনের খোরাক হিসেবে আনন্দ-বিনোদন প্রাপ্তির জন্য যতটুকু আবশ্যক তার সব কিছুই এর মধ্যে রয়েছে । তবে কখনো কখনো বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের দেশের নাটক-সিনেমায়ও অশ্লীলতা প্রবেশ করেছে । ধীরে ধীরে সে অশ্লীয়তার গভীরতা বৃদ্ধি পেয়ে স্থায়ী একটা ক্ষতের সৃষ্টি করেছে । মানসিকতার পচন সৃষ্টিকারী সে ক্ষত শুধু নিজেই বাড়ছে না বরং সমাজকেও ধ্বংসের দিকে টেনে নিচ্ছে । এছাড়া আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ততার সুযোগ নিয়ে এমন সব সংস্কৃতির ছোঁয়া নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছে যা বিবেক ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট । অশ্লীল সংস্কৃতির প্রভাবে দিন দিন সমাজে অন্যায়-অপরাধ বেড়েই চলছে । অথচ এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির চেষ্টা না করে আরও গভীরে শিকড় প্রথিত করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ।
প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারী-মার্চ-এপ্রিল জুড়ে দেশের প্রায় প্রতিটি শহর-নগরে আনন্দ মেলার নামে একটি উৎসব বসে । এটাকে আবার কখনো যাত্রা কিংবা সার্কাস নামেও নামকরণ করা হয় । বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে উপজেল-থানা পর্য্যায় পর্যন্ত এর আয়োজন করা হয় । স্থানভেদে এর রূপও ভিন্ন হয় । অল্প সময়ে কোটি টাকা আয়ের এ এক সুবর্ণ সুযোগ । কয়েক রাতের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ কোটিপতিতে পরিণত হয় । লাভের অঙ্কটাই মূখ্য বিষয় নয় কেননা অবসন্ন মনকে প্রফুল্ল করার জন্য এ তো এক মহা আয়োজন ! নামে আনন্দ মেলা হলেও এর মাধ্যমে কতটুকু আনন্দ দেওয়া হয় তার সীমা সম্পর্কে ধারণা পেতে এ সংশ্লিষ্ট লোকদেরকে জিজ্ঞাসা সাথে কথা বলেছিলাম । অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যখন বৃহৎ কিংবা মফস্বল শহরে আনন্দ করার একটু সুযোগও রাখা হয়না তখন এ ধরণের আনন্দ মেলার দিকে মানুষ আগ্রহী হয় । কিন্তু আনন্দ মেলায় যেসব কর্মকান্ড হয় তা কি সভ্য ও রুচিশীল মানুষের জন্য ? স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সময় কাটানোর আদৌ কি কোন অবস্থা সেখানে থাকে ? দিনের আলোতে হয়ত কিছু সময় ঘুরে বেড়ানো যায় কিন্তু রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সেখান থেকে যেন শয়তানও পালাতে চায় !
মেলার কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হরেক রকমের খাবার, নতুন নতুন জিনিসের সংগ্রহ । যে জিনিসগুলো দেখতে আকর্ষণীয় কিন্তু দামে হবে সস্তা । শিশুদের জন্য থাকবে নাগরদোলা, বেলুন ফাটানো, ট্রেন ভ্রমন, পুতুল নাচের ব্যবস্থা । সব বয়সীদের জন্য থাকবে হরেক রকমের আয়োজন যা প্রকৃত আনন্দ দিতে সক্ষম । বৃত্তাকার স্থানে ব্রেকহীন মটরগাড়ীর ঘুর্ণয়মান অবস্থা, হাতি দিয়ে নানা কৌশল দেখানো, বানর কিংবা সাপের খেলা, ম্যাজিকসহ আরও কত কি । মেলার কোন এক কর্ণারে বসে ক্যানভাসার চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে তার রকমারী জিনিসের সাফল্যের কথা বলে দর্শক-ক্রেতাদরে আকৃষ্ট করবে । আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে থাকবে ধুমায়িত কাপের পার্শ্বে চুমুক । দল বেঁধে বন্ধুরা ঘুরবে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে । ক্রয়ের চেয়ে দেখবে বেশি । ফাঁকে ফাঁকে পছন্দের দু’এটি কিনেও নিবে । বাহারি আলোকচ্ছটায় বর্ণিল হবে মেলার চারধার । ছোট্ট শিশুরা দলবেঁধে ছুটবে আর চিৎকার চেঁচামেচি করবে । এ যেন এক ভিন্ন পরিবেশ । শত দুঃখে দুঃখী মানুষও এখানে উপস্থিত হলে আনন্দের উপলক্ষ খুঁজে পাবে । কেননা মেলা যে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি । দেশের মানুষকে কিভাবে আনন্দের মাধ্যমে সুখ দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা করেই এ মেলার আয়োজন । কিন্তু বর্তমানে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলার পিছনে আনন্দ নামক বিশেষণ সংযুক্ত করে এখন কি সব কান্ডকারখানা করা হচ্ছে ? আনন্দ প্রদানের এমন সব আয়োজন করা হচ্ছে যা সমাজকে কলুষিত করছে । মানুষকে ক্ষণিকের মোহাবিষ্ট করে ধ্বংস করা হচ্ছে মানুষের নীতি নৈতিকতা ।পরিবার, সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির সব রসদ প্রকাশ্যেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে । এভাবে আর কতদিন চলবে ?
