নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।
পিলখানা তখন মৃত্যুপুরী - ১
------------------------ডঃ রমিত আজাদ
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী এক শান্ত শীতের সকাল । মাত্র কয়েক মাস হয় নতুন সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। দেশের সর্বত্র তখন আলোচনা চলছে, কেমন যাবে আগামী ৫ বছর। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এতকাল মার্কিনিরা শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতি দেখে অভ্যস্ত। তাদের প্রেসিডেন্ট হাউজের নামও তারা দিয়েছিল ‘হোয়াইট হাউজ’, সেই হোয়াইট হাউজ হঠাৎ করে ব্ল্যাকের নেতৃত্বে চলে গেল। পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে আসা নেতা বারাক হোসেন ওবামা নিজেই পরিবর্তন হিসেবে আবির্ভূত হলেন। সেই ‘পরিবর্তন’ চিন্তাধারা আদলে “দিন বদলের” প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আমি তখন ইষ্ট-ওয়েষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি, সেদিন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছিলাম। সকালে ক্লাস না থাকায় চেয়ারম্যান স্যারের রুমে বসে কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনা করলাম। উপস্থিত অন্যান্য অধ্যাপকরাও নতুন সরকার নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বেশিরভাগকেই খুব আশাবাদী মনে হলো। অনেকে বলছিলেন দু’বছরের আর্মি ব্যাকড গর্ভনমেন্টের পর নতুন সরকার নিঃসন্দেহে অনেক সচেতন হবে। গত দুই বছরে যা ঘটেছে তা ছিল অনেকটাই নজিরবিহীন। এত ব্যাপক ধর পাকড় ও ধোলাইয়ের পর, অসাধু ব্যক্তিরা আর খুব সহজে অপকর্ম করার সাহস পাবেনা। দু-এক জন বলছিলেন, “বাংলাদেশের ব্যাপার! যে দুর্নীতির বীজ রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছে সেই ব্যাকটেরিয়া খুব সহজে দমন হবার নয়”। কেউ কেউ বললেন “না, না, পরিবির্তন, আসবে”। তার উত্তরে কেউ কেউ বললেন, “হ্যা পরিবর্তন! দেখলাম পরিবর্তনের নমুনা, মসজিদ আক্রমন দিয়ে শুরু হয়েছে”। আমি বললাম, “বাংলাদেশের মূল সমস্যা ‘চেতনার সংকট’ আমাদের যথাযথ কোনো ন্যাশনাল আইডোলজি নেই। আমাদের অন্তর্মুখীনতার চাইতে বহিঃর্মুখীনতাই বেশি। আমাদের বুঝতে হবে ইসলামাবাদ নয় ঢাকা, দিল্লী নয় ঢাকা, ঢাকাই আমাদের প্রাণ”। আমার কথা শুনে অনেকেই ভ্র“ কুঞ্চিত করলেন। “আপনার ভাই, ঐ একই কথা, ন্যাশনাল আইডিওলজি আবার কী? দেশ চলছিলো, চলবে।” একথা সেকথার পর গেলাম নিজের রুমে। সময় আনুমানিক সকাল দশটা হবে। আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে এসএমএস পেলাম, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ মার্কেট এলাকায় গোলযোগ চলছে, ঐ জায়গাগুলো এড়িয়ে চলুন।’ আমি ভাবলাম বোধহয় ছাত্ররা গোলযোগ করছে। বাংলাদেশে গোলযোগ মানেই তো ভাঙচুর। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে ড্রাইভারকে বললাম, “গাড়ী নিয়ে বাসায় চলে যাও, সাবধানে যেও”। উপরে উঠে আবার ডিপার্টমেন্ট অফিসে গেলাম। ডিপার্টমেন্ট সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করলাম, “গোলযোগের কথা কিছু শুনেছেন? কী হয়েছে?” তিনি একটু চুপ থেকে বললেন, “স্যার আমি সঠিক বলতে পারবনা, শুনেছি বিডিআর-রা তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে হৈ চৈ করছে।” সাথে সাথে আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকে উঠল, ‘সশস্ত্র ব্যক্তিরা গোলযোগ করছে! এ যে ভয়াবহ!’
