নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।
ওম মনিপদ্মে হুম – ২
-------------------------------ড. রমিত আজাদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সমুদ্রজয়ী বাঙালীরা: ভারত উপমহাদেশে বাঙালীরাই প্রথম সমুদ্রভ্রমণকারী শক্তিশালী জাতি। পান্ডু রাজার ঢিবিতে স্টিটাইট (Steatite)পাথরের কতকগুলি চিহ্ন খোদিত একটি গোলাকার সীল পাওয়া গিয়েছে।মনে করা হয় যে সীলটির খোদিত চিহ্নসমূহ চিত্রাক্ষর(Pictpgraph)এবং সীলটি ভূমধ্যসাগরীয় ক্রিট দ্বীপের, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে নির্মিত। এই সীল ও প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শন থেকে মনে করা হয় প্রাচীন সভ্যতার ক্রীট দ্বীপের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। এছাড়াও সমুদ্রপথে আমাদের জাভা, সুমাত্রা, শ্যাম (থাইল্যান্ড), ইত্যাদি দেশের সাথে বাণিজ্য ও যোগাযোগ ছিলো। মহাভামসা (Mahavamsa) অনুযায়ী বাংলার রাজপুত্র বিজয় সিংহ খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৪ সালে লঙ্কা জয় করেন এবং তার নাম দেন সিংহল। এই নিয়ে কবিতা রয়েছে ‘আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়, সিংহল নামে রেখে গেলো নিজ শৌর্যের পরিচয়’ । এছাড়া বাঙালী-রা মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও শ্যামে বসতি স্থাপন করেছিলো।
বাংলা শুরুতে আর্য সাম্রাজ্যের বাইরে ছিলো। আর্যরা বাংলার জনগণকে পছন্দ করতো না। ঐতরেয় ব্রাহ্মনে (Aitareya Brahmana) বাংলার (বঙ্গ-এর) জনগণকে দস্যু ও অনার্য বলে আখ্যা দেটা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যক (Aitareya Aranyaka)গ্রন্থেও বাংলাদেশের মানুষের নিন্দাসূচক উল্লেখ রয়েছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৯)।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল । মগধের কথা রামায়ণ এবং মহাভারতে পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধের (খ্রীষ্টপূর্ব ৫৬৩ থেকে ৪৮০ পর্যন্ত) সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি । মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে । বিহার এবং বাংলার অধিকাংশ জায়গাই মগধের ভিতরে ছিল তবে বাইরেও অনেক জায়গা ছিলো। গৌতম বুদ্ধ-এর ভাষা ছিলো মগধি প্রাকৃত (মগধি প্রাকৃত ও পালি ভাষা খুব কাছাকাছি)। তিনি আর্য ছিলেন কি অনার্য ছিলেন এই নিয়েও প্রচুর বিতর্ক রয়েছে (Johannes Bronkhorst’s book “Greater Magadha” was a very fine example of a revisionist history. It argued that the Aryan culture had not penetrated to Buddha’s region of birth and life (Magadha) and hence did not have a caste system and a very insignificant population of Brahmins)। তবে তাঁর প্রচারিত দর্শন যে অবৈদিক (heterodox) ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই।
দার্শনিক এরিস্টটলের শিষ্য আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী ৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয়। রাজ্যপিপাসু আলেকজান্ডার জানতেন যে দক্ষিণ এশিয়ার একেবারে পূর্বদিকে এক মহাপরাক্রমশালী জাতি আছে যার হস্তিবাহিনী ভয়াবহ। এই জাতি ইতিমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম শক্তিশালী সমুদ্রভ্রমণকারী জাতি হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। সমুদ্রপথে দূরবর্তি জাভা, সুমাত্রা, শাম ইত্যাদি দেশের সাথে তারা বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছে। মহাভামসা ইতিহাস গ্রন্থ অনুযায়ী এই দেশের (বঙ্গদেশ) রাজপুত্র বিজয় সিংহ (খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৪) লঙ্কা জয় করে তার নাম সিংহল দেন। এছাড়া তারা মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও শামদেশেও তাদের নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপন