নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।
কুরসী ও স্বদেশ
---------- রমিত আজাদ
অনেকগুলো বছর আগের কথা। বাংলায় তখন চলছে বৃটিশের শ্বাসরুদ্ধকর শাসনামল। আমি একবার নিজ কর্মস্থল থেকে দূরে গেলাম নিছক বেড়াতে। সাগরের বাতাস কার না ভালো লাগে? স্থানীয় তিনজন ব্যাক্তি খোঁজ পেয়ে আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমার ভ্রমণ-টি যদিও রাজনৈতিক ছিলো না, তারপরেও উনাদের নিয়ে সাগরের সৈকত ঘেসে একটা খোলা জায়গায় বসলাম চা খেতে। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আমিও কথাপ্রসঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলাম। নিঃসন্দেহে বৃটিশের নির্যাতন-নিপীড়ন ও তা থেকে আমাদের মুক্তি কি করে হতে পারে, স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়গুলো আমাদের আলোচনায় উঠে এলো। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমাদের কাছাকাছি বসেছিলেন একজন অপরিচিত ভদ্রলোক, উনার 'দেহের ভাষা' দেখে মনে হচ্ছিলো, তিনি আমাদের আলোচনায় আগ্রহ বোধ করছেন, অনেকটাই কান খাড়া করে শুনছেন, আবার আলোচনায় যোগ দিতে দ্বিধান্বিত। বিষয়টি সন্দেহজনক! তখন আমাদের পিছনে টিকটিকি লেগে থাকতো। তবে সেই টিকটিকি, আমার পিছু পিছু এত দূরদেশে আসবে বলে মনে হয়না। এমন হতে পারে যে সে বৃটিশের চর, আমাদের কথা শুনছে মনযোগ দিয়ে, তারপর জায়গা মত পৌঁছে দেবে। যদিও আমাদের কথাবার্তা ছিলো নিছক আলোচনা, কোন কর্ম-পরিকল্পনা নয়, ঐ মিশন নিয়ে আমি ওখানে যাইওনি। লোকটির উপস্থিতির সুরাহা করার উদ্দেশ্যে আমি প্রশ্ন করলাম, "ভাই কি এখানে বেড়াতে এসেছেন?" তিনি মাথা নেড়ে বললেন, "জ্বী না"। আমি আবারও প্রশ্ন করলাম, "ভাই কি স্থানীয়?", তিনি আবারো মাথা নেড়ে বললেন, "জ্বী না"। এবার আমি কিছুটা অবাক হয়ে, কিছুটা শঙ্কিত হয়ে জানতে চাইলাম, "তাহলে?" তিনি উত্তর দিলেন, "আমি এখানে চাকুরী করি"। আমরা পরস্পরের মুখ চাইলাম।
আমি: কি চাকুরী?
ভদ্রলোক: (আরেকটু কাচুমাচু হয়ে) জ্বী বৃটিশের সরকারী চাকুরী।
আমরা আবারো পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।
আমি: কোন বিভাগে?
তিনি উত্তর যা দিলেন তাতে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয় টাইপের। ঐ মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। কথাবার্তা চালিয়ে যাবো, না কি কোন অজুহাত দেখিয়ে উঠে পড়বো? সব চাইতে ভালো হতো উঠে সোজা দৌড় দিলে। তবে সেটা পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে দিতে পারে।
আমরা কিছু সময় নীরবতা পালন করলাম। আমাদের নীরবতা দেখে ঐ ভদ্রলোক বললেন,
ভদ্রলোক: ভাই আপনারা আলোচনা চালিয়ে যান। দ্বিধা বোধ করবেন না।
আমি: জ্বী, বুঝতেই পারছেন দেশকে মুক্ত করা প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনাটি স্বাভাবিক আলোচনা না। আপনার সামনে এখন এই আলোচনা করি কি করে?
ভদ্রলোক: আপনাদের শঙ্কা আমি বুঝতে পারছি। তবে আপনারাও বুঝুন, আমি ইংরেজ নই। আপনাদেরই মতন এদেশীয়।
আমি: তা বটে। তবে কি জানেন, অনেক এদেশীয়ই আজ ইংরেজদের ধামা ধরে আছে। আমাদের মত মানুষদের পিছু লেগে আছে, আমরা দেশের ভালো চাই জেনেও, তারা ইংরেজদের হাতে আমাদের তুলে দিচ্ছে।
ভদ্রলোক: আপনার পরিচয়?
উনার কাছে এখন আমার আসল পরিচয় বলা মানেই ঝুঁকি। তারপরেও আমার মন বললো, এই লোক আমাদের কোন ক্ষতি করবে না। তাই বলেই ফেললাম,
আমি: ভাই আমি একজন স্কুল শিক্ষক। এটি আমার পেশাগত পরিচয়, আমার আরেকটি পরিচয় হয়তো আপনি ইতিমধ্যে আঁচ করতে পেরেছেন।
ভদ্রলোক: জ্বী, ঠাউড় করতে পারি।
আমি: এখন আপনি বলুন, আপনার সামনে কি আর আমরা স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করতে পারি?
ভদ্রলোক: ভাই আপনাদের মত এই দেশটা আমারও। আমি নেহাত পেটের দায়ে চাকরীটা করি। যখন চাকরীটা নিয়েছিলাম, বয়স ছিলো কাঁচা, অতশত ভাবি নাই, পেট চালানোর চিন্তাই ছিলো বেশী। পেটের জ্বালায় আর কুরসীর খাতিরে বিদেশী শাসকদের গোলামী করছি।
আমি: আর এখন?
