নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শিল্পীর সুরে ঝংকারিত, ‘কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে……………মনে হয় বাবার মত কেউ বলেনা আয় খুকু আয়’ গানের কলিগুলোতে কেবল বাবার ভালোবাসাই চিত্রিত হয়েছে । মানুষ বয়সে কিংবা আকৃতিতে যত বড়ই হোক বাবার কাছে সে সেই ছোট্ট শিশুটি । মাতৃগর্ভ থেকে সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার পর প্রথমবারের মত বাবা যখন সন্তানের মুখ দেখে কিংবা কোলে তোলে সেদিনের সেই অনুভব সন্তানের প্রতি বাবার শেষদিন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে । কালের প্রবাহে দুর্বল শিশুটি পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে তুললেও সে তার পিতার কাছে সব সময় শিশুর আসনে । বাবার চোখে কিংবা মনে সন্তানের বাড়ন্ত রূপটি কখনোই ধরা পড়েনা । বাবা তার দায়িত্ব ও পিতৃত্বসূলভ আচরণ তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বহাল রাখতে চায় । সময়ের পরিবর্তনে বাবাও একদিন সন্তান নির্ভর হয়ে পড়ে ঠিক কিন্তু বাবা সব পরিবেশেই বাবা । সন্তানের প্রতি বাবার এ দায়িত্ববোধ এবং প্রকৃতি সৃষ্ট ভালোবাসা তাকে দিয়েছে মহত্বের স্থান । কোন পুরুষকে বাবা হতে হলে তার মধ্যে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন । যিনি জন্মদান করেন তিনি সর্বসময় বাবা হতে পারবেন এমন নিশ্চয়তা থাকেনা । জন্মদাতা আর বাবার মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য । যে পার্থক্য আকাশ ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বকেও হার মানায় । সকল জন্মদাতা বাবা হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেনা । বাবার তুলনা চলে বটবৃক্ষের সাথে । যিনি শত-সহস্র ঝড়-ঝাঞ্ঝা নিরবে সহ্য করতে রাজি কিন্তু তার সন্তানদের প্রতি অতি ক্ষুদ্র আঘাত কিংবা কষ্টের ছিটেফোঁটা লাগাতেও নারাজ । দাম্পত্যের সূখ জলাঞ্জলি দিয়ে অনেক বাবা তার সন্তানদের ভালো রাখতে নিরলস পরিশ্রম করেন । নিজের শরীর আবৃত কিনা সেদিকে তার সামান্যতম খেয়াল নাই কিন্তু সন্তানের শরীর উন্নত ও দামি পোশাকে মুড়িয়ে রাখতে সদা ব্যস্ত । নিজে না খেয়ে ভাগের সকল খাদ্য ছেলের পাতে তুলে দিতে যিনি এতটুকু কার্পণ্য দেখাননি কোনদিন তিনিই বাবা । জীবন-যৌবনের সকল সূখ-শান্তির ত্যাগ করে শুধু সন্তানদের ভবিষ্যত তৈরি করতে যিনি সকাল থেকে রাত আবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত খেঁটে যান তিনিই শ্রদ্ধেয় বাবা । শরীরের রক্ত পানি করে বাবা তার সন্তানের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত এঁকে দিয়ে যান । বাবা ত্যাগের দর্শন গ্রহন করে সন্তানকে ভোগের নিশ্চয়তা দিতে সদা বদ্ধপরিকর ।
পৃথিবীতে বহু ভাষা বিদ্যমান থাকায় ভাষা ভেদে শব্দ বদলে যায় । অবস্থানের ভিন্নতায় বদলে যায় উচ্চারণও । তবে কিছু শব্দে বদলায় না রক্তের টান । চিরায়ত ভালোবাসার সবটুকুই একত্রিত হয়ে তৈরি করে অদ্বিতীয় ব্যঞ্জনা ও ভালোবাসার প্রকাশ । বাবা উচ্চারণ করে আমরা যতটা আপ্লুত হই তার চেয়ে কম আপ্লুত হয়না জার্মানরা ‘ফ্যাট্যা’ উচ্চারণ করে । ইংরেজদের ‘ফাদার’ কিংবা ‘ড্যাডের’ সাথে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবেনা আরব বিশ্বের ‘আবুন’ কিংবা ভারতের ‘পিতাজীর’ মধ্যে । ড্যানিশরা ‘ফার’ বলে যেভাবে আপ্লুত হন ঠিক তেমনি আফ্রিকানরা ‘ভাদের’ বলেও আপ্লুত হন । সন্তান বাবাকে ডেকে যতখানি আত্মতৃপ্তি অনুভব করে তার চেয়ে ঢের বেশি তৃপ্তি অনুভব করে বাবা তার সন্তানের মুখ থেকে মধুর স্বরে বাবা ডাক শুনে । পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় বাবা তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসার সবটুকু প্রকাশ দেখাতে পারেনা কিন্তু তার অর্থ এই নয়, বাবা তার সন্তানকে ভালোবাসে না । পৃথিবীতে এমন অজস্র বাবা আছে যারা সন্তানের জন্য প্রাণ দিতে দ্বিতীয়বার