করে। যুদ্ধনেশাগ্রস্ত আলেকজান্ডার-কে এই রাজ্য জয়ের নেশায় পয়ে বসলো। তিনি হুকুম দিলেন তাঁর বাহিনীকে পুর্বমুখে ঐ দেশের দিকে অগ্রসর হতে। কিন্তু এতটা পথ জয়ী হয়ে আসা আলেকজান্ড্রীয় সেনাবাহিনী এবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই তারা অজুহাত দেখাতে থাকে যে তারা রণক্লান্ত এবং আর সামনে তারা যেতে চায়না। আলেকজান্ডার অনড় হয়ে বসলে তার বাহিনী বিয়াসের কাছে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং আরও পূর্বদিকে যেতে অস্বীকার করে। গ্রীক পরিব্রাজক মেগাস্থানিস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন্ডিকা’-য় উল্লেখ করেছেন, এই জাতির নাম গঙ্গাঋদ্ধি (Gangaridae)। যার অর্থ “Wealth of the Ganges”। দিওদোরাস সিকুলাস (Diodorus Siculus) উল্লেখ করেছেন, ভারত উপমহাদেশের সবচাইতে শক্তিশালী জাতি ছিলো গঙ্গাঋদ্ধি জাতি, এর রাজা বিশ হাজার অশ্ব, চার হাজার হস্তি, দুই হাজার রথ ও দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্যের এক শৌর্যপূর্ণ বাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডারের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হন। আলেকজান্ডার তখন তাঁর সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল। গ্রীক পলিম্যাথ টলেমী (৯০-১৬৮ খ্রীষ্টাব্দ) লিখেছেন গঙ্গারিডী জাতি গঙ্গা নদীর মোহনার পাঁচটি মুখের পুরোটাতেই রাজত্ব করতো। অর্থাৎ সেই রাজ্যের অবস্থান যেখানে ছিলো সেটাই আজকের বাংলা। গঙ্গারিডী রাজ্য বাংলারই প্রাচীন রূপ, গঙ্গাঋদ্ধি জাতি আমাদেরই পূর্বপুরুষগণ।
আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তানের পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনামলে মগধ রাজ্য (বাংলা সহ) মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় (৩৪০ – ২৯৮ খ্রীষ্টপূর্ব)। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সন্তান ছিলেন বিন্দুসার (৩২০-২৭২ খ্রীষ্টপূর্ব) এবং নাতি ছিলেন অশোক মৌর্য্য (৩০৪ – ২৩২)। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তার ছেলে বিন্দুসার ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী এবং বৈদিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। এই দর্শনটি বাংলায় প্রচলিত অবৈদিক বৌদ্ধ দর্শনের বিপরীত ছিলো। এদিকে অশোক মৌর্য সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। বাংলার দর্শন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করার ফলে বাংলার জনগণের সাথে তাঁর আর কোন দার্শনিক/ভাবাদর্শগত বিরোধ ছিলো না।
পিটকগ্রন্থ সংযুক্ত নিকায়ে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধ একবার সুম্ভভূমির (সুহ্মভূমি) অন্তর্গত সেতক নামক নগরে আগমন করে কিছুদিন অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তেলপত্ত জাতকেও (১ম খন্ড, জাতক নং ৯৬) সুমভ্ বা সুহ্ম জনপদের নামোল্লেখ রয়েছে। এজনপদটি গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী দক্ষিণতম ভূখন্ড, অর্থাৎ বর্তমান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলীর বহুলাংশ পশ্চিম এবং হাবড়া জেলা নিয়ে গঠিত ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। (রায়, নীহার রঞ্জন; বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, কলিকাতা, ১৩৫৬, পৃঃ ১১৭)। অঙ্গুত্তর নিকায়ের ‘কজঙ্গল’ নামে একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বুদ্ধ একসময় কজঙ্গলার সুবেসু বনে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ চম্পা হতে কজঙ্গল গিয়েছিলেন। বর্তমান এ জনপদের নাম কাঁকজোল। এটা প্রাচীন অঙ্গ, উত্তর রাঢ় ও গৌড়ের মধ্যবর্তী রাজমহলের পার্শ্ববর্তীতে অবস্থিত ছিল। ঐতিহাসিকগণও কজঙ্গলকে বঙ্গের অন্তর্গত বলে অভিহিত করেছেন। সংস্কৃত বিনয় গ্রন্থে এ সীমা পুড্রবর্ধন পর্যন্ত বলে উল্লেখ আছে। (রায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০০ ও ৪৯৪)।
