নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।

রমিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাস প্রসঙ্গ: সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি -পর্ব ১, ২

১৭ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৫

ইতিহাস প্রসঙ্গ: সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি -পর্ব ১, ২
----------------------------------------------- ড. রমিত আজাদ



ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয়গুলোর একটি। বিষয়টির উপর আমার প্রথম আগ্রহ জন্মে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মরহুম মাজহারুল হক স্যারের প্রাঞ্জল লেকচার শুনে। আমরা তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, স্যার আমাদের পড়ানো শুরু করলেন সিন্ধু সভ্যতা থেকে। উনার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছিলাম যে, আমাদের এই উপমহাদেশেই এতো পুরাতন একটি সভ্যতা ছিলো। স্যারের কাছ থেকেই প্রথম জেনেছিলাম যে আমাদের এই উপমহাদেশ আঠারো শতকের মাঝামাঝির (অর্থাৎ পলাশীর ট্রাজেডির আগে) আগ পর্যন্ত একটি ধণাঢ্য অঞ্চল ছিলো, ইউরোপের মানুষরা এই দেশ সম্পর্কে বলতো 'A land where milk and honey flows'. স্যারের কাছ থেকে আরো জেনেছিলাম 'what Bengal thinks today, India thinks tomorrow' -গোপালকৃষ্ণ গোখলে। স্যারের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম বিজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে পরাজিত ধৃত পুরু কেমন বীরের মতো বলেছিলেন "আপনার কাছ থেকে আমি সেই আচরণটিই আশা করি, যা একজন রাজার কাছ থেকে আরেকজন রাজা আশা করতে পারে।" নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার জন্য আর পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের সাক্ষাৎ ঘটেনি। তাছাড়া আমাদের বাংলাদেশে এই বিষয়টি অনেকটাই অবহেলিত। তাই এরপর ছিটেফোটা যেটুকু পড়েছি, তা নিজ আগ্রহেই পড়েছি। বিষয়টির সাথে নতুন করে পুণরায় সাক্ষাৎ হয় ইউরোপে আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সে পড়তে গিয়ে। ওখানে ছাত্র-ছাত্রী বিজ্ঞান, কলা বা ব্যবসা যেই বিভাগেরই হোক না কেন ইতিহাসের উপর একটি কোর্স তাকে বাধ্যতামূলক করতেই হবে। আমার নব সাক্ষাৎটি হয়েছিলো বেশ পাকাপোক্তভাবেই। কারণ লক্ষ্য করলাম বাধ্যতামূলক কোর্সটি ছাড়াও, সেখানে যে কোন বিষয় পড়ানোর আগে, ঐ বিষয়ের ইতিহাসটি তুলে ধরা হয়। কখনো কখনো কোন একটা টপিক পড়ানোর আগেও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-টি বোঝানো হয়। এর ফলে বিষয়টি একেবারেই পাহাড়ী ঝর্ণার জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যায়।

মাঝে কিশোর বয়সে একবার একটি উপন্যাস পড়েছিলাম যার নাম 'হৃদয়ের পথে খুঁজো', যেখানে নায়ক একজন আত্মম্ভরী তরুণ কৌশুলী রাজনীতিবিদ, আর নায়িকা একজন সাদাসিদা মেধাবী তরুণী যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্রী। বইয়ের পাতার লেখাগুলো সে মনযোগ দিয়ে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে উচ্চ নম্বর পেয়ে সবার গতানুগতিগ বাহবা কুড়ায়। আর তাতেই সে সন্তষ্ঠ! প্রাতিষ্ঠানিক বিচারে অমেধাবী তরুণ রাজনীতিবিদ ছেলেটি যখন তাদের তরুণ জীবনের প্রথম পরিচয়ের দিনে তরুণীটিকে প্রশ্ন করেছিলো, "ইতিহাস পড়ছো? তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি যা পড়ছো, তার পুরোটাই সত্য অথবা কতটুকু সত্য তুলে ধরতে পারছে, তোমার এই ইতিহাসের বইগুলো??" পরীক্ষার নম্বরের বিচারে মেধাবী তরুণীটি এমন একটি প্রশ্ন ইতিপূর্বে কখনো শোনেওনি, এই নিয়ে ভাবেও নি, তাই তরুণের এই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন শুনে মুগ্ধ হয়েছিলো। আর মিষ্টি মধুর প্রেম ও পরিশেষে ট্র্যাজিক এই উপন্যাসটির এই পর্যায়ে এসে আমিও একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমার মনেও সহসাই প্রশ্ন জেগেছিলো, 'তবে কি ইতিহাসে আমরা যা পড়ছি, তার সবটুকু সত্যি নয়?' তবে ধাক্কাটা খুব জোড়েসোরে লাগেনি বা মনের গভীরে ক্ষতও সৃষ্টিই করেনি, কারণ আমার বয়স তখন খুবই কম ছিলো।

