নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্যদিন

প্রতিটি সর্যাস্তে বুক বাঁধি একটি অন্যদিনের সূর্যোদেয়র প্রত্যাশায়.......

রিউ

.............. । কিন্তু আমার ভাবনা ছিল অন্যরকম। আমার বয়স তখন 9 বছর। মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রিয় গ্রাম, সব ছেড়ে চলে আসি শহরে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের সীমানা ছাড়িয়ে........... । প্রিয় ঠিকানাগুলোর সাথে আমার দূরত্ব প্রতিনিয়ত কেবল বেড়েই চলছে। উপরে উঠার এই সিঁড়ির শেষ কোথায় আমার জানা নেই। ভয় হয়, আমি কি আবার আমার সেই ফেলে আসা অতীতে, প্রিয় গ্রামে, প্রিয় মাটি আর মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার সময় পাব?............

রিউ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার ছেলে বেলা-2

০২ রা মার্চ, ২০০৭ রাত ১২:২৭

আমাদের দেশে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা সহ ভবিষ্যৎ গড়ার সব বেপারে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকাই বেশী থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এই সহজ হিসাবটাতে একটু গরমিল দেখেছি। আমাদের মা-ই ছিলেন আমাদের সমস্ত প্রেরণার উৎস। শান্ত মেজাজের অসম্ভব ধৈর্য্যের অধিকারী এই মহিয়সী মায়ের দূরদশর্ীর্ এবং সাহসী ভূমিকার কারণে তাঁর সন্তান হিসাবে আজ এতদূর আসতে পেরেছি। বাবার একগুঁয়েমি, বেখেয়ালীপনা, সাংসারিক টানাপোড়েন আর হাজারো প্রতিকূূলতার মাঝেও মা আমাদের লেখা পড়ায় কোন ছেঁদ পরতে দেননি। তাই আমরা ভাই-বোনেরা মাকে অসম্ভব ভালবাসি। আমার মা আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্ত্বপূর্ণ।



আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল তের কি চৌদ্দ বছর বয়সে। আর বাবার ছিলেন প্রায় দ্বিগুণ বয়সী। পড়াশোনায় মা ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। মেধা আর মনযোগ দেখে আমার নানা চেয়েছিলেন মাকে উচু ক্লাশ পর্যন্ত পড়াতে। কিন্তু ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় মাকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে পেরেছিলেন আমার নানা। গণিতে মা'র দখল ছিল অসাধারণ। আমরা বড় হয়েও দেখেছি মা'য়ের এক শিক্ষক আমাদের বাড়িতে আসতেন, যিনি মাকে স্কুলে গণিত পড়িয়েছিলেন। বয়সে সত্তোরোত্তর আমার মা-র সেই শিক্ষক মোটা গ্লাসের ভিতর দিয়েও খুব সামান্য দেখতে পেতেন। লাঠিতে ভর করে চলতেন। সারা জীবন গণিতে শিক্ষকতা করার বদৌলতে তখনকার মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক গণিতে তাঁর এতটাই দখল ছিল যে, যে কোন শ্রেণীর যে কোন অংক মুখে মুখে করে দিতে পারতেন। তিনি এলেই আমরা অংক নিয়ে তার কাছে বসে পরতাম। চোখে না দেখেও অংক করে দেয়াটাকে আমাদের কাছে যাদুর মত মনে হত। প্রথমে তিনি আমাদের অংকটা পড়তে বলতেন আর মন দিয়ে শুনতেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতেন। এক সময় বলতেন, দেখতো অংকের ফলটা এত কি-না? আমরা আগে থেকেই অংকের রেজাল্ট বের করে বসে থাকতাম। তিনি অংকের রেজাল্ট দশমিক পর্যন্ত বলে দিতেন। আর আমরা অবাক হয়ে যেতাম। কলম নেই, খাতা নেই, অংক করে ফেলেছেন- এ কি করে সম্ভব! আমরা ভীষণ মজা পেতাম। অংক করা শেষ হয়ে গেলে তিনি আমাদেরকে মায়ের স্কুল জীবনের সুন্দর সুন্দর গল্প শোনাতেন। আমার মায়ের সেই বৃদ্ধা স্কুল শিক্ষকের একটা বদ অভ্যাস ছিল। যখনই তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন, মা'র কাছে এটা-ওটা চাইতেন। অথচ অর্থ-সম্পদের দিক থেকে ওনি যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিলেন। এই এটা-ওটা চাওয়াটাকে সভাবতই ওনার ছেলে-মেয়েরা ভালচোখে দেখতনা।