সুত্তপিটকের অঙ্গুত্তর নিকায়ে বঙ্গান্তপুত্ত নামে এক খ্যাতনামা বৌদ্ধ আচার্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। অপরদিকে পিটকগ্রন্থ থেরগাথা ও সংযুক্ত নিকায়ে বঙ্গীশ নামে একজন প্রতিভাবান ভিক্ষুর উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। তাঁর কবিত্বের প্রতিভা ছিল অসাধারণ; তাৎক্ষণিক স্বরচিত কবিতাচ্ছন্দে তিনি বুদ্ধ ও বুদ্ধ-শিষ্যদেরগুণগান রচনা করে সকলকে অভিভূত করে দিতেন। প-িতদের ধারণা বঙ্গান্তপুত্ত ও বঙ্গীশ বঙ্গদেশের অধিবাসী ছিলেন বলেই এরূপ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। (Malalasekara, G.P; Dictionary of Pali Proper Names,Vol. II, P. 803)| Ae`vb kZK (Mitra, R.L.; The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal; Royal Asiatice Society of India, Calcutta,1971, pp. 73, 237
বাংলার যুবরাজ বিজয় সিংহ শ্রীলংকায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সহায়তা করেছিলেন, সিংহলী কিংবদন্তী এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় (বৌদ্ধসাহিত্য মহাবংস মতে (W. Geiger, ed.; Mahavamsa. PTS. London, 1958, ch. XII)। বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, বিজয় সিংহ ঘটনাটি ঘটিয়েছিলে ৫৪৪ খ্রীষ্টপূর্বে, সেটা গৌতম বুদ্ধের জীবনকালেই ঘটেছিলো (গৌতম বুদ্ধের জীবনকাল ছিলো ৫৬৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)। এর অর্থ এই দাঁড়ায় এই যে, বাংলার যুবরাজ বিজয় সিংহ গৌতম বুদ্ধের জীবনকালেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন ও তা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, বুদ্ধ দীর্ঘ ছয়মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যথাক্রমে পুড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ), সমতট (পূর্ববঙ্গ), তাম্রলিপ্তি (দক্ষিণ বা দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গ) ও কর্ণসুবর্ণ (পশ্চিমবঙ্গ) রাজ্যে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে আরো উল্লেখ করেছেন যে, তিনি উপরোক্ত জনপদ বা রাজ্যগুলো পরিদর্শনকালে অশোক কর্তৃক নির্মিত বহু স্তূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয় শতকে রচিত দিব্যাবদান গ্রন্থে জানা যায় যে, মধ্যদেশের পূর্বসীমা পুড্রবর্ধন নগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল (Law, B.C; Geography of Early Buddhism, Delhi 1973, pp.1-2)|
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী শিলালিপি থেকে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মৌর্য আমলে পুড্রবর্ধন বর্তমান মহাস্থান একটি প্রসিদ্ধ শাসনকেন্দ্র ছিল এবং এখানে একজন ‘মহামাত্র’ বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক যুগের প্রথম সূচনা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক) শাসনামল থেকে। তিনিই প্রথম তৎকালীন ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পন্ডিতদের ধারণা সমগ্র বাংলাদেশ তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল (আহমেদ, নাজিমউদ্দিন; মহাস্থান, ময়নামতি ও পাহাড়পুর, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃঃ ৬)। মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী-শিলালিপিখানি মৌর্যসম্রাট অশোক কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত বলে স্থিরকৃত হয়েছে। এ লিপিতে ছবগ্গীয় বা ষড়বর্গীয় থেরবাদী ভিক্ষুদের উল্লেখ রয়েছে। এ শিলালিপির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত জনসাধারণের প্রতি রাজকীয় কোষাগার এবং শষ্যভান্ডার থেকে তেল, ধান, গন্ডক ও মূদ্রা সাহায্যদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনামা থেকে প্রমাণিত হয় যে, পুড্রবর্ধন রাজ্য মৌর্যসাম্রাজ্যভূক্ত ছিল কিংবা