এই ধাক্কা নতুন করে লাগতে শুরু করলো গত শতাব্দীর নব্বই-য়ের দিনগুলোতে। পৃথিবীতে তখন একের পর এক ঘটে যাচ্ছে অপ্রত্যাশিত কিন্তু অনিবার্য সব ঘটনা। একসময়ের তৃতীয় বিশ্বের তরুণদের ক্রেজ সমাজতন্ত্রের তখন টালমাটাল অবস্থা। পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাজন সৃষ্টিকারী দুইটি মতাদর্শের মাঝামাঝি শান্ত্রীর মতো অটল দাঁড়িয়ে থাকা বার্লিন প্রাচীরের পতন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পালের গোদা প্রবল প্রতাপশালী পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভরাডুবি অতঃপর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া। দেশে দেশে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ও তাদের নেতাদের হয় মৃত্যুদন্ড অথবা পলায়ন, ভাগ্য ভালো থাকলে নিজ দেশেই নিভৃতযাপন। আর এই সব ডামাডোলের মধ্য দিয়ে প্রথমে ইরাকের কুয়েত আগ্রাসন আর তারপর বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বের ঐক্যবদ্ধভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। এইসব কিছু আমাকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করলো। এতকাল ইতিহাসে যা পড়েছি তার কতটুকু সত্যি?

আমার এখনো মনে পড়ে ১৯৯০ সালে আমাদের ইতিহাসের ক্লাস নিতে আসা একজন বয়স্ক শিক্ষক যখন আমাদেরকে বোঝাচ্ছিলেন সমাজতন্ত্রের দুর্বল দিকগুলো ও কেন পেরেস্ক্রোয়কা (পুনর্গঠন) প্রয়োজন, আমি তখন অবাক হয়ে উনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, "কয়েক বছর আগে একদলীয় কম্যুনিস্ট সরকারের শাসনামলে আপনি কি এই কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন? না কি আপনি নিজেই তখন ভিন্ন কথা বলতেন? আপনি এখন যা বলছেন, পূর্বেকার ইতিহাসে তো আমরা ভিন্ন রকম পড়েছি।"

আমার পারিবারিক পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ বামপন্থী ছিলেন। তাদের সুবাদে পারিবারিক লাইব্রেরীতে কিছু লালবই (কম্যুনিজম-এর উপর লিখিত বইগুলোকে ঐ নামে ডাকা হতো) ছিলো। আমি মাঝে মাঝে ওগুলো পড়তাম। ঐ কাঁচা বয়সে সমতা, শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি কথাগুলো দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম। আর সেই সময় আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিদের একটা বিরাট অংশ ঐ মতাদর্শের অনুসারী হওয়ায় তাদের লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-গান-সিনেমা-নাটক ও শিল্পে সাম্যবাদী চিন্তা-ভাবনার ছাপ থাকতো, এর দ্বারা আমরা কিশোর-তরুণরাও প্রভাবিত হতাম। আমাদের তখন সাধারণ ধারনা ছিলো যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে রয়েছে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ। পুঁজিবাদের পরবর্তি ও উন্নত ধাপ এটি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশও একসময় ঐ সমাজ ব্যবস্থা গঠন করবে। স্বপ্নের সেই সমাজব্যবস্থা ভিতর থেকে দেখে ও তার টালমাটাল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করছিলাম।

বারবার শুধু মনে প্রশ্ন জাগছিলো, তাহলে আমরা লাল বইগুলোতে যা পড়েছিলাম তা কি সত্যি ছিলোনা। ঐ কাঁচা বয়সে ছাপার অক্ষরে কোন কিছু দেখলে তাকে ধ্রুব সত্য মনে করতাম। তদুপরী চোখের সামনে নতুনভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা, ডকুমেন্টারি ফিল্ম, খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রমাগত জানতে পারছিলাম যে, অতীতের লেখা ও প্রচার-প্রচারণা গুলোর মধ্যে ছিলো চরম প্রতারণা। আমার এখনো স্পষ্ট মনে করে, মস্কোর রেড স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একদল মানুষ বিক্ষোভ করছিলো, আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, "এতোদিন পর আপনাদের বোধোদয় হলো? আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন?" তারা আমাকে উত্তরে বলেছিলো, 'মিডিয়া আমাদের সাথে প্রতারণা করেছিলো।" বুঝলাম যে, ছাপার অক্ষরে যা কিছু পড়ি, টেলিভিশন-পেক্ষাগৃহের রঙিন পর্দায় যা কিছু দেখি তার অনেক কিছু প্রতারণামূলকও হতে পারে। তখন মনে মনে নিজেকেই বারবার প্রশ্ন করছিলাম "সত্যের মাপকাঠি কি?"

