নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রিফাত হাসানের ব্লগ

রিফাত হাসান

আমরা কী দারুণ গল্পসভা কথা সাম্রাজ্যে ছিলাম

রিফাত হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাস্কর্য বিতর্ক: আরো কিছু নোট

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:২৯

ভাস্কর্য এবং তৎসংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার, এবং ভাস্কর্য বিতর্ক: কয়েকটি প্রশ্ন ও কিছু ফুটনোট, এই দুইটি লেখার পর এ বিষয়ে আর পোস্ট দেবো না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু এ সংক্রান্ত কয়েকটি প্রতিক্রিয়ার পোস্ট এলো আবার, এবং সেইসাথে ভাস্কর্য রাজনীতির আরো জরুরী কিছু দিক নজরে আনা দরকার বলে মনে হয়েছে, যা আমাকে আবার নোট আকারে এই লেখার প্রয়োজনকে উস্কে দিয়েছে। সর্বশেষ ফারুক ওয়াসিফ নামের একজন ব্লগারের পোস্ট



ফারুক ওয়াসিফ যে পোস্ট দিয়েছেন, তার মূখ্য জায়গা হলো, কওমি মৌলভিদের ধর্মীয় বা অন্যান্য সম্ভব অবস্থানের সাথে রিফাত হাসানের পোস্টের অবস্থানকে এক করে দেখা। তিনি সম্ভবত আমার এই অবস্থানটিতে কথা বলতে সংকোচ বা বিহবল বোধ করেন, যে, মৌলভীদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াগুলো যে ভাষা এবং প্রক্রিয়ায় হয়েছে, তার ব্যাপারে প্রশ্ন করা। এটার কারণ হতে পারে, কওমি মৌলভিদের বিরুদ্ধে তার নিজের বর্ণবাদী অবস্থান। যেমন: বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট টিকেই আছে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আর পুঁজির কারুণ্যে। দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ দিলে, এদের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত।



হায়, ফারুক ওয়াসিফ তাদের নেতাদের ভাষা বুঝেন, ভাস্কর্য যারা বানাতে চান তাদের ভাষাও বুঝতে চান, তাদের পক্ষ বিপক্ষ হয়ে কথা বলতে ব্লগ লিখেন, কিন্তু মূর্খ দরিদ্র মাদ্রাসার ছাত্রদের ভাষা বোঝার প্রয়োজন অনুভব করেন না। তাই, সবসময় দরিদ্র মাদ্রাসার ছাত্রদের বাদ দিয়েই কথা বলতে আগ্রহী। এই বর্ণবাদী মন দিয়ে তিনি কোন অবস্থান গ্রহণ করতে চান?



এই প্রশ্নটির উত্তর কিছুটা পরিস্কার হয়, তিনি যখন বলেন: ভাস্কর্য ভাঙ্গাই যদি প্রগতিশীলতা হয় তাহলে সাদ্দামের মূর্তি ভেঙ্গে বুশও একজন দশাশই প্রগতিশীল। ব্যাস, তাহলে সমস্যাটারে কি ফারুক প্রগতিশীলতা সংক্রান্ত সমস্যা বলেই চিহ্ণিত করছেন শেষমেষ। কারণ, আমি নিশ্চিত সেরকম কোন সমস্যায় তাড়িত হয়ে বা তার উল্লেখ করে আমার পোস্টের অবতারণা করিনি। এখানে, এই জায়গায় এসে তাই, আমাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। কারণ, আমি যদ্দুর বুঝি, আমাদের প্রগতিশীলতার কোন সমস্যা নেই, এই মহার্ঘ জিনিশটার কোন দরকার আছে বলেও আমি মনে করি না আমাদের জন্য। এই জিনিশটা নিয়ে ফালতু সময় ব্যয় করা একটা আর্ট হতে পারে, এই ভাস্কর্য যেমন আর্ট, ভাঁড় নাট গোষ্ঠির জন্য, তেমন।



এবার দেখি এর রাজনীতিগুলি বুঝতে গিয়ে তিনি কী দেখেন। তিনি এখানে খুব আশ্চর্য হয়ে দেখেন, জামাত নেতা মুজাহিদকে আড়াল করার জন্যই এ্কটি ভাস্কর্য ভাঙ্গার নাটকের মহড়া হলো সরকারের পক্ষ থেকে। তার এই দেখাটি দেখে তার রাজনৈতিকতাবোধ এবং ডগমেটিক অবস্থান নিয়ে আমার খটকাগুলো পোক্ত হয়। বলা বাহুল্য, এই প্রপঞ্চটিই ভাস্কর্য সংক্রান্ত পপুলার আলোচনাগুলির উপজিব্য যা একটু সিরিয়াস হওয়ার ভাণ করেছে, এবং আলোচনার গভীরে প্রবেশ করতে গিয়েও থেমে গিয়েছে। ফারুক ওয়াসিফের এই পোস্টের বিবিধ জরুরী পর্যবেক্ষণ থাকা স্বত্ত্বেও, এই ডগমেটিক অবস্থানটি তার লেখাটিরে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরাতো এটা বিশ্বাস করি না যে, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে সরকারের অজান্তে মুজাহিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোওয়ানা দিয়েছে, আর সরকারকে এই বিষয়টিকে আড়াল করার জন্য ভাস্কর্য ভাঙ্গার নাটক করতে হচ্ছে। কারণ, আমরা জানি, কী সাধু এবং স্বাধীন এই সরকারের বিচার বিভাগ! এমন আবালরকম স্বাধীন যে, আদালতের রায়ের আগের দিন সাংবাদিকদের সামনে উপদেষ্টা সেই রায়ের অনুলিপি পড়ে শুনান।



কিন্তু আমি ভাস্কর্য বিরোধীতাকে সমর্থন করি। কেন করি, সেটির একটি আলোচনা আমি করেছি, আমার এ সংক্রান্ত দ্বিতীয় পোস্টটিতে। আমি একটি স্পষ্ট বাক্য বলেছি, যে, একটি পাবলিক স্পেসে এই ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় রাস্ট্র নাগরিকদের সাথে যেহেতু এ সংক্রান্ত রাজনৈতিক বোঝাপড়া শেষ করে নাই, তাহলে এটি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের অনুমিত এগরিমেন্ট এর ভায়োলেশন কিনা। এবং এও বলেছি যে, এটি কোন ধর্মীয় বিষয় নয়, এটি হল আইকনকে ব্যবহার করে রাস্ট্রের ধর্ম হওনের কাঙ্ক্ষা, যেইটারে প্রতিরোধ করা সব নাগরিকের দায়িত্ব। কিন্তু তিনি এই পয়েন্টে 'আত্মহারা হয়ে' যান, এবং লুঙ্গি পড়া মাদ্রাসা ছাত্রদের বিপরীতে তার কল্পিত আরেক লুঙ্গি পরা কৃষক বাউলের ভাস্কর্যরে দাঁড় করান। তার অবস্থান কি এটাই নয়, যারা বলে, ওরা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী। আমি যে ধরণের অবস্থান সম্পর্কে দ্বিতীয় পোস্টটিতে বলেছি যে, নতুন পরিস্থিতির ডাইনামিজম হলো, ওরা ফকির লালনকে বাউল পরিচয় দিয়ে এমনই এক পেটিবুর্জোয়া, বর্ণবাদী, ফ্যাসিস্ট লড়াইয়ের জন্য আইকন বানালো।



এবং কয়েকটি ফুটনোট



ক. অনুমিত এগ্রিমেন্ট বা সোশাল কন্ট্রাক্ট কে ইউরোপীয় ধারণার ভিতরকার টার্ম হিশেবে ধরা ভুল হবে। এডওয়ার্ড সাঈদ-উত্তর প্রাচ্যবিদ্যার গভীরতর গবেষণাগুলো য়্যুরোপীয় অভিজ্ঞতার সোশাল কনট্রাক্ট এর ধারণার বাহিরে এটির ঐতিহাসিক ও মৌলিক ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশ সনাক্ত করেছে।



খ. মৌলভীদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াগুলো যে ভাষা এবং প্রক্রিয়ায় হয়েছে, তার ব্যাপারে প্রশ্ন করার মানে এই নয় যে, মৌলভিদের কর্মকাণ্ডকে নির্বিচারে সমর্থন করা।



৩. একই কারণে, বাংলাদেশের বর্তমান সংকটকালে, মিনার বানানো বা ভাস্কর্য পুননির্মিত করার দাবী তৈরী করে মৌলভি এবং মৌলভি বিরোধীদের মুখোমুখি অবস্থানটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিয়ে কাদের লাভ হচ্ছে সেটি ভেবে দেখা দরকার।



৪. কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভর্তিতে বাধা প্রদানের মাধ্যমে মৌলভি এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের বিরুদ্ধে এই বর্ণবাদী অবস্থানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলো?



৫. নির্বাচন কবে হবে?





মন্তব্য ৬৬ টি রেটিং +১৯/-২০

মন্তব্য (৬৬) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:২৯

বিডি আইডল বলেছেন: বেহুদা

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:০৬

রিফাত হাসান বলেছেন: ঠিক আছে।

২| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৩৪

হাসিব মাহমুদ বলেছেন:
মাইনাস

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:১৩

রিফাত হাসান বলেছেন: ভাল কথা।

৩| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৩৫

বেয়াকুফ বলেছেন: মাইনাসের লগে থাবড়।

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৫৮

রিফাত হাসান বলেছেন: ভয় পাইলাম।

৪| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৩৮

বিষাক্ত মানুষ বলেছেন: আপ্নেরে খুঁজে

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:২৩

রিফাত হাসান বলেছেন: ও।

৫| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৪০

হাসিব মাহমুদ বলেছেন:
পি.আলো ব্লগে এইজাতীয় পোস্ট দিতে পারেন । নিরাপদে খুব সমাদর পাবেন ওখানে । ত্রিভুজ, ফজলে এলাহী, দ্বীপবালক, উম্মু আব্দুল্লাহ, আশরাফ, ফারজানা মাহবুবার মতো প্রমিনেন্ট ব্যক্তিরা ওখানে ব্লগিয়ে থাকেন ।

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ২:৩৬

রিফাত হাসান বলেছেন: ভাল।

৬| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৪২

বেয়াকুফ বলেছেন: এই, তুই ই কি পেচালির মডারেটর ছিলি? বন করে রাকসস কেলা?

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৪০

রিফাত হাসান বলেছেন: ঐটা কেডা ভাই। আমি নহি।

৭| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৪৩

হাসিব মাহমুদ বলেছেন: এইটা সেই রিফাত না মনে হয় বেয়াকুফ (গন্ডু নাকি?) । ইনি আরো বড় মাপের জিনিস ।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৫৪

রিফাত হাসান বলেছেন: :(

৮| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৪৫

সাদাকালোরঙিন বলেছেন: হ তোরা মাদ্রাসায় পড়বি আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি রে মাদ্রাসা বানাবি । তাতে ঢাকা ইউনিভার্সিটির মান বাড়ব। যদি তোগো এত ঢাবি তে পড়ার শখ থাকে তাইলে ঢাবির মানের পড়াশুনা কর। ঢাবি কোন সেপারা পড়ার জা্য়গা না ।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ২:১৭

রিফাত হাসান বলেছেন: হ, বুঝছি, আপনি ঢাবির প্রতিভাবান ছাত্র।

৯| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৪৬

বেয়াকুফ বলেছেন: স্নোবল @হাসিব। গন্ডু প্রফাইলে এমুন পিকচার রাকতে যাবে কেন?

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৫৭

রিফাত হাসান বলেছেন: :(

১০| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:৪৯

হাসিব মাহমুদ বলেছেন: আমি ভাবলাম গন্ডুর ফটুক এ্যালাউ কর্তেছে না মডুরামেরা । শমশের আর মাথামুটার এ্যাগেইনস্টে এইরকম ঘটনা আছে ।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৫৯

রিফাত হাসান বলেছেন: ও।

১১| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৩:৪৮

শঙ্খচীল বলেছেন: ঢাকা ইউনিভার্সির আইন, অর্থনীতি, ইংরেজী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সহ বিভিন্ন সাব্জেক্টে একশ এর মত টিচার আছে যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড মাদ্রাসা। সুতরাং এই নীল দলের শিক্ষক গুলি রাজনৈতিক উদ্দ্যেশ্য হাসিলের জন্য ই মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যান করতে চাইছে। অন্য কোন কারনে নয়। এটা বুঝার মত বুদ্ধি একটা বাচ্চা ছেলের ও আছে।

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:০৩

রিফাত হাসান বলেছেন: একটা বাচ্চা ছেলের আছে। বুড়ো ভামদের নেই।

১২| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৪:৩১

পি মুন্সী বলেছেন: রিফাতের এই পোষ্ট যত শক্তিশালী পয়েন্ট তুলেছে এপর্যন্ত হাজির উপরের মন্তব্য তাতে মনোযোগে ঢালতে ততই দূর্বল; ফলাফলে, তারা রিফাতকে উপেক্ষা করেছে।
আমার মনে হচ্ছে, রিফাতকে কেবল ওর ভাস্কর্য বিরোধীতার অবস্হান দেখে কোন পক্ষে তার অবস্হান তা বুঝতে পেরে গেছি বলে নিশ্চিত হওয়াটা ভুল হবে; যদিও আবার বলে রাখতে হয়, কোন জায়গায় দাড়িয়ে রিফাত বিরোধীতা করছে তার চেয়ে রিফাত বিরোধীতা করছে এটাকেই সবাই মুখ্য করে দেখছে।
আমি বিশেষ করে ফারুক ওয়াসিফের মনোযোগ আকর্ষণ করবো। রিফাতের কথায় ফারুকের প্রতি শ্লেষ আছে সত্য, যেটা সে এড়াতে পারলে ভাল হত। তবু ফারুকের প্রতি অনূরোধ রাখব সম্ভব মনে করলে, আলোচনাকে সবল করার স্বার্থে এদিকটা উপেক্ষা করতে।

"বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" বলেই কী আমরা "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দিতে পারি? এটাই সারকথায় রিফাতের তোলা প্রশ্ন।

আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না থাকাতেই বোর্ডিং বা কওমি মাদ্রাসায় গরিব মা-বাবারা বাচ্চাদের পড়তে পাঠিয়েছে -এটাই মাদ্রাসায় এনরোলমেন্টের প্রধান ও সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে, কী মানের শিক্ষা তাঁর বাচ্চা লাভ করবে এটা বিষয় নয়। মূল বিবেচনাটা ওখানে বাচ্চাটার ফ্রি খাওয়া থাকা নিশ্চিত হবে। এরপর এর মধ্য দিয়ে যদি কিছু আদব শিখে এটা উপরি পাওনা। বাকিটা লিল্লাহ তে ছেড়ে দেওয়া।
এই পরিস্হিতিতে, প্রগতিশীল বা শ্রেণী রাজনীতির অবস্হান থেকে কেবল "নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" বা নেতারা রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় ইসলামি রাজনীতি করে - একথা বলেই কী আমরা "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দিয়ে কথা বলব? গরীব মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে শত্রুর কাতারে ঠেলে দিব? আবার, "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দিব কেন, আর ওদের নেতাদের সম্পর্কে এতটুকু জানাশুনাই কী আমাদের ইসলামকে মোকাবোলার জন্য যথেষ্ট? প্রগতিশীলতার জায়গা থেকে "নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" এটা চোখে পড়া যেমন গুরুত্ত্বপূর্ণ সম্ভবত এর চেয়ে বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ কথা মাদ্রাসা ছাত্রদের গরীবী দশা ও উৎস; যেখানে "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দেবার প্রশ্নই উঠেনা। ফলে রিফাতের কথা আমি যেভাবে বুঝেছি, উনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মনোযোগের আহ্বান করছেন। আমার কী এই গরির মাদ্রাসা ছাত্রদের সাথে একটা এনগেজমেন্টের তাগিদ বোধ করব? পাশে দাড়াব? করলে কীভাবে সে প্রশ্নও আছে। আছে সেইসাথে ইসলাম মোকাবোলার প্রশ্নও। ভেবে দেখতে বলি।


একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ:
রিফাতের এবারের ফুটনোটে আগের মত "অনুমিত এগ্রিমেন্ট বা সোশাল কন্ট্রাক্ট" এসেছে। সময়াভাবে আগে আমি ঐ বির্তকে যোগ দিতে পারি নাই। এবার এর সুযোগ নিয়ে বলতে চাই, সোশাল কন্ট্রাক্ট এর ধারণাটা সবসময়ই ইতোমধ্যেই সামনে হাজির কোন রাষ্ট্রের মধ্যে সামাজিক চুক্তি ধারণা কিভাবে কাজ করে চলেছে তা ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা হয়েছে। জ্যাঁ জ্যাঁক রুশোও সোশাল কন্ট্রাক্ট এর ধারণাটা এনেছিলেন তাঁর সময়ের ইতোমধ্যেই সামনে হাজির রাষ্ট্রটাকে ব্যাখ্যা করতে; হাজির রাষ্ট্রকে ন্যায্যতা দিতে যা ব্যয় হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কী করে গঠন ও কায়েম করতে হয় সে প্রসঙ্গ বুঝতে রুশো তেমন কাজে লাগে না। রাষ্ট্র একটা থাকলে তাকে বুঝতে এটা কাজে লাগে। ফলে শেষ বিচারে সোশাল কন্ট্রাক্ট এর ধারণার প্রসার, একটা নিপীড়ক রাষ্ট্রকে ন্যায্যতা দিতে বা কিছু সংস্কারের করতে যে ভাবনা লাগে তাই প্রসব করে। আমাদের চিন্তাকে একটা চক্করের মধ্যেও ফেলে দেয়। রিফাতের সোশাল কন্ট্রাক্ট আলোচনাটার অভিমুখও সেদিকে।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৩২

রিফাত হাসান বলেছেন: ধন্যবাদ পি মুন্সী, আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য। আপনার যোগদান এবং আলোচনা দুইটারেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবি। কিন্তু, ফারুক ওয়াসিফ নীচে যে মধ্যস্থতার কথা বলে আপনাকে ধন্যবাদ দিলেন, সেটির ভাষা কিছুটা বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে আমার। যেমন: রিফাতের কথায় ফারুকের প্রতি শ্লেষ আছে। এইসব।

যাই হোক, আমরা বিষয়ে ফিরতে চাই। আপনার মন্তব্যের প্রথম অংশের সাথে দ্বিমত পোষণের কোন কারণ নেই। তাই এ প্রসঙ্গে আমার কথাটি দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করছি না। বরং আপনার মন্তব্যের দ্বিতীয় অংশটির বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার মনে করছি। আপনি বলেছেন: শেষ বিচারে সোশাল কন্ট্রাক্ট এর ধারণার প্রসার, একটা নিপীড়ক রাষ্ট্রকে ন্যায্যতা দিতে বা কিছু সংস্কারের করতে যে ভাবনা লাগে তাই প্রসব করে। আমাদের চিন্তাকে একটা চক্করের মধ্যেও ফেলে দেয়। এই কথাটি আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু যখন বলেন, রিফাতের সোশাল কন্ট্রাক্ট আলোচনাটার অভিমুখও সেদিকে।, আমাকে বুঝতে হয় যে, আমার আলোচনার অভিমুখটিরে আপনি পুরোপুরি ধরতে পারেন নাই। পুরোপুরি শব্দটা বলছি, কারণ আপনি উপরে আরেকটি বাক্য উচ্চারণ করেছেন যেখানে আমার আলোচনার অভিমুখ সম্পর্কে একটি সন্তোষজনক ধারণা আছে: প্রগতিশীলতার জায়গা থেকে "নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" এটা চোখে পড়া যেমন গুরুত্ত্বপূর্ণ সম্ভবত এর চেয়ে বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ কথা মাদ্রাসা ছাত্রদের গরীবী দশা ও উৎস; যেখানে "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দেবার প্রশ্নই উঠেনা। ফলে রিফাতের কথা আমি যেভাবে বুঝেছি, উনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মনোযোগের আহ্বান করছেন। অথবা যখন বলেন, "বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" বলেই কী আমরা "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দিতে পারি? এটাই সারকথায় রিফাতের তোলা প্রশ্ন।