মৌর্যসম্রাটের আজ্ঞাবহ সামন্তরাজ্য ছিল। কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন অনুযায়ী প্রাক গুপ্তযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অপরদিকে পিটক বহির্ভূত পালি সাহিত্য বিশেষ করে বংশ সাহিত্য পাঠে জানা যায়, বুদ্ধ বোধিজ্ঞান লাভের আট বছর পর গবম্পতি থেরর প্রার্থনায় মিয়ানমারের (বার্মা) প্রাচীন রামঞ্ঞ রাষ্ট্রের সুধর্মপুরে উপনীত হয়েছিলেন। (মহাস্থবির, ধর্মাধার; অনুঃ শাসনবংস পৃঃ ৫৫)। বুদ্ধ যদি স্বয়ং মিয়ানমারে গমন করে থাকেন তাহলে তাঁকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হয়েছিল, কারণ তখন এটাই ছিল মিয়ানমারে যাবার প্রশস্ত ও সহজ পথ। কাজেই তখন চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া, কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধ স্বয়ং একবার চট্টগ্রামের হস্তীগ্রামে এসে পক্ষকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই হস্তীগ্রাম পটিয়ার হাইদগাঁও বলে মনে করা হয়। এখানে একটি বুদ্ধমন্দির বা কেয়্যাংও ছিল (আলম, ওহিদুল; চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল), চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃঃ ৮)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদও উল্লেখ করেছেন যে, বৌদ্ধরা এদেশের আদি অধিবাসী (ইসলামাবাদ, পৃঃ ১২)। পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরীও একই মতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, মগধদেশ হতে বৌদ্ধধর্মের প্রচারকগণ পূর্ব দেশে এসে ধর্ম প্রচার করেন এবং চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রাচীনতম ধর্ম। (চট্টগ্রামের ইতিহাস, চট্টগ্রাম, ১৯২০, পৃঃ ২)।
উপর্যুক্ত আলোচিত বৌদ্ধ ঐতিহ্য, পালি ও বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য, প্রচলিত কিংবদন্তী, চৈনিক পর্যটকদের বিবরণ, ঐতিহাসিক ও গবেষকদের অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, বুদ্ধের সময়কাল খ্রিঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতক থেকে খ্রিঃ পূঃ ৩য় শতকের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম বাংলাদেশে প্রচারলাভ করেছিল এবং মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পরবর্তীতে স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি সমগ্র বাংলাদেশে একটি প্রধান ধর্ম হিসেবে দীর্ঘকাল বেঁচেছিল এবং এদেশের সমাজ, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতা প্রভৃতির সামগ্রিক বিকাশে অসীম অবদান রেখেছিল। মূলত এখনও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ দর্শনের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্ব অর্থাৎ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৩য় শতক পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশ বছরের মধ্যে পূর্ব ভারতের (বাংলাদেশ) ইতিহাস সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা হলো খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০ থেকে ৪০০ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত বাংলা শাসন করেছিলো Mahameghavahana Dynasty (c. 250 BC–400 AD) এই রাজবংশের শাসকরা ছিলেন Mahamegha Vahana (?), Kharavela (c.193–179 BC) ও
Vakadeva (or Vakradeva) (?)। তারপর বাংলা শাসন করে Shunga Dynasty (185–73 BC) এই রাজবংশের শাসকরা ছিলো Pushyamitra Shunga (185–149 BC), Agnimitra (149–141 BC), Vasujyeshtha (141–131 BC), Vasumitra (131–124 BC), Andhraka (124–122 BC), Pulindaka (122–119 BC), Ghosha Vajramitra Bhagabhadra ও Devabhuti (83–73 BC)। এরপর শাসন করে Kanva Dynasty (73–43 BC) এই রাজবংশের শাসকরা ছিলো Vasudeva (from 73 BC), Bhumimitra Narayana ও Susharman (Until 43 BC.)। এইসব শাসকদের কারো কারো সম্পর্কে মোটামুটি জানা যায়, আর কারো সম্পর্কে খুব কমই জানা আছে।