সম্প্রতি বিশ্বের ইতিহাসে খ্যাতিমান একটি গ্রন্থ আমার হস্তগত হয়েছে। তার কিছু অংশ তুলে দিলাম।

‘ইতিহাস এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিশ্বের সকল জাতি ও গোত্রের কাছে সমভাবে আদরনীয়। কি পন্ডিত কি মূর্খ সকলেই ইতিহাসের মধ্যে উপদেশ অনুসন্ধান করে। ইতিহাস আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কালচক্রের আবর্তন সকল বিষয় ও বস্তুকেই নিয়ত পরিবর্তন করেছে। একটি রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব ঘটছে, তার ব্যপক বিস্তৃতি পৃথিবীর সমৃদ্ধি আনয়ন করছে, আবার কালের অমোঘ বিধানে তার পতনও ঘটছে।

কিন্তু ইতিহাসের অন্তর্নিহিত শক্তি এই বাহ্য বিবরণের তুলনায় অধিকতর ব্যপক ও তাৎপর্য-মন্ডিত। তা আমাদের সামনে বিষয় ও ঘটনাবলীর কারণ এবং বিকাশ ও বিনাশের মৌলিক উপাদানসমূহকে উদঘাটিত করে। বস্তুত মুসলিম ইতিহাসবিদগণ এই সত্যকে সামনে রেখে ঘটনাবলীর বিবরণ সংগ্রহ ও উহা গ্রন্থাকারে বিন্যস্ত করে গিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তিকালে অনেকেই উক্ত ঘটনাবলীর সাথে মিথ্যা কাহিনী ও কল্পিত বর্ণনার সংযোজন করেছে। বিচার-বিশ্লষণের পরিবর্তে ধারণা ও শ্রুতিনির্ভর কল্পনা ইতিহাস বর্ণনায় তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। পরবর্তি ইতিহাসবিদগণ ক্রমশ এই ধারাকেই অক্ষুন্ন রেখেছে, এবং তাদের এই কল্পিত অতিরঞ্জিত বিবরণই আমাদের নিকট এসে পৌছেছে। এতে সত্যানুসন্ধানের কোন চেষ্টা নাই। বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে কলুষমুক্ত করার কোন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়না। এর ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, তারা অন্ধ বিশ্বাসের শিকারে পরিণিত হয়েছে এবং বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন লোকদিগের বিবরণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এই কারণেই সাধারণ মানুষদের মধ্যে অন্ধ বিশ্বাসের এমন ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে।

অসংখ্য ব্যক্তি ইতিহাস রচনায় আত্মনিয়োগ করলেও যথার্থ ইতিহাসবিদের সংখ্যা অতিঁ নগন্য। অনেকে ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলেছেন। আবার অনেকে সমসাময়িক ইতিহাসের বিবরণ দিতে গিয়ে নিজ দেশ, রাষ্ট্র ও অঞ্চলবিশেষের বর্ণনার উপর ইতিহাসকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। অতঃপর এমন একদল ইতিহাস লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে যারা মানসিকতার দিক থেকে সংকীর্ণ এবং বিশ্বাসের দিক থেকে সম্পুর্ণ অন্ধ ও অবিবেচক। কালচক্রের আবর্তন কিভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং তদ্দরুন মানবচরিত্র ও সমাজপ্রগতি কিভাবে বিবর্তিত হয়, তার কার্যকারণ তারা আদৌ উপলদ্ধি করতে পারেনাই। এর ফল দাঁড়িয়েছে যে তাদের বর্ণনা বর্ণনা মাত্রই, এর ভিত্তি জানা যায়নি। তারা কতগুলি পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন মাত্র। বিষয় গুরুত্ব বলতে কিছু নাই।

ফলত তাদের সংগৃহিত বিবরণ ঐতিহাসিক দূরদৃষ্টির অভাবে সম্পুর্ণ অন্তসারশূণ্য হয়ে পড়েছে। তারা কোন রাষ্ট্রের বিবরণ দিতে গিয়ে তার উত্থান-পতন ইত্যাদির বিবরণে কার্যকারণ বিশ্লেষেণে কোন প্রকার চেষ্টা করে নাই। সেখানে কেবল রাষ্ট্রশক্তির প্রারম্ভ ও বিনাশের কথাই আছে, একটি রাষ্ট্রশক্তি কিভাবে অন্য একটি শক্তির স্থলাভিষিক্ত হয় - কিভাবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে; সে সম্পর্কে কোন ধারণাই দেয়না। আমার গ্রন্থে উপরোক্ত বিশ্লষণের প্রতি মনোনিবেশ করিব।