এবার সেই আলোচনায় আসি, যেটি নিয়ে আপনার সন্দেহ। দুই ধরণের মৌলিক অবস্থান থেকে রাষ্ট্র এবং তার বিবিধ হেজিমনিগুলিরে আলোচনা করা সম্ভব। একটি হলো, বিদ্যমান রাষ্ট্র ধারণার বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহণ করে সেই জায়গা থেকে রাষ্ট্রের বিবিধ হেজিমনিগুলিরে প্রশ্ন করা, দেখা, এবং একটি অন্যতর বৈপ্লবিক সংগঠন সম্ভাবনার কথা বলা। কিন্তু আমরা যখন নাগরিক অধিকার প্রভূত বিষয়গুলিরে আলোচনায় আনতে যাই, তখন বিদ্যমান রাষ্ট্রের অস্তিত্বরে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েই আলোচনাটি শুরু করি। এবং এক্ষেত্রে যখন আমি রাষ্ট্রের কাছে অধিকারের দাবী নিয়ে কথা বলি, তখন আপাত ধরেই নিই যে, রাষ্ট্রের সেই অথরিটি আছে। অর্থাৎ তুমি আমার অমুক অমুক অধিকার প্রটেক্ট করার দায়িত্ব নিয়েছো, কিন্তু এখন সেইসব হরণ করছো তুমি নিজেই। যেমন র‍্যাব যখন বিচারবহির্ভূতভাবে ক্রসফায়ার ঘটিয়ে মানুষ হত্যা করে, তখন আমরা বলি যে, তুমি আমার বিচার পাওয়ার অধিকার হরণ করছো, যেটি তুমি আমাকে দেবার কথা বলে সংবিধান লিখেছো। এই দ্বিতীয় অবস্থানের জায়গাটি এমনই যে, রাষ্ট্ররে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলি নিতান্তই অর্থহীন। রুশোর সোশাল কনট্রাক্ট থিওরি বিদ্যমান রাষ্ট্ররে বৈধতা দিতে তৈরী সন্দেহ নেই, তাই আমি ফুটনোটে তার সাথে আমার ডিসক্লেইমার জারি রেখেছিলাম।

১৩| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:২৭

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন: ধন্যবাদ পি মুন্সী, আপনার যোগদান এবং মধ্যস্থতা দুইয়েরই জন্য। পলেমিকাল আলোচনায় শ্লেষের ব্যবহারের সঙ্গে আমি পরিচিত। কাজেকাজেই ওদিকে আমার সমস্যা নাই। ওটা বিতার্কিকের আত্মবিশ্বাস মেরামতের রসায়ন। যার লাগে সে তার ব্যবহার করতেই পারে।
আমি কেবল ভাবছি, রিফাত হাসানের চৌকষ চিন্তা আর নিবিড় নজর কীভাবে আমার উত্থাপিত প্রশ্নগুলি, বাস্তবতার আলামতগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে লম্ফ দিয়ে প্রতিপক্ষকে বর্ণবাদী বলায় শান্তি পেল! আলোচনার মেরিট এতে নষ্ট হয়। কী করা যাইবেক, প্রত্যেকেই আপন মূর্তিতে জগতকে দেখতে চায়, যতক্ষণ না তার হুঁশ হয়।

প্রথমত আমি বলেছিলাম,

''উভয় সংস্কৃতির পারস্পরিক আক্রোশের ব্যাপারটা আমি বুঝি, কিন্তু জরুরি অবস্থার মধ্যে মৌলভিদের কোন প্রতিবাদ জনগণের দিক থেকে জরুরি ও রেডিক্যাল ছিল তার হদিস পেলাম না। আমাদের কর্পোরেটপুষ্ট শিক্ষিত কলোনিয়াল মধ্যবিত্ত আর মধ্যপ্রাচ্যপুষ্ট মৌলভিদের মধ্যে একটা স্বার্থগত দ্বন্দ্ব আছে জানি। উভয়েই যে রাষ্ট্রের দুধ-মধু-ঘি খাওয়ার জন্য কামড়াকামড়িরত, তাও তো দেখা। এর বাইরে মৌলভিদের কোনো সত্যিকার রেডিক্যাল অংশ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু দেখিয়ে দেবেন কি তারা কারা?
এই মৌলভিরা মোটেই অশিক্ষিত নয়, তারা রীতিমতো (আরবি-ফার্সি-ইংরেজি) শিক্ষিত। নানান এলেমদারির সঙ্গে তাদের কানেকশন। তাদের মধ্যে পশ্চিমা ভাবধারায় শিতি ধনীর দুলালেরাও যেমন আছে, আবার মোসাদের টাকার চ্যানেলও ফকফকা শোনা যায়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ঐ সিভিল এভিয়েশনের আমলা বা ফখরু সরকারের ড. ব্যা. অলা উপদেষ্টাদের সঙ্গে তাদের অর্থাৎ ঘোড়া আর গাধার মিলনও আকছারই তো দেখি। ব্যারিস্টার মইনুলের আমলের কথা স্মরণ করতে বলি। স্মরণ করতে বলি, ঢাকা শহরের এন্তার শপিং মলগুলোতে সাজানো ইতর যৌনাবেদনমাতানো মেনেকিন মূর্তিগুলো বা আর বিশ পঞ্চাশটা জায়গায় বিভিন্ন কর্পোরেট স্পন্সরড ভাস্কর্য কিন্তু তারা ভাংতে যায়নি। কালচার ইন্ডাস্ট্রির রগরগে দৃশ্যসংষ্কৃতি ও পুঁজিবাদী পৌত্তলিক সমাজের সকল আইকনের সঙ্গে সহবাসে তারা রীতিমতো অভ্যস্ত। সাম্রাজ্যবাদের খনিজ লুণ্ঠন ও সোফা-হানা-পিএসসি, এফডিআই ইত্যাদির বিরুদ্ধে একটা ঢিলও তাদের চুঁড়তে দেখা যায়নি। মার্কিন দূতাবাস তাদের কাছ থেকে সর্বদা নিরাপদ। সুতরাং পুঁজিবাদী সমাজের কোন কোন আইকন তারা আঘাত করে, ভাঙ্গে, কীভাবে তারা রাষ্ট্রবিরোধী হয়, তার সুলুক কিন্তু রিফাত হাসানের লেখায় নাই। যাহা নাই, তাহাকে আমলে নিই কীভাবে? ''

এখানেও তিনি সেই উত্তরটি দেননি। পাল্টা বিকৃত উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে লেগেছেন যে, আমি বর্ণবাদী, কারণ আমি মাদ্রাসা ছাত্রদের শ্রেণী অবস্থানের বিষয়টি বাদ দিয়ে রাখতে চাই। অথচ আমি প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলাম:

''বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট টিকেই আছে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আর পুঁজির কারুণ্যে। দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ দিলে, এদের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত। কবে তারা সুবিধাভোগের বিপরীতে দাঁড়াল? গরিব, সবদিক থেকে নিপীড়িত সম্ভাব্য শ্রেণী সংগ্রামের অগ্নিগর্ভ নিম্নবর্গীয় হিসেবে এই শ্রেণীটির প্রতি আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও তাদের রাষ্ট্র যত অবিচার করেছে, তার সঙ্গে কৃষক শ্রেণীর ওপর চলা অবিচারের তুলনা চলে। কোনো কাকতাল নয় যে, এরা সেই কৃষকদেরই সন্তান বা সন্তুতি। কিন্তু কবে, ইসলামপন্থি নেতারা সুবিধার মধুর নহর থেকে গা উঠিয়ে এদের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়েছে?''

আপত্তির আরো জায়গা রয়েছে, কিন্তু আমি কিঞ্চিত অপেক্ষা করে দেখতে চাই যে, এসবের উত্তর পাই কি না। না পেলে আমি আমার মতো অগ্রসর হব। মিছা ফেনা না তুলে বিষয়টার কেন্দ্রে যাওয়া দরকার। আর তার জন্য একচুয়ালি এক্সিস্টিং হিস্টরিতে অর্থাৎ আমাদের রাজনীতির ঘটনাবলির মধ্যে কীভাবে ঘটনাটি ঘটছে, সেটা সাব্যস্ত না করে আলোচনা করা হবে আলোচনাটাকে ঐতিহাসিক বাস্তবের সীমার বাইরে নিয়ে যাওয়া। আমার মনে হয়, সেই পথে আমরা পরস্পরের দেখা পাব না, জনমুক্তির রাজনীতিও সেদিকে হাঁটবে না।

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৮:০০

রিফাত হাসান বলেছেন: ফারুক ওয়াসিফ, দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমার পোস্টের আলোচনায় এবং পি মুন্সির কমেন্টে একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে, আপনি মন্তব্য করতে গিয়ে, হয়তো বেখেয়ালেই, তার পুরোটাই এড়িয়ে গেলেন। সেটি হলো: "বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" বলেই কী আমরা "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দিতে পারি? তার পরিবর্তে আপনি আমার বিরুদ্ধে আপনার কমেন্টকে বিকৃতির অভিযোগ করলেন এবং আপনার পুরো মন্তব্যটি তুলে দিয়ে স্বস্থি পেতে চাইলেন। যাক, আমিও স্বস্থি পেলাম, আমাকে আর কোট করতে হলো না। আপনার কোট করা লাইনগুলো এই প্রশ্নটির কোন উত্তর নেই, বরং এই প্রশ্নটিকেই শক্তিশালী করে।

আমি যেটিরে আপনার বর্ণবাদী অবস্থান বলতে চাইছি, সেই ব্যাপারটির কোন ব্যাখ্যা এলো না, শুধুমাত্র অস্বীকার ছাড়া। আপনি বলতে চেয়েছেন, আলোচনাকে ভীন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আমি আপনার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছি। কিন্তু আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখতে পেতেন, আমার প্রথম পোস্ট থেকে শেষ পোস্ট পর্যন্ত সবগুলির অভিমুখই মূলত মৌলভিদের বিরুদ্ধে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর এই বর্ণবাদী আক্রোশের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা। বরং আপনিই আলোচনাকে ভীন্নখাতে প্রবাহিত করলেন এই পোস্টের মূল অভিমুখকে আলোচনায় না এনে বিবিধ শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটিয়ে। তাই, আমাকেও কেবল ভাবতে হচ্ছে, ফারুক ওয়াসিফের চৌকষ চিন্তা আর নিবিড় নজর কীভাবে আমার উত্থাপিত প্রশ্নগুটিরে এড়িয়ে গেল।

যাই হোক, আমার পর্যবেক্ষণগুলি বলি বরং।

ক. আপনার পোস্টটি বর্ণবাদী শুধু নয়, আপনার একটি প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানও নির্দেশ করে। সেটি হল, ভাস্কর্যের জন্য কান্নাকাটি করে প্রচুর লেখালেখি, মিছিল মিটিং প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়েছে ব্লগে এবং ব্লগের বাহিরে, মাঠে-ময়দানে। তাদের ভাষা, শ্রেণী, এবং রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা একটি রাজনৈতিক জরুরী কাজ ছিল। কিন্তু এই এলিটদের মূর্তি নিয়ে লাফালাফির ব্যাপারে আপনার একটা সিঙ্গেল পোস্ট নেই। অথচ আমি সেই জরুরী প্রশ্নটি উত্থাপন করার পর, আপনি নিজে সেই শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে মৌলভিদের ''শিল্প-নাশকতা''(!) নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখালেন এই বলে যে, দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ দিলে, এদের নেতারা সবাই ''সম্পত্তিবান'' শ্রেণীভুক্ত। আচ্ছা, এই আন্দোলনে এই গরিব মাদ্রাসা ছাত্ররা কেন অংশ নিয়েছে বলে আপনার মনে হয়? মওলানা-মৌলভিদের কি ' মন ' বলে কিছু নাই? তারা কি আবুল, যে তাদের কোন বুদ্ধি নেই, চিন্তা নেই। ফারুক সাহেব, আপনার চিন্তা অরিয়েন্টালিষ্টদের মতই প্রতিক্রিয়াশীল।

নেতারা ''সম্পত্তিবান'' শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত, কেবল এই কারণে যদি মৌলভিদের আন্দোলনকে বাতিল করতে চান, তাহলেতো ভাস্কর্যের পক্ষের অবস্থানটিরেও আরো গুরুতর প্রশ্ন দিয়ে শায়েস্তা করা যায়। কারণ, এখানে ভাস্কর্যের পক্ষে গরিব জনগোষ্ঠির কেউই কাজ করছে না, এলিট গোষ্ঠি ছাড়া। এবার স্মরণ করুনতো, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যে ফ্যাসিস্ট দলটি নেতৃত্ব দিয়েছিল তার নাম আওয়ামী লীগ। এবং সন্দেহাতীতভাবে তারা ''সম্পত্তিবান'' শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। এখন আপনার কোন শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে আপনি মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেন, আবার মৌলভিদের ভাষ্কর্যবিরোধী অবস্থানকে কেবলই নেতৃত্বের ''সম্পত্তিবান'' হওয়ার কথা বলে বাতিল করে দেন? অনুগ্রহপূর্বক একটু বলবেন, নেতৃত্ব বিশেষ শ্রেণীভূক্ত হওয়ার কারণে তার আন্দোলন বিষয়েই কথা বলা যাবে না, এই নীতি কেন নিলেন?

খ. আপনি একটা তৃতীয় পজিশন নির্মাণ করার কথা বলেছেন যা আমার কাছে মূলত বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি ও সংস্কৃতির তল্পি বহনের নামান্তর মনে হয়েছে।

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব কালচারাল এলিটদের বিষয়ে গা জ্বালা করে বলে নিজেকে আলাদা করে তৃতীয় পজিশনে নিয়ে আবার যে কথা বলছেন, তা অই মধ্যবিত্ত্ব এলিটদের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানকেই বৈধতা দিতে তৎপর। আবার লালন নিয়ে আপনার বক্তব্য এই এলিটদেরই মতন হুবহু। তাই কোন তৃতীয় অবস্থান তৈরী আপনি করেনই নাই, বরং দ্বিতীয় গ্রুপটিরই সমর্থনে একটি ছায়া অবস্থান তৈরী করেছেন: "আমি মনে করি, দুটোই এক বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল। তবে ঐ যে এই বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভাস্কর্য অপসারণের রাষ্ট্রীয় নাশকতার বিরুদ্ধের আন্দোলনটি তুলনায় গণতান্ত্রিক।

‘তুলনায় গণতান্ত্রিক’... বাহ, চমৎকার সাধু অবস্থান, ভাষা সত্যিই অচেতনকে প্রকাশ করে।

সাধুদের লালন চর্চায় মূর্তি নিয়ে লাফালাফি কখনো দেখি নাই, লালনের চিন্তায় মূর্তি নিয়ে লাফালাফি নেই, তাই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির পক্ষে কৌশলি ডিফেন্সে না গিয়ে লালনপন্থিরা কীভাবে লালন চর্চা করে তা কষ্ট করে একবার দেখে আসা দরকার আপনার। নচেত মূর্তি এবং ভাষ্কর্যবিরোধিতাকে লালন বিরোধীতা বলে চালিয়ে আপনি কোন উসিলা হাসিল করতে চান, সেই প্রশ্নটি আসবে।

১৪| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪১

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন: রাষ্ট্র ও সংবিধানকে একটা সামাজিক চুক্তি হিসেবে দেখার খাতক আমি নই। এ বিষয়ে পি মুন্সী বলেছেন। আমি তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলতে চাই যে, এটা রাষ্ট্র গঠিত হবার প্রক্রিয়া হিসেবে ইতিহাসের কোথাও দেখা যায় নাই। রাষ্ট্র গঠিতই হয়, সমাজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এবং তার ওপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সক্রিয় থাকবে বলে। সম্মতি আদায় বলপ্রয়োগেরই সহযোগি। রাষ্ট্রগঠনের পরে সেকারণে সামাজিক চুক্তি বলে হেজিমনি আরোপ করার চেষ্টা চলে। আমাদের কাজ হচ্ছে, রাষ্ট্রের ওই বলপ্রয়োগের ভিতকে উন্মোচন করা এবং তাকে নড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। রাষ্ট্র তুমি আমার সঙ্গে চুক্তি করে লঙ্ঘন করেছ বলে তোমাকে বেত মারব জাতীয় বিরোধিতায় বিপ্লবী রাজনীতির কাজ নাই। আমারো নাই।

দ্বিতীয়ত যে রাষ্ট্র ভায়োলেন্সের ওপর প্রতিষ্ঠিত সে প্রতিনিয়ত আইন সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মধ্যে সেই ভায়েলেন্সেরই পুনরুৎপাদন করে চলে। পাবলিক স্পেসে ভাস্কর্য স্থাপন রাষ্ট্রের ওই হেজিমনি নির্মাণের অংশ, এবং নিজের ভাস্কর্য নিজেই ভাঙ্গার মধ্যে দিয়ে সে হেজমনির প্রমাণ হিসেবে নিজের একচেটিয়া ক্ষমতাকেই আরো সুনিশ্চিত ভাবে দেখিয়ে দেয়। সুতরাং, রাষ্ট্র নাগরিকদের না জানিয়ে ভাস্কর্য বসানো অপরাধ হলে, তাদের সম্মতি ছাড়া সেটাকে আবার সরানোও তার নতুন ভায়োলেন্স। রিফাত হাসান এই দ্বিতীয় দিকটি দেখতে চাচ্ছেন না। কারণ, তিনি যে বুর্জোয়া আধুনিকতাবাদীদের সমালোচনায় সপ্তমুখ, তাদেরই একটি আকর ধারণায় বসত গেড়ে রেখেছেন যে, রাষ্ট্র নাকি এক সোশ্যাল কনট্রাক্ট। হায়রে, মন না মতি?