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের শেষান্তে অথবা চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের অব্দে অথবা চতুর্থ শতকের প্রারম্ভে গুপ্ত বংশীয় আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করতেন। আবার কারো কারো মতে গুপ্তগণ বাঙালি ছিলেন এবং প্রথমে বাংলাদেশেই রাজত্ব করতেন। আবার চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিং-এর বিবরণের উপর নির্ভর করে ইতিহাসবিদ ডি. সি. গাঙ্গুলি অনুমান করেছেন যে, গুপ্তবংশীয় রাজাদের আদি বাসস্থান বাংলাদেশেই ছিলো। সেটা বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে থাকতে পারে অনুমান করা হয় ((বাংলাদেশের ইতিহাস, গ্রন্থকার: ফোর ডক্টরস)। তবে এ দুই অভিমতের পক্ষে কোনো জোড়ালো যুক্তি বা তাথ্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩-৩৪)। শ্রীগুপ্তের পুত্র ঘটোৎকচ, তাঁর পুত্র চন্দ্রগুপ্ত এবং তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্ত ও পৌত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বহুরাজ্য জয় করে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবংশীয় সম্রাটগণ খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। গুপ্ত সম্রাজ্যের প্রারম্ভে বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশ স্বাধীন ছিল। গবেষকগণ মনে করেন যে, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে সমগ্র বাংলাদেশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল কিংবা গুপ্ত সাম্রাজ্যের আনুগত্যাধীন ছিল (চৌধুরী, কিরণ চন্দ্র; ভারতের ইতিহাস কথা, কলিকাতা,১৯৯৫, পৃঃ ৪৮৭)। উত্তরবঙ্গে গুপ্তযুগের কতিপয় আবিষ্কৃত তাম্রশাসন থেকে জানা যায় বাংলাদেশের উত্তরাংশ নিয়ে সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি ‘ভূক্তি’ বা প্রদেশ গঠিত ছিল। এটা ‘পুড্রবর্ধন ভূক্তি’ নামে পরিচিত ছিল এবং সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত প্রদেশপালের দ্বারা শাসিত হত। তবে এ বিষয় নিশ্চিত যে, গুপ্ত সম্রাটগণ দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন।
গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণ ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুসারী। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক। গুপ্ত বংশীয় শাসনামলকে ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবনের যুগ’ বলা হয়। তবে । চন্দ্রগুপ্ত সনাতন ধর্মের অনুসারী এবং বৈদিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। এই দর্শনটি বাংলায় প্রচলিত অবৈদিক বৌদ্ধ দর্শনের বিপরীত ছিলো। চন্দ্রগুপ্তের ছেলে ও নাতি সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫ – ৩৭৫ খ্রীষ্টাব্দ) ও চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় (৩৮০ – ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলা আক্রমণ করে অনেক অংশ দখলে নিয়েছিলো। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত যখন বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলো সেই সময়ে তখন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতট রাজ্য ও পশ্চিম বাংলার পুষ্করণ রাজ্য স্বাধীন ছিলো। ধারনা করা হয় যে পুষ্করণআধিপ চন্দ্রবর্মাই এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক পরাজিত চন্দ্রবর্মা। দিল্লীর কুয়াতুল ইসলাম মসজিদের প্রাঙ্গনে অবস্থিত লৌহ স্তম্ভগাত্রে ক্ষোদিত লিপি এই সময়কার বাংলার ইতিহাসে কিছুটা আলোকপাত করে। এই লিপিতে চন্দ্র নামধারী এক রাজার বিজয় কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। উল্লেখ করা আছে যে তিনি বঙ্গে তার শত্রূ নিধন করেছিলেন এবং বীর বঙ্গীয়রা তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছিলো। (বাংলাদেশের ইতিহাস, গ্রন্থকার: ফোর ডক্টরস)। ধারনা করা হয় যে, সেই চন্দ্র রাজা হয় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত।