এরপর একদল ইতিহাসবিদদের আবির্ভাব ঘটলো যারা সংক্ষিপ্তকরণকেই তাদের মূল লক্ষ্য করলেন। গলে তাদের সংগৃহত ইতিহাস শুধু সম্রাটদের নামের তালিকায় রূপান্তরিত হয়েছিলো। এই সকল বিষয় পর্যালোচনা করে আমি বিশ্লেষণ ভিত্তিক ইতিহাস রচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম, অতীত ঘটনাবলীর রহস্য উদঘাটনে প্রবৃত্ত হইলাম। আশা করি এর ফলে পাঠক অন্ধ-বিশ্বাস ও শ্রুতি নির্ভরতা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে, এবং অতীতের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণের আলোকে ভবিষ্যতের চিত্রও নিজের চোখের সম্মুখে দেখতে পাবে।‘

(খ্যাতিমান মুসলিম জ্ঞানতাপস ইবনে খলদুনের (১৩৩২ -১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দ) সাড়া জাগানো গ্রন্থ 'আল মুকাদ্দিমা' গ্রন্থের শুরুর কিছুটা অংশ তুলে ধরলাম)

আসলে 'ট্রুথ ইন হিষ্ট্রী' বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই চৌদ্দ শতকেই জ্ঞানতাপস ইবনে খলদুন এই বিষয়ের উপর সন্দেহ প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। এবং কি করে তার বিচার করতে হয় সেটাও বলেছেন। উনার মৃত্যুর পরেও কয়েক শতাব্দি পেরিয়ে গিয়েছে। আরো অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে। জন্ম হয়েছে নতুন নতুন মতাদর্শের। ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়েও বিতর্কের অবসান ঘটেনি। আমি বলতে চাই যে, ছাপার অক্ষরে লেখা থাকলেই তা ধ্রুব সত্য নয়। লেখকের মতি-গতি উদ্দেশ্য, সময়কাল, শাসকশ্রেণির প্রভাব থেকে শুরু করে অনেক ফ্যাক্টরই বিবেচনা করে সত্য-অসত্য যাচাই করতে হয়।

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়েও ইদানিং বেশ আলোচনা হয়ে নেটে তোলপাড় হচ্ছে। পক্ষে ও বিপক্ষে রেফারেন্স হিসাবে গত শতকের কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করছে। বিষয়টি হলো আটশত বা একহাজার বা দুইহাজার বছর আগের কোন ইতিহাস জানতে চাইলে সেই সময়ের রচিত কোন গ্রন্থেই খুঁজতে হবে। এবার আরো একটা প্রশ্ন জাগে - সেই সময়ে কোন ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছিলো কিনা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা পেলাম - ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন আরম্ভ হওয়ার পূর্বে কোন ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করা হয়নাই। খোয়ারিজমের আবু রায়হান বিরুনি (আল বিরুনি, ৯৩৭ থেকে ১০৪৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) সুলতান মাহমুদের হাতে বন্দি হয়ে গজনীতে আনিত হন। অতঃপর একবার মাহমুদের বাহিনীর সাথে পাঞ্জাবে আসেন তিনি। ভারত সম্পর্কে প্রাপ্তব্য সকল সংবাদই তিনি নিষ্ঠার সাথে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। পরে তিনি হিন্দুস্তান ('তারিখ-আল-হিন্দ';) নাম দিয়ে একখানি বিশ্বকোষের সংকলন করেন। এই বইখানি অমূল্য নানা ঐতিহাসিক তথ্যের ভান্ডার। প্রথম সত্যিকার ইতিহাস অবশ্য রচনা করেন মিনহাজউদ্দিন জুজইয়ানি (জন্ম ১১৯৩ খ্রীষ্টাব্দ) নামে জনৈক পারস্যবাসী। ইনি এর রচিত ইতিবৃত্তখানির নাম দেন এর পৃষ্ঠপোষক সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের নামানুসারে 'তবাগত-ই-নাসিরি'। চতুর্দশ শতকে ফারসী ভাষায় মূল্যবান নানা ঐতিহাসিক তথ্য সংকলিত করেন জিয়াউদ্দিন বারানি ও শামস্ সিরাজ আফিফ। ...... গ্রন্থখানীর নাম দেন 'তারিখ-ই-ফিরুজ শাহী'। (তথ্যসূত্রঃ ভারতবর্ষের ইতিহাস, গ্রন্থকার: আন্তোনভা, বোনগার্দ-লিভিন-কতোভস্কি), প্রকাশক: প্রগতি প্রকাশনা, মস্কো)।