আমার বাবা সারা জীবনই ছিলেন একটু বেখেয়ালী টাইপের। সংসারের প্রতি তার কখনোই খুব বেশী দায়বদ্ধতা ছিলনা। গ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকতেন। গ্রামে এমন একটি প্রতিষ্ঠানও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যাতে আমার বাবার অবদান নেই। স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ- এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করা বাবার নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিজে সারা জীবন একই সাথে দুই-তিনটা চাকুরী করেছেন। প্রচুর টাকাও উপার্জন করেছেন। কিন্তু কোন সঞ্চয় ছিলনা। নিজের পকেটের টাকা বেহিসাবে খরচ করেছেন প্রতিষ্ঠানের পেছনে। তবে তিনি সংসারের কোন টাকা নিজের ওইসব কাজে খরচ করতেন না। আমার মা সংসারের সেই সামান্য আয় থেকেই সংসার চালাতেন।



আমার দাদা ছিলেন একজন খুবই সাধারণ প্রান্তিক কৃষক। নিজের যতটুকু জমি ছিল তাতে সংসার চলতনা। তাই বাড়তি আয়ের জন্যে ভাগে অন্যের জমি চাষ করতেন। এভাবে হয়তো সংসার চলত, কিন্তু সঞ্চয় থাকতনা। তাই একটু বাড়তি সঞ্চয়ের জন্য সারাদিনের হাড় ভাংগা খাটুনির পরেও রাতের বেলায় কাঠ চিঁড়তেন। সপ্তাহান্তে সেই কাঠ গঞ্জের বাজারে বিক্রি করে যে বাড়তি টাকা পেতেন, তা দিয়ে একটু একটু করে জমি কিনতেন। আর এভাবেই তিনি তার প্রিয় সন্তানদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত রচনা করে গিয়েছিলেন। এমন স্নেহপরায়ণ দাদুকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার জন্মের বেশ আগেই তিনি স্বর্গবাসী হয়েছেন।



আমাদের পুরনো বাড়িটি (দাদার বাড়ি) ছিল বিশাল এক বিলের উত্তর পাড়ে। স্থানীয় ভাবে বিলটির নাম ছিল "বেলাই বিল"। শুকনো মৌসুমে বিলে কোন পানি থাকত না। অত্যন্ত উর্বর মাটির সেই বিলে প্রচুর ধান ফলত। আর সেই ধানই ছিল বিলের আশ-পাশের মানুষের সারা বছরের একমাত্র ফসল। কোন বছর বন্যা বা অন্যকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে যদি বিলের ফসল নষ্ট হয়ে যেত, সে বছর ওই এলাকায় দুর্ভিক্ষের মত অবস্থা হয়ে যেত। বর্ষায় সেই শুকনো বিল পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যেত। বিশাল বিশাল ঢেউ আমাদের বাড়ি সংলগ্ন পাড়ে আছড়ে পড়ত। আর দক্ষিণের ঝিড়ি ঝিড়ি বাতাস নারকেল পাতায় অদ্ভূদ সুরেলা এক শব্দ সৃষ্টি করত। দক্ষিণের জানালা খুলে আমরা সেই ঢেউ দেখতাম। আর রাতের বেলা যখন ঘুমাতে যেতাম, নারকেল পাতার সেই সুরেলা শব্দ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। সে শব্দই ছিল আমাদের ঘুম পারানি গান। যেদিন আকাশে একাদশীর চাঁদ থাকত, সে দিন খুব সুন্দর লাগত ঢেউগুলোকে। চাঁদের আলোতে ঢেউগুলো চিক চিক করত আর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসত পাড়ের দিকে। যেন বিশাল এক আলোর মিছিল। সেই চিক চিকে ঢেউয়ের দিকে অনেক ক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকলে মনে হত যেন ঢেউ নয়, আমি-ই সেই আলোর মিছিলের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে ভেসে যাচ্ছি। আর এভাবে ঢেউয়ের শব্দ আর নারিকেল পাতার ঘুম পারানি গান শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে যেতাম।