আমার মনে পড়ল অনেক বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৭, ৮ ও ৯ নভেম্বর এর কথা, যখন কর্নেল তাহেরের ক্ষ্যাপাটে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকদের হাতে নিহত হয়েছিল নারীসহ ৪০ জন নিরীহ, নিরাপরাধ অফিসার। যেই ব্যক্তিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে দেশের মানুষের জীবন রক্ষার্থে তারাই যদি ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠে অস্ত্রের মুখ ঘুরিয়ে দেয় আমাদের দিকে এ যে ভয়ংকর। বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার মত।
স্ত্রীকে টেলিফোন করে বললাম, ‘ছেলেকে স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে এসো শহরে গোলমাল হচ্ছে’। স্ত্রী বললেন, "তুমি ফিরবে কী করে?" বললাম, “আমি পুরুষ মানুষ, হেটে দৌড়ে কোনো না কোনোভাবে তো পৌছাতে পারব”। ইতোমধ্যে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে খবর। একজন অধ্যাপক উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, “শুনলাম প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। আমার ছেলের স্কুল ঐদিকে, কী করে যে ওকে আনবে আমার স্ত্রী! আমিই বা যাব কী করে? টেলিভিশন দেখা দরকার। ওখানে সরাসরি সংবাদ জানা যাবে। আমাদের ডিপার্টমেন্টে টিভি ছিলনা। অন্য এক ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সেখানেও অনেক অধ্যাপক বসেছিলেন। নানা জন নানা মন্তব্য করছিলেন।
ঃ কি করে হঠাৎ এমন ঘটনা ঘটলো? গোয়েন্দা বাহিনী কী করে?
ঃ গতকাল প্রধানমন্ত্রী পিলখানায় গিয়েছিলেন, সেখানে কী কথা হল?
ঃ বিডিআর-রা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হলো কেন?
ঃ রাইফেলস্ স্কোয়ারের মার্কেটের দখল নিয়ে মারামারি লেগেছে।
ঃ মার্কেট করে কেন? আর্মি, বিডিআর, পুলিশকে ব্যবসা থেকে যতদুরে রাখা যায় ততই মঙ্গল।
ইত্যাদি নানা মন্তব্য।
আসলে আমরা তখনো বুঝতে পারছিলাম না, গোলমালটা কিসের? কে কার সাথে গোলমাল করছে? এই সময়ে একটা টেলিফোন পেলাম, আমাদের কলেজের একজন সিনিয়র ভাই প্রাক্তন এয়ারফোর্স অফিসার ফোন করলেন, "হ্যালো তোমাদের হামিদ তো বিডিআর-এ আছে, তাইনা?" আমার বুক ধড়াস করে উঠলো! তাইতো, অনেক বন্ধু-বান্ধবই তো আর্মি অফিসার আছে, বিডিআর-এ কেউ নেই তো? হামিদ অনেক আগেই বিডিআর থেকে র্যাবে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল জানতাম। ওকে নিয়ে চিন্তা করিনা। কিন্তু আরও তো অনেকেই আছেন! ওদের কী অবস্থা? ক্যাডেট কলেজে পড়ার কারণে ক্লাসমেট, সিনিয়র, জুনিয়র অনেকেই আর্মি অফিসার আছেন। দু’এক জনকে ফোন করে জানলাম পিলখানার ভেতরে আমাদের সিলেট ক্যাডেট কলেজের মাহবুব ভাই আছেন। বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো! এরপর কয়েকটা দিন গেল অনেক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুঃখ, কান্না আর হতাশার মধ্যে দিয়ে।
বাংলাদেশে মিডিয়া একসময় খুব দুর্বল ছিল। টিভি চ্যানেল ছিল মাত্র একটি, সেটাও সরকারি। অধিবেশনের সময় ছিল সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত। দৈনিক পত্রিকা ছিল অল্প কয়েকটি, তাও সেগুলো ঐদিন পাওয়া যেত কেবল রাজধানী ঢাকায়। অন্যান্য বড় জেলা শহরগুলোতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যেত। আর গ্রামে গঞ্জে পৌঁছাত একদিন পরে। সাপ্তাহিক পত্রিকাও ছিল অপ্রতুল। সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল বিচিত্রা। আমরা কানকথা শুনতাম, বিচিত্রার প্রচ্ছদ কাহিনী উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা হয়। জনমত সৃষ্টি করে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সমজাতীয় অভিযোগ দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদের বিরুদ্ধেও ছিল। এটি একটি খুব ইন্টরেস্টিং ব্যাপার, প্রচারযন্ত্র রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। এই বিষয়টি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশরা; তাই তারা প্রচারযন্ত্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো।