এবার সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গে আসি। ইতিহাসবিদ তো ইতিহাস লিখেছেন, কিন্তু তিনি কতটুকু সত্য লিখেছেন? কারণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো, 'ইতিহাস বিজয়ীদের সম্পদ'। আরও রয়েছে এডলফ হিটলারের প্রচার মন্ত্রী সত্য হন্তারক পল জোসেফ গোয়েবলস-এর 'বিগ লাই থিওরী'। একটা সিনেমায় দেখেছিলাম সম্রাট নেপোলিয়ান-এর অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁর মাতা Letizia Ramolino উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু নেপোলিয়ন রাজ-চিত্রকরকে আদেশ দিয়েছিলেন যেন অভিষেক অনুষ্ঠানের পেইনটিং-এ একটি জায়গায় তাঁর মাকে চিত্রিত করা হয়, যাতে ইতিহাস জানে যে তাঁর মাতা অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্মসাল ও বয়স সম্পর্কেও নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে ইংরেজ ইতিহাসবিদরা কোন কোন বইয়ে মৃত্যুর সময় উনার বয়স দেখানো হয়েছে ১৭ বছর, কোন কোন বইয়ে ১৯ বছর, আবার কোথাও ২১ বছর দেখানো হয়েছে। আবার উনার একটি কন্যা সন্তান (উম্মে জোহরা) ছিলো যার বয়স কোথাও পাঁচ, কোথাও সাত দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো উনার কন্যার বয়স যদি হয় সাত, আর মৃত্যুকালে উনার বয়স যদি হয় উনিশ, তবে কি উনি এগারো বছর বয়সে বিয়ে করে বারো বছর বয়সে সন্তানের পিতা হয়েছিলেন? এইভাবেই সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস রচনাকারীরা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ২০০৫ সালে নোবেল বিজয়ী দার্শনিক-সাহিত্যিক হ্যারল্ড পিন্টার তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন -the majority of politicians, on the evidence available to us, are interested not in truth but in power and in the maintenance of that power. To maintain that power it is essential that people remain in ignorance, that they live in ignorance of the truth, even the truth of their own lives. What surrounds us therefore is a vast tapestry of lies, upon which we feed.

তাহলে আমরা কি কেবলই বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবো? এমন কোন মাপকাঠি কি নেই যার মাধ্যমে আমরা কোন একটি গ্রন্থের সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারবো?

পরবর্তি পর্বে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
(চলবে)


ইতিহাস প্রসঙ্গ: সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি -পর্ব ২
------------- ড. রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)

জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন স্কুলজীবনে লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন না। তদুপরি পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা। তাই একবার এক সাংবাদিক উনাকে প্রশ্ন করেছিলো, "আপনি তো স্কুলজীবনে লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন না, অথচ আজ আপনি জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী। এখন আপনি কি মনে করেন যে বিদ্যালয় শিক্ষার কোন প্রয়োজন নাই?" জবাবে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, "অবশ্যই নয়। বিদ্যালয় শিক্ষা মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়, এটার প্রয়োজন আছে।" হ্যাঁ, এই বিদ্যালয় শিক্ষাই মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়, তাই বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত বাধ্যতামূলক সাবজেক্টগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ইতিহাসগ্রন্থগুলিতে যা লেখা থাকে সেটাই শিক্ষার্থীদের মনে দাগ কেটে থাকে। অবচেতন মনে সেটাকেই সত্য বলে মেনে নেয়। এখন কথা হলো, সেই পাঠ্যক্রম কারা ঠিক করে? নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাসীনরা।

রাজনীতির ধ্রুপদী উদ্দেশ্য হলো, 'ক্ষমতা দখল'। তাই যে ব্যাক্তি, দল বা গোষ্ঠিই রাজনীতি করুক না কেন তারা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করে থাকে (ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন)। এবং ক্ষমতা পাওয়ার পর তারা রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে তাদের সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে। এখন কথা হলো এই যে, তারা বিদ্যালয় পাঠ্যক্রমে কি এমন কোন কিছু অন্তর্ভুক্ত করবে যা তাদের এই উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করবে? সেখানেই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ইতিহাসের নিরপেক্ষতা ও সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করবার অবকাশ থেকে যায়।