বিশাল সেই ঢেউয়ের পাহাড় ভেংগে ছোট ছোট ডিংগী নৌকায় মানুষ যাতায়াত করত এপাড় থেকে ওপাড়ে। তখনো ইঞ্জিনের নৌকার প্রচলন হয়নি। আমরা ছৈ -ওয়ালা পালতোলা নৌকায় চড়ে নানার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম সেই বিশাল বিল পেড়িয়ে। প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগত। বিশাল বিশাল ঢেউ ছোট নৌকাকে এমন ভাবে দোলাত যে আমরা ভয়ে ছৈয়ের ভেতর থেকে বের হতাম না। এক সময় বড় বিল পেড়িয়ে আমাদের নৌকা গ্রামের ছোট ছোট বিলে প্রবেশ করত। ততক্ষণে সূর্য ডুবু ডুবু। শেষ বিকেলের সোনা রোদ ছড়িয়ে পরেছ সবুজ গাছের পাতায় পাতায়। সারা দিনের সফর শেষে পাখিরা ঝাঁক বেধে নীড়ে ফিরছে। বাতাস ও থেমে গেছে। সচ্চ কালো টলটলে জলের বুকে ছোট ছোট ঢেউ তিরতির করছে। শব্দ বলতে পানিতে মাঝির বৈঠার ছলাত ছলাত। নৌকার দুলুনি ও থেমে গেছে। আমরা ছৈয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতাম। মা ছৈয়ের ভেতরে থেকেই উঁকি দিয়ে দেখত টলটলে জলের বুকে ছোট ছোট ঢেউ আর শান্ত প্রকৃতির হৃদয় কারা সৌন্দর্য। নৌকার পাটাতনের দুই পাশে বসে আমরা টলটলে জলে হাত দিয়ে বসে থাকতাম। কি যে আনন্দ হত। হাতের নাগালে কোন শাপলা কিংবা পদ্মফুল এলেই এক টানে তুলে নিতাম। তাতে নৌকার গতি কমে যেত সামান্য। মাঝি পেছন থেকে মৃদু বকা দিতেন। মা সাবধান করতেন যেন শাপলা বা পদ্মফুল তুলতে গিয়ে পানিতে পড়ে না যাই। তবু আমাদের আনন্দে কোন ছেদ পড়ত না। নানার বাড়ি যেতে যেতে শাপলা আর পদ্মফুলের বিশাল সংগ্রহ হয়ে যেত আমাদের। কার সংগ্রহ বেশী হয় তা-ই ছিল আমাদের প্রতিযোগীতা। কারণ, পরে এসর আর কোন কাজে আসত না। নৌকা ঘাটে ভিড়লে সব বিলের জলে ফেলে দিতাম। যেটা থেকে যেত, তা ছিল মনের ছোট্র পরিমন্ডলে এক ফালি নিখাঁদ আনন্দ আর ভাললাগা, যা চোখ বুজলে আজও অনুভব করি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০০৭ ভোর ৬:৪৮

অতিথি বলেছেন: ভাল লিখেছেন....

২| ০৬ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৩:০৭

মুম রহমান বলেছেন: বেলাই বিল যেতে চাই, পথটা বাতলে দেবেন দয়া করে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.