২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের প্রচারণায় ধীরে ধীরে ভূমিকা রাখতে শুরু করে নব্য আবির্ভূত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে মানুষ সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় দর্শন ইন্দ্রিয়কে। এক মার্কিন সিনেমা ব্যবসায়ী টেলিভিশন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ছয়মাস ঐ বাক্সের দিকে তাকিয়ে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়বে’। কিন্তু তার কথা সত্য হয়নি। দর্শন ইন্দ্রিয়ের ক্ষুধা মেটাতে ওটাই হয়ে ওঠে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম। বাংলাদেশের দর্শকদের অনেকদিনের চাহিদা ছিল বেসরকারি টিভি চ্যানেলের। ইতোমধ্যে অবশ্য ভারতীয় অনেকগুলো টিভি চ্যানেলই চালু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থি অর্ধনগ্ন নৃত্য হৈ-হুল্লোড় আর ভায়োলেন্স দেখে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের জনগণ বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। কে কবে চালু করলো এইসব হাবিজাবি, কেন চালু করলো বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তাই বেসরকারি বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল চালু হওয়ায় জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সবাই আশা করলো এবার গুণগত মানসম্পন্ন আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ কিছু পাওয়া যাবে।
পিলখানায় গোলযোগের প্রকৃত সংবাদ জানতে আমরা দেশী বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর উপর আস্থা স্থাপন করলাম। ইতোপূর্বে ১৯৭৫ থেকে বেশ কিছু সেনা বিদ্রোহের খবর আমরা শুনেছিলাম। কিছু পেয়েছিলাম পত্রিকায় আর দু’একটি এসেছিল কানে কানে। পিলখানার ঘটনাটি দেখলাম লাইভ টেলিকাস্ট। বিডিআর-এর পোষাক পরিহিত কয়েকজনের হাতে অস্ত্র দেখলাম। আবার বিডিআর এর পোষাকে দু’জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। সবকিছু আবার ঘোলাটে হয়ে উঠলো। হত্যাকারী ও নিহত উভয়েই বিডিআর, তাহলে কে কাকে মারছে? কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া কাটলো, লাইভ টেলিকাস্টে দেখলাম, কেউ একজন বিদ্রোহী বিডিআরদের লেখা চিঠি পড়ে শোনাচ্ছে, ‘আমরা বিডিআর-রা নির্যাতিত, আমরা আর্মি অফিসারদের দ্বারা নির্যাতিত। তাই আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছি। আমরা বিদ্রোহী।' এবার ধোঁয়া কাটলো, ‘আর্মি অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে নন-অফিসাররা।'
এবার অনেক প্রশ্ন ভীড় করলো আমার মনে। নন-অফিসাররা কেন বিদ্রোহ করলো অফিসারদের বিরুদ্ধে? নিজে সামরিক স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে জানি, সৈনিক জীবনে সিনিয়রদের কমান্ড মেনে চলতে হয় এটাই রীতি। ছাত্র জীবনে আমরা মাঝে মাঝে সিনিয়রদের উপর মনঃক্ষুণ্ণ হতাম সত্যি। তবে সেটা মিটেও যেত। এর কারণ মূলত: ছিল আমাদের ভাবাবেগপূর্ণ কাঁচা বয়স আর ছাত্র জীবন। কিন্তু ম্যাচিউরড পেশাগত জীবনে তা হবে কেন। তিনি তো বেতনভুক, এই কমান্ড মানার জন্য তিনি রীতিমতো পয়সা পান। তবে কি ঈর্ষা? তিনি অফিসার হতে পেরেছেন, আমি হতে পারিনি সেই হিংসা থেকে ক্ষোভ? তাকে তো বুঝতে হবে, এটা যোগ্যতার ব্যাপার। যিনি যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন তিনি অফিসার হয়েছেন, যিনি অর্জন করতে পারেননি তিনি হননি। অনেক জেসিও, এন.সি.ও-কে দেখেছি সেই দুঃখবোধ থেকে নিজের ছেলেকে মনের মতো গড়ে অফিসারে পরিণত করেছেন। আরেকটি কারণ হতে পারে ‘স্বাধীনতা’। আর্মি অফিসারদের অধীনে থাকতে চায়না সীমান্ত রক্ষীরা, তারা স্বাধীনতা চায়। যদি এটাই কারণ হয়ে থাকে তাহলে সমস্যাটি ‘ফিলোসফিকাল’। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি চার অক্ষরের এই শব্দটি, ‘স্বাধীনতা’। কী এই স্বাধীনতা? স্কুল জীবনে খুব ভালো বুঝতে পারিনি। পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে একটি গল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের বলা হয়েছিল, ‘যা করলে সত্যিকারের আনন্দ পাওয়া যায়, তাই স্বাধীনতা’। বাংলার শিক্ষক এটা শিখালেন, ইংরেজীর শিক্ষক তা শুনে ক্ষেপে উঠলেন। বুঝলাম স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যেও ‘স্বাধীনতা’র সংজ্ঞা প্রশ্নে ঐক্যমত নেই। তাহলে দেশের অপরাপর মানুষদের কী অবস্থা? তারা কি স্বাধীনতার সংজ্ঞা জানে? একবার একজন প্রাক্তন বেসামরিক কর্মকর্তাকে ‘চেইন অফ কমান্ডের’র কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে, এই কনসেপ্টটা এখন ওল্ড এবং কেবলমাত্র বাহিনীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাহলে? তিনি বললেন যে, মডার্ন কনসেপ্ট হল ‘ফ্রীডম’। কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া হবে না। ঊর্ধ্বতনদের দেখে অধ্বঃস্তনরা শিখবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সবকিছু মেনে চলবে। কথাটা আমার মনে ধরেছিল। কিন্তু বাহিনীর ক্ষেত্রে ফ্রীডম কতটুকু প্রযোজ্য? এই অস্ত্রধারীরা ভয়াবহ। তাদের অস্ত্র যাতে কোনোক্রমেই মিসইউজড্ না হয় এই লক্ষ্যে সর্বক্ষন তাদের নজরদারী করে সদা সতর্ক থাকতে হবে। চতুর্থ আরো একটি কারণ যা হতে পারে, সেটা কিছুতেই ভাবতে চাইছিলাম না, তা হলো এই সহজ সরল জওয়ানগুলোকে কেউ উসকে দিয়েছে কিনা?
দুপুরের দিকে আমার এক বন্ধুর টেলিফোন পেলাম। স্কুল জীবন থেকেই আমরা রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলাম। ঘটনার দিন তিনি খুলনা ছিলেন। তিনি বললেন,
রি: কি রে, ঢাকায় কী হচ্ছে?
আমিঃ বিডিআর-এর নন-অফিসাররা বিদ্রোহ করেছে।
রি: বিদ্রোহ করারই কথা।
আমিঃ কেন?
রি: আরে সব আর্মি অফিসার এনে বিডিআর ভরে ফেলেছে। বিডিআর-এ আর্মি আসবে কেন?
আমি: আর্মি অফিসার আসলে সমস্যা কী?
রি: কেন? কেন আসবে? তুই হলে মানতি?
আমি: আমি বিদেশী ডিগ্রীধারী একজন স্পেশালিষ্ট। তারপরেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমেরিকা থেকে, জাপান থেকে, ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সিনিয়র অধ্যাপকরা আমার মাথার উপর বসছে না? যোগ্যতা থাকলে কেন তাকে মানব না?
আমার এই কথার পর বন্ধুটি আর তেমন কথা বললো না, সে উপসংহার টানলো এইভাবে যে, সে মনে করে গত দুই বছরের তত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের সাথে এর একটা যোগাযোগ রয়েছে এবং দোষ আর্মিরই।
দুপুরের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় চলে গেলাম। জাতির এই গভীর সংকটে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষনা করা হলো।
যাওয়ার পথে সবার মুখে মুখে একই কথা। অনেকেরই কানে ছিলো মোবাইল টেলিফোন। সেখানেও ঐ একই বিষয় নিয়ে আলোচনা। আমার কয়েকজন আর্মি অফিসার বন্ধুদের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ চেষ্টা করলাম, কিন্তু তখন নেটওয়ার্ক এতো বেশি মাত্রায় ব্যস্ত ছিল যে কোথাও রিচ করতে পারলাম না।
বাড়িতে গিয়ে আবার বসলাম টিভি সেটের সামনে। ঐ একই সংবাদ টিভিতে দেখানো হচ্ছে, নন-অফিসাররা অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তাদের অনেক দাবী দাওয়া আছে। এবার আমাদের মনে প্রশ্ন, সরকার কী করছে? করার দুটো পথই রয়েছে ক) সামরিক এ্যাকশনের মাধ্যমে কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করা, খ) আলাপ-আলোচনা করে কোনো সমঝোতায় আসা। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, মিউটিনি ইজ মিউটিনি- এগুলোকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না । কঠোর হাতেই এটা দমন করা দরকার। যা শুনতে পেলাম আর্মি ও র্যাবের একাধিক ট্রুপ পিলথানা ঘিরে রেখেছে। ভাবলাম যে কোনো মুহূর্তেই এ্যাকশন শুরু হতে পারে।
হঠাৎ আমার মনে হলো, আমার প্রতিবেশী ‘ম’ ভাই এর ছোট ভাই কুমিল্লায় বিডিআর-এর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নকিবুর। বুকটা ধড়াশ করে উঠলো। সাথে সাথে ফোন দিলাম ‘ম’ ভাইকে। সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম।
আমি: নকিব ভাই কেমন আছেন?