আবার জাতীয় গৌরব (national pride) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশেও কখনো কখনো সৃষ্টি করা হয়েছে মিথ। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান রাজনীতিক ও কলাম লেখকের একটি লেখায় আমি একটি ঘটনা পড়েছিলাম, তিনি যেভাবে লিখেছিলেন আমি অবিকল সেভাবেই তুলে ধরছি –
'এ প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি ছবির কথা বলব। ছবিটির নাম মনে করতে পারছি না। ৮০ সালে ছবিটি দেখার সুযোগ হয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সৌজন্যে। পল্টন মোড়ের কাছে আমেরিকান বাইসেন্টেনিয়াল হলে এই ছবিটার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। গুটিকতক দর্শক। ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তন্মধ্যে প্রধান। কাহিনীর সবটুকু মনে নেই, তবে তার নির্যাস ভুলে যাওয়ার নয়। তা নিম্নরূপ :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ভাইস প্রেসিডেন্ট দীর্ঘকাল পর তার নির্বাচনী এলাকায় এসেছেন। এসেছেন এক অতি নগণ্য ব্যক্তির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এই ব্যক্তিটি সারা জীবন নানা অপকর্ম করেছেন। মূলত গুণ্ডা হিসেবেই তার পরিচিতি। এমন এক ব্যক্তির শেষকৃত্যে সুদূর ওয়াশিংটন থেকে ছুটে এসেছেন রাষ্ট্রের মহামান্য ভাইস প্রেসিডেন্ট!
ওই ছোট্ট শহরের একটি ছোট্ট পত্রিকার তরুণ সম্পাদক এর রহস্য ভেদ করতে মনস্থ করলেন। তার পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় সেটি মোক্ষম হেডলাইন করবেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টকে তার পত্রিকা অফিস দেখাতে নিয়ে গেলেন। তারপর তাকে একান্তে পেয়ে ধরে বসলেন : মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট, কী কারণে এই লোকটার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আপনি এতদূর ছুটে এসেছেন? তার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?
ভাইস প্রেসিডেন্ট একটু বিব্রত হলেন। কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, তাহলে শোন।
অতঃপর তিনি এই শহরে তার জীবনের শুরুটা বর্ণনা করেন। কীভাবে তিনি কপর্দকহীন অবস্থায় এখানে আসেন। তারপর একসময় শহরের এক সুন্দরী তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। দুজনের মধ্যে ভাব হয়ে গেল। কিন্তু ওই মেয়েটির প্রতি নজর ছিল এই শহরেরই এক ভয়ংকর গুণ্ডার। লোকটি ছিল শহরের ত্রাস। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। তার শিকারের প্রতি হতভাগা ছোকরা হাত বাড়িয়েছে। গুণ্ডাটি মহাক্ষিপ্ত। ছেলেটাকে নানাভাবে নাজেহাল করতে থাকল। শেষতক ডুয়েল লড়ার আহ্বান জানিয়ে বসল। তখনকার দিনের সামাজিক রীতিতে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ডুয়েল লড়ার চ্যালেঞ্জ দেয়া হলে তা গ্রহণ না করা ছিল ভয়ংকর কাপুরুষতা। লড়তে অস্বীকার করলে মেয়েটিকে ছাড়তে হবে। লড়াই হলে যে জিতবে সে মেয়েটিকে পাবে। এ লড়াইয়ে কেউ যদি প্রাণ হারায় সেজন্য কেউ দায়ী থাকবে না।
ডুয়েলের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে গোটা শহরের লোক এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। দুইজনের হাতে দুটি গুলিভরা পিস্তল তুলে দেয়া হল। দুজনকে দুদিকে বিপরীতমুখী করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। রেফারি এক দুই তিন বলতেই দুজনে ঘুরে গিয়ে পরস্পরকে গুলি করবে। শহরের লোকজন সবাই আফসোস করছে। এই অসহায় ছেলেটি তো নির্ঘাত মারা যাবে। মেয়েটিও একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