গুপ্ত শাসনামলে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথম পাদে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন (৩৩৭ – ৪২২ খ্রিস্টাব্দ) বৌদ্ধ ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষে আগমন করেন (৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দ) ১৪ বছর ভারতবর্ষ, শ্রীলংকা ও যবদ্বীপ পরিভ্রমণ শেষে ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয়ের শাসনামল চলছিলো। তিনি গঙ্গার পথ ধরে চম্পা হতে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তাম্রলিপ্তি বন্দরে (তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, সিংহলি গ্রন্থ এবং গি্রক ভৌগোলিক ও চৈনিক তীর্থযাত্রীদের বিবরণে উল্লিখিত প্রাচীন মানব বসতিস্থল। এ সকল গ্রন্থ ও বিবরণ থেকে জানা যায় যে, পূর্ব উপকূলবর্তী তাম্রলিপ্তি গঙ্গা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে তার কাছে অবস্থিত ছিল। গ্রিক পন্ডিত টলেমির মানচিত্রে বাংলায় তমলিটিস নামে একটি বন্দরনগরীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেটি প্রাচীন বাংলার তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত বন্দরেরই অন্য নাম বলে মনে করা হয়।) দুই বছর অবস্থান করে বৌদ্ধ সূত্র ও প্রতিমা চিত্র নকল করেছিলেন।
উত্তরবঙ্গ দীর্ঘকাল গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত ছিলো, এবং আঞ্চলিক শাসনের কেন্দ্র ছিলো পৌন্ড্রনগর ( বর্তমান মহাস্থানগড়)। পাহাড়পুর ও দামোদরপুরের বিভিন্ন তাম্রশাসনে গুপ্তযুগের নিদর্শন পাওয়া যায়। মোটামুটি ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশ গুপ্তাধিকারভুক্ত ছিলো। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এই সময় প্রচলিত থাকলেও গুপ্ত সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সময়ে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম (যার পরবর্তি রূপ হিন্দু ধর্ম)-এর অভ্যুত্থান ও প্রসার লাভ ঘটে। ইহার প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তযুগের বিভিন্ন তাম্র শাসনে। এই শাসন সমূহে ভূমিদান প্রধানত ব্রাহ্মণরাই লাভ করেছিলো। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য বাগযজ্ঞ ও পৌরাণিক দেব-দেবীর পূজার প্রচলন এবং ব্রাহ্মণদের জন্য নতুন নতুন বসতি স্থাপনের সাক্ষ্যও এই লিপিসমূহে পাওয়া যায়। (বাংলাদেশের ইতিহাস, গ্রন্থকার – ফোর ডক্টরস)।
সম্রাট অশোক, সম্রাট কণিষ্ক, রাজা অজাতশত্র“, হর্ষবর্ধন এবং পালবংশীয় রাজদের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বৌদ্ধদের সামাজিক অবস্থা শৌর্য বীর্যহীন হয়ে পড়ে। শৃঙ্গ বংশীয় মগধরাজ পুষ্যমিত্র (খৃষ্টপূর্ব দুই শতক) হুন নায়ক তোরমান (খৃস্টীয় ৫০০) ও তার পুত্র মিহিরগুল (শৈব উপাসক) খৃস্টীয় ৫১৫-৫৩০), ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদ কুমারীল ভট্ট (খৃস্টীয় ৭০০-৮০০), শঙ্করাচার্য (খৃস্টীয় ৭৮৮-৮২০), রাজা লক্ষণসেন (খৃস্টীয় প্রায় (১১৭৮-১২০৫) প্রমুখ বৌদ্ধ বিদ্বেষীদের চক্রান্ত ও আক্রমনের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকান্ড, অত্যাচার, অনাচার এবং ধর্মান্তরিত করার উন্মত্ত উলঙ্গ প্রয়াস, বৌদ্ধ ভিক্ষু পন্ডিত মনীষীদের এই উপমহাদেশ ত্যাগে বাধ্য করে। এতদ্ সত্ত্বেও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে সমতল এলাকায় (বৃহত্তর চট্টগ্রাম কুমিল্লা ও নোয়াখালী) বৌদ্ধ ধর্মের সেই প্রদীপ্ত শিখা অম্লান থেকেছে। সেই সময় বৌদ্ধ মনীষীদের দেশ ত্যাগের ফলে এদেশে রচিত গ্রন্থের অস্তিত্ব নেপাল, তিব্বত ও চীন দেশে পাওয়া যায়। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপাল রাজ দরবার থেকে আবিষ্কৃত এদেশের সিদ্ধাচার্যদের রচিত বাংলাভাষার আদি নির্দশন বৌদ্ধ গান ও দোঁহা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই উপমহাদেশে বৌদ্ধ সংস্কৃতি এক সময় বিস্ময়কর সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। পাহাড়পুর সোমপুরী মহাবিহার, বাসু বিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড় কুমিল্লার ময়নামতি শালবন বিহার, দিনাজপুরের জগদ্দল বিহার, আনন্দ বিহার, চট্টগ্রামের পন্ডিত বিহার, অধুনা আবিষ্কৃত বিক্রমপুর বিহার, বাংলার নিকটবর্তি নালন্দা, বিক্রমশিলা, অজন্তা, ইলোরা, গান্ধারা, প্রভৃতি আমাদের অতীত ইতিহাসের উজ্জ্বলতায় চিরভাস্বর। এখান থেকে বৌদ্ধ ধর্ম সাম্য মৈত্রীর ধারায় এক সময় বিস্তৃত এশিয়া ভূখন্ড ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৌদ্ধধর্ম মানবের কর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সৎকর্মের জন্য সুফল, কুকর্মের জন্য কুফল। কর্ম মানুষের জীবনের সাথে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। এই ধর্মে জাতিভেদ প্রথা নাই। জন্মসুত্রে নয়, কর্মসুত্রে মানুষের মান-মর্যাদা নির্ধারন করা হয়।
শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্ম বাংলার বিক্রমপুরে হলেও অনেক ইউরোপীয়ানরা অতীশকে Atisha এবং তাঁকে 11th century Tibetan Buddhist master বলা হয়েছে। এবং Oṃ maṇi padme hūṃ- এই মন্ত্রটি বাংলার বজ্রযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধদের মন্ত্র হলেও বর্হিবিশ্বে এই মন্ত্রকে তিবেটান (তিব্বতের) মন্ত্র হিসেবে জানে। উল্লেখ্য, বজ্রযানীদের প্রধানা দেবী হলেন তারা। ইনি ছিলেন বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী। মাতঙ্গী পিশাচী ডাকিনী যোগীনি -প্রমূখ তুচ্ছ দেবীও বজ্রযানীদের আরাধ্য ছিল। বজ্রযানীগণ বিশ্বাস করতেন দেবদেবীদের করূণা ভিক্ষা করে লাভ নেই। এদের বাধ্য করতে হবে। যে গ্রন্থে এ কাজ করার উপায় সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে-তাদের বলা হত ‘তন্ত্র’।
যে কারণে বজ্রযান কে বলা হয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। মন্ত্র এবং যন্ত্র -এ দুই হল বজ্রযানের সাধনার উপকরণ। যন্ত্র হল মোহিনী প্রতীক, যা সঠিক ভাবে আঁকতে হয়। (মোহিনী প্রতীক হল religious symbolism. যা মার্কিন লেখক ড্যান ব্রাউন আধুনিক পাঠকের কাছে পরিচিত করেছেন) বৌদ্ধধর্মে পদ্ম বিশুদ্ধতার প্রতীক। পদ্ম নীল রং ছাড়া যে কোনও রঙের হতে পারে। (ইদানিং যে নীল রঙের জলপুষ্প দেখা যায় তা আসলে শাপলা (পদ্ম নয়))।
বজ্রযানের প্রধান মন্ত্র হল:
ওম মনিপদ্মে হূম।
এর অনেকগুলো অর্থ রয়েছে বলে ধারনা করা হয়। সম্ভাব্য একটি অর্থ হলো, ‘আহা, মনিই প্রকৃত পদ্ম …’
বিহারের বিক্রমশীলা বিহারটি ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্র। একাদশ এই মঠের বজ্রযানী বৌদ্ধরা তিব্বতে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন । তিব্বতে আজও অসংখ্যবার ‘ওম মনিপদ্মে হূম’ জপ করা হয়।’আহা, মনিই প্রকৃত পদ্ম’ – অনেকের মতে, এই মন্ত্রটি বুদ্ধ এবং প্রজ্ঞাপারমিতার এবং বোধিসত্ত্ব এবং তারা দেবীর যৌনমিলনের প্রতীক। তবে বজ্রযান কেবলি যৌন সাধনপন্থা নয়, বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি রহস্যময় রূপ।
‘ওম মনিপদ্মে হূম’, বাংলার এই মহামন্ত্রটির আরো চমকপ্রদ কিছু অর্থ ও ব্যখ্যা রয়েছে। পরবর্তি পর্বে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র:
১। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল
২। ইমরান যুবায়ের-এর ব্লগ
৩। http://www.munshigonj.com/Famous/Atis.htm
৪। Click This Link
৫। http://thebuddhisttimes.com
৬। http://wikipedia.org
১৫ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:০৭
রমিত বলেছেন: মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই জুন, ২০১৫ সকাল ১১:৩৪
লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: প্রচুর তথ্যে ভরা লেখনী
চলুক ---
শুভকামনা রইল