ভাস্কর্য বসানো ও সরানোর মধ্যে তাই গুণগত একটি পরিবর্তন ঘটে যায়। সেটা হলো রাষ্ট্র+হুজুর শক্তির হেজিমনিক দাপটের চিহ্ন প্রতিষ্ঠা। সমকালীন দেশীয় ও বিশ্ব রাজনীতির ধারার মধ্যে এই ঘটনা অনূদিত হয়ে চলবে, রাষ্ট্রীয় মদদে তালেবানি কাজ হিসেবে। এই কাজের ক্ষমতা আমাদের মাদ্রাসা ছাত্ররা কীভাবে অর্জন করেন এবং কেন সেই ক্ষমতাকে তারা তাদের রাজনৈতিক ও মানবিক মুক্তির উদ্দেশ্যে চালিত করতে পারেন না, তার বিচার ছাড়া তাই এই ক্ষমতাকে গ্রহণ করবার কোনো জায়গা থাকে না।

এর বাইরে ভদ্রলোকি সং সাজার ভড়ংওয়ালা প্রতিবাদের সাংষ্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিচার করা যেতেই পারে। কীভাবে সংস্কৃতিকে তারা তাদের হেজিমনিক উপস্থিতির কাজে ব্যবহার করে, কীভাবে সংষ্কৃতায়নের নামে তারা জনগোষ্ঠীর সংষ্কৃতিকে দলন করে নিজেদের উপনিবেশিক সামাজিক অবস্থান ও প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখে, সেই আলোচনা অবশ্যই করবো। কিন্তু এর পাল্টা যারা আপাতত তাদের নিয়েই কথা হচ্ছে যখন, তখন সে পথে কিছুটা হাঁটি! দেখা যাক, মান্যবর রিফাত হাসান আমার জন্য কী লইয়া বইসা আছেন!!!

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:১৯

রিফাত হাসান বলেছেন: পি মুন্সির মন্তব্যের উত্তর দ্রষ্টব্য।

১৫| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪৪

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন: এইটা আমার এ বিষয়ে লেখা-দুইটার লিংক; রিফাত হাসান দেন নাই, আমি দেয়া কর্তব্য মনে করলাম।

রিফাত হাসানের ‌'ফাজলামীর সীমা' এবং ফুটনোটের গবাক্ষপথে রাজনীতির মারেফত দর্শন Click This Link

এবং লালন উৎখাতের মচ্ছব বসিয়ে হাওয়ার ওপর তাওয়া গরম করে কার জন্য পিঠা ভাজা হচ্ছে? Click This Link

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৪৩

রিফাত হাসান বলেছেন: দু:খিত, প্রথমে খেয়াল করা হয় নাই। এখন লিঙ্কটি যোগ করে দিলাম। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

১৬| ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫

রাশেদ বলেছেন: পরথম আলো বল্গ এ আপনাকে মাথায় তুলে রাখপে!

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:৪৬

রিফাত হাসান বলেছেন: তাই?

১৭| ০৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:১৯

সুমন রহমান বলেছেন: "বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" বলেই কী আমরা "দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের কথা বাদ" দিতে পারি?"

- পি মুন্সীর এই বক্তব্যে রিফাত হাসানের সমর্থন রয়েছে দেখা যায়। হুম... এভাবে দেখলে তো পারি না। তবে এটুকু বোঝা যায় যে, ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের সম্পত্তিবান নেতাদের ব্যাপারে রিফাত হাসান এবং পি মুন্সীর অনাস্থার পরিমাণ ফারুক ওয়াসিফের সামন না হলেও কাছাকাছি। এখন যদি এভাবে দেখি যে, এই দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্ররা তাদের নেতৃত্বে ইসলামী লেবাসধারী সম্পত্তিবান একটা শ্রেণীকে আনক্রিটিক্যালি মেনে নিয়েছে..... তাহলে তর্কটা আরেকটা গোত্তা খায় বলে মনে হয়। ভাস্কর্য ইস্যুতে আমরা যদি দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের ইনস্ট্যান্ট রিঅ্যাকশনকে ক্রিটিক্যালি জাস্টিফাইড ভাবতে পারি, তাইলে তাদের নেতৃত্বের ব্যাপারে তাদের এপ্রিসিয়েশনের জায়গাটিকেও নিশ্চয়ই ক্রিটিক্যালি বিচার করে দেখতে পারি। ফলে, দুটো প্রশ্ন উঠে:

১. দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্ররা গত চার দশক ধরে তাদের সাথে লটকে থাকা লুম্পেন নেতৃত্বকে কখনো ক্রিটিক্যালি দেখেছে কিনা,

২. যদি না দেখে থাকে, তবে অন্যান্য ইস্যুতে তাদের "স্বতঃস্ফূর্ত" রিঅ্যাকশন রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হলে এই রাজনীতির চক্করে দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের হিস্যার পরিমাণ কিভাবে নির্ধারণ করবো?

ধন্যবাদ।

১৮| ০৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:২৪

দিশাহারা ওমর সোলাইমান বলেছেন:
উকানে যান। মাথায় তুলে রাকপে।

১৯| ০৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ ভোর ৪:০৫

তরিকুল হুদা বলেছেন: এই আলোচনাকে সিরিয়াস জায়গায় নেয়ায় সুমনকে সচেস্ট দেখে ভাল লাগছে।আলোচনার সিরিয়াসনেস বজায় রেখে আর বেশি কাদা না ছড়ালে আরো ভালো হয়।

সুমনের প্রশ্ন অবশ্য তখনি আসে যখন আমরা মেনে নেই যে কমপক্ষে 'দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্র'রা এই আন্দোলনের একটা অংশ। প্রশ্ন পড়ে মাথায় আরো কিছু প্রশ্ন আসলো।

১. এই তর্কে দরিদ্র বা সম্পত্তিবান তথা অর্থনৈতিক অর্থে যদি 'শ্রেণী' বুঝানো হ্য় তাইলে তো মুশকিল।অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক শ্রেণীর তো ফারাক আছে,নয় কি?এই ফারাকের যায়গা থেকে আপনি প্রশ্নটা কেমনে উঠাবেন?

২.ফোকাসটা ঘুরে ফিরে 'দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্র'দের উপর বেশী আসতেছে মনে হয়।তাহলে কি আপনি অন্যপক্ষ অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল মধ্যবিত্ত বলতে রিফাত যা বুঝাইছেন তার সাথে একমত?

৩.লুম্পেন নেতৃত্বের সমস্যাতো সাধারনভাবে বেশীর ভাগ ছাত্র আন্দোলনের,তাই না?তাইলে একে ক্রিটিক্যালি বিচারের দায় শুধু 'দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্র'দের ঘাড়ে লটকানো কেন?

৪.এমনকি সম্ভাবনা থাকতে পারে যে, আরো বেশী অন্যান্য ইস্যুতে তাদের "স্বতঃস্ফূর্ত" রাজনৈতিক অংশগ্রহনের ফলে বিকল্প কোন ন্যায্য নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে?যদি হয়েও থাকে তাহলেও কি আপত্তির কোনো কারন থাকতে পারে?থাকলে সেগুলা কি?

২০| ০৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:০৭

সুমন রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ তরিকুল হুদা, আমার ব্ক্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার মন্তব্য এবং রিফাত হাসানের মৌনতা থেকে ঠাহর করতে পারি যে, আপনার প্রশ্নগুলো রিফাতেরও প্রাণের প্রশ্ন। আর আমাকে যেহেতু প্রশ্নগুলো করেছেন, তাতে ধরে নিচ্ছি যে আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই এই প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করি।

১. শ্রেণী কনসেপ্টটা সবসময়ই ঝামেলাজনক। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শ্রেণী যেমন আছে, সাংস্কৃতিক শ্রেণীকরনও সমাজে হয়ে থাকে। ফলে, আমি যখন মাদ্রাসা ছাত্রদের লুম্পেন নেতৃত্বের কথা বলি, তখন সেটাকে একটা বিশেষ কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী হিসেবেই দেখি। "শ্রেণী" জিনিসটারে প্রবলেমাটাইজ না করেও এই প্রশ্নটা উত্থাপন করা যায় এবং আলোচনা ফোকাসড রাখার খাতিরে আমি সেটাই করতে আগ্রহী।

২.বর্তমান প্রেক্ষিতে দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের অন্যপক্ষ হিসেবে আমরা শিক্ষিত রূচিশীল মধ্যবিত্তকে সনাক্ত করতে পারি। কিন্তু রিফাত কোন্ অর্থে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলেন সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এখানে আরেকটা অদ্ভূত ব্যাপার: দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্রদের আন্দোলন প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে শিক্ষিত রূচিশীল মধ্যবিত্তের বিপক্ষে। প্রান্তীয় শ্রেণী হিসেবে এরা কখনই অর্থনৈতিক/রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে না।

৩. তরিকুল হুদা, এই প্রশ্নটা আমার পূর্বানুমিত। করেছেন বলে ধন্যবাদ। লুম্পেন নেতৃত্বের সমস্যা সর্বত্র। কিন্তু যে আন্দোলনের বিপ্লবাত্মক সম্ভাবনা আছে, তার নেতৃত্ব দীর্ঘদিন কখনই লুম্পেন থাকে নি। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। বর্তমানের ছাত্র আন্দোলনের কথা বাদ দিয়ে বরং ইংরেজ আমলের কৃষক বিদ্রোহগুলোর কথা ধরুন, এমন কি কানসাট বা শনির আখড়ার কথা ধরুন...নেতৃত্ব ভেতর থেকে উঠে আসা জিনিস। ইনসিডেন্টাল। এসব আন্দোলন নেতৃত্ব তৈরি করেছে, নেতৃত্ব বদল করেছে। বর্তমানের মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে এসব প্রণোদনা নাই। এমন কি এদের আন্দোলনে ভাতকাপড় পর্যন্ত কোনো ইস্যু হয় না। ফলে আমি এসব আন্দোলনে কোনো বিপ্লবী সম্ভাবনা দেখি না।

৪. ভাতকাপড় তথা মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত। কোন্ যাদুমন্ত্রবলে এসব ইস্যু তাদের রাজনীতিতে আসেনা?

মাদ্রাসা ছাত্রদের আন্দোলনের বিপ্লবী সম্ভাবনায় যারা বিশ্বাস করেন তাদেরকে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে।

২১| ০৯ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:৩৭

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন: ‌দুটো জিনিষি খেয়াল করলাম, রিফাত হাসান তাঁর সঙ্গে দ্বিমত উত্থাপনকারীদের পোস্টে গিয়ে কমেন্ট করেন না এবং সরাসরি উত্তর না দিয়ে পুনরুক্তি তাঁর দিলপসন্দ্। আমার লেখায় এবং কমেন্টে উদ্ধৃত দুটো প্যারায় বিবদমান দুটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সাংষ্কৃতিক গঠনের রূপটি দেখানো হয়েছে। আশা করি, তিনি সেটার সঙ্গে এনগেজড হয়ে আলোচনায় আসবেন।

সুমন রহমানের প্রশ্নগুলোর সঙ্গে একাত্ম। এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির একটি ক্রিটিক অপেক্ষা করছে। যাকে রিফাত হাসান আমার বর্ণবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান বলে চিহ্নিত করছেন, সেই অবস্থানের ব্যাখ্যা আমার কমেন্টগুলিতে ছড়িয়ে আছে। বিশেষত ১৪ নং কমেন্টের বক্তব্যের কোনো উত্তর না দেয়া থেকে বোঝা যায়, রিফাত সেদিকে যাওয়া সুবিধা মনে করছেন না। বরং আমরাই চেষ্টা করি না কেন, তাঁর অবস্থানের মধ্যে যে সুপ্ত ফ্যাসিস্ট বাসনা রয়েছে, তা দেখাতে।

ভাস্কর্য ভাঙ্গার পক্ষে-বিপক্ষের গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও শ্রেণীবিচার না করে তাকে দেখা হচ্ছে দুটো শত্রু গোষ্ঠীর পারস্পরিক হিংসা হিসেবে। এই সাবজেক্টিভিটির কারণে বিষয়টার রাজনৈতিক চেহারা তাঁর সামনে ধরা পড়ছে না। তাই বারবার মৌলভিদের মন আছে, তারাও শিল্প বোঝে ইত্যাকার অপ্রাসঙ্গিক কথা চলে আসছে। মন আছে বলেই তো তারা সক্রিয়। দরকার সেই মনের সুলুকসন্ধান করা।
একটি আক্রোশকে ডিফেন্ড করে অন্য আক্রোশকে অশুভ বলা দিয়ে মৌলভীদের পক্ষে তাঁর শর্তহীন পক্ষপাত স্পষ্ট হয়। সেই পক্ষপাতকে আমি প্রশ্ন করতে চাই এভাবে:

ক. মৌলভীদের রাজনৈতিক অবস্থান কী কারণে প্রতিক্রিয়াশীল নয়, কী কারণে বাংলাদেশের জনমুক্তির সংগ্রামে তা অগ্রসর অবস্থান দখল করবে, তা রিফাত হাসানকে দেখাতে হবে। আধুনিকতাবাদী শহুরে এলিটদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিক্রিয়াশীলতা দিয়ে মৌলবীদের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে ঢাকা বা জায়েজ করা যাবে না।

খ. মাদ্রাসা ছাত্রদের গরিব পর্যন্ত বুঝেছেন রিফাত। কিন্তু ঐ গরিবের শ্রেণীগত ভিত্তিটি কী? যে সুপ্ত শ্রেণীবোধ তাদের মধ্যে জায়মান তাকে বিকশিত করবার রাজনীতিটি কী? কোন নের্তৃত্ব ও মতাদর্শে তারা তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি ঘটাবে?

গ. মুক্তিযুদ্ধে নের্তৃত্বদানকারী অন্যতম দলটি চরিত্রগত প্রতারণা ও ফ্যাসিবাদী আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও ঐ বিশেষ মুহূর্তে তাদের অবস্থান সার্বিকভাবে গণবিরোধী ছিল না, ছিল সুবিধাবাদী। ৭১-এ সম্পত্তিবান বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত ও কৃষক-মেহনতি মানুষের সাধারণ স্বার্থগত ঐক্য হয়েছিল, পাকিস্তানের বৃহত পুঁজিপতি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আজ ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে বাংলার মানুষের সেরকম কোনো স্বার্থগত রাজনৈতিক ঐক্যের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এরা সকলে মিলে আওয়ামী-বিএনপিসমেত রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের মালমশলা ছাড়া আর কিছু নয়।

ঘ. হ্যাঁ, আমার অবস্থানটি আপনার বিচারে অবশ্যই তৃতীয়। একদিকে বহুজাতিক পুঁজিপুষ্ট ইঙ্গ-ভারতীয় এলিট অন্যদিকে সৌদি-পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াপুষ্ট ইসলামী এলিটদের দুই বাহু আজ জনগণকে পিষ্ট করছে। তবে অবশ্যই ক্ষতিকারিতার দিক থেকে প্রধান শত্রু ইঙ্গ-ভারতীয় অংশটি। ইসলামীরা তার বিরোধিতা দূরে থাক, তারই অনুষঙ্গের ভূমিকায়। এর বাইরে শোষকদের কলোনিয়াল আধুনিকতা, প্রগতি, উন্নয়ন ও সামন্তীয় ইসলামী গডফাদার ও তাদের বুর্জোয়া সংস্করণ জামাতের বাইরে তৃতীয় অবস্থান গ্রহণ করবার জরুরত উপস্থিত। কারণ, বুর্জোয়া ডেভেলপমেন্টালিস্টদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থা এখানে কোনো কার্যকর বিরোধিতা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে তাদের সেই রাজনৈতিক সম্ভাবনাও খুবই কম। বরং বারে বারেই তারা প্রতিক্রিয়ার হাতিয়ার হয়েছে। জনগণের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে ধর্মকে বাধা হিসেবে হাজির করছে। মুষ্ঠিমেয়র বলপ্রয়োগেই এদের ভরসা। সেজন্য সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় আগ্রাসী শক্তির মধ্যে এরা নিজেদের সমর্থন ও প্রতিপালক খোঁজে। এদের পক্ষে যে রাজনৈতিক অবস্থানটি রিফাত এবং তাঁর সহমর্মীরা নিতে চান, তা প্রকারান্তরে এই প্রতিক্রিয়াশীলতারই সাফাই। এবং পশ্চিমা বিশ্লেষণী টুল ব্যবহার করলেও মর্মগতভাবে তা বাংলাদেশি কায়েমি স্বার্থের ইসলামপন্থিদের প্রতিক্রিয়াশীলতাকেই মহিয়ান করে। এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের ভেতরের ফ্যাসিবাদী মানসিকতা এদের মধ্যেও চালান হয়ে আসে।

ফুটনোট: ভাস্কর্য-বিরোধী আন্দোলনের নেতার যোগসাজশ বিষয়ে নিউ এজ পত্রিকায় রেহনুমা আহমেদের কলামে কিছু তথ্য পরিবেশিত হয়েছে:
A Human Rights Watch report, Bangladesh: Breach of Faith (2005) had stated that KN (খতমে নবু্য়ত) had close links to the ruling BNP through the Jamaat-e-Islami and the IOJ, its coalition partners. I remembered other things too. It was the same Noor Hossain Noorani who had said, Tareq Zia, Senior Secretary General of the BNP, was their “Amir and same-aged friend,” and had threatened police officials saying Tareq would directly intervene if Khatme Nabuwat’s anti-Ahmadiya campaign was obstructed. According to reports, highup intelligence agency officials (DGFI, NSI) had mediated contacts between the ruling party and the KN. He had met the DGFI chief in Dhaka cantonment thrice, Noorani had thus boasted to Satkhira reporters in 2005, a statement never publicly refuted by the intelligence agency (Tasneem Khalil, The Prince of Bogra, Forum, April 2007, issue withdrawn, article available on the internet).

What links does the present military-backed caretaker government, and more so, its intelligence agencies, have with these extremist groups? I cannot help but wonder. Is there more to what’s happening than meets the eye?

