নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজের সম্পর্কে বলার মত তেমন কিছুই এখনও অর্জন করতে পারি নি।

ডি এইচ তুহিন

মোঃ দেলোয়ার হোসেন তুহিন

ডি এইচ তুহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দ্বৈতসময় - ০.২

১৩ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:৩৯

হাসান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই মহিলা কে? পাপ্পু কে? এই নামে শুধু বাবা-মা, গ্রামের মানুষ ডাকত! শহরে কেউ এই নাম জানে না। গোসল/নামাজের কথা বলছে, কিন্তু এটা কার বাসা? মহিলার চেহারা ভাল করে দেখতে পায় নি চোখে এসব কিছু গোলাটে দেখেছে। চোখ কচলে আবার ভাল করে তাকিয়ে দেখে উনার মা'র মত লাগছে মহিলার চেহারা। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, বাড়ির দেয়ালগুলো মাটির, নিচে খড়ের ছাউনি দেওয়া উপরে টিন দেওয়া ছাদ বৃষ্টির পানি ও গরম ব্যালেন্স করতো গ্রামে এভাবে, কাঠের জানালা। সব কিছু পুরোনো পুরোনো লাগছে যেন উনি হুট করে ছোট বেলায় এসে পড়েছেন তিনি। মাথা ঝাঁকি দিয়ে ঘোর কাটানোর চেষ্টা করলেন, কিছুই হল না সব আগের মতই আছে। শরীর ঝিম ঝিম করছে, মাথাটাও ভারি লাগছে। তিনি চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় পা বাড়ালেন চশমাটাও সাথে নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন—এটা তার শহরের আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট নয়, গ্রামের পুরোনো বাড়ি। বাতাসে ভেসে আসছে ধানক্ষেতের সুঘ্রাণ, নারকেল গাছের মাথায় ঝুলে থাকা ডাবের সারি, বাড়ির ঘাটায় দেখা যাচ্ছে বাঁশের সাঁকো, সবকিছুই চেনা-পরিচিত —
এই বাড়িটা তো...
হে এই বাড়িটা তো শৈশবের বাড়ি! যেখানে তিনি দাদা-দাদি সহ বাবা-মা'র সাথে থাকতেন! বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হলো। মনে হচ্ছে, গভীর স্বপ্নে আছেন।
ভেতরের রুম থেকে বারান্দায় এসে মায়ের মত দেখতে মহিলাটি আবার বললেন, "কি রে পাপ্পু? দাঁড়িয়ে থাকবি কতক্ষণ? যা, তোর বাবা মসজিদে যাবে, তুইও আয় গোসল সেরে, একসাথে যেতে পারবি।"
বাবা?
হাসান সাহেব ঘাবড়ে গেলেন। তার বাবা তো অনেক বছর আগেই মারা গেছেন! কিন্তু ওই যে, উঠানে যে মানুষটা পায়চারি করছে, তাকে তো অনেকটাই চেনা চেনা লাগছে। তিনি ভালভাবে তাকালেন—হ্যাঁ, এ তো তার বাবা! ঠিক সেই চেহারা, যেভাবে তিনি ছোটবেলায় দেখতেন। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?
হাসান সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার চৌকাঠ ধরলেন। এটা স্বপ্ন না বাস্তব, বুঝতে পারছেন না। তার মন বলছে, এটা সত্যি... কিন্তু ব্রেইন মানতে চাইছে না।
তিনি ধীরে ধীরে বাবার দিকে এদিয়ে গেলেন। তার বাবার পরনে লুঙ্গি, স্যান্ডেল পায়ে, এক হাতে একটা ছোট বটি অন্য হাতে বড় সাইজের একটি লাউ। ঠিক যেমনটা ছোটবেলায় দেখতেন প্রতি শুক্রবারে বাবা নিজের করা বাগানে সময় দিতেন। এখানে উনি ছোট বাগান করতেন লাউ ফলাতেন পুইশাক লাগাতেন, কুমড়ো, টমেটো সহ বিভিন্ন সবজির চাষ করতেন। অন্যান্য দিন মা সময় দিতেন বাগানে বাবা অফিসে থাকতো। আমাদের ধানের জমি বর্গা দেওয়া ছিল। সেখান থেকে ধান পেতাম সবজি বাবার বাগানে হতো মাছ ছিল পুকুরে আর মা হাঁসমুরগি ও ছাগল দিয়ে মাংসের চাহিদা পূরন করতেন৷ বাবার ছোটখাটো একটা সরকারি চাকরি করতেন বেতন যা পেতেন তা দিয়ে আমাদের পড়াশুনার খরচ চলে যেতো। বাবা হাসান সাহেবের দিকে এদিয়ে এলেন। তিনি হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিরে পাপ্পু, এত দেরি করলি উঠলি কেন? মসজিদে যাবি না? এখনও গোসল করিস নি দেখছি। যা গোসল করে আয় এক সাথে যাবো মসজিদে।
হাসান সাহেবের গলা শুকিয়ে গেল। তিনি কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। বাবা বেঁচে আছেন? তিনি কি সত্যিই অতীতে চলে এসেছেন?
কীভাবে? নিজেকে চিমটি কাটলেন—ব্যথা পেলেন। তাহলে এটা স্বপ্ন নয়! গতকাল রাতে ছিলেন নিজের ফ্ল্যাটে এখন আছেন শৈশবের গ্রামে? সবকিছু মেলানোর চেষ্টা করছেন-
-গতরাতে মদ খেলাম, শাহ-এমরানের সাথে...
তারপর?
তারপর কি হলো?
এখানে কিভাবে এলাম?
উফ মাথা ঘুরছে মনে এই বুঝে পরে যাবেন মাঠিতে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটা কথা মাথায় আসলো। তিনি কি এখন সত্যিই ছোট হয়ে গেছেন? নাকি তার বর্তমান বয়সের দেহেই অতীতে এসেছেন? তার হাত-পা দেখলেন, না, এ হাত তো ছোট বেলার মতো নয়, বরং এখনও বড়দের মতোই লাগছে। ঘরের ভেতরে ডুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলেন—না, তিনি এখনো মধ্যবয়সী হাসান সাহেবই আছেন!