‘ম’ ভাই: ভাল আছে।
আমি: উনি কোথায় আছেন?
‘ম’ ভাই: ভিতরে আছে।
আমি: উনি কি কুমিল্লায় আছেন?
‘ম’ ভাই: না, কুমিল্লায় থাকবে কি? এখনতো বিডিআর সপ্তাহ চলছে। নকিব দরবারে ছিলো। এখন পিলখানার ভিতরে আছে।
আমার বুকটা আরেকবার ধড়াশ করে উঠলো। নাকিব ভাইতো বাঘের মুখে আছে!
আমি: এখন?
‘ম’ ভাই: আরে চিন্তা করবেন না। কোনো একটা পথতো সরকার বের করে ফেলবে। তারপর নকিব বের হয়ে আসবে। (বেশ নিশ্চিন্ত মনে বললেন তিনি)। আমি কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকতে পারলাম না। আমার উদ্বেগ বেড়েই চললো। টেলিভিশনের পর্দায় কড়া নজর রাখলাম। দুপুরের দিকে সংবাদ পেলাম কামরাঙ্গির চরে ভেসে এসেছে দু’জন অফিসারের লাশ, তবে তাদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। পিলখানার ড্রেনে ফেলে দিলে লাশ দুটি ভেসে কামরাঙ্গির চরে চলে যায়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল হত্যাকাণ্ড নজরে ফেলে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে বিদ্রোহীরা। এদিকে নিহতদের লাশ সংগ্রহ করার জন্য পিলখানার গেটে উপস্থিত হয়েছে রেডক্রিসেন্ট এর সদস্যরা।
ধীরে ধীরে মনে হলো সরকার কোনো এ্যাকশনে যাবেনা। বরং তারা রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। ২৫ ফেব্রুয়ারী, বুধবার ২০০৯- এ দিনভর অস্বাভাবিক পরিস্থিতির পর দুপুরের দিকে বিক্ষুদ্ধ বিডিআর-এর একটি প্রতিনিধি দলের (খুব সম্ববত ১৪ জন) সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ হয়। আমরা অধীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আলোচনার ফলাফল জানতে। তারপর যা জানতে পারলাম তা হলা, ২৫ ফেব্রুয়ারী সকালের ঘটনায় যারা জড়িত ছিল তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা দর্শকরা আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝতে পারলাম না, আড়াই ঘণ্টা বৈঠকের পর এটা কি ফলাফল হল? আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাচ্ছিলাম বিডিআর-এর ডিজি কোথায় আছন? আমাদের অফিসাররা কোথায় কী অবস্থায় আছেন? বেশ অহমিকার সাথে ক্যামেরার সামনে দাড়াঁলো ডি এ ডি তৌহিদ। সে জানালো যে, সাধারণ ক্ষমার আশ্বাস পেয়ে তারা অস্ত্র সমর্পন করে ব্যারাকে ফিরে যাবে। সাংবাদিকদের একজন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, “ আপনাদের কতজন মারা গিয়েছেন? হঠাৎ করে ডিএডি তৌহিদের মুখভঙ্গী কঠোর ও বিশ্রী হয়ে এলো। সাংবাদিকের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সে উল্টা ঘুরে গেলো। পরবর্তীতে জেনেছিলাম পিলখানা তখন মৃত্যুপূরী।
(চলবে)
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:১৫
রমিত বলেছেন: আপনার লেখাগুলো আমি সেই সময়ই পড়েছিলাম।
২| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:২০
রুদ্রাক্ষী বলেছেন: এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে '
০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:২৩
রমিত বলেছেন: সত্যিই তাই। এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে '!!!!
৩| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:২১
রুদ্রাক্ষী বলেছেন: এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে '
০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:২৩
রমিত বলেছেন: এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে '!!!
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৪
হাসান কালবৈশাখী বলেছেন:
কিছু প্রশ্নগুলোর উত্তর এখানে পাবেন
- কি ঘটেছিল সেদিন দরবার হলে?
তিন পর্বে।
Part 1
Click This Link
part2
Click This Link
Part 3
Click This Link