২২| ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:১৫

পি মুন্সী বলেছেন: আমি সরি, কিছু করার ছিল না। পেটের দায় বড় দায়, সেই দায়ে আটকে গেছিলাম। বোধহয়, এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেছে ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে থাকার কারণে এখানে ফিরতে পারিনি। ক্ষমা চেয়ে শুরু করছি, এবার দেখি আলোচনাটাকে গঠনমূলকভাবে চাঙ্গা করতে পারি কী না। ইতোমধ্যে দেখছি তুলকালাম ঘটে গেছে।

আমার কিছু অবজারভেশন দিয়ে শুরু করছি।
১। আমরা সবাই একটা পোষ্টকে কেন্দ্র করে এত বেশি ইস্যু জড়ো করে ফেলেছি যে কোন একটার প্রতি আমাদের সবার নূ্ন্যতম মনোযোগগুলো একাট্টা করার সুযোগ নিতে পারিনি। ফলে আলোচনা কোন একটাতে কেন্দ্রভূত না থেকে বিস্তর প্রসঙ্গে ছড়িয়ে গেছে। ফলাফলে কোন প্রসঙ্গকেই সুবিচার করা হয়নি।
রিফাতের মূল পোষ্ট থেকে অনেক প্রশ্ন বা ইস্যু নিশ্চয় খাড়া করা সম্ভব। কিন্তু আমি মনে করি, আমার একটা ব্লগে জড়ো হয়েছি, ফলে এর সীমাবদ্ধ পরিবেশ, আমাদের সময় দেওয়া ইত্যাদি আমাদের বিবেচনায় নিতেই হচ্ছে। তাই, একই পোষ্টের বক্তব্যে অনেক ইস্যুতে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বেছে একটা বা দুটোর বেশি প্রসঙ্গ এ্যড্রেস করার বাস্তবতা নাই। এভাবে একটা বা দুটা ইস্যুকে ছোট ছোট করে প্রসঙ্গ তুলে আমাদের একমতের জায়গাগুলো যদি একজায়গায় করতে পারি, সেইসাথে ভিন্নমতগুলোকেও অন্ততপক্ষে যদি চিহ্নিত ও স্পষ্ট করতে পারি - তাহলে আমি মনে করি আমরা অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবো। এটা নিশ্চয় সবাই মানবো যে, একটা দুইটা পোষ্টে আমাদের সব সামাজিক বিতর্কগুলোর নিরসন বা সমাধান হবে না। আমার এই পদ্ধতিগত প্রস্তাব সবাইকে ভেবে দেখতে বলবো। এটাতে সংযোজন বিয়োজনও অবশ্যই হতে পারে। আবার দেখুন, এতে আমাদের ব্লগে সময় দেওয়াটারও মোটামুটি একটা লক্ষ্য গন্তব্য ঠিক হতে পারে। ব্লগে কেন সিরিয়াস হয়ে সময় দিব তারও একটা কারণ আমাদের জানা থাকবে। আমার বন্ধুরা লক্ষ্য করবেন, রিফাতের মূল পোষ্ট থেকে আমি কেবল দুটো (একটায় রাখতে পারলে ভাল হতো) প্রসঙ্গ বের করে তুলে এনেছি। তার মানে বলতে চাচ্ছি অন্য অনেক প্রসঙ্গেই অনেক কিছু বলবার বা ভিন্নতা থাকলেও সেগুলো আনিনি। কারণ এতে কোন প্রসঙ্গকেই যথাযথ সময় ও বিচারে আনা যেত না। আমার এই প্রচ্ছন্ন বাসনা দিয়ে সম্ভবত বন্ধু সুমন রহমানকে ছুতে পেরেছিলাম। ওর লেখায় আলোচনা তোলার ধরণে আমার তাই মনে হয়েছে। সুমনের প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম, যেটা তরিকুল হুদা কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। শেষে অবশ্য এটাও আর আগায়নি, নানান প্রসঙ্গে ছড়িয়ে গেছে। এই অবস্হায় আমার প্রস্তাব এখানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে অনুরোধ রাখছি।

আরও অন্য কিছু কথা বলবার আছে। একটু সময় চেয়ে নিচ্ছি। আসছে সেগুলো।

২৩| ১৩ ই নভেম্বর, ২০০৮ ভোর ৬:১০

পি মুন্সী বলেছেন: আগের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক, এবার ফারুক ওয়াসিফের বক্তব্য প্রসঙ্গে কিছু খুচরা মন্তব্য করে এখনকার মত শেষ করব।

১। আমি মনে করি, যেকোন ঘটনা ব্যাখ্যা করতে আমাদের কেবল দেশীয় রাজনীতির এক্টর বা ফেনোমেনা বা এর কলাকুশলীর মধ্য নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখলে ঐ ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ বা ভুল হতে বাধ্য। একটা গ্লোবাল প্রেক্ষিতের কথা তাই অবশ্যই মাথায় থাকতে হবে। গ্লোবাল প্রেক্ষিতে স্হানীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আমাদের অর্জন করতে হবে, দেখার দৃষ্টি লাগবে। এমনকি আশির দশকে আমরা যতদূর ভাবতে পারতাম ঐ ভাবনার পুঁজি ভেঙ্গে আজকের ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করা যাবে না। ঐ ভাবনারও আপডেট লাগবে। ফারুকসহ সকলের আলোচনায় এই ধরণের ঘাটতিটা আছে বলে আমার মনে হয়েছে।
''বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট" বলে একটা ধারণার মাধ্যমে ফারুক তাঁর কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছে। উপরের কথাগুলোর প্রেক্ষিতে আমার দৃষ্টিতে ফারুকের এই ধারণাটা অসম্পূর্ণ। আশির দশকের "পেট্রোডলার" বলে কমিউনিষ্টদের হাতে গড়া একটা ব্যাখ্যা বা ধারণাটা ছিল - ''বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট" বলতে "পেট্রোডলার" এর বেশি ধারণাটা আর আগায় নাই। অথচ আমরা পছন্দ করি বা না করি, চাই বা না চাই নানান নামে, ধরণে ইসলামি রাজনীতি আজ একটা গ্লোবাল ফেনোমেনন আকারে হাজির। একে মোকাবোলা করার সক্ষমতা লাভ করতে চাইলে, নিজেদের চিন্তাকে অগ্রসর বলে দাবি করতে চাইলে প্রথমত, আমাদের অবশ্যই এই ফেনোমেনন সম্পর্কে একটা গ্রহণযোগ্য বাস্তব ব্যাখ্যা লাগবে। যেমন "বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্টের নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" এতটুকু ভাবতে পারা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই যথেষ্ট না। কারণ কেবল বাংলাদেশের ইসলাম এবং এদের নেতাদের সম্পত্তির দিক থেকে শ্রেণী বৈশিষ্ট দিয়ে আজকের গ্লোবাল ইসলামি রাজনীতি ব্যাখ্যা সম্পন্ন করা কী সম্ভব? বলা বাহুল্য, এটা প্রয়োজনের তুলনায় তখনও যেমন যথেষ্ট ছিল না আজকেও অবশ্যই নয়। তবু যথেষ্ট না মানলেও ফারুকের জায়গায় দাঁড়িয়ে ফারুকের ''বাংলাদেশের ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট" বুঝেছি, কাজ চালানোর জন্য ফারুকের শব্দাবলীই ব্যবহার করেছি।।

২। আমার ১২ নম্বর মন্তব্যের উত্তরে রিফাত বলছেন, আপনার মন্তব্যের প্রথম অংশের (অর্থাৎ সোশাল কন্ট্রাক্ট নিয়ে আমার কথার) "সাথে দ্বিমত পোষণের কোন কারণ নেই"। তবুও সে কেন "সোশাল কন্ট্রাক্ট" শব্দটা বেছে নিবার তাগিদ বোধ করেছে - এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। ওর ব্যাখ্যাটা আমি বুঝেছি, ওর প্রয়োজনটা উপলব্দি করে গ্রহণ করেছি। তবু রিফাতকে পরামর্শ রাখব, আগামিতে শব্দটা এড়িয়ে চলতে। যেমন, সামাজিক চুক্তির কথা না বলে রিফাত বলতে পারে, রাষ্ট্র নাগরিকের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজে গঠিত হয়েছে, গঠনতন্ত্রে বা কনষ্টিটিউশনে এর লিখিত প্রতিশ্রুতি আছে। পরে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, অপারগতা বা জরুরী আইন জারির নীট মানে হলো রাষ্ট্র আসলে নাই, নতুন রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলনই এখনকার কাজ -এভাবে। সার কথায়, রাষ্ট্র মানে একটা সামাজিক চুক্তি - এধরণের কোন অর্থ রিফাতের কথা থেকে যেন না দাঁড়ায় তা খেয়াল রাখতে হবে। আগেই বলেছি, রিফাত জানিয়েছে ওর, এর "সাথে দ্বিমত পোষণের কোন কারণ নেই" এবং আমি এটা গ্রহণ করেছি।
তো এখন ফারুককে আমার বলবার বিষয় হলো "রাষ্ট্র নাকি এক সোশ্যাল কনট্রাক্ট" একথা তুলে রিফাতকে বিব্রত বা হেস্তনেস্ত করার না করলেই ভালো। কারণ, রিফাত স্বীকার করছে, এই অর্থে কথাটা সে ব্যবহার করে নাই। নাগরিকের কাছে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কথাটাকেই (ভুল) শব্দ চয়নে সামাজিক চুক্তি বলে ফেলেছে। ফলে, আমার প্রস্তাব, - পরিভাষা বিষয়ক তর্ক, ভালো বিতর্ক করার জন্য এড়ানো ভাল। তবে, রাষ্ট্র সম্পর্কে ফারুকের আপত্তির কারণ আমি অনুমান করতে পারি। ফারুক ঠিকই জেনেছে, সমাজের শ্রেনী বিরোধের অমীমাংসেতার ফলাফল হলো রাষ্ট্র। এজন্য রাষ্ট্র মানে একটা সামাজিক চুক্তি - এই ছেঁদো কথা ফারুকের ভালো লাগার কোন কারণ নাই। তবে সমস্যা হলো ফারুকের জানা তত্ত্বীয় কথাটার ব্যবহারিক মানে কী, সেই ট্রানস্লেশন বা ব্যবহারিক ভাবান্তর লাগবে।
৩। লেখা পড়ে যতটুকু বুঝতে পারি, রিফাত ও ফারুক একই চিন্তার পরিকাঠামো অনুসরণ করে বড় হয় নাই। দুজনে একই চিন্তার পটভূমির উপর বেড়ে উঠে নাই। ফলে চিন্তার পরিভাষাগত একটা তফাৎ তো অবশ্যই আছে বা থাকবে। এই অবস্হায় পরস্পরকে মানা বা মানানোর জন্য নয়, পরস্পর কী বলছে তা ভাবান্তরে বুঝার (মানা নয়) একটা উদ্যোগ ঊভয় দিক থেকে থাকাটা গুরুত্ত্বপূর্ণ। সেই কাজে অগ্রগতির আগে তাঁদের উভয়ের অবস্হানে বিরোধ আছে বা তা শত্রুতাপূর্ণ - এটা আগাম ধরে নেওয়া জরুরি না; পরস্পরকে বুঝার পরেও বিরোধীতা বা শত্রুতা করা যেতে পারে।
৪। রাষ্ট্র কেমন করে গঠন হয় সে প্রসঙ্গে নিজের ধারণা বলতে গিয়ে ১৪ নমৃর মন্তব্যে ফারুক বলছেন, "রাষ্ট্র গঠিতই, সমাজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এবং তার ওপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সক্রিয় থাকবে বলে। সম্মতি আদায় বলপ্রয়োগেরই সহযোগি। রাষ্ট্রগঠনের পরে সেকারণে সামাজিক চুক্তি বলে হেজিমনি আরোপ করার চেষ্টা চলে। আমাদের কাজ হচ্ছে, রাষ্ট্রের ওই বলপ্রয়োগের ভিতকে উন্মোচন করা এবং তাকে নড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। রাষ্ট্র তুমি আমার সঙ্গে চুক্তি করে লঙ্ঘন করেছ বলে তোমাকে বেত মারব জাতীয় বিরোধিতায় বিপ্লবী রাজনীতির কাজ নাই। আমারো নাই"।
আমি এই কথা থেকে ফারুকের রাষ্ট্র সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারক পেয়েছি। রাষ্ট্রের উপস্হিতি সব না হলেও সমস্যার বড় একটা গোড়া - এমন একটা ধারণা ওখানে আছে। এছাড়া, ক) এটা গড়ে উঠার সময় থেকেই "সমাজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে" গড়ে উঠে। খ) আমাদের কাজ রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের ভিতকে উন্মোচন করা। গ) তাকে নড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। ইত্যাদি তো আছেই।
আমাকে ফারুকের ধারণাটা আরও পরিস্কার বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, আগামি তে। যেগুলো জানার চেষ্টা করব তা হলো, ১। রাষ্ট্র গড়ার কোন কর্তব্যের আমাদের আছে কী না? ফারুকের ধারণাটা কেমন? ২। যদি থাকে তবে, কেমন সে রাষ্ট্র? সেও কী তাহলে গড়ে উঠার সময় থেকেই "সমাজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে" গড়ে উঠবে? ৩। সেটাও কী বলপ্রয়োগের উপর বেঁচে থাকবে? ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। আমি মনে করি এসবের উত্তর আমাদের সবার জানা খুব দরকার। ফারুককে এখনই উত্তর দিতে বসতে বলছি না। হয়তো ফারুকের অন্য কোন লেখার ভিতর দিয়ে ওর আরও ধারণা পেয়ে যেতে পারি। তবে আগে যেভাবে বলেছি, আলাদা করে ছোট ছোট প্রসঙ্গ তুলে মনোযোগ দিয়ে তা করতে হবে।

বণ্ধু সুমনকে নিয়ে এর পরের প্রসঙ্গ শুরু করতে চাই। আজ এখানেই।

২৪| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:৫৮

প্রতিদিন বলেছেন: রিফাত ভাই, আপনের এই লেখাটি পইড়া হজম করতেছিলাম ১৫ দিন ধইরা। আপনের লেখার সাথে সাথে ফারুক ওয়াসিফের আজকে এই কালকে ঐ অবস্থান দেইখা আমারও বহুত রকম হাজত তৈরী হৈতেসিল, কোনটা লইয়া কই সেটি নিশ্চিত হৈতে গিয়া কমেন্টানোর সুযোগ পাইলাম না। যাই হউক, ফারুকরে দেইখা একখান ছড়া মনে হইতেসিল, মনিষী সুকুমার রায়ের।

ধেড়েটার বুদ্ধি দ্যাখ
চড় মেরে সে নিজের গালে
কে মেরেছে দেখবে বলে
উঠেছে গিয়ে টিনের চালে।

আপাতত সেইটা দিয়া লই। আশা করি ফারুক নারাজ হৈবেন না। পরে কথা কমুনে।

২৫| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:১৪

সুমন রহমান বলেছেন: উপরে পি মুন্সীর বক্তব্য পড়েছিলাম বেশ কয়দিন আগে। ফারুক ওয়াসিফ এর সাথে তিনি এনগেজ করেছিলেন, আমার সাথে এনগেজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। বুঝতে পারি, ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারছেন না। আমি মনে করি ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে এই তর্কটা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চলে এসেছে। এসব আলাপগুলো সেরে নিতে পারলে বাংলাদেশের "ইসলামী" র‌্যাডিক্যাল রাজনীতির সম্ভাবনা নিয়ে অনেক দরকারি বিষয় আমরা অবগত হতে পারবো।

আগাম ধন্যবাদ জানাই পরবর্তীতে পি মুন্সী এবং আরো যারা যারা এই ইস্যুটি এনগেজ করবেন তাদের সবাইকে। যেসব প্রশ্ন আমাকে তাড়িত করে চলেছে, আশা করি আপনাদের আলাপ থেকে আমি সেসবের উত্তর খুঁজে পাবো।

২৬| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:১৯

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন: হ্যাঁ, আমিও অপেক্ষা করে আছি। আলোচনার হাল দেখা যাচ্ছে পি মুন্সিই ধরেছেন। রিফাত হাসান হয়তো সময় পাচ্ছেন না। যাহোক, আপনার প্রশ্নগুলো বিষয়ে উত্তর এলেই বরং আমার কথা বলা ভাল। এই আলোচনাটার একটা পরিণতি পাওয়া দরকার।

আর @ প্রতিদিন, ভাল বলেছেন। তবে নিজের নামে নিজের কথা বলা শিখুন। নাহলে আপনার কথা মতো, ‌''‌কোনটা লইয়া কই সেটি নিশ্চিত হৈতে গিয়া কমেন্টানোর সুযোগ পাইলাম না।'' সেইটা আর পাইবেনও না।
ছড়াটা আমিই উদ্ধৃত করেছিলাম আপনার কোনো ভাইবেরাদরকে। তাতে যে ব্যথা পেয়েছেন বুঝতে পারছি। এখন সেই ব্যথার প্রতিকার কী আর আমার তোলা ছড়া আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হবে রে ভাই। জানেন তো পেছনে ব্যথা পেলে, সেই ব্যথার উপশম নিজে নিজেই করতে হয়। নইলে ব্যথার্ত পেছনটা যদি আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, দেয়া ব্যথা ফেরত নেন, সেটা নিতে পারি। তবে চিন্তা হচ্ছে, তা করতে গেলে যে আবার ব্যথা পাবেন! জানেন তো হাইকোর্ট করলেও সবকিছু ফেরত আসে না।

২৭| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:০৭

প্রতিদিন বলেছেন: জনাব ফা.ও, আপনে দু:খ পাইসেন দেহি। প্রত্থমে তার লাইগ্যা দরদ।

সুকুমার রায়ের ছড়ার পেটেন্ট আপনে লইয়া রাখসেন জানতাম না। তাইলে অন্য কোবতে ব্যবার করতাম। কীসব ব্যথাফ্যাথার কথা কইলেন, মন উজাইসে নেহি? হোমিওপ্যাথি লইয়া আমার একটা পোষ্ট আছে, খেয়াল কইরা পইড়া আইসেন। দুস্ক চইলা যাইবে বন্ধু।-তয় আপনেরে আমি চিনি না, আপনের লগে কুনো অতীত প্রেম নেই কইলাম, তয় অতিথীপনার কমতি নাইক্কা। মনীষী জসিমউদ্দীনের আর একখান কবিতা কইয়া তাই এইবারের লাইগ্যা ক্ষান্ত দিই। কথা হমুনে পরে।

আমার বাড়ি যাইয়ো ভ্রমর বসতে দিমু পিড়া
খইমুড়ি খাইতে দিমু বিন্নি ধানের চিড়া

২৮| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:২২

রিফাত হাসান বলেছেন: ফারুক ওয়াসিফ এবং প্রতিদিন দুজনকেই বলছি, ছেলেমানুষী ব্যক্তিগত আক্রমণ আলোচনাকে ভীন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে। দয়া করে কবির লড়াইয়ের চেয়ে জরুরী বিষয়গুলিতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেই কি ভাল নয়, এতে আমাদের আলোচনাটি ভাল গন্তব্য পাবে বলেই আমার বিশ্বাস। আশা করি সবাই সেকিদটায় খেয়াল রাখবো।