তাহলে ব্যাপারটা কী? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, কীভাবে এটা সম্ভব হলো। তিনি কি মদের নেশায় আছেন এখনও হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? কিন্তু সবকিছু এত বাস্তব মনে হচ্ছে!
তখনই তার মা আবার ডাকলেন, "কি রে পাপ্পু, গোসল করবি না? খিচুড়ি বাহিয়েছি তোর পছন্দের টেবিলে দিয়েছি ঠান্ডা হয়ে যাবে তো না হয় আগে খেয়ে নে একটু পর গোসলে যা।"
তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। হাত-মুখ ধোয়ার জন্য উঠানের পাশের টিউবওয়েলের কাছে গেলেন। পানি টেনে মুখে দিলেন—ঠান্ডা ঝলমলে পানি! অনুভূতি একদম বাস্তব। তিনি চারপাশটা আরেকবার খেয়াল করলেন। উঠানের পাশে রাখা পুরনো কাঠের চেয়ার, দেয়ালের সঙ্গে হেলান দেওয়া সাইকেল, দাদির হাতের তৈরি নকশা করা চৌকি—সবকিছুই অবিকল তার ছোটবেলার মতোই আছে!
তিনি হাত-পা ধুয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। মায়ের সাজানো মাটির হাঁড়ির ওপর ঢাকনা দেওয়া গরম ভাপ ওঠা খিচুড়ির গন্ধে তার নাক জুড়িয়ে গেল।
"বস, খেয়ে নে," মা আদুরে কণ্ঠে বললেন।
তিনি চুপচাপ বসে পড়লেন। ছোট করে প্রথম লোকমাটা মুখে তুললেন। খিচুড়ির স্বাদ তার মনের গভীরে যেন একটা ঢেউ তুলল। এ তো সেই স্বাদ, যা তিনি বহু বছর ধরে ভুলে গেছেন! চট চট করে পেট ভরে পুরো দুই বাসন খিচুড়ি খেলেন। খেয়ে আর নড়তেই পারছেন না। কিছুক্ষন বসে ধীরে ধীরে উঠে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন।
দরজার বাইরে থেকে চেনা এক কণ্ঠস্বর এলো, "পাপ্পু! চল, ঘাটে যাবি?"
হাসান সাহেব গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারলেন, এটা তার ছোটবেলার বন্ধু মিরাজ! কিন্তু মিরাজ তো। অনেক বছর আগে নারিকেল গাছ থেকে পরে মারা গিয়েছিল! তার গা শিউরে উঠল। তিনি আস্তে করে চেয়ার থেকে উঠলেন, দরজার দিকে পা বাড়ালেন। সামনে দাঁড়িয়ে আছে চৌদ্দ-পনেরো বছরের এক কিশোর, গায়ে হাফ প্যান্ট, পরনে ঢিলেঢালা গেঞ্জি। একেবারে তার ছোটবেলার মিরাজ! তিনি ভয় আর বিস্ময়ের দাঁড়িয়ে থাকতেই মিরাজ হেসে বলল,
"কিরে পাপ্পু, কি হলো? এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছিস কেন?"
হাসান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "না… মানে… আমি একটু… পরিক্ষা নিয়ে ভাবছিলাম। এখন যাবি?"
-"নদীতে দাদু জাল ফেলেছে। মাছ ধরতে যাবি না?"
ছোটবেলায় এই নদীর ঘাটেই তো কত সাঁতার কেটেছেন, গামছা দিয়ে মাছ ধরার খেলাও খেলেছেন!
মিরাজ হাত টেনে বলল, "চল"
হাসান সাহেব কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। উঠান পার হয়ে মিরাজের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন কাঁচা রাস্তা ধরে। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, পথের পাশে খেজুরগাছ, পাখির কিচিরমিচির—সবকিছু এত চেনা, অথচ সব অচেনা লাগছে! হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখলেন, সামনে বাঁশের সাঁকো। ছোটবেলায় এখান দিয়েই তো তিনি নদীর ওপারে যেতেন। কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল—এই সাঁকোর ওপর দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে একবার তিনি পড়ে গিয়েছিলেন, হাঁটুতে গভীর কাটা লেগেছিল! তার তো এখনও সেই কাটা দাগ আছে। তিনি এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে নিজের হাঁটুর দিকে তাকালেন—হ্যাঁ, দাগটা ঠিকই আছে!
তখনই মিরাজ বলল, "দেখ, দাদুর জালে অনেক মাছ ধরা পড়েছে!"
হাসান সাহেব তাকিয়ে দেখলেন, এক বয়স্ক লোক নদীর ধারে জাল থেকে মাছ ছাড়াচ্ছেন।
তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
এটা তো তার দাদু!
কিন্তু দাদু তো…
হাসান সাহেবের শরীর ঝিমঝিম করছে। তার দাদু নদীর পাড়ে বসে জাল টানছেন, মুখভর্তি সাদা দাড়ি, পরনে লুঙ্গি আর সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। চোখেমুখে সেই পরিচিত কোমল হাসি। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? দাদু তো বহু বছর আগে মারা গেছেন! মৃত্যু মানুষগুলো সব জীবিত হয়ে উনার আসেপাশে ঘুরছে বাবা-মা,মিরাজ এখন আবার দাদু .....

চলবে......

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.