নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।
আমার ভাষা - আমার ভালোবাসা - পর্ব ২
--------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
ভূমিকাংশ
শহীদ মিনারের সাদাকালো ছবি তার নীচে লেখা, 'আমরা সালামের ভাই, আমরা বরকতের ভাই'। খুব ছোটবেলায় ('৭৫/'৭৬ সালের কথা বলছি) ফেব্রুয়ারী মাস এলেই দৈনিক সংবাদপত্র 'দৈনিক বাংলা'-য় একটি কলাম দেখতে পেতাম এই শিরোনামে। আগ্রহ জাগলো মনে, প্রতি ফেব্রুয়ারীতে এই কলাম আসে কেন? কি লেখা আছে এই কলামে? কে সালাম? কে বরকত? কেন তারা আমাদের ভাই? একটু জ্ঞান হলে পড়তে শুরু করলাম আর জানতে শুরু করলাম আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরব গাঁথা। আরও বেশী পুলকিত হলাম যখন জানলাম আমার নিজেরই দাদা ও ফুপু ছিলেন এই আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।
আমাদের পূর্বপুরুষদের শ্রম ও মেধার মূল্যে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা সকল দেশের সেরা আমাদের জন্মভূমির সহসা পতন ঘটে পলাশীর ট্রাজেডী-তে। স্বাধীনতা হারিয়ে আমরা দিন দিন শ্রীহীন হতে থাকি। একই সাথে স্বাধীনতার প্রয়োজনও উপলদ্ধি করতে শুরু করি। স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধির সাথে সাথে স্বাধীনতা হারানোর কারণটি কি সেটাও খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণটি খুঁজে বের করতে পারলেই প্রাপ্তির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা আমরা হারিয়েছি কেবলমাত্র উমিচাঁদ ও জগৎ শেঠের চক্রান্ত ও মসনদলোভী মীরজাফরের নির্বুদ্ধিতায় নয় তার চাইতেও বড় কারণ জাতীয়তাবাদের অভাবে । জাতীয়তাবাদ - অর্থাৎ দেশ আমাদের, নবাব আমাদের, মাটি আমাদের ভাষা আমাদের, এই বোধ। এই বোধ যদি দেশবাসীর মধ্যে সজীব থাকত তো কয়েকটা স্বার্থপর মানুষের চক্রান্তে বাংলার পতন ঘটত না।
স্বাধীনতা লুপ্ত হলো যে জিনিসের অভাবে স্বাধীনতা মিলিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও তারই হাতে। ধীরে ধীরে এদেশের মানুষ তা বুঝতে শুরু করলো। যতই এই বোধ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো ততই দানা বেধে উঠতে শুরু করলো বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন - ফকীর মজনু শাহ্-র বিদ্রোহ, তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হাজী শরিয়তুল্লাহ্র আন্দোলন, এক একটি সোপান। যার ফলাফল ছিল ১৯৪৭ সালে বাংলার মাটিতে বৃটিশ শাসনের পতন।
স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা আবারও নতুন করে উপলদ্ধি করতে শুরু করলাম ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা বিরোধী জিন্নাহ্র ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। এবার জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে ১৭৫৭ সালের চাইতে অনেক বেশী মজবুত ছিল, তাই ঘোষণা কানে প্রবেশ করতে না করতেই গর্জে উঠেছিল উপস্থিত জনতার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর - 'নো নো নেভার'।
'অপমানে, অপমানে যেদিন জ্বলে উঠেছিলে বর্ণমালা,
সেইদিন থেকে শুরু হলো পালা বদলের খেলা'
সেই পালা বদলের খেলা-য় '৪৮ থেকে '৫২, '৫২ থেকে '৫৪, '৫৪ থেকে '৬৯, '৬৯ থেকে '৭১, সর্বপোরি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
কি ঘটেছিল ১৯৪৮-এ, কি হয়েছিল ১৯৫২-তে, কেন এতগুলো তাজা প্রান ঝরে গেল ভাষা আন্দোলনে? ভাষার জন্য আন্দোলন করতে হলো কেন? রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা কি সত্যিই খুব জরুরী? মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে কি লাভ হয়? কবে থেকে যাত্রা শুরু হলো বাংলা ভাষার? কেমন ছিল বাঙলা ভাষার নানা কাল? আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? আগামী গন্তব্য কোথায়? আমার শিশু মনে এইসব প্রশ্ন যতই উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করলো, ততোই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম যেখানে যত তথ্য পাই।
শুরু হয়েছিল সেই শহীদ মিনারের সাদাকালো ছবি তার নীচে লেখা, 'আমরা সালামের ভাই, আমরা বরকতের ভাই'- দিয়ে, শেষ এখনো হয়নি। হয়তো হবেও না। এযাবৎ কাল নিজের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা সম্পর্কে যা জেনেছি ও যা বুঝেছি তা ধারাবাহিকভাবে লিখে যাওয়ার চেষ্টা করব এই সিরিজে। পাঠকদের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।
ভাষা কি?
বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, সে প্রতীকের জগতে বসবাস করে। তার জীবনের প্রয়োজনে নানা ধরনের প্রতীক সে ব্যবহার করে। এমন একটি প্রতীক হলো ভাষা - ধ্বনীর পিঠে ধ্বনী সাজিয়ে সৃষ্ট এই প্রতীক। ভাষা মানুষ ব্যবহার করে তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য এবং অন্যের মনের ভাব নিজে বোঝার জন্য। মূল কথা - ভাষা হলো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। ভাষা বিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ভাষাবিদ্যা বলা হয়। বর্তমান বিশ্বের ভাষাসমূহের সঠিক সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না, তদুপরী ভাষা ও উপভাষা (dialect)-র মধ্যে আংশিক বা অবাধ পার্থক্য বিষয়টির উপরও তা নির্ভর করে। যাইহোক, আনুমানিক হিসাবে বিশ্বে ছয় থেকে সাত হাজার ভাষা রয়েছে।
ইংরেজি শব্দ "langage" ইন্দো ইউরোপীয় dn̥ǵ ʰ wéh ₂ ল্যাটিন lingua অর্থ "জিহ্বা, বক্তৃতা, ভাষা"। ভাষা শব্দটি মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয় কোড , সাইফার , এবং কৃত্রিমভাবে নির্মিত যোগাযোগ সিস্টেমে (যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ) । এই অর্থে ভাষা হল প্রতীকের সিস্টেম যা তথ্য এনকোডিং এবং ডিকোডিং ব্যবহৃত হয়।
ভাষার জন্ম হয় ও কালের স্রোতে তা বিবর্তিত হয়ে নব নব রূপ ধারণ করে। আবার অনেক সময় ভাষার মৃত্যু হয়ে কেবল লেখ্য রূপটিই বিরাজ করে, আবার কখনো কখনো একেবারেই হারিয়ে যায়। কোন ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস নিরুপন করা যাবে আধুনিক ভাষার সাথে তার পূর্বতন ভাষার তুলনা করে। একদল ভাষা যার পূর্বতন ভাষা ছিল একটি তাদেরকে একটি ভাষা পরিবার বলা হয়। যেমন, ইন্দো ইউরোপীয় পরিবার - স্প্যানিশ, ইংরেজি, পর্তুগীজ, বাংলা, হিন্দি, রাশিয়ান, জার্মান, মারাঠী, ফরাসি, ইতালিয়ান, পাঞ্জাবি, এবং উর্দু। সেমিটিক ভাষা, যার অন্তর্ভুক্ত আরবি, আমহারিক, হিব্রু; এবং বান্টু ভাষা, যা সোয়াহিলি, জুলু, শোনা, এবং সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে আরও শত শত ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। ইদানিং সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে যে আজকের কথ্য ভাষার মধ্যে সম্ভবত 50 থেকে 90% ভাষা 2100 সালের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
মানুষের ভাষা কেন অনন্য?
মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণিও নিজেদের মধ্যে নানাভাবে যোগাযোগ করে থাকে। যেমন মৌমাছি বা বানর তারাও নৃত্য, ইশারা ও ধ্বনীর মাধ্যমে যোগাযোগ করে । কিন্তু তাদের সিস্টেমটি একটি বদ্ধ সিস্টেম। সেখানে কিছু সীমিত সংখ্যক প্রতীক রয়েছে। অন্যদিকে মানুষের ভাষা উন্মুক্তএবং উত্পাদনশীল, যার মানে হল মানুষ সসীম সেট ধ্বনি থেকে অসীম সেট নতুন শব্দ ও বাক্য তৈরি করতে পারে।
এছাড়াও, কোন বিশেষ ভাষার ব্যাকরণ মূলত অবাধ, অর্থাত্ যে কোনো সিস্টেম শুধুমাত্র সামাজিক মিথস্ক্রিয়া মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রাণীরা কেবল সীমিত সংখ্যক ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে যা জেনেটিকালি সঞ্চারিত হয়।
বেশ কিছু প্রজাতির প্রাণী (যেমন Bonobo Kanz) সামাজিক শিক্ষার মধ্যে দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যম শিক্ষা গ্রহন করতে পেরেছে। একইভাবে, পাখি এবং বহু প্রজাতির তিমি তাদের অন্যান্য প্রজাতির সদস্যদের কাছ থেকে গান শিখতে পেরেছে। যদিও বেশ কিছু প্রাণী প্রচুর শব্দ ও প্রতীক শিখতে পেরেছে, তার পরেও কোন প্রাণীই মানব ভাষার জটিল ব্যাকরণতো দূরের কথা এমনকি চার বছর বয়সী মানব শিশুর চাইতে বেশী সংখ্যক প্রতীক শিখতেও সমর্থ হয়নি।
ভাষার উৎপত্তিঃ
ভাষা উৎপত্তি সম্পর্কে তত্ত্ব তাদের মৌলিক অনুমিতি অনুযায়ী ভাগ করা যেতে পারে. কিছু কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী ধারণা করা হয় যে, ভাষা এত জটিল যে আমরা কিছুতেই কল্পনা করতে পারিনা ভাষার চুড়ান্ত রূপ শূণ্য থেকে উপস্থিত হয়েছে, এটা আমাদের আগে প্রাক - মানব পূর্বপুরুষদের মধ্যে প্রাক ভাষাগত সিস্টেম থেকেই প্রসূত হওয়ার কথা। এই তত্ত্বকে বলা ধারাবাহিকতা-ভিত্তিক তত্ত্ব । বিপরীত দৃষ্টিকোণ হয় যে মানুষের ভাষা এমনই একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য যে এটি কিছু অ-মানুবের মধ্যে থেকে পাওয়া গেছে। তাই এটা অবশ্যই আছে প্রাক হোমোনিডি থেকে পরিবর্তিত হয়ে প্রথম দিকের মানুষের মধ্যে হঠাৎআবির্ভূত হয়েছে। এই তত্ত্কে বলা হয় ব অধারাবাহিকতা-ভিত্তিক তত্ত্ব । একইভাবে, চমস্কি এর ভাষার সৃজক দৃষ্টিভঙ্গি বলে ভাষা সহজাত যা মূলত জেনেটিকালি এনকোডেড। আবার functionalist তত্ত্ব বলে ভাষা একটি ব্যবস্থা যা মূলত সাংস্কৃতিক, এবং তা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া মাধ্যমে শেখা। ধারণা করা হয় যে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স-এর ভাষার উদ্ভব এক লক্ষ বছর আগে।
ভাষাবিদ্যার উড্ভব:
একটি পুর্নাঙ্গ শাস্ত্র হিসাবে ভাষাবিদ্যার উড্ভব আমাদেরই উপমহাদেশে আজ থেকে ২০০০ বছর আগে। যতদূর জানা যায়, এর সুত্রপাত ঘটান ভারতীয় ভাষাবিদ পাণিণী খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতা্ব্দীতে। তিনি সংস্কৃত ব্যকরণের ৩৯৫৯ টি বিধি আবিষ্কার করেন।তার কিছুকাল পরে সুমেরীয়রা সুমেরী ও আক্কাদিয়ান ভাষার মধ্যে ব্যকরনগত পার্থক্য খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়। ধীরে ধীরে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায়ও ব্যকরণ চর্চা শুরু হয়।
মস্তিষ্ক এবং ভাষাঃ
মস্তিষ্কের সকল ভাষাগত কার্যকলাপের সমন্বয় কেন্দ্র; মস্তিষ্কই ভাষাগত চেতনা এবং ভাষার অর্থ উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্য স্বীকার করে নি্তে হবে যে, ভাষা বিষয়ক স্নায়ু সংক্রান্ত জ্ঞান আমাদের সীমিত। যদিও আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে সাথে এর উন্নতি হয়েছে। ভাষার স্নায়বিক অধ্যয়নকে neurolinguistics বলা হয়।
(চলবে)
(আজ মহান ভাষা দিবস। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন ও অবদান রেখেছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। ভাষা সৈনিক আমার শ্রদ্ধেয় দাদাজান মরহুম এ্যাডভোকেট এমদাদ আলী ও ফুপু ডাক্তার কামরুন্নিসা সহ সকল ভাষা সৈনিক ও শহীদদের এই পর্বটি উৎসর্গ করলাম।)
©somewhere in net ltd.