২৯| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৩৯

পি মুন্সী বলেছেন: আমাকে সময় দিয়ে অপেক্ষা করেছেন জেনে সুমন, ওয়াসিফ রিফাতসহ সকলকে ধন্যবাদ। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক এবার সুমনকে উসিলা করে প্রসঙ্গে যাচ্ছি।
ধরা যাক সিআইএর প্রোগ্রামে পরিচালিত সেবা সংঘ এ্যফিলিয়েটেড কোন বাংলাদেশি ট্রেড ইউনিয়ন দেশে খুবই শক্তিশালী একটা শ্রমিক সংগঠন, ফলে অনুমান করতে পারি ওর নেতারা সবাই কেমন সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্তের হবেন। এখন ওর অধীনস্ত শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিচার কেমন নিব? নেতারা সম্পত্তিবান বলে এই বিচারে "দরিদ্র শ্রমিকদের কথা কী আমরা ভাবা বাদ" দিব? এই সংগঠনের তৎপরতাকে সামগ্রিক একক সম্পত্তিবানদের কাজকারবার বলে বুঝে শ্রমিকদের "কথা বিবেচনা বাদ" রাখব? না কী কী সুনির্দিষ্ট বৈষয়িক কারণে ঐ শ্রমিকেরা ওটা তাদের নেতা বলে মানছে সেটা বুঝার চেষ্টা করব, শ্রমিকদের বের করে আনার ভাবাদর্শগত সংগ্রাম, পদক্ষেপ ইত্যাদি নিব - করার কর্তব্যবোধ করব? নিশ্চয় পরেরটাই করব।
এই দিক থেকে বিচারে ওয়াসিফের ইসলামি নেতাদের সম্পত্তিবান অর্থে শ্রেণী বিচার কাঠিতেই একে মেনে নিয়ে রিফাত প্রশ্ন তুলে বলছেন, তাহলে মাদ্রাসা ছাত্ররাও তো দরিদ্র, তাদের নিয়ে আমাদের কর্তব্য নিশ্চয় আছে। সেদিকে আমরা মনোযোগ দিতে হবে।
রিফাতের কথাকে আমি যদি আরও পজিটিভলি নেই, তাহলে দাঁড়ায়, এটা আমাদের রাজনীতিতে স্রেফ 'পশ্চাদপদ' ইসলামি রাজনীতির উকিঝুকি বা আনাগোনার তুচ্ছ সমস্যা বলে মেনে একে রাজাকার বলে মোকাবোলা করার বিষয় নয়। একে শক্ত মোকাবোলার লক্ষ্যে বড় প্রেক্ষিতে বললে ইসলামের সাথে গোড়া ধরে একটা এনগেজমেন্টে, পর্যালোচনায় আমাদেরকে যেতেই হবে। এটা নেহায়েতই রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধ বলে ঐ সীমার মধ্যে বেধে ভাববার মত কাজ নয়।
এই ব্লগে মোহম্মদ আরজু নামের নিক কোন এক পোষ্টে আমিনীর মত নেতাদের সাথে মাদ্রাসা ছাত্রদের সম্পর্ক নিয়ে একটা ইঙ্গিত দিতে দেখেছিলাম। কারা মাদ্রাসায় ভর্তি হতে আসে? মৌলবি হুজুররা কাদেরকে ছাত্র হিসাবে পায়? - সে প্রসঙ্গে।
মাদ্রাসায় রিক্রট বা এনরোলমেন্টটা প্রসঙ্গে ব্যতিক্রমীগুলোকে বাদ দিলে, মূলধারার বেশিরভাগে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তা তাৎপর্যপূর্ণভাবে লক্ষণীয়। গরীব বাবা-মা, স্বামীহারা মায়ের সন্তান, এতিম বাচ্চার মুরুব্বি - সমাজের মার্জিনাল অংশে যাদের বসবাস - সংসারের খাওয়াপড়া যোগাতে যে হিমশিম, বাচ্চার পড়ালেখা ওখানে অনেক দূরের বিষয়। অনেকে লক্ষ্য করেছেন কী না জানিনা; গরীব মানুষদের কাছে মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ওখানে থাকাখাওয়ার একদম ফ্রি বন্দবস্ত আছে। ফলে দরিদ্র মানুষদের ভাবনায় একদম ভুল নেই, কেন সে বাচ্চাকে মাদ্রাসায় দিবে। বাচ্চার থাকাখাওয়ার বন্দবস্ত ওখানে হবে, সেই সাথে আল্লার নামাজ কালাম কোরান পাঠে যদি কিছু এলেম হয়, কিছু যদি মানুষ হয় - এটা তো উপরি পাওনা, বিশাল ব্যাপার। এরপর সমাজের স্রোতে নিজের একটা জায়গা সে করে নিতে পারবে নিশ্চয় - এই হলো তাঁর বিশ্বাস। এছাড়া বস্তি বা অল্প আয়ের সমাজের পরিবেশে কু-সঙ্গ থেকে বাঁচিয়ে বাচ্চা মানুষ করা কত কঠিন তাও তাঁর জানা হয়ে গেছে। উল্টো দিকে দেখুন, কোন্‌ বাবা মা না বুঝে - ভালো পড়ালেখার, ভালো ইস্কুলের সাথে ভবিষ্যতে বাচ্চার করে খাবার সম্পর্ক কত গভীর। তবে এটা আবার তাঁর সামর্থের প্রশ্ন, বাচ্চার পিছনে অর্থ বিনিয়োগের সামর্থ। ফলে সামর্থ ও নাগালে পাওয়া সম্ভব এমন সুযোগ অনুযায়ী অর্থাৎ কাপড় অনুযায়ী কোট কাটার পথ সে নেয়। ওকে বোকা ভাবার কোন কারণ নাই। ফলে একটা মাদ্রাসা খুললে তার জন্য ছাত্র পাবার মত অবস্হা সমাজে একদম রেডিমেড। এধরণের মাদ্রাসা মক্তব খোলার প্রয়োজন ও ছাত্র পাওয়ার অবস্হা - এই ব্যবস্হা সমাজে বহু পুরানো। মূলত সমাজের হীতকারীদের দানে মাদ্রাসাগুলো চলতো। এটা ছিল সমাজের প্রচলিত দাতব্য উদ্যোগগুলোর একটা ধরণ। তবে এর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে একালে এনজিও কালচার, রাষ্ট্র ব্যবস্হায়। ঠিক বোধহয় তাও নয়, এই কালচারটা টাকা সংগ্রহের ও প্রদানের একটা উপায় বড়জোড়। আর সংগ্রহের ও প্রদানের মত পরিস্হিতি ও শর্ত হাজির হওয়ার কারণটা আমাদের সমাজের বাইরের, যখন দেশের বাইরে থেকে কেউ টাকা দেবার তাগিদ বোধ করেছে।
এবার, মওলানা মৌলবি যারা মাদ্রাসা খুলছেন তাদের দিক থেকে দেখব। এতক্ষণের বর্ণনাটা কিছুটা ওয়াসিফের মত একটা অর্থনৈতিক প্রকরণ (category) মেনে করা, তাও আবার ছাত্র বা অভিভাবকের কনসার্ন - এই দিক থেকে দেখে। শ্রেণী রাজনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণভাবে দেখা দেখানোর প্রয়োজনে।
আগের লেখায় ওয়াসিফকে কথা দিয়েছিলাম আজকের দিনে একটা গ্লোবাল প্রেক্ষিতের কথা মাথায় না থাকলে ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ বা ভুল হতে বাধ্য। তাই মওলানা মৌলবি যারা মাদ্রাসা খুলছেন তাঁদের দিক থেকে এবার কথা পাড়ার সময় এই দিকটা খেয়াল রাখব। একটু সমস্যা হয়ে গেছে, এই লেখা ইতোমধ্যেই কলেবরে বড় হয়ে গেছে। ফলে আপাতত শিরোনামে বলবে। পরে প্রশ্নোত্তরে মন্তব্যে প্রয়োজন মত বিস্তার করব।
এটা অনেকটা কর্মচারির মনে সুপ্ত দোকান মালিক হওয়ার স্বপ্নের মত। মাদ্রাসা বোর্ড থেকে আলিম, ফাজিল বা আরও অন্য কিছু পাশ করা লোকটা বা স্বাধীনের পর ইসলামি রাজনীতি করা লোকটা সমাজে কোথায় নিজেকে নিয়োজিত করবে, পেট বাঁচাবে? কী সে পারে যার বিনিময়ে সমাজ তাকে একটা পেশা দিবে? ভাবছে, মাদ্রাসা দিতে পারলে ভাল হত। তবে দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসা চালানোর মত লোক সমাজে ছিল কিন্তু তা খুব একটা লোভনীয় জুতসই পেশা ছিল না।

আমাদের এবার তাকাতে হবে ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের দিকে। না, ইরানী বিপ্লব কত ভাল একটা বিপ্লব ছিল তা ফেরি করতে নামতে বলছি না। বিশ্ব ইতিহাসকে নতুন আকার দিতে, গতিপথ, অভিমুখ ঠিক করে দিতে এই বিপ্লব কী প্রভাব ফেলেছিল সেদিকে নজর করাতে চাইছি। পঞ্চাশের দশকে জামাল নাসেরের আরব জাতীয়তাবাদের তোলপাড় উত্থানের পর এই প্রথম ইসলামি সমাজে একটা বড় ধাক্কা লেগেছিল এতে। অর্থনৈতিক চরিত্রের দিক থেকে জাতীয়তাবাদী আবার স্পিরিটের দিক থেকে ধর্মীয় ফলে একটা ইসলামি লেবাসও আছে এই বিপ্লবের। তবে, এই ধাক্কা ইরানী সমাজে যা ঘটিয়েছে তার চেয়ে বড় ঘটনা হলো ইরানের বাইরে এই ঘটনার প্রভাব প্রতিক্রিয়া। আরব বিশ্বে সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া ঘটে শিরোমনি সৌদি আরবে, রাজতন্ত্রে। রাজতন্ত্রকে এই আঁচ থেকে রক্ষা করতে প্রথমেই শিয়া-সুন্নির আওয়াজ তুলে একে শিয়া বিপ্লব লেবেল লাগিয়ে বলা হল এটা শিয়া বিপ্লব, অর্থাৎ আমাদের সুন্নিদের জন্য না। সেই সাথে বাদশাহ সৌদি রাষ্ট্রের পক্ষে ভাবাদর্শ তৈরিতে বিদেশে মুসলিম দেশগুলোতে প্রচার চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রচার কাজের টাকা বাংলাদেশে নতুন করে মাদ্রাসা জেগে উঠার অর্থনৈতিক ভিত্তি দেয়। এই ঘটনা মাদ্রাসা মালিককেন্দ্রিক ইসলামি রাজনীতিক উত্থানসহ আরও বহু কিছু ঘটিয়েছে, মাদ্রাসার ছাত্ররা যে রাজনীতির রিজার্ভ ফোর্স। ঐ একই সৌদি প্রোগ্রাম পাকিস্তানেও চলেছে। তবে পাকিস্তানের দিকে তাকালে মনে হয় অন্তত একটা ক্ষেত্রে আমরা বেঁচে গিয়েছি। আমাদের দেশে শিয়া জনগোষ্ঠি খুবই কম। পাকিস্তানে বড়, ফলে মাদ্রাসা মসজিদ গড়তে গিয়ে সৌদি ও ইরান রাজনীতির লড়াই পাকিস্তানের মাটিতে ঘটেছে, একে অপরের মসজিদে হামলা, বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে, এখনও চোরাগোপ্তা ঘটে। বাংলাদেশে এটার প্রভাব মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিতে ছোঁয়া লাগলেও এই প্রচারটা হয়েছে অনেকটা হুইসপারিং ক্যাম্পেনের মত। যেমন হঠাৎ আমরা আবিস্কার করেছি, আমরা আর খোদা হাফেজ না বলে আল্লাহ হাফেজ বলছি, রেডিও টিভিও বলছে। কেউ হয়তো খেয়ালই করিনি ঘটনাটা। ১৯৭৫ এর পর জামাতে ইসলামীর রাজনৈতিক পুনর্বাসন যেটা ঘটেছে, আমরা বেখবর বলে যেটাকে জামাতের ৭১ এর আগের রাজনীতি মনে করি, এটা সম্ভব হয়েছে সৌদি প্রোগ্রামের কারণে। বলা যায় সৌদিরা জামাতের ৭১ এর রাজনীতির দায়দায়িত্ত্ব না নিয়ে তাদের নতুন রাজনীতি প্রচারের দায়দায়িত্ত্ব দিয়েছে। এটা গিলতে জামাতের কষ্ট হয়েছে। আব্দুর রহিমকে IDL (১৯৭৫ এর পর জামাত প্রথম যে নামে রেজিষ্টেশন নেয়, আত্মপ্রকাশ করে) থেকে বের করে দিতে, ঢাকা ডাইজেষ্ট পত্রিকা দখল, মওলানা জব্বারের নেতৃত্বে ইরানী লাইনের অনুসারিদের বের করতে, ছাত্রশিবিরের সভাপতি আব্দুল কাদেরকে সরাতে - এরকম বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বেরিয়ে এরা পরে খেলাফত আন্দোলন, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন অনেক কিছু করেছে। ওকথা এখন থাক। যেটা এখন প্রাসঙ্গিক তা হল আমরা এই বিশ্ব ঐতিহাসিক বদল টাকে (কেন বিশ্ব ঐতিহাসিক বললাম তার বিস্তার এখন করতে পারছি না, তবে বলে রাখি এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট যা আজ ঘটনা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আল-কায়েদা রাজনীতি পর্যন্ত এসেছে) আমলে নেই নাই, বুঝিওনি। বড়জোড় বুঝেছি '৬০ এর দশক থেকে তেল বেচা টাকার কারণে (পেট্রোডলার) সৌদিদের ইসলামি রাজনীতিতে একটা প্রভাব আছে।

সৌদিরা তাদের কাজ করেছে, জামাতের পুনর্বাসিত হতে চেয়ে যা করলে সম্ভব তাই করেছে। প্রশ্ন হল, ১৯৭৫ এর পর ইসলামি রাজনীতি আবার জামাতে ইসলামিসহ নানান ইসলামি দলের মাধ্যমে আমাদের সমাজে জায়গা করে নিতে পারল কেন? নিশ্চয় কোনভাবে সমাজে ওদেরকে, ওদের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার বাস্তব পরিস্হিতি ভাল ছিল, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু কেন ছিল এবং আছে - এর উত্তর আমরা খুঁজে দেখিনি। রাজাকার গালির তোড়ে আর কার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি - এসব মামুলি পরিচিত দিক থেকে আমি প্রশ্নটা করিনি। কারণ জামাতকে বিচারে ফাঁসিতে লটকে দিলেও কমবেশি একইভাবে ইসলামের মুখোমুখি আমাদের হতেই হতো। এই বস্তুগত ভিত্তিটা হলো, আমরা ১৯৭১ এ ধর্মের ভাবাদর্শগত মোকাবোলা করে মুক্তিযুদ্ধ করিনি (করতে পারলে ভাল হতো তবে এটা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছারও বিষয় ছিল না)। ধর্মের নামে একটা বিভৎসতা আমরা দেখেছি মাত্র। এতে ধর্মের ভাবাদর্শগত মোকাবোলা হয়ে যায়নি। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, এতে ধর্ম কী তা জানা জানানো হয়নি। আইনের উৎস কী? আমাদের নতুন সমাজে আইনের উৎস কী হবে? কেন ধর্মীয় না হয়ে মানুষ হবে, আমরা জানি না। মানুষ অর্থাৎ নাগরিক নাকি আইনের উৎস বলে আমাদের কনষ্টিটিউশনে লেখা আছে। অথচ আমাদের সমাজের সাধারণ ধারণায় এটা প্রতিষ্ঠিত নয়। আল্লার আইন চাই বা কোরান আমাদের সংবিধান কেউ দাবী করলে আমরা ভেবাচাকা খেয়ে যাই। মুখ দিয়ে কথা ফোটে না। কেবল রাজাকার বলে গালি বের হয়। কার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি তা নিয়ে রীতিমত ফাটাফাটি। কেউবা অষ্ফুট স্বরে ভদ্রভাবে বলি ওটা পশ্চাদপদ, মধ্যযুগীয় চিন্তা। কেউবা গলা ফাটিয়ে বলি আমি ধর্ম মানি না, আল্লা মানি না। এতে সমাজের ভাবান্তর হয়না। বরং ইসলামিষ্টরা মজা পেয়ে প্রচার চালায়, নাস্তিকদের কান্ডকারখানা দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আরও খেপিয়ে তোলার কাজটা আরামের হয়।
ফলে সুমনের যে প্রথম প্রশ্ন, ১. দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্ররা গত চার দশক ধরে তাদের সাথে লটকে থাকা লুম্পেন নেতৃত্বকে কখনো ক্রিটিক্যালি দেখেছে কিনা, -- এর উত্তর হবে না, দেখছে না। কারণ ক্রিটিক্যালি দেখার মত ধর্মকে পর্যালোচনা করে দেখার মত ভাব, মোকাবোলা সমাজে নাই বা এমন প্রবল নয় যে এর আছর তাঁর উপর পড়ছে বা পড়বে।
ধর্মের পর্যালোচনা বা মোকাবোলা নিয়ে উপরে অনেক বার কথা তুলেছি। বিমুর্ততা ভেঙ্গে এটা কেমন হতে পারে হাতের কাছের, Click This Link এই পোষ্ট টা দেখুন। আমার ভাল লেগেছে। ষ্টাইলটা ভাল। মানে এটাই আদর্শ তা বলছি না। কিন্তু দেখলাম প্রায় কেউই কোন মন্তব্য করেনি। হয়ত ধর্ম বিষয়ক পোষ্ট মনে করে, ধর্ম নাম শুনেই ভেগেছে। ধর্ম নিয়ে কথা বলার কাজ মৌলবিদেরকে একচেটিয়া দিয়ে দিলে তো এমনই ঘটার কথা।
যেকথা বলছিলাম, ঐ মাদ্রাসা ছাত্রদের কাছে অনুমান করতে পারি, আমরা হয় নাস্তিক, নয় বুশের চর, নয় দিকে দিকে ইসলামের জাগরণের কালে কানে সীসা ঢেলে মোহর মারা মানুষ। ভাবছে, মুসলমান আর খৃষ্টানে ধর্মযুদ্ধের লড়াই শুরু হয়ে গেছে অথচ আমরা বুঝতে পারছি না।
দেখা যাচ্ছে, আমাদের থেকে ওদের পর্যন্ত এক বিস্তর ফারাক, এক উপসাগরের দূরত্ত্ব। এই দুরত্ত্ব ঘুচাতে না পারলে আমাদের কোন সম্ভাবনা নাই বলেই আমার ধারণা।
একটা ছোট্ট প্রশ্ন দিয়ে এখন শেষ করব, সুমনের উত্তর শেষ হ্য় নাই। আবার আসছি।
ধরা যাক আমেরিকান এ্যমবেসী একটা জরিপ কাজ করেছে বাংলাদেশের স্হানীয় এক তথ্য সংগ্রাহক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কাজটা হলো সব কওমি মাদ্রাসাগুলোর উপর। ওর সারাদিনের পাঠ্যসহ অন্যান্য কার্যক্রম কী চলে, কখন কোনটা করা হয়, কী পড়ানো হয়, অবসরে কী করে ইত্যাদি সব। এই বর্ণনা শুনে আমাদের মনে হতে পারে এতো সব নির্দোষ ব্যাপার, ঠিকই তো করছে। তাহলে এবার পরেরটুকু শুনুন। প্রতিটা মাদ্রাসার ভৌগলিক অবস্হানও GPS দিয়ে তারা সংগ্রহ করেছে। কেন? সন্দেহ হলে বা না হলেও ড্রন দিয়ে হামলা যাতে করতে পারে। এই হামলা হলে আমরা কী করব?

মতিউরের মত খুশি হব? জারদারির মত লুলা হাতপা ছুড়ে সার্বভৌমত্ত্ব লঙ্ঘনের অক্ষম কথা তুলব? চেয়ে চেয়ে দেখব আমরা কীভাবে আফগানিস্তান পাকিস্তান হয়ে যাব? নাকি অন্য কিছু?