ভাববেন না । মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসার এক অনন্য নজির । তিনি সন্তান হুমায়ুনের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি । এমন স্বার্থহীন যার ভালোবাসা, সেই পিতাকে সন্তানের খুশির জন্য জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয় । অতীতে বাবা বলতে সংসারের সেই রাশভারী মানুষটিকে বুঝাতো যিনি কম কথা বলেন, একটু-আধটু শাসন করেন । যাকে এড়িয়ে চলতে সন্তানরা চেষ্টা করে, যার সাথে কম বিষয় শেয়ার করা হয় । কিন্তু সময় বদলেছে । এখন বাবা বলতে সন্তানের সবচেয়ে ভালো ও কাছের বন্ধুকে বুঝায় । সাধারণত মেয়েরা বাবাকে বেশি ভালোবাসে বলে বাবা-মেয়ের বন্ধুত্ব দৃঢ় হয় একথা যুক্তির বিচারে টেকানো দায় হলেও বাস্তবতা অস্বীকার করার নয় । বর্তমান সময় ছেলে-মেয়ে উভয়েই বাবার ভালো বন্ধু । সন্তান তার সকল বিষয় অনায়াসে বাবার কাছে শেয়ার করে এবং বাবাও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সন্তানের মুখে হাসি ফোঁটাতে সদা প্রস্তুত । এসব কিছুর পরেও বাবা পরিবারে এখনো অনেকটা উপেক্ষিত । মায়ের সাথে সন্তানের যেমন গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় তার তুলনায় অনেক কম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাবার সাথে । বাবার সাথে সম্পর্ক যেন শুধু ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কেন্দ্রিক । শহরের আধুনিকি পরিবার কিংবা গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারে বাবা বৃদ্ধ হলেও কার্যত তাকে পিছিয়ে রাখা হয় । সন্তানকে যিনি ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে লালন-পালন করে বড় করেছে সেই সন্তানেরা বাবার বৃদ্ধাবস্থার দূর্বলতাকে মূল্যায়িত করেনা ।
মায়ের তুলনায় বাবার প্রতি ভালোবাসার বৈষম্য ঘুচাতে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব বাবা দিবস পালন প্রথা । যদিও প্রতিটি দিন বাবার প্রতি ভালোবাসায় কাটানো অত্যাবশ্যক তবুও অধুনা বিশ্বের কিছু দেশ নির্দিষ্ট একটি দিনে বাবা দিবস পালন করার রীতি প্রচলন করেছে । পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এ দিনটিকে বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়েছে । প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে বিশ্বের ৫২টি দেশে পালন করা হয় পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের বিশেষ দিন হিসেবে । যদিও পিতার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিনের প্রয়োজন পড়ে না তবুও মা দিবসের অনুকরণে এ দিনটি পালিত হয় বাবা দিবস হিসেবে । বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শুরু হওয়া বাবা দিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য ছিলো সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য । ধারণা করা হয়, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জেনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় এই দিনটি প্রথম পালিত হয় । তবে, সনোরা স্মার্ট ডড নামের ওয়াশিংটনের এক ভদ্রমহিলা তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন । তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই ১৯১০ সালের ১৯ জুন বাবা দিবস পালন শুরু করেন এবং ডড থেকেই বাবা দিবসের উদ্ভব বলে মনে করা হয় । শুরুর দিকে বাবা দিবসের উদযাপন খুব টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায় । সন্তানরা মা দিবস পালনে যেভাবে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখাত তার সামান্য অংশও দেখাত না বাবা দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে । প্রথম দিকে এটাকে হাস্যরস হিসেবেই বিবেচনা করা হতো । তবে ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে । ১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসে সরকারী ছুটি দাবি করে একটি বিল উত্থাপন করা হয় । ১৯২৪ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ন সমর্থন দেন । অবশেষে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন বাবা দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন । বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই জুনের তৃতীয় রবিবারকে বাবা দিবস হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে ।