আনন্দ মেলার নামে যে সব কান্ডকারখনা হয় তার মধ্যে জুয়া খেলা অন্যতম । জুয়া কোনদিন মানবের উপকারী হতে পারে না । অর্থ ধ্বংসের এক চরম খেলা হিসেবে যুগে যুগে এটা পরিচিত ছিল । ধর্মীয়ভাবে যেমন জুয়া খেলার বৈধতা নাই তেমনি বৈধতা নাই রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমেও । জুয়া সর্বগ্রাসী একটি পদ্ধতি । হাজার হাজার লোকের মধ্যে মাত্র কয়েকজনকে বিত্তশালী করে অন্যদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয় । জুয়ায় শুধু অর্থ নষ্ট হয়না বরং সমাজে ডেকে আনে নানা জটিলতা । পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা কেড়ে নেয় । জুয়ারীরা সমাজে যে কোন অন্যায় করতে পারে । ন্যায়-অন্যায় বলে তাদের কাছে কোন আলাদা মানদন্ড থাকেনা । তাদের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা ঘণীভূত হয় । আনন্দ মেলায় জুয়ার কয়েক ধরণের পদ্ধতির চর্চা হয় । তার মধ্যে গুটি জুয়া ও হাউজি অন্যতম । নিমিষে ভাগ্য বদলানোর আশায় অনেকেই নিজের সর্বস্ব জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয় । অবশ্য তাদের ভাগ্যও বদলায় তবে সেটা নেতিবাচকভাবে ! হাউজি অন্যতম একটি জোচ্চুরি । অবস্থান ভেদে নাম্বার ফর্দের দাম ভিন্ন হয়ে থাকে । সংখ্যা মিলানোর এ খেলায় আয়োজক কর্তৃপক্ষ লাখ লাখ টাকা আয় করে নিলেও অংশগ্রহনকারীরা শুণ্য । যারা হাউজিতে অংশগ্রহন করে তাদের সিংহভাগই ক্ষতিগ্রস্থ হয় । এছাড়া প্রতিদিন র্যাফেল ড্র’র নামে লটারি বিক্রি করেও তারা কোটি কোটি টাকা আয় করে নিয়ে যায় ।
আনন্দ মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় তবে মানবতার জন্য ক্ষতিকর কাজটি হয় রাতের বেলায় । রাত যত গভীর হয় ততই জমে ওঠে মেলার মূল আকর্ষণ । যাত্রার নামে মেয়েদের নগ্ন নাচে মগ্ন হয় সমাজের একাংশ তরুণ । নগ্ন নাচ দেখতে দেখতে বসে মদ, ফেনিসিডিল ও গাঁজার আসর । প্রায় সারা রাত ধরে চলে এ নগ্ন উৎসব । ক্ষণিকের মোহে মানুষ তার বিবেক বিসর্জন দেয় । প্রতিটি ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই নগ্ন নাচ অস্থায়ীভাবে বন্ধ হলেও এর প্রভাব বন্ধ হয়না । যে তরুণ-যুবকের সারা রাত নগ্নতা উপভোগ করে তার প্রভাব কি খুব দ্রুত শেষ হতে পারে ? তাইতো ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পরকীয়া, ইভটিজিংসহ নানা ধরণের অপরাধ সমাজে বাড়তেই থাকে । অবশ্য নারীর প্রতি এ জাতীয় অপরাধ দমনে রাষ্ট্রের আইন আছে এবং মিডিয়ায় বেশ আলাপচারিতাও চলে কিন্তু অপরাধের কারখানায় অপরাধ উৎপাদন অব্যাহত রেখে তো ভোক্তাকে ফিরিয়ে রাখা যাবে না । দেশের উঠতি তরুণ-যুবকদেরকে ধ্বংসের এ আয়োজন কেন ? এগুলো বন্ধ করা উচিত । অপরাধকে চিরকাল অপরাধ হিসেবেই পরিচয় দেয়া উচিত । প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে যে অপরাধ সংগঠিত করা হয় তা দমন করতে না পারলে সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে তা ঘুচানোর সাধ্য কারো থাকবে না । আইনও তখন অসহায় ভূমিকা পালন করবে ।