৩০| ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৪৮

রিফাত হাসান বলেছেন: আর একটি বিষয় পরিস্কার করা দরকার মনে করছি। তার আগে সুমন রহমান, পি মুনশি, ফারুক ওয়াসিফ, তরিকুল হুদা এবং অন্যান্য যারা এ আলোচনায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেওয়াটা আমার কর্তব্য। আমি সবার মন্তব্যগুলি খুব আগ্রহ সহকারে পড়ছি। এবং সময় নিচ্ছি। তাই, উত্তর দেয়ার চেয়ে আপাতত সবার আলোচনাগুলি পড়াকেই পছন্দ করছি। আরো কিছুদিন চলুক না। আমিও অংশগ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ, আমি মনে করি, সবার অংশগ্রহণ আলোচনাটাকে একটা ভাল গন্তব্য দিবে। এক্ষেত্রে উপরে সুমন রহমানের মন্তব্যটি আমাদেরকে আগ্রহী করে তুলছে নিঃসন্দেহে।

১৭ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:২৪

রিফাত হাসান বলেছেন: এই মন্তব্যটি লিখতে লিখতেই উপরে পি মুনশি মন্তব্য করেছেন দেখি, তাঁকে ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

৩১| ১৭ ই নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ৭:০৩

পি মুন্সী বলেছেন: এবার শুরু করবো শ্রেণী বিষয়ক জটিলতাকে নিয়ে, এর ভিতর দিয়ে গভীরে যাব।
সুমন বলছিলেন, "শ্রেণী কনসেপ্টটা সবসময়ই ঝামেলাজনক। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শ্রেণী যেমন আছে, সাংস্কৃতিক শ্রেণীকরনও সমাজে হয়ে থাকে"।
আবার তরিকুল হুদা বলছিলেন,"এই তর্কে দরিদ্র বা সম্পত্তিবান তথা অর্থনৈতিক অর্থে যদি 'শ্রেণী' বুঝানো হ্য় তাইলে তো মুশকিল"।

আজকালকার পরিস্হিতিতে পুঁজির গ্লোবাল হাজিরার দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে বললে, পুঁজি আপনাকে যে বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক অবস্হায় রেখেছে এর বিরুদ্ধে, মানে পুঁজির ঠিক করে দেওয়া অবস্হানের বিরুদ্ধে আপনি নিজেকে ফিরে পেতে যা হয়ে উঠতে চাইছেন ওখানে আপনি রাজনৈতিক শ্রেণী। সাধারণভাবে বললে, নিজের বৈষয়িক সত্ত্বা বা একজিসটেন্স এর উর্ধে উঠে প্রজ্ঞা অর্থে স্পিরিচুয়াল (spiritual) মানুষ হওয়াটাই রাজনৈতিক শ্রেণী। ফলে স্পষ্টভাবে সে সচেতন ও লড়াকু সত্ত্বাও বটে। তাই বিপ্লবী মাত্রই স্পিরিচুয়াল (spiritual) মানুষ। অন্যেরা বৈষয়িক সত্ত্বার অধীনস্ত হয়ে অনুগামি সক্রিয় তৎপর বলে তার অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সত্ত্বা একাকার, এর মধ্যে কোন ভিন্নতা নাই। স্পিরিচুয়াল (spiritual) মানুষও সে নয়। ধর্মতাত্ত্বিক অর্থে অনেক মাওলানা মৌলবিকে স্পিরিচুয়াল (spiritual) বলে দাবী করা হয় অবশ্য, যেটা এক রহস্য, এর উর্ধে কোন মানে করে না।

সুমন "সাংস্কৃতিক শ্রেণীকরণ" বলতে কী বুঝিয়েছে আমি বুঝিনি।
তবে, শ্রেণী ব্যাখ্যায় দুইটা বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। ১. ইকোনমিক ডিটারমিনিজম: সবকিছুকে অর্থনৈতিক শ্রেণী বা ক্যাটাগরিতে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। ইকোনমিক অবস্হান সবসময় রাজনৈতিক অবস্হানের সাথে সামজ্ঞস্য মেনে চলে না, সবটা ব্যাখ্যাও করতে পারে না। ফলে ঘটনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ইকোনমিক ডিটারমিনিজম পরিহার করতে হবে। যেমন, "ইসলামী স্ট্যাবলিশমেন্ট নেতারা সবাই সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" এই বয়ানের মধ্যে ইকোনমিক ডিটারমিনিজমের ঝোঁক আছে। মূলত সমস্যাটা "সম্পত্তিবান শ্রেণীভুক্ত" বলার ভিতরে। সম্পত্তি দিয়ে শ্রেণী মাপতে যাওয়া যাবে না। সম্পত্তির বিভিন্ন রূপ দিয়ে উৎপাদন সম্পর্কের রূপ বদল ধরা যায় কী না - এটা মার্কসের ষ্টাডির একটা বিষয় ছিল। আবার সম্পত্তি বলতে সম্পত্তি সম্পর্কের রূপ বুঝতেন তিনি, ফলে সম্পত্তি মার্কসের কাছে কোন অর্থনৈতিক ক্যাটাগরি নয়, দার্শনিক বা অর্থশাস্ত্রীয় (political economy) ক্যাটাগরি। সেই অর্থে মার্কসের শব্দ ব্যবহারে কোন কিছুই ইকোনমিক ক্যাটাগরি নয়। শব্দ একই, তাঁর সময়ে ব্যবহৃত মূলধারার ইকোনমিক ক্যাটাগরি কিন্তু তিনি তাঁর দেখার দৃষ্টিভঙ্গীর (political economy) কারণে নতুন ও প্রকৃত অর্থ দিচ্ছেন। ।
২. পুঁজির গ্লোবাল উপস্হিতির কারণে এর প্রভাবকে বিবেচনায় না নিয়ে স্হানীয় শ্রেণী, এমনকি রাজনৈতিক শ্রেণী দিয়েও ঘটনার কোন হদিশ বা ব্যাখ্যা করা যাবে না, মেলানো যাবে না। যেমন, পরাশক্তির সৎ প্রার্থীর আন্দোলন বা দূর্নীতির রাজনীতি বিবেচনায় না নিলে দেশের রাজনৈতিক কলাকুশলীদের তৎপরতা ব্যাখ্যা করা যাবে না। মনে হবে ভালই তো দূর্নীতি মুক্ত করার কাজ করছে ফকরুদ্দিন। পুরো ঘটনাই যে বিশ্বব্যাংকের করানো এডিবি এর একটা এ্যান্টিকরাপশন ও গুড গর্ভনেস প্রজেক্ট, আর ওয়ার এন্ড টেরর এর রাজনীতি একটা মিশাল তা জানা যাবে না। এ'আবার এমনই এক প্রজেক্ট যার প্রজেক্ট ডিরেক্টর যেন খোদ রাষ্ট্রের বসায়ে দেওয়া প্রধান নির্বাহী ফকরুদ্দিন। এটা কোন প্রতীকি বা ঠাট ঠমকে বলা কথা বলছি না, সত্যি সত্যিই এই প্রজেক্টের থার্ড ফেজ শুরু হয়েছে নভেম্বর '০৮ থেকে, শর্ত মেনে মূল্যায়ন রিপোর্ট দিয়ে টাকা ছাড় করানো হয়েছে ঠিক যেমন হয়ে থাকে কোন প্রজেক্টের বেলায়। এই প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করছি।

এরপর ভাস্কর্য ইস্যুতে কিছু নোতকা। পরে আপনাদের প্রতিক্রিয়া মন্তব্য সাপেক্ষে শ্রেণী সংগ্রাম আর সুমন আবার দেখি "ইসলামী" র‌্যাডিক্যাল রাজনীতির সম্ভাবনা নিয়ে কথা তোলার যে আগ্রহ নিয়ে বসেছে - তা নিয়ে কথা বলতে পারি।

ভাস্কর্য: সমস্যার গোড়া ধরে বললে, ধর্ম মানে ধর্মতত্ত্বের সাথে আমাদের পর্যালোচনা বা মোকাবিলা না হওয়া সংক্রান্ত সংকট। আগে ইঙ্গিতে বলেছি ১৯৭১ এ এটার কিছুই হয় নাই। অথচ ভেবেছি আমরা আধুনিক হয়ে গেছি, আসলে নকল করেছি, ধর্মকে চাঙ্গে তুলে বা পাশ কাটিয়ে ধর্ম মানি না বলতে পারলেই আমার আগাতে পারব ভেবেছি।

ফলে সংস্কৃতিতে শিল্পকলার প্রসঙ্গে এসে ধরা খেয়ে গেছি। তবে, বলে নেয়া ভাল এখন যেভাবে ভাস্কর্য বিতর্ক এসেছে এটা বর্তমান শাসকদের পলিটিক্যাল এজেন্ডায় মটিভেটেড উস্কানিমূলক কাজ। সেই সাথে ইস্যুটাকে তাঁদের একটা পরীক্ষা করে নেওয়া হয়ে গেছে - আগামিতে পরাশক্তির কাজে বিভেদ জাগাতে এটাকে কতদূর ব্যবহার করা যাবে। তবে অবশ্যই বলতে হবে এটা যতদূর ব্যবহার করতে পেরেছে এটা প্রমাণ করে সমস্যা কত গভীর, কাজ কত বাকী রয়ে গেছে।
একটা প্রশ্নের ধাঁচে উত্তর দেবার চেষ্টা করি। সংস্কৃতিতে শিল্পকলার প্রসঙ্গে এসে ধরা খেল, বিরোধ উদোম হয়ে পড়তে দেখছি আমরা। অথচ, ইসলামি রাজনীতির যে যুক্তি আমরা ভাস্কর্যের বেলায় দেখছি গানের ক্ষেত্রেও তো একই বিরোধ সংঘাত দেখতে পাওয়ার কথা, নয় কী? দেখি না কেন? ভাবতে থাকুন।
অন্য আর দিকে দেখি। নজরুল হামদ, নাদ লিখেছিলেন, সুর দিয়ে গেয়েছিলেন। যেটা আজকের চোখে দেখা সংস্কৃতিতে টিভিতে রমজান মাসে, বা ধর্মীয় বিশেষ দিনে বা প্রত্যেক চ্যানেলের ইসলামি প্রোগ্রামগুলোতে একছত্র ও ওতপ্রতভাবে আত্মস্হ হয়ে গেছে। যেন এটা টিভির যেকোন ইসলামি প্রোগ্রামের অনুসঙ্গ। ওটাকে আর আমাদেরই কাছের বাঙালি নজরুলের কাজ না, যেন ওটা আরব ইসলামের সংস্কৃতি, ফলে ওকে আলাদা ভাবা যায় না। অথচ এই নব্বুই দশক পর্যন্ত দেখেছি আমার অনেক কমিউনিষ্ট বন্ধু নজরুলের এসব কান্ড পারলে অস্বীকার করে, লজ্জা পায়। আর একটা তথ্য দেই, নজরুল, আব্বাসউদ্দিনের গ্রাম বাংলায় বিখ্যাত হবার অন্যতম একটা কারণ ছিল, গ্রামে মুসলিম লীগের জনসভা বা ভোট চাইবার সভা শুরু হবার আগে ফজলুল হক বা সোহরওয়ার্দ্দি মত নেতাদের ষ্টেজে বসানোর পর তাঁরা দুই গায়ক হামদ নাদ গাইতেন। একবার কোন এক নেতার (নাম মনে পড়ছে না, আবুল হাসিমও হতে পারেন) এক গান এত ভাল লেগে যায় যে পরপর দুবার একই গান গাইতে হয়েছিল। আব্বাসউদ্দিনের স্মৃতি কথা বইয়ে এর বিস্তারিত আছে।
গান গাওয়া বা শোনা হারাম - এই বিশ্বাস ভেঙ্গে গ্রামের মানুষকে বাইরে আনার জন্য আল্লাহ'র গুনগান সম্বলিত (হামদ নাদ মূলত তাই। ভজনও দেবদেবীর ভজনামূলক গান, ফলে ওখান থেকে আইডিয়াটা পেয়ে থাকতে পারেন। ) গান লিখে সুর করে দুজনে গাইতেন যাতে মানুষের ভুল ধারণা ভাঙ্গে, আবার আল্লাহ'র গুণগান বলে আপত্তির সুযোগ নাই। দেখা যাচ্ছে ৪৭ এর আগে মুসলিম লীগ শুধু পাকিস্তান আন্দোলনই করেনি ওর ভিতর একটা সাংস্কৃতিক দিকও ছিল। নজরুল আব্বাসউদ্দিনকে গানের লড়াই কোন স্তর থেকে শুরু করতে হয়েছিল সেসব আজকের আমরা বুঝতে চাইনি। আমাদের আধুনিক প্রগতিশীল মন এতটাই নিষ্ঠুর নির্মম যে রেডিমেড সব কিছু পেয়ে ঐ কষ্টের ব্যাথাও অনুভব করতে শিখিনি, উল্টে নজরুলের হামদ নাদের কান্ডে লজ্জা পেয়েছি, নজরুল প্রগতিশীল ছিলেন কী না এনিয়ে বিস্তর তর্কের ঝড় তুলেছি, আমরা এমনই প্রগতিশীল, সেক্যুলার!
নজরুল আব্বাসউদ্দিন আমাদের টিভি মিডিয়াকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছেন। নইলে নিষ্প্রাণ ধর্মকথা আলোচনা করতে গিয়ে মিডিয়াকে অস্তিস্তের সঙ্কটে পড়তে হত। এদানিং দেখি, আরও সংযোজন, হামদ নাদ ক্লাসিক স্বরে রাগ মিশিয়ে পেশাদার ক্লাসিক গায়ক দিয়ে গাওয়া হচ্ছে, খুবই ভাল কথা।
তাহলে আমার কথার মানে দাঁড়ালে, গানের জগতের মোকাবিলাটা পাকিস্তান আন্দোলনের আমলেই (৪৭ এর আগে) সেরে ফেলা হয়েছিল বলেই আজ আর কোন মারামরি নাই। আজ আপনি চাইলে, নাচানাচি করে বেসুরে বা উচ্চস্বরে দেশ বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহকারে যা মনে চায় করতে পারেন। আফগান বীরযোদ্ধাদের গানও আপনি শুনতে পারেন।
দুঃখ শুধু নজরুল আব্বাসউদ্দিনের লড়াইয়ের কথা কেউ জানে না।

তাহলে ভাস্কর্য নিয়ে এখন আমাদের উপায় কী? একটা বোধহয় হতে পারে নজরুল কেন ভাস্কর্য শিল্পী হলেন না এনিয়ে আমরা আপশোষ করতে পারি। তবে সেক্ষেত্রেও আবার আমাদের নজরুল আব্বাসউদ্দিনের লড়াইয়ের কথা জানতে হবে, লজ্জামুক্ত হতে হবে।

৩২| ১৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৯:৩৭

সুমন রহমান বলেছেন: পি মুন্সীকে ধন্যবাদ তাঁর দীর্ঘ এবং সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য। নানান বিষয় উঠে এসেছে এই মন্তব্যে, যা থেকে আমরা এ দেশের ইসলামী রাজনীতির ভূত ভবিষ্যত নিয়ে একটা কার্যকরী আলাপ দাঁড় করাতে পারি। দীর্ঘ মন্তব্য তাঁর, যে কোনো বিচারে একে সংক্ষেপিত করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবু, আলোচনার সুবিধার্থে পি মুন্সীর মন্তব্য থেকে কিছু পয়েন্ট তুলে ধরি এবং এ নিয়ে আমার আলাপটি চালানোর চেষ্টা করি:

১. যেমনটা আমি ভেবেছিলাম, এবং রিফাতকে প্রশ্ন করেছিলাম, যে গত চার দশকে ইসলামী রাজনীতি তার বিদ্যমান নেতৃত্ব নিয়ে কোনো না কোনোভাবে ক্রিটিক্যাল হয়েছিল কিনা। পি মুন্সী পরিষ্কার ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দিয়েছেন সেটা হয় নাই। কেন হয় নাই এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যায় আমার দ্বিমত নাই। এখন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা, এই যে আনক্রিটিক্যাল মাস, তাদের রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা কিভাবে দেখবো?

২. পি মুন্সী আমাদের মাদ্রাসাগুলোর পলিটিক্যাল ইকোনমি মার্কসীয় ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক্ষেত্রে একটি বিষয় তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। সমাজের নিচুতলার সহায়সম্বলহীন মানুষের বাচ্চাদের এবং এতিমদের জন্য মাদ্রাসা একটা নির্বিকল্প জায়গা হিসেবে আজো টিকে আছে, আমাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর উন্নয়নের গালে চপেটাঘাত হয়ে। ঠিক আছে। কিন্তু কওমী মাদ্রাসা জিনিসটা গোড়াতে একেবারেই গরিবের পাঠশালা জাতীয় কিছু ছিল না। কওমী শিক্ষাপদ্ধতির একটা এন্টি কলোনিয়াল গুরুত্বও আছে। ইংরেজি মিশনারী শিক্ষার প্রসারের সেই যুগে কওমী ব্যবস্থা কিন্তু রীতিমত একটা প্রতিবাদের প্রতীক হয়েই দাঁড়িয়েছিল। মাদ্রাসা নিয়ে কথা বলতে গেলে এই ঐতিহাসিক ভূমিকাটি আমাদের ভুলে থাকা উচিৎ হবে না।

৩. ফারুক ওয়াসিফের কোনো একটি পয়েন্টে পি মুন্সী এই গোটা বিষয়টাকে গ্লোবালি দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। আমিও তাই মনে করি। কিন্তু সাথে সাথে এই নোক্তাখানিও দিতে চাই যে, ইসলামী রাজনীতি দুনিয়ার নানান জায়গায় নানারকম চেহারা নিয়ে হাজির আছে। আলকায়েদা, হিযবুত তাহরীর এবং জামিয়া ইসলামিয়ার রাজনীতি এক পাটাতনের নয়। ফলে, এখানে ভাস্কর্য ইস্যুতে আমরা সমাজের প্রায়-সর্বহারা একটি গোষ্ঠীকে সনাক্ত করেছি, য়ুরোপে কিন্তু যারা ইসলামী রাজনীতির ঝান্ডা বহন করেন তারা অবস্থাপন্ন ঘরের। ফলে, ইকোনমি তাদের মার্জিনালিটি বোঝার একমাত্র জায়গা নয় এবং এ কারণেই সম্ভবত এই রাজনীতির ব্যবচ্ছেদে মার্কসের চেয়ে গ্রামশির ব্যাখ্যা আমাদের বেশি সহায় হয়ে উঠতে পারে। ইসলাম সত্যি সত্যি আমাদেরকে একটা পোস্ট-ন্যাশনালিস্টিক পরিচয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আজকে যখন কোনো মিশরীকে, ইরানী বা আলবেনীয়কে পরিচয় জিজ্ঞেস করা হয়, সে বলে সে মুসলিম। দুই দশক আগেও হয়ত সে মিশরী, ইরানী কিংবা আলবেনীয় ছিল।

ফলে, গ্লোবালি ইসলাম জিনিসটা আরো বেশি জটিল লাগে। আমি নিশ্চিত না মাদ্রাসা ছাত্রদের ভাস্কর্য ভাঙার ইস্যুকে পি মুন্সী গ্লোবাল ইসলামী রাজনীতির কোন জায়গায় লোকেট করেন? রাষ্ট্রীয় উস্কানিতে বা রাষ্ট্রপক্ষের নীরবতার সুযোগে একদল মাদ্রাসা ছাত্র মূলত মধ্যবিত্তের রূচিবোধের ওপর একহাত নিল। গ্লোবাল ইসলামী রাজনীতি কিন্তু এই শ্রেণীকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে না। নাকি দেখে?

৪. পি মুন্সীর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। উদ্ধৃত করি:

"ধরা যাক আমেরিকান এ্যমবেসী একটা জরিপ কাজ করেছে বাংলাদেশের স্হানীয় এক তথ্য সংগ্রাহক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কাজটা হলো সব কওমি মাদ্রাসাগুলোর উপর। ওর সারাদিনের পাঠ্যসহ অন্যান্য কার্যক্রম কী চলে, কখন কোনটা করা হয়, কী পড়ানো হয়, অবসরে কী করে ইত্যাদি সব। এই বর্ণনা শুনে আমাদের মনে হতে পারে এতো সব নির্দোষ ব্যাপার, ঠিকই তো করছে। তাহলে এবার পরেরটুকু শুনুন। প্রতিটা মাদ্রাসার ভৌগলিক অবস্হানও GPS দিয়ে তারা সংগ্রহ করেছে। কেন? সন্দেহ হলে বা না হলেও ড্রন দিয়ে হামলা যাতে করতে পারে। এই হামলা হলে আমরা কী করব?