কিন্তু একি? গুলি ছোঁড়ার শব্দ মিলিয়ে না যেতেই দুর্ধর্ষ গুণ্ডাটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ওই নিরীহ ছেলের হাতেই সে প্রাণ হারাল! শহরের লোকজন মহাউল্লাসে ছেলেটিকে মাথায় তুলে নাচতে থাকল। ওই ভয়ংকর লোকটার মৃত্যুতে তারা যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। ছেলেটি রাতারাতি হিরো হয়ে গেল।
তাকে শহরের শেরিফ বানানো হল। কিছুদিন পর জেলা গভর্নর। তারপর সিনেটর। তার নামডাক সারা দেশে ছড়িয়ে গেল। অতঃপর একদিন একেবারে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এতটুকু কাহিনী বলে ভাইস প্রেসিডেন্ট একটু দম নিলেন। তরুণ সম্পাদক বললেন, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট, আপনার এই কাহিনী তো এ অঞ্চলের সব লোকেরই জানা। ওটা শুনতে শুনতেই আমি বড় হয়েছি। আর আপনি যাকে হত্যা করেছেন, সে আমার পিতাকে হত্যা করেছিল তার বিরুদ্ধে সংবাদ ছাপার কারণে। তাকে হত্যা করে আপনি এই শহরটাকে রক্ষা করেছেন। সেজন্য আপনার নাম এ শহরের ছেলে-বুড়ো সবার মুখে মুখে। সেই বীরত্বের জন্যই আপনি ধাপে ধাপে উপরে উঠেছেন। আপনার স্থান এখানকার মানুষের হৃদয়ে। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব তো পেলাম না। ওই গুণ্ডাটির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?
ভাইস প্রেসিডেন্ট তখন আবার শুরু করলেন : তাহলে শোন। কথাটা বলে ফেলাই ভালো। তোমরা জান যে, ওই গুণ্ডাটিকে সেদিন আমি হত্যা করেছিলাম। কিন্তু সেটা মোটেই সত্য নয়। সেদিন সে আমার গুলিতে মারা যায়নি। তাকে হত্যা করেছিল ওই মানুষটি, যাকে একটু আগে আমরা কবর দিয়ে এলাম।
তরুণ সম্পাদকের চোখে-মুখে বিস্ময়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলতে থাকলেন : এই লোকটি ছিল ওই গুণ্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার দুরবস্থা দেখে তার মায়া হয়। একটা নিরীহ ছেলেকে ও এভাবে মেরে ফেলবে! সবার অলক্ষ্যে সে আমার পেছনের দিকে একটি বাড়ির ছাদে তার বন্দুক নিয়ে অবস্থান নেয়। আমি জীবনে কখনও বন্দুক ছুঁড়িনি। আমার হাত কাঁপছিল। ট্রিগার টিপতেই ভুলে গেছি। কিন্তু এই লোকটি যথাসময়ে পেছন থেকে গুলি ছুঁড়েছে। তার গুলিতেই গুণ্ডাটি ধরাশায়ী হয়। আমার গুলিতে নয়। মানুষ আমাকে মিছেই হিরো বানিয়েছে। সব মিথ্যে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট তার কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। তরুণ সম্পাদকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো সত্যটা জেনেছ। আমি চাই তুমি বিষয়টা সবিস্তারে তোমার কাগজে ছেপে দাও। লোকে সত্যটা জানুক। তাদের ভুল ধারণা দূর হোক।
তরুণ সম্পাদক এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে নোট নিচ্ছিলেন। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন। তারপর ধীর গতিতে তার নোট খাতাটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়তে থাকলেন। বললেন, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট, আমি এই কাহিনী ছাপব না। কাউকে কখনোই বলব না। আপনাকে ঘিরে যে মিথ জনমনে বদ্ধমূল হয়ে আছে, সেটা একটা মূল্যবান সম্পদ। ওই মিথ মানুষকে সাহস জুগিয়েছে। আশার আলো দেখিয়েছে। আপনাকে এগিয়ে নিয়েছে। আপনার মাধ্যমে তারাও এগিয়েছে। ওটা ভেঙে দেয়া ঠিক হবে না। ওই মিথ যেখানে আছে সেখানেই থাকুক।
এই বলে তার নোট বইয়ের ছেঁড়া টুকরোগুলো একটি একটি করে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।‘
(Click This Link )
এইভাবে অসত্য/অর্ধসত্য অনেক কিছুও মিথে পরিণত হয়ে ইতিহাসে ঠাই পেয়েছে।

পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে এ যুগের 'মিডিয়া স্কেপটিসিজম (media skepticism)' - বিশ্বব্যাপী মিডিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন গোষ্ঠিতন্ত্র ও রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক মহল। একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পরিবেশন, বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা করছে ভিন্ন ভিন্ন মিডিয়া। তারা কখনো সত্যকে গোপন করছে, কখনো সত্যের সাথে মিথ্যাকে মিশ্রিত করছে, আবার কখনো কখনো নির্লজ্জ্বভাবে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। এই কারণেই পাঠক-শ্রোতা-দর্শক দের মনে জন্মেছে সন্দেহবাদ (skepticism)।

ছাত্রজীবনে (১৯৮৬ সাল) একবার আমাদের শিক্ষক ও পন্ডিত লেখক রফিক কায়সার স্যারকে প্রশ্ন করেছিলাম, "স্যার রাশিয়ার সমাজব্যবস্থাটি কেমন?" আমাদের ধারণা ছিলো স্যার বামপন্থী, অতএব এর সমর্থনে কিছু বলবেন। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে স্যার উত্তর দিয়েছিলেন, "বলা মুশকিল। দেশটি বদ্ধ, নিউজ বাইরে খুব একটা আসেনা। একদলীয় শাসন থাকার কারণে কোন শাসক ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁর সমালোচনা হয়না, সমালোচনা হয় কেবল সে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর।" সেসময় দেশে চলছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামল। অসহনীয় ঐ দিনগুলিতে সরকারী মিডিয়াগুলোতে ছিলো কেবলই তার স্তুতি। একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভির নাম হয়েছিলো সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স। আর আমরা জনগণ করছিলাম কেবলই আস্ফালন।

ক্যাডেট কলেজ ব্লগের নিয়মিত লেখক হাসান মাহমুদ-এর লেখা 'আমার ইতিহাস ভাবনা'-য় পড়েছিলাম - ১৯১৪ সালে দক্ষিন-কলোরাডোর কয়লাখনি অঞ্চলে রকফেলারকর্তৃক হরতালরত একদল নারী+শিশুকে পুড়িয়ে মারার নির্মম কাহিনী। যা আমেরিকার ইতিহাসের যাবতীয় সিলেবাস+পাঠ্যবই এড়িয়ে গিয়েছিলো। অনুরূপভাবে ১৯৩৭-৩৮ সালে তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনের ভিনিৎসিয়া শহরে স্তালিনের শাসনামলে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ এন.কে.ভে.দে. কর্তৃক সাড়ে নয় হাজার এথনিক ইউক্রেণীয়দের গনহত্যার সংবাদ পৃথিবীতো দূরের কথা সেই দেশের মানুষও জানতে পারেনি। আবার ১৯৬২ সালে (১-২ জুন) তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নভোচেরকাস্ক শহরে খাদ্য-রসদের দাবীতে ও কারখানা-ইন্ডাস্ট্রীর মানবেতর পরিবেশের উন্নয়নের দাবীতে সংঘটিত শ্রমিকদের প্রতিবাদ সভায় সোভিয়েত বাহিনীর ঝাপিয়ে পড়া ও নিদেনপক্ষে ২৬ জন শ্রমিক-কে হত্যার ঘটনাও অপ্রকাশিত ছিলো। ঘটনাটি Novocherkassk massacre নামে পরিচিত। এরকম কমপক্ষে এগারোটি ম্যাসাকার হয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নে যার সবই গোপন করা হয়েছিলো।

'সত্যবাদীকে সবাই ভালবাসে' এমন কথা প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু কথাটা সত্য? আমি মনে করি সত্যকে কেবল সত্যবাদীরাই ভালবাসতে পারে । যারা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত তারা কখনো সত্যবাদীকে ভালবাসতে পারে না। তাদের প্রধান শত্রুই সত্য । মিথ্যাবাদীরা পৃথিবীতে মিথ্যাকে জয়ী দেখতে চায়। বিষয়টির প্রতিফলন নিঃসন্দেহে ইতিহাসে রয়েছে।

কিছু কিছু কারণে ইতিহাস হয়েছে কলুষিত, আর এই কারণেই ইতিহাসে সত্য উদঘাটনটা খুবই জরুরী। পরবর্তি পর্বে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

(চলবে)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৭

কাজী আবু ইউসুফ (রিফাত) বলেছেন: অসাধারণ! চালিয়ে যান, সমুদ্রের গভীর থেকে তুলে আনুন সত্যিকার মুক্তো আর তা উদ্ভাসিত করুন সবার জন্য। ধন্যবাদ।

১৭ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮

রমিত বলেছেন: মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

২| ১৭ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৭

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সাথে আছি রমিত ভাই। :)

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ৮:০৫

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ।
লেখাটা নির্বাচিত পাতায় আসেনি, তাই পাঠক কম।

৩| ১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ৮:১৪

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: পাঠকের দঙ্গল তো আপনার ফেসবুকে কম নাই। ব্লগের বড় ব্যাপার হইলো এইখানে ডকুমেন্টেড থাকে, নির্বাচিত হইলো নাকি না হইলো তাতে কি যায় আসে?

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ৮:৩২

রমিত বলেছেন: আমিও তাই ভাবছি। তবে ফেসবুকের পোস্ট সবাই কি পড়ে? অবশ্য অনেক সাইলেন্ট রীডার আছে। যাহোক, লেখাটি প্রকাশিত হলো, এটাই বড় কথা।
মনোবল যোগানোর জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

৪| ১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ৮:৪৮

কোলড বলেছেন: I like it. You are one of the very few Bangladeshi who likes to read the other side of the story. We need more people like you.

১৮ ই জুন, ২০১৫ রাত ২:১৩

রমিত বলেছেন: Thank you very much for your nice comment.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.