মা দিবস কিংবা বাবা দিবস পালনের জন্য নির্ধারিত কোন দিন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না । সন্তানের কাছে প্রতিটি দিন তার বাবা-মায়ের জন্য । প্রতিটি দিনই পিতৃ-মাতৃ দিবস হওয়া উচিত । সন্তানের কাছে জীবিত বাবা-মা পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ । পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশে প্রতি বছর পালন করা হচ্ছে বাবা দিবস । অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও বাবা জন্য নির্দিষ্ট কোন দিনের কল্পনা করতে হতো না । পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ করতে গিয়ে অবহেলা বাড়ছে বৃদ্ধদের প্রতি । দিন দিন বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে চলছে । সন্তানের সাথে পিতামাতার দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে । অনেক সন্তান দিন, মাস কিংবা বছরেও একবার খবর নেয় না বৃদ্ধ বাবা কেমন আছে । কি করে তার সময় কাটছে । বাসগৃহের সবচেয়ে অন্ধকার কুঠুরীতে বাবা পেয়েছে আশ্রয় । আবার কোন কোন দূর্ভাগ্য বাবা সুদূঢ় বৃদ্ধাশ্রমে আপনজনহীন হয়ে মৃত্যুকে ডাকছে । সন্তানের একটি চিঠির জন্য মাসের পর মাস কিংবা বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গুনছে । মৃত্যু উপস্থিত হয় ঠিক কিন্তু সন্তানের কাঙ্খিত চিঠি বাবার হাতে পৌঁছে না । আবার কোন কোন কুলাঙ্গার সন্তানের হাতে বাবা নিরর্য্যাতিত হয় বলেও শোনা যায় । যারা সারা বছরে একটি বারের জন্যও বাবার খোঁজ নিতে, বাবার পাশে বসে দুদন্ড ব্যয় করে না তাদের জন্য আড়ম্বরপূর্ণভাবে বছরের একটি দিনকে বিশেষায়িত করে বাবা দিবস পালন করা আবশ্যক কিন্তু যে সন্তান কাজের খোঁজে সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে বাবার সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ নিয়ে বের হন এবং কাজের শেষে বাসায় ফিরে বাবার সেবা করেন তার জন্য নির্দিষ্ট করে বাবা দিবস পালনের কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না । তুবও যারা সখে কিংবা বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করতে চান তাদেরকে অনুৎসাহিত করা উচিত হবে না কেননা বাবা সন্তান থেকে অন্তত একটি দিনের কিছুটা সময় তো পেলো । আজ যারা বাবা দিবস পালন করে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে বাবাকে বিভিন্ন চমক দিচ্ছে তাদের স্মরণ করা উচিত এই বাবাই সন্তানের শৈশবে কিংবা কৈশরে প্রতিটি দিনে তার জন্য চমক রেখেছিলো । পৃথিবীর কোন বাবাই সন্তানের কাছ থেকে বস্তুগত উপহার পাওয়ার আকাঙ্খা করেনা বরং বাবার কাছে সন্তানের পক্ষ থেকে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হল আদুরে গলায় বাবাকে ডাকা, বাবা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা, পাশে ক্ষনিক সময় বসা, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, বাবার কাছে বিনায়াবনত হওয়া । নির্দিষ্ট বাবা দিবসের শিক্ষা যেন বাবার প্রতি সন্তানের সারা বছরের প্রতিটি মূহুর্তের জন্য শিক্ষা হয় । বাবার আশ্রয় যেন কোন অন্ধকার কুঠুরী কিংবা বৃদ্ধাশ্রম না হয়ে সন্তানের মনের কুঠুরী হয় তার নিশ্চয়তা জরুরী । বাবার প্রতি ভালোবাসাই যেন আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন হয় ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
.
facebook.com/raju69mathbaria/
©somewhere in net ltd.