মতিউরের মত খুশি হব? জারদারির মত লুলা হাতপা ছুড়ে সার্বভৌমত্ত্ব লঙ্ঘনের অক্ষম কথা তুলব? চেয়ে চেয়ে দেখব আমরা কীভাবে আফগানিস্তান পাকিস্তান হয়ে যাব? নাকি অন্য কিছু?"

-- ভাবনার কথা। কী করবো? পুরো বিষয়টি আসলে একটা রাষ্ট্রাতিরিক্ত জায়গায় চলে গেছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এখানে ফাঁপা বুলিমাত্র। ইসলাম যেহেতু রাষ্ট্রসীমার উর্ধ্বে একটা রাজনৈতিক পরিচয় ধারণ করে ফেলেছে ইতোমধ্যে, কাজেই সাম্রাজ্যবাদ তাকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নামক সত্তার কোডগুলোকে থোড়াই পাত্তা দেবে তা বলাই বাহুল্য।

"আমরা" বলতে পি মুন্সী এখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের বুঝিয়েছেন নিশ্চয়। আমার জবাব হল জাতীয়তার মামলা দিয়ে এখানে কিছুই করার নাই। কারণ আমাদের বিব্রত জাতীয়তাবোধের বাউন্ডারির বাইরে দিয়েই সাম্রাজ্যবাদ এবং তার প্রতিপক্ষ ইসলামের শত্রুতা বিকশিত হয়েছে। ফলে এখানে রাষ্ট্রীয় "অক্ষমতা"র জন্য রাষ্ট্রকে একমাত্র দায়ী ভাবতে রাজী নই আমি।

আরো কথা বলছি পরের মন্তব্যে।

৩৩| ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৫৩

ঘোর-কলিযুগ বলেছেন: ঘুরতে ঘুরতে আইয়া পরলাম, দেহি এলাহি কান্ড। জবরদস্ত সব আলোচনা চলতাছে। পোস্টে-এর আলোচনার গন্ডি ছারায়া মেলা দিকে ডালপালা ছরাইছে। তয় মুস্কীলও তৈয়ার করছে, কইত্থেকা শুরু করণ যায়, তাও আবার নাদান পাঠকের কমেন্ট, হেইডা মুই বুঝতারছিনা।

তয় এটা বিষয়ে মুই টাশকি খাইছি, ''দেখা যাচ্ছে ৪৭ এর আগে মুসলিম লীগ শুধু পাকিস্তান আন্দোলনই করেনি ওর ভিতর একটা সাংস্কৃতিক দিকও ছিল। ''-- এই কথা খানের মর্ম লইয়া মুই ভাবতাছি। আপনে এট্টু বিশদ করতারেন? মোর কামে লাগে। কেন না বঙ্গদেশীয় বাম বা প্রগতিশীলগো কাছে তো শুইনা আইতাছি উহা আতিশয় সাম্প্রদায়িক ঘটনা। অসাম্প্রদায়িকতা তাতে খানখান হইয়া ছত্রখান, এই করঙ্ক মোচনের লায় '৭১-এর অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এই বিষয়ে দুই ঘাগু বাম আমারে সেকেন্ড করবেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও বদরুদ্দীন উমর।

৩৪| ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ১১:৪৪

সুমন রহমান বলেছেন: আমাদের দেশের ইন্টেলেকচুয়াল তর্ক শেষপর্যন্ত রশি টানাটানি খেলা। অর্থাৎ কেউ নিজের জায়গা থেকে নড়বে না, এবং অপরপক্ষকে কতটুকু নড়াতে পারে সেই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নিজের আত্মম্ভরিতা গড়ে তুলবে। আশার কথা, বর্তমান তর্কটি সেই ধারার নয় এবং পলেমিকসের ছন্দে আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থান রিভাইজড হতে দিচ্ছি। এখন গোড়া থেকে আমরা যদি এই তর্কের ইস্যুটি খেয়াল করি তাহলে এই ইতিবাচক মনোভাবটি ঠাহর করতে পারবো। যেমন:

১. রিফাত হাসান এর ইস্যুটি ছিল রাষ্ট্র যেহেতু পাবলিক স্পেসে একটা স্থাপনার ব্যাপারে জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে ভায়োলেশন করেছে, অতএব ভাস্কর্য ভাঙার দাবিটি সেই ভায়োলেশনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জাস্টিফাইড।

২. এর জবাবে আমরা ভাস্কর্য ইস্যুটির সাংস্কৃতিক রাজনীতির দিকে ফোকাস করতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, ভাস্কর্য ভাঙার দাবির জবাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জাস্টিফাইড কেননা এই ঘটনা তার পরিচয় সংকট তৈরি করে।

৩. পি মুনশী এই জায়গায় কিন্তু রিফাতকে সমর্থন করছেন এমন মনে হচ্ছে না। তিনি এই জায়গায় বরং এক ধরনের সোশ্যালাইজেশনকে পলিসি হিসেবে প্রমোট করছেন। দেখিয়েছেন, নজরুল এবং আব্বাস উদ্দীন এর হামদ ও নাত লিখার বদৌলতে কিভাবে আমাদের ইসলামী মানসে গান "হালাল" হয়ে উঠল। নজরুল নিজে ভাস্কর হলে আজ এরকম একটা পরিস্থিতির খপ্পরে আমাদের পড়তে হত না, এমন ইঙ্গিতও রেখেছেন তিনি।

এই চিন্তাপদ্ধতি আমার পছন্দ। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষিতে পলিসি হিসেবে কতটা লাগসই সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। রেডিক্যাল রিফাতের সাথে পলিটিক্যাল মুনশীর এই মোকাবেলা চমৎকার লাগল।

ঐতিহাসিক জায়গা থেকে যদি দেখি: নজরুল এবং আব্বাস উদ্দীনের গানকে হালাল করার এই রাজনীতি সফল হবার কারণ ছিল তাঁদের শ্রেণিগত পজিশনালিটি ("অবস্থান" লিখলাম না সঙ্গত কারণে)। আবার মধ্যবর্গ ও নিম্নবর্গের যে দুস্তর ব্যবধান বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি, নজরুল এবং আব্বাস উদ্দীনকে সেটা দেখতে হয় নাই। এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে মধ্যবর্গের কোনো শিল্পীর পক্ষে নিম্নবর্গের প্রতিনিধি হয়ে ওঠা কঠিন। আর ম্যানিপুলেশন তো পদে পদে। নিম্নবর্গের আইকন কুদ্দুস বয়াতী মিডিয়ায় শেষমেষ একটা পানির পাম্পের বিজ্ঞাপন হয়ে যাওয়াটাকেই মোক্ষ ভাবেন। তদুপরি, সেই সময়টা ছিল বাঙালি/বাংলাদেশী জাতিসত্তার চেহারাটি পরিস্ফূট হয়ে ওঠার এক গুরুত্বপূর্ণ সময়।

ফলে, নজরুল কিংবা আব্বাস উদ্দীন এর "কৌশল" দিয়ে বর্তমানে কার্যকরী কিছু করা যাবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে আমার। সন্দেহটি এ কারণে যে, বর্তমান সময়টি একজন নজরুল বা আব্বাস উদ্দীনের পুনর্জন্ম দিতে আর সক্ষম নয়। ফরহাদ মজহার আছেন, লড়াই করে যাচ্ছেন তাঁর মত। তবে এটা তো ঠিক যে, নিপাট অবজ্ঞা কিংবা ঘৃণা দিয়ে এই অবস্থার মোকাবেলা করার এলিটিপনা থেকে সরে আসতে হবে মধ্যবিত্তকে। শ্রেণী ব্যবধান যতই দুস্তরতর হতে থাকবে, মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব ততই প্রকটতর হতে থাকবে। প্রসঙ্গচ্যুতি ঘটবে বলে এ বিষয়ে শুধু নোক্তা দিয়েই ক্ষান্ত হলাম।

৩৫| ২১ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ৮:৪৯

পি মুন্সী বলেছেন: প্রায় চারদিন পরে আসলাম। ফারুক ওয়াসিফের কোন মন্তব্য এখনও দেখলাম না। যাই হোক, সুমন এর ৩২ নম্বর মন্তব্য থেকে কিছু সাড়া দিয়ে শুরু করি। ওর মন্তব্যের ১. নম্বর পয়েন্ট: "রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা কিভাবে দেখবো" - এই বাক্যাংশ তুলে আনলাম।
রাজনৈতিক ইসলাম: কথাটা এত তাড়াতাড়ি তুলে ফেলা ঠিক হলো কিনা জানি না। কারণ, সমস্যা হলো "আধুনিক" মধ্যবিত্তের আধিপত্যে সাংস্কৃতিক আসরে ইসলাম প্রসঙ্গে পক্ষে বা বিপক্ষে কোন ডায়ালগ প্রায় অসম্ভব। কোন বিবেচনা-বোধহীন এই আসর এসব আলোচনাকে রাজাকার বলে লেবেল লাগিয়ে নিজেদের ইস্যু না বুঝার অক্ষমতা ঢাকতে খুবই তৎপর। আপনিও বলেছেন বটে, তবে ওটা "আলকায়েদা, হিযবুত তাহরীর না জামিয়া ইসলামিয়ার রাজনীতি" এসব পাটাতনের খবর - তাদের কাছে এগুলো সব একই রকম - রাজাকার। এর ব্যতিক্রম যারা তাদের কেউ কেউ এই "রাজনৈতিক ইসলাম" শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত বটে, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এই শব্দচয়ন একটা পশ্চিমা মনের। এমন পশ্চিমা মন যে ধরে নিয়েছিল পশ্চিমে আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম হবার আগে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় যে ভুমিকা ছিল, আধুনিক রাষ্ট্র কায়েমের পর সেটা শেষ হয়ে গেছে। তাঁরা আসলে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের রাজনৈতিক ভুমিকা বলতে বুঝেছিল খ্রীষ্টান ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের রাজনৈতিক ভুমিকা। শুধু তাই নয়, আসলে ঘটেছিল খ্রীষ্টান ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা বা মোকাবিলার ভিতর দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম, অথচ ধরে নেয়া হয়েছিল এতে সব ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা বা মোকাবিলার ঘটে গিয়েছে, অথবা বলা যায়, ধরে নিয়েছিল দুনিয়ায় অন্য কোন ধর্ম নাই, বড়জোড় মধ্যযুগীয় কিছু ব্যাপার স্যাপার আছে ফলে তা এত আমল করার কিছু নাই। খ্রীচানিটির সাথে সাথে সব কিছুর কবর হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ কথাটা দাড়িয়েছিল এমন যে পশ্চিম দুনিয়ায় আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গিয়েছে মানে দুনিয়ায় সকল ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা ঘটে গিয়েছে। পশ্চিমা মনের এই ভাবনা কলোনি-সূত্রে আমরাও পেয়েছি, তবে রেডিমেড। কোন কষ্ট করতে হয় নাই। আমাদের সমাজের ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা বা মোকাবিলা না করেই ভেবেছি -এই রেডিমেড মাল দিয়ে আমাডের চলবে। খবর নেই নাই আমরা পশ্চিমের মতই কোন খ্রীচান সমাজে নই, ফলে আমাকেও আমার ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের একটা পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে হবে, মোকাবিলার কাজটা করতে হবে। আসলে পশ্চিমা আধুনিক রাষ্ট্র কায়েমে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের একটা পর্যালোচনার ব্যাপার স্যাপার ছিল কী না - সে খবরই তো জানা নেই এদের। আবার ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা মোকাবিলার মানেই বা কী - সে তো আর এক বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।
এসব অজ্ঞানতার গুমোর এত সহজে ও তাড়াতাড়ি বোধহয় ফাঁস হতো না। পশ্চিম যেটা ধরে নিয়েছিল খ্রীচানিটিই দুনিয়ার একমাত্র ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা এবং পশ্চিম দুনিয়ায় আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গিয়েছে মানে দুনিয়ায় সকল ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা ঘটে গিয়েছে, বাকি সবটুকু যা আছে তা অসভ্য মধ্যযুগীয়দের কাজ কারবার - ফলে কলোনি যুগ থেকে চলে আসা (তৃতীয় বিশ্ব) অসভ্যদের শাসন ও সভ্য করার নামের লুন্ঠন ন্যায্য। এভাবেই চলে আসছিল এতদিন। গণতন্ত্র, ব্যক্তির উন্মেষ, অধিকার, মানবাধিকার চার্টার ইত্যাদি সব ধারণা সারা দুনিয়ার (পিছিয়ে পড়া বা রাখা দুনিয়াসহ ) সব সমাজসহ সবার জন্য আদর্শ করণীয় ও পালনীয় বলে বিনাবাধায় বড় কোন কার্যকর চ্যালেজ্ঞ ছাড়াই রাজত্ত্ব করে চলছিল। তেল বা যাকেই কেন্দ্র করে হোক না কেন, ৯/১১ ও আল-কায়েদার বিশ্ব-ঐতিহাসিক উত্থান গেল প্রায় দশ বছর ধরে পশ্চিমের এই সমস্ত ভাবনা দুনিয়ার ষ্টান্ডার্ড বলে যা কিছু দাড়িয়েছিল তাকে আজ চ্যালেজ্ঞ করেছে। পশ্চিমকে অবশ্যই একে মোকাবিলা করতে হবে, হচ্ছেও। আমার বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে চ্যালেজ্ঞ করলেই বা করা মানেই তা জয়লাভের নিশ্চয়তা বা ইঙ্গিত। স্পষ্ট থাকার জন্য বলা দরকার, এটা স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত নয়। অথবা ইসলামের প্যানইসলামিক উত্থান নয়, বা ইসলাম বনাম খ্রীষ্টান এর ক্রসেডও নয় - যদিও এরকম অনেক ব্যাখ্যাই আমরা দেখেছি, আরও অনেক পাব হয়ত সামনে। অর্থাৎ উপরে আমি পরিস্কার করেছি, এটা দুটো সভ্যতার সংকটও নয়, ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের পুনরুত্থান বা ক্রসেডও নয়। সাম্রাজ্যবাদের সংকট বা পুঁজির দুনিয়ার (ক্যাপিটালিজমের) সংকটটাই এখন এভাবে ইসলামের নামে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে; যা দেখে এখন পর্যন্ত এটাকে ইসলামের উত্থান বা ক্রসেড বলে ভাববার ব্যাখ্যা করবার ধারাই প্রবল।
ফলে পশ্চিমা মন যে কেবল খ্রীচানিটিকে দেখে ধরে নিয়েছিল ধর্মের রাজনৈতিক যুগ আধুনিক রাষ্ট্রে এসে শেষ হয়ে গিয়েছে - এখন ইসলামের নামে রাজনৈ্তিকতা দেখে সে আর তার তত্ত্ব মিলাতে পারছে না। তাই একে ব্যাখ্যা করতে বলছে এটা রাজনৈতিক ইসলাম। অর্থাৎ এতদিন পূঁজির অনুগত, পূঁজির সাথে যে কোন সংঘাতে লিপ্ত হতে চায় না বরং হাতে হাত ধরে হেটেছে - এটা সেই ইসলাম না; যাকে সে নেহায়েতই এক "ধর্মের" মর্যাদা দিয়ে রেখেছিল। বরং এটা র‌্যাডিক্যাল, লড়াকু।

একটা ইতিবাচক ঝোঁক রেখে এতক্ষণ কথা বলার পরও আমি মনে করি পশ্চিম তার তত্ত্বের সংকট মেটাতে যা বুঝে বুঝুক, আমরা একে "রাজনৈতিক ইসলাম' বলে বুঝব না।
পুঁজি যে দুনিয়া বানিয়ে রেখেছে এর উর্ধে ও পরে কোন দুনিয়া দেখার মত দুর্সাহস এখনও আমরা যারা রাখি তারা এঘটনায় ইসলামি মোড়ক আছে বলে একে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বলে ভাবলে ভুল হবে। এমনকি আমরা ইসলামি বা খ্রীচানি ক্রসেড বলে ব্যাখ্যার প্রচারণায় মুগ্ধ হয়ে থাকতে পারি না।
এখনও পর্যন্ত আলকায়েদা ধরণের ইসলামি ধারাগুলো একটা ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের সংগ্রাম বলে মনে করে। দুনিয়াব্যাপী এক খিলাফত ও শরীয়া প্রতিষ্ঠা এর লক্ষ্য। এক ধর্মযুদ্ধ তারা লড়ছে। খ্রীচানিটি তার শত্রু। আমেরিকা এই শত্রুর শিরোমনি। ফলে টুইন টাওয়ারে হামলা তার কাছে আমেরিকান প্রাইডে হামলা, পুঁজিতন্ত্রের কোন কেন্দ্রে নয়।
এখন একটা কথা বলব যেটা গুরুত্ত্বপূর্ণ। আলকায়েদা কী বুঝে, কী ধ্বংশ করল কী মনে করে করল আর ওটা আসলে যা, পুঁজির দুনিয়ার এর আসল তাৎপর্য কী - এটা না জেনেও একাজ করা সম্ভব। আবার একে ভাঙ্গার পথে ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দুনিয়া কোথায় যাবে তাকেও আলকায়েদার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে কী না, পরিস্হিতি ব্যাড়ে পাবে কী না - এগুলো একবারে আলাদা বিষয়। তত্ত্বের জোড় থাকলে যোগ্য ইতিহাসের নায়ক হলে, সক্ষম হলে পারবে নইলে হাতছুট এক গর্ভস্রাব হবে - এটাই তো স্বাভাবিক।
তবে আপাতত এটা পরিস্কার যে পশ্চিম - গণতন্ত্র, ব্যক্তির উন্মেষ, অধিকার, মানবাধিকার চার্টার ইত্যাদি সব - ধারণা বলে যতদূর চলে গিয়েছে - এর চেয়ে কম বা পিছনের কিছু দিয়ে পশ্চিমের উপরে কোন তত্ত্ব বিজয় লাভ করতে পারে না।, মানুষের নতুন ধারণা ও সমাজে ন্যায়বিচার কিভাবে আরও ভালো ভাবে দিতে পারে সে ধরণের আরও উন্মেষ বা বিকশিত কোন ধারণা দিয়েই যা সম্ভব। ইসলামের ঝান্ডা তুলে খিলাফত ও শরীয়া ধারণা দিয়ে এটা সম্ভব নয়। তবে কাম্য ঐ নতুন অগ্রসর ধারণায় উপাদান হিসাবে ইসলামকে অবশ্যই নিবে।

তাহলে এই পরিস্হিতি আমার লেখার মধ্যেও যেমন আছে, "র‌্যাডিক্যাল ইসলামের" প্রতি এই গুরুত্ত্বে কী আছে?
এর উত্তর হলো - এটা র‌্যাডিক্যাল, লড়াকু তাই। যতক্ষণ এটা লড়াকু, বুঝুক বা না বুঝুক, মানুক না মানুক পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পুঁজির দুনিয়ার সমাজ সভ্যতার বিরুদ্ধে যতক্ষণ সে আপোষহীন লড়াকু থাকবে ততক্ষণ এটা বিশাল সম্ভাবনাময় হয়ে আমাদের সামনে হাজির থাকবে। কারণ লড়াকু সে মাঠে, আপনার আমার চেয়ে অনেক বেশী। লড়বার পথে চিন্তার দিক থেকে কোন নতুন রিয়েলাইজেশনে বা বন্ধুর কারণে যদি সে চিন্তায় র‌্যাডিক্যালাইজ বা রাডিক্যাল ট্রান্সফরমেশন ঘটে যায় তবে একে ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নাই, বিশ্বঐতিহাসিক ঘটনা হবে সেটা। তবে এটা সম্ভবনা মাত্র - এর বেশি ভাববার কিছু নাই। আবার বিপরীতে কোন কারণে পুঁজিতন্ত্র এখন যেমন আছে তেমনই রেখে বাকি সবকিছুতে ছাড় দিয়ে যদি বতর্মান সংঘাতের মীমাংসার পথ হাজির দেখা যায় তবে এটা গর্ভস্রাব হবে নিঃসন্দেহে।

আপনার "র‌্যাডিক্যাল ইসলামের" মধ্যে এই ধারাও আছে। তুরস্কের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন। জামাতও সক্রিয়ভাবে এই লাইনের কথা ভাবছে। আফগানিস্তানে আলকায়েদা বাদ রেখে তালেবানদের সাথে আমেরিকান সমঝোতার উদ্যোগের অর্থ সে ইঙ্গিত বহন করে।
তাই যতক্ষণ এটা লড়াকু ততক্ষণই এর সম্ভবনা।
সাধারণভাবে বললে, সমস্যাটাকে রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধের মধ্যে বুঝবার চেষ্টা করার মানে আধুনিক হয়ে আমেরিকান বৈদেশিক নীতির অংশ হয়ে ওর মধ্যে আশ্রয় খুজা।

৩৬| ২১ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:৩৯

ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন: জনাব পি মুন্সি, দুঃখই প্রকাশ করতে হচ্ছে। চাকরগিরি করে খাই ইদানিং। ফলে সময় ও মেজাজের বড়টাই তারা খায়। বাকিটা সাংগাঠনিক ও নানান মামলায় দিয়ে আর ফুরসত পাইনি। আজ এখানে লিখব ভেবে ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থান বিষয়ে এটা এটা লিখে ফেলেছি: Click This Link

আশা করব, প্রাসিঙ্গকতার খাতিরে দেখবেন। কাল এই দরবারে ধর্না দেওয়ার সাধ মিটবে আশা রাখি।

৩৭| ২৯ শে নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:২২

পি মুন্সী বলেছেন: সুমন রহমানের কোন প্রতিক্রিয়া দেখছি না। আপনার আগ্রহের প্রসঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ইসলাম নিয়ে এত কথা বলার পরও কোন মন্তব্য নাই কেন? প্রসঙ্গের ভারে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন নাকি?