ভদ্রলোক: আর এখন অনেক কিছুই বুঝি।
আমি: কি বোঝেন?
ভদ্রলোক: চাকরীতে আমি নীচু তলার লোক। উঁচুতলায় যাবো কি করে বলেন? উঁচুতলা তো সব সাহেবদের দখলে। আমাদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
আমার সঙ্গী: সেই সাহেবদের কথায়ই তো উঠছেন বসছেন?
ভদ্রলোক: শুনেছি, কয়েক পুরুষ আগে আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন নবাবের বাহিনীর একজন সেনাপতি। অর্থ-বিত্ত-জৌলুস সবই ছিলো তার। ইংরেজদের অঙ্গুলী হেলনে বেঈমান মীরজাফর এক কলমের খোঁচায় কয়েক হাজার সৈন্যের চাকুরী খতম করেছিলো, তাদের মধ্যে আমার পূর্বপুরুষও ছিলেন। এরপর আমাদের অবস্থা ধীরে ধীরে পড়ে যায়।
আমি: যেহেতু সাহেবরা আমাদের সাপ্রেস করে রেখেছে তাই সেই পড়ে যাওয়া থেকে আর উঠে আসা সম্ভব হয় নাই, তাইতো?
ভদ্রলোক: জ্বী ভাই। সেই কথাই আজকাল ভাবি। নীচুতলায় চাকুরী করি বলে ইংরেজদের কত অবমাননা যে সইতে হয়! কথা টকটক করে বলে ইংরেজীতে, গালিটা দেয় বাংলায়! একেবারে বুকে এসে বেধে! যদি আমাদের সোনার দেশ বিদেশী শত্রুদের হাতে না চলে যেত, তাহলে আজ আমিও হয়তো আমার পূর্বপুরুষদের মতো সমাজের উঁচু তলাতেই থাকতাম, ইংরেজদের গোলামী করতে হতো না।
আমি: যাক, শেষতক বুঝতে পেরেছেন তা হলে। নিজ ভূমে যখন ভীনদেশীরা জেঁকে বসে তখন কতটা হারাতে হয়! এজন্যেই আমরা দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত আছি। ওদের তাড়াতে পারলে আমাদের ভূমিতে আমরাই হবো শাসক।
ভদ্রলোক: ভাই, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, আপনাদের সাথে যোগ দেই। কিন্তু বৌ-বাচ্চাদের মুখ চেয়ে আর সাহস করে উঠতে পারিনা।
আমি: আমার তো মনে হয় উল্টা, সেই বৌ-বাচ্চাদের মুখ চেয়েই সাহসটা করা উচিৎ। দেশ মুক্ত হলে ওরাও ভালো থাকবে।
ভদ্রলোক: প্রতিবাদ করতে হলেও শক্তি লাগে। ছা-পোষা মানুষ আমি, সেই শক্তি আমার নাই।
আমি: আমরাও যে খুব শক্তিমান তা না।
ভদ্রলোক: কিন্তু আপনাদের মনের জোর আছে। তার তারিফ না করে পারিনা।
আমি: আমাদের এই সংগ্রামে কি আপনার সহযোগীতা পেতে পারি?
ভদ্রলোক: আমার অত সাহস নেই ভাই। কিন্তু আপনাদের জন্য আমার দোয়া রইলো। আর একটা ছোট্ট অনুরোধ।
আমি: কি অনুরোধ?
ভদ্রলোক: আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়টা কাউকে বলবেন না।
আমি: জ্বী, আচ্ছা।
ভদ্রলোক আমাদের কাছ থেকে উঠে ধীরে ধীরে চলে গেলেন। উনার গায়ের পোষাক সাগরের বাতাসে উড়ছিলো। ঐ একই বাতাসে উড়ে 'ইউনিয়ন জ্যাক', অথচ আমাদের পুর্বপুরুষরা যেই সাগরে একদিন প্রভুত্ব করতেন সেই সাগরের বাতাসে আমাদের নিজেদের পতাকা উড়ারই কথা ছিলো।
চা-বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম, কত দিতে হবে? আমাকে অবাক করে দিয়ে চা-বিক্রেতা জানালো, ঐ ভদ্রলোক আমাদের বিলটা দিয়ে গেছে।
আমি ভাবছিলাম কুরসী ও স্বদেশ দুটো দুই জিনিস। কুরসীর খাতিরে অনেক কিছুই করতে হয়, অনেক সময়ই মুখ বুঁজে থাকতে হয়; আর স্বদেশ থাকে হৃদয়ে। হৃদয়ে যে একবার স্থান নেয় তাকে আর কখনো সেখান থেকে মুঁছে ফেলা যায় না।
তারিখ: ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ সাল
সময়: ভোর ২টা ৪৫ মিনিট।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৫৯
রমিত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:০৬
অগ্নি সারথি বলেছেন: কুরসী ও স্বদেশ দুটো দুই জিনিস। কুরসীর খাতিরে অনেক কিছুই করতে হয়, অনেক সময়ই মুখ বুঁজে থাকতে হয়; আর স্বদেশ থাকে হৃদয়ে। হৃদয়ে যে একবার স্থান নেয় তাকে আর কখনো সেখান থেকে মুঁছে ফেলা যায় না।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৫৯
রমিত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
৩| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৫৮
রমিত বলেছেন: লেখাটিকে নির্বাচিত পাতায় স্থান দেয়ার জন্য সামু কর্তৃপক্ষ-কে ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:৩২
টারজান০০০০৭ বলেছেন: দারুন লিখেছেন স্যার। স্বদেশটা হৃদয়ে না থাইকা বাইরেও থাকলে ভালো হইতো !