যে সকল স্থানে আনন্দ মেলার আয়োজন করে নানা ধরণের অপরাধ কর্মের সুযোগ করে দেওয়া হয় তা শহর থেকে খুব দূরে কিংবা প্রশাসনের অগোচরে নয় । কিভাবে এ ধরণের অশ্লীলতার আয়োজকরা তাদের আয়োজন সফলতার সাথে শেষ করে তা নিয়েও রয়েছে নানা জিজ্ঞাসা । প্রশাসন কি কিছুই জানে না ? জুয়া খেলা যেহেতু রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমেই নিষিদ্ধ কাজেই প্রশাসনের সামনে সে অপরাধ হয় কি করে ? রাতের নগ্ন নাচনেওয়ালীরা কোন বলে প্রকাশ্যে নগ্ন হয়ে যুব সমাজকে ধ্বংস করার সাহস পায় ? বিভিন্ন মানুষের সাথে আলাপ করে যা স্পষ্ট হয়েছে তা সত্যিই অবাক করার মত । লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে অবৈধকে বৈধ করতে সময় লাগে না । স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে খোদ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সবার মূখ বন্ধ করার ব্যবস্থা থাকে । তাই কেউ আর বাঁধার কারণ হতে যান না । পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় শান্তির জন্য আনন্দ মেলার নামে এসব অনৈতিক আয়োজন বন্ধ করা সময়ের দাবী । এ অশ্লীলতা বন্ধ হলে নারীদের সাথে সংগঠিত অপরাধ বহুলাংশে কমে যাবে । কাজেই প্রশাসনকে সঠিকভাবে আইনের দায় শোধ করতে হবে । মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে প্রকাশে জুয়া খেলা কিংবা নগ্ন নাচের আয়োজন করা হবে তা মেনে নেওয়া যায় না । এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠা জরুরী । সব কিছুর পরেও মূল ভূমিকা প্রশাসনকেই পালন করতে হবে । সমাজকে ধ্বংসে হাত থেকে রক্ষা করুণ । যুব-তরুণেরা আদর্শবান হয়ে গড়ে না উঠলে রাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং সে ক্ষতির প্রভাব সামগ্রিকভাবে সবাইকেই সহ্য করতে হবে । তাইতো অবিলম্বে আনন্দ মেলার নামে নিষিদ্ধ জুয়া ও অশ্লীলতার আয়োজন বন্ধ করার ঘোষণা দিতে হবে এবং স্থায়ীভাবে এটাকে নিষিদ্ধ করতে হবে । দেশে কাজের অভাব নাই । সুতরাং এ মেলার সাথে সংশ্লিষ্টরা ভিন্ন কোন সামাজিক পেশার সাথে যুক্ত হয়ে তাদের জীবিকা ধারণ করুক । নগ্নতা এ জাতির জন্য কল্যান সাধণ করতে পারবে না-এ চির সত্যটি সবাইকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে বিশেষকরে দায়িত্বশীলদের তো আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
facebook.com/raju69mathbaria/
©somewhere in net ltd.