![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাইরে কি প্রচণ্ড বৃষ্টি!
কাল পরীক্ষা। অথচ কোনভাবেই পড়ায় মন বসাতে পারছি না। বারবার শুধু ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। শৈশবের কথা, শৈশবের বৃষ্টির কথা, বৃষ্টিতে ভেজার কথা।
আমাদের বাড়িটা ছিল টিনের। সামান্য বৃষ্টিতেই ঝমঝম শব্দ করত। বৃষ্টি বেশি হলে তো কথাই নেই! একেকবার বাতাস এমন ভাবে ঝাপটা মারত যে, মনে হত ঘরের চাল বোধহয় উড়িয়ে নিয়ে গেল! চালে অনেক ফুটো ছিল বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথে মা বড়বড় কয়েকটা ফুটোর নিচে পাতিল রাখত, ঘর যেন না ভিজে যায়। বৃষ্টি শেষ হলে দেখা যেত, পাতিলে কোন পানি নেই, ঘর ঠিকই ভিজে গেছে!
দিনে বৃষ্টি হলে মা’র চোখ ফাকি দিয়ে নেমে পরতাম উঠোনে। কাদা দিয়ে উঠোন পিচ্ছিল করা হতো, তারপর একেকজন হেটে যেতাম, আর দুমাদ্দুম পরতাম। মা বাবাকে পাঠিয়ে দিত, নচ্ছার ছেলেপুলেগুলোকে ঘরে তুলতে। বাবা একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের সাথে বৃষ্টিতে ভিজত, আর একটু পরপর মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, “উঠলি না? এখনও উঠলি না? কি নচ্ছার ছেলেপুলেরে বাবা! ধরলেই হাত ফসকে পালিয়ে যায়!” আমরা হাসতাম আর অপেক্ষায় থাকতাম, কখন বাবা তাল হারিয়ে পড়ে যায়। আমাদের অপেক্ষা তখনই সার্থক হতো, যখন বাবা পড়ে যেত (আমাদের ভাষায় বোয়াল মাছ ধরত!) ঘর থেকে মায়ের খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যেত।
মাঝে মাঝে শুরু হতো কালবৈশাখী। ঝড়ের মাঝেই চলে যেতাম আম গাছের নিচে। একটি আম পড়লো আর ওইটা নিয়ে কি টানাটানি! এ বলতো আমি আগে ধরছি, সে বলতো আমি আগে ধরছি। এটা নিয়ে হাতাহাতি থেকে মারামারি পর্যন্ত হতো। যারা বয়সে একটু বড় ছিল, তারা প্রথমে উৎসাহ দিত মারামারিতে, তারপর একসময় ঝগড়া মিটিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে দু’পক্ষ হতে দুই চারটি বড়বড় আম নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে মাথায় অথবা কপালে আম পড়তো। মাঝে মাঝে ফেটেও যেত। আমরা মরতাম হিংসায়। কারণ, তখন যারা ঝড়ের মাঝে আম কুড়োতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে, তারা আলাদা একটা বীরত্ব নিয়ে আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াতো!
তুমুল বৃষ্টিতে চলে যেতাম পুকুরে। প্রথমে পানির পাশে গর্ত খুড়ে তার একপাশে কাদা দিয়ে ঘেরাও দিতাম কতগুলো অনভিজ্ঞ কই অথবা পুঁটিমাছ, নতুন পানি পেয়ে লাফিয়ে উঠত, আর পড়তো তৈরি করা গর্তে। সারাদিনে একটা মাছও যদি লাফিয়ে গর্তে পড়তো আমাদের আনন্দের সীমা থাকতো না। আমরা একটু পরপর গর্তে হাত দিয়ে মাছটা দেখতাম আর ওইটা যে কতটা বোকা সেই বিষয়ে নানান অভিমত ব্যক্ত করতাম।
বিকেলে বৃষ্টি হলে অবধারিত বিষয় ছিল ফুটবল খেলা। খেলাটা হতো বাড়ির উঠোনে অথবা ঈদগাহ মাঠে। শুরুটা হতো উঠোনে। একটু পরই মা হই হই করে উঠত, “নচ্ছার পোলাপাইন, উঠান পিছলা করতেছিস না? দাড়া আসতেছি।” আমরা কখন মা আসবে ঐ অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকতাম না। ছুটে যেতাম ঈদগাহ মাঠে। সেখানেও কোন সমস্যা নেই। কারণ ঐ মাঠটাও পিচ্চিল। আর আর একটা সুবিধা, মাঠের পাশেই পুকুর। ইচ্ছা করেই বল পুকুরের মাঝখানে পাঠিয়ে দিতাম। তারপর একসাথে নেমে পড়তাম পুকুরে। যে আগে বলটা নিয়ে উপরে উঠতে পারবে, সেই জয়ী এবং পুরষ্কার হিসেবে পেত একটা বাড়তি কিক দেয়ার সুযোগ। অধিকাংশ সময়ই দেখা যেত, বল মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, আর বিজয়ী বেচারাও পড়ে যাচ্ছে। বল বাবাজী মনে হয় আমাদের দুর্দশা দেখে হাসত।
সন্ধার দিকে করা হতো চালভাজা। বিশাল বাটিতে মা চাচিরা চালভাজা দিতেন। পাশে আলাদা বাটিতে থাকতো আস্ত পিঁয়াজ আর আস্ত মরিচ। একমুঠো চালভাজা, পিয়াজে এক কামড় আর মরিচে এক কামড়। চালভাজাটাকে মনে হতো স্বর্গের কোন খাবার। আমরা চালভাজা খেতাম প্রতিযোগিতা করে। বেছে বেছে ছোট মরিচটা নিতাম আর দুই কামড়ে সাবাড় করতাম। মরিচের বোঁটাটা যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতাম। খাবার শেষে গোনে দেখা হতো কার কয়টা বোটা জমা হয়েছে। যার সবচেয়ে বেশি সেই জয়ী। আমাদের দিকে সে তাকাতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে। আমরা ঈর্ষায় মরতাম।
রাত্রে শোয়ার সময় ঠাণ্ডার জন্য একটা কাঁথা দেয়া হতো। বড়ভাইয়াকে মাঝখানে রেখে আমরা আবদার জুড়তাম, “দাদা, কিচ্ছা শুনাও।” দাদা বেছেবেছে সবচেয়ে ভয়ংকর ভুতের গল্পটাই ঐদিন শুনাত। অবধারিত ভাবেই পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে মায়ের সামনে পড়তামনা। কারণ বৃষ্টির দিন দেখেই হোক অথবা দাদার গল্প শুনে ভয় পেয়েই হোক কেউ একজন বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে! মা যখন টের পেতেন, আমরা ক্রমাগত একজন আরেকজনকে দোষারুপ করতাম। মা সবার কথাই বিশ্বাস করতেন, এবং সবার কানে ধরে টেনে গোসল করতে পাঠাতেন।
.
.
.
দিন গুলো আর নেই। ইটে ছাওয়া শহরটাতে কখন বৃষ্টি হয় টেরই পাই না। যখন বাইরে বের হয়ে দেখি, রাস্তাঘাট ভেজা, নিজের ভাগ্যকে দোষ দেই। ভাগ্যটা নিতান্তই খারাপ না হলে কি আর সেই দিনগুলো আমি হারিয়ে ফেলি?
©somewhere in net ltd.