৩৮| ৩০ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৩৬

সুমন রহমান বলেছেন: পি মুন্সী, আসলে আলাপ একটা পর্যায়ে শেষ হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। অন্তত আমার দিক থেকে। তবে শেষ হওয়া মানে একেবারে শেষ হওয়া এমন তো না। নিভন্ত চুলায় খোঁচা দিলে আগুন নতুন তেজ পায়। সেটা দেয়া যেত। দিই নি ইচ্ছা করেই।

শব্দবন্ধের রাজনীতি আছে, সেটা আপনি বলেছেন, আমিও কম বেশি সচেতন। "রাজনৈতিক ইসলাম" পশ্চিমা লেবেল, এর বিপরীতে আপনি একে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম বলতে চান মনে হয়। আপনার ফ্রেমওয়ার্কটিও আমার কাছে পশ্চিমাই মনে হয়েছে, কারণ আপনি মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে এই ফেনোমেনন বুঝতে চেয়েছেন। "পশ্চিম"কে ত্যাজ্য করার আগে তার সাথে আমাদের হিসাব নিকাশ পরিষ্কার হওয়া ভাল। কোনো আউটস্ট্যান্ডিং দেনা না থাকাই শোভন।

প্রশ্ন রেখেছিলাম, এই ইসলামী আন্দোলন কেন ভাতকাপড়ের নয়? কেন ধর্মতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক ইস্যুগুলো এদের এজেন্ডা হয়ে ওঠে? পি মুন্সী যেহেতু মার্কসীয় ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে এই ফেনোমেননকে ব্যাখ্যা করেন তাই আসলে এসব প্রশ্নের মোড়কে আমার জিজ্ঞাসা ছিল, কিভাবে এই নিম্নবর্গের আন্দোলন বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে? আদৌ করে কিনা?

আপনার নীরবতা থেকে উত্তর খুঁজে নিলাম। করে না। আগেও যেমন প্রশ্ন করেছিলাম এই গোষ্ঠী তার নেতৃত্বের প্রতি ক্রিটিক্যাল কি না। তখন আপনি জানিয়েছিলেন যে এরা এদের নেতৃত্বের ব্যাপারে ঐতিহাসিক কারণেই ক্রিটিক্যাল না। তাহলে কি দাঁড়াল?

যে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীকে সামনে রেখে আমরা সমাজবিপ্লবের খোয়াব দেখছি এরা

১. নিজেদের নেতৃত্বের ব্যাপারে ভীষণরকম আনক্রিটিক্যাল।

২. বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ককে কোনোভাবে চ্যালেঞ্জ করে না।

৩. এদের ইস্যু মূলত সাংস্কৃতিক, ফলত এরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। মনে রাখতে হবে, এরা মধ্যবিত্তের যে অংশের সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে, সেই মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতাবান শ্রেণী হিসেবে তার অবস্থান সমাজে ইতোমধ্যেই অনেকটা হারিয়েছে। ফলে এরা মূলত আরেকটা বিপন্ন সংস্কৃতিকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

এতো গেল বাংলাদেশের কথা। বহির্বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের চেহারা কিন্তু অন্য। সেখানে ইসলামী শক্তি সাম্রাজ্যবাদের সংকটটাকেই পরিস্ফূট করে তুলছে, পি মুন্সী বলেছেন। বলাবাহুল্য, লেবেল এক হলেও ঐ আন্দোলনের ছিঁটেফোঁটাও নেই এ দেশের মাদ্রাসা ছাত্রদের মুভমেন্টে। সাম্রাজ্যবাদ তো দূরের কথা, এরা রাষ্ট্রক্ষমতাকেই এখন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করে নি। করতে আগ্রহী এমন মনে হয়ও না। শায়খ আর বাংলাভাইদের ইউটোপিয়া বাদ দিলে এখানে সেই অর্থে রেডিক্যাল ইসলাম আমি তো দেখি না। এখানকার যা কিছু মুভমেন্ট সবই এক ধরনের ম্যানিপুলেশনই মনে হয়েছে। এই ম্যানিপুলেশন নেতৃত্বের। আর এই "ইসলামী" নেতৃত্ব অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্তে উন্নীত হওয়া শ্রেণী, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি পেলে তার আইডেন্টিটির ষোলকলা পূর্ণ হয়। এর জন্যই এত লড়াই, এত এত মূর্তি ভাঙার খেলা!

আর দরিদ্র মাদ্রাসা ছাত্র আসলে এই দুইরকম মধ্যবিত্তের মধ্যকার হাড্ডি কামড়াকামড়ি খেলার একটা ইনস্ট্রুমেন্ট মাত্র। এখানে কোথাও তার ভয়েস নাই।

ফলে, পি মুন্সী যেখানে সর্বশেষ আশ্রয় নিচ্ছেন, সেই রেডিক্যাল বা লড়াকু অবস্থানটিও কতটা এই গোষ্ঠী হোল্ড করে এটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর কেউ র‌্যাডিক্যাল হলেই তার পানে সকল স্বপ্ন তাক করে বসে থাকবো, এই শিক্ষাও তো ইতিহাস থেকে পাই না।

পাই না বলেই চুপ করে বসে আছি, সখা হে!

৩৯| ৩০ শে নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৫২

আলিফ দেওয়ান বলেছেন: ফেসিবাদি সুমন রহমান, বাথিজা তুমি এখন চুপ কেন?ভলাখা বাষ্কর্য বাঙ্গা নিয়ে কিছু বল্ল

৪০| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৫:০৮

জানে আলম বলেছেন: সহজ কিছু কথা

৪১| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৪৪

পি মুন্সী বলেছেন: সুমন বলছেন, "আপনার ফ্রেমওয়ার্কটিও আমার কাছে পশ্চিমাই মনে হয়েছে, কারণ আপনি মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে এই ফেনোমেনন বুঝতে চেয়েছেন"। আপনার একথা থেকে আমি বুঝলাম, ১. মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্কে আপনার আপত্তি আছে। ২. আমার ফ্রেমওয়ার্ক মানে "মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্ক" পশ্চিমা বলে আপনার আপত্তি।
এখন যেটা আমি নিশ্চিত হতে চাই তা হলো, আপনার আপত্তিটা কোথায়? খোদ মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্কে (তা সে পশ্চিমের হোক কি পূবে হোক)? না কী মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্কটা পশ্চিমের ধারণা বলে? এটা একটু পরিস্কার করবেন, তাহলে আপনাকে বুঝতে সহজ হবে। অন্যন্য প্রসঙ্গে পরে আসছি।

৪২| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:০৭

সুমন রহমান বলেছেন: পি মুন্সী, পশ্চিমা ফ্রেমওয়ার্কে কিংবা মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্কে আমার আপত্তি নাই। আপনি যখন আল কায়েদার উত্থান জাতীয় প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিংবা এই "ইসলামী" প্রপঞ্চকে নামকরন করতে গিয়ে পশ্চিমাদের তত্ত্বের সংকট দেখছেন, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম আপনারও ফ্রেমওয়ার্ক পশ্চিমা। এটুকুই। নতুন ভাবধারা যে সবসময় নতুন ফ্রেমওয়ার্ক ধরেই হাজির হতে হবে এমন নয়। কিন্তু আমরা যখন পশ্চিমের "তত্ত্বের সংকট" বুঝতে চেষ্টা করবো পশ্চিমেরই ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে, তখন প্রকারান্তরে আমি "পূবে"র পাদানি নিয়ে ধন্দে পড়ে যাই।

আমাকে বুঝতে একটা তথ্য হয়ত কাজে আসবে। ব্যক্তিগত গবেষণায় আমি যে ফ্রেমওয়ার্কটি ব্যবহার করতে চেষ্টা করছি তাকে পন্ডিতেরা "পোস্ট গ্রামশিয়ান" বলেন।

ভালো থাকুন।

৪৩| ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:৫০

পি মুন্সী বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে বুঝার মত একটা তথ্য দেওয়ার জন্য।

তার মানে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন, "পোস্ট গ্রামশিয়ান" ফ্রেমওয়ার্কটা পূর্বের? তাই যদি হয় তবে আপনার কী বিবেচনায় কীভাবে এটাকে পূর্বের ভাবছেন? জানার জন্য অপেক্ষা করব।

আর একটা প্রশ্ন, "পোস্ট গ্রামশিয়ান" ফ্রেমওয়ার্ক কী মার্কসিস্ট ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে? কোন কোন জায়গায় আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, গ্রামশি কী মার্কসিষ্ট? আপনার বিবেচনা কী?

আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।

পরের অংশ আমার নিজের কিছু কথা।
আমার একটা অবজারভেশন হলো, যারা গ্রামশিয়ান মূল মার্কসে (মার্কসবাদে নয়) দখল তাঁরা কম রাখেন।
আর, তত্ত্ব পশ্চিমের হলে পূর্বে তার ব্যবহারযোগ্যতা নাই বা ধন্দ লাগবে - একথা সত্যি না। ধন্দ তখনও লাগবে যখন পশ্চিমকে যথেষ্ট জানা না থাকবে, ঐ তত্ত্ব কোন কোন জায়গায় কী কী সীমাবদ্ধতা কারণে পূর্বে প্রযোজ্য নয় (আদৌ যদি প্রযোজ্য না হবার মত কিছু থাকে) সেসব জায়গায় পরিস্কার না থাকব।
আসলে তর্কটাকে পশ্চিম বনাম পূর্বের স্রেফ ভূগোলঘটিত নয়, দেশ-কাল-পাত্র মূলক এবং একসাথে, চর্চার ভিতর দিয়ে পশ্চিমে মানুষের একটা অভিজ্ঞতা দাঁড়িয়ে আছে। এটা দূর্বলও নয় যে টোকা দিলেই ফেলা দেয়া যাবে, বরং ওর চেয়ে অগ্রসর কিছু থাকলে নতুন অভিজ্ঞতার সূচনা করা যেতে পারে। আবার ওর সবই পরিত্যাজ্য বা সবই চোখ বন্ধ করে অগ্রসর মনে করে গ্রহণীয় ব্যাপারটা সেরকমও নয়। আরও আছে, পূর্বের থেকে কোন তত্ত্ব জাগতে পারে অবশ্যই েবং জাগবেও, তবে এটা যদি কেবল পূর্বের থেকে যায় তবে এর কোন ভবিষ্যত নাই এবং আদৌ পূর্বের থেকে যেয়ে আমাদের কোন কাজে লাগবে বা কিছু করতে পারবে বলে আমি মনে করি না। বরং একে অবশ্যই বৈশ্বিক (ওয়ার্ড) চরিত্রের হওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে যাতে পশ্চিমের চেয়েও অগ্রসর ও পশ্চিমের সঙ্কটগুলোকেই মোকাবিলার করার ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। আমি এভাবেই দেখি।

৪৪| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ৮:৪৬

পি মুন্সী বলেছেন: আমার দিক থেকে শেষ করতে হবে মনে হচ্ছে। একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে বার বারে ভুলে যাই। সেটা দিয়েই শেষ করব।
সুমন ও ফারুক উভয়েই আমাকে ভুলভাবে পড়ে অভিযুক্ত করার সুযোগ নিতে চেয়েছেন। সুমন বলছেন, ""কেউ র‌্যাডিক্যাল হলেই তাঁর পানে সকল স্বপ্ন তাক করে বসে থাকবো, এই শিক্ষাও তো ইতিহাস থেকে পাই না""। ফারুক তাঁর এক অন্য পোষ্টে আমার এক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে একই ধরণের অভিযোগ করেছেন।

প্রথমতঃ, আমি কোথাও স্বপ্ন তাক করে বসে থাকার জন্য বলিনি, পীড়াপীড়ি করিনি বা ইঙ্গিত করিনি। হাত গুটিয়ে নেওয়া না, নিজের কর্তব্য অনুধাবন নির্ধারণ করে কাজ ঠিক করে নামতে ইঙ্গিত দিয়েছি। প্রত্যেক শ্রেণীকে স্ব স্ব স্বপ্ন কল্পনার পছন্দের রংয়ের বিপ্লবকে বাস্তবে সম্পন্ন করে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় তাঁর স্বপ্ন সঠিক, এটা কোন পেটিবুর্জোয়া কল্পনার ফানুস না। এখানে কেউ কাউকে তাঁর পছন্দের রংয়ের বিপ্লব করে দিবে - এটা ভাবা অবিবেচক বেআক্কলী ও অনৈতিহাসিকও বটে।
তাহলে র‌্যাডিক্যালের প্রসঙ্গটা কেমন করে আসলো? সুমন "র‌্যাডিক্যাল ইসলাম" বলে একটা প্রসঙ্গ তুলেছে, আমি তুলিনি। আমি শব্দটা উৎপত্তি কোথা থেকে এবং কারা কী প্রেক্ষিতে চালু করেছে এ'প্রসঙ্গটা তুলে ধরেছি। এরপর কথাটায় সতর্কতা জানিয়ে বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্হিতিকে একেবারেই নৈব্যক্তিকভাবে একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমরা সঠিক মনে করি বা পছন্দ করি না করি, আমি বলতে চেয়েছি অবজেকটিভলি দেখলে এর মধ্যে র‌্যাডিক্যালিজম বা লড়াকু চরিত্র আছে। পাঠক লক্ষ্য করবেন র‌্যাডিক্যাল কথাটা আমি তুলি নাই। সুমন আগ্রহ করে বলছেন, এসব আলাপগুলো সেরে নিতে পারলে বাংলাদেশের "ইসলামী" র‌্যাডিক্যাল রাজনীতির সম্ভাবনা নিয়ে অনেক দরকারি বিষয় আমরা অবগত হতে পারবো"। সেকথার প্রেক্ষিতে র‌্যাডিক্যাল কথাটা এসেছে।
আবার লক্ষ্য করবেন, আমি বলেছি, র‌্যাডিক্যালিজম বা লড়াকু চরিত্র আছে, বলিনি ওদের ঘোষিত রাজনীতি বা এর লক্ষ্য র‌্যাডিক্যাল বা লড়াকু। আমার ভাষায় বলেছি, রাজনীতি বা এর লক্ষ্যের প্রকল্পটা ধর্মতাত্ত্বিক। এবং ওরা ভাবছে লড়াইটা ক্রসেডের, বুশের ভাবনার মতই তবে উল্টাপিঠ। খ্রিচানিটির বিরুদ্ধে ইসলামের। এখানে আমি ""ভাবছে''" কথাটা ইচ্ছা করে ব্যবহার করেছি। অবজেকটিভ বৈষয়িক পরিস্হিতিকে কে কী ভাবলো, ব্যাখ্যা করলো আর পরিস্হিতিটা আসলে কী - এদুটো একই জিনিষ নয়। একই হবে এমন কোন মাথার দিব্যি মত অবশ্যম্ভাবিও নয়। গড়মিল একটা থাকতেই পারে। এবং এখানে গড়মিল আছে এদিকেই আমি চোখ ফিরাতে চেয়েছি। আবার ঐ ভাবনা বাস্তবায়নে র‌্যাডিক্যাল বা লড়াকু জীবনপণ হওয়ার কারণে এই গড়মিলটা কাটিয়ে উঠবেই তারও কোন নিশ্চয়তা নাই - তবে একটা সম্ভবনা অবশ্যই।
আসলে এখানে আমি যেভাবে দেখা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের চেষ্টা করেছি সেটা হলো, একটা রাজনীতি (আমি যা বলে নিজেকে দাবী করছি) আর ঐ রাজনীতির লক্ষ্যে নেয়া গৃহীত পদক্ষেপ (step) বা কাজের ধরণ অর্থে রাজনৈতিক কর্মসূচী (দাবি-দফা নয়) - এই দুটোকে আমি এক করে দেখিনি (আমরা অবশ্য এভাবে দেখতে অভ্যস্ত নই, সে যাক)। যেমন লাল ঝান্ডা তুললে বা কমিউনিষ্ট নাম রেখে একটা রাজনীতি ঠিক করলেই শেষ পর্যন্ত ওটা কমিউনিষ্ট পার্টি, বিপ্লব বা ক্ষমতাদখল করবে - এটা নিশ্চিত হবে না। এই রাজনীতির লক্ষ্যে নেয়া গৃহীত পদক্ষেপ (step) বা কাজের ধরণ অর্থে রাজনৈতিক কর্মসূচী লড়াইয়ের পথে কেমন হবে শেষ বিচারে এই (step) টাই নির্ধারক হয়ে যাবে ওটা কাদের পার্টি ছিল, ফলে পরিণতি বা ফলাফল কেমন হবে। কারণ, শেষ বয়চারে, পদক্ষেপটাই ঠিক করে দেয় পার্টিটা কাদের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কমিউনিষ্ট আন্দোলন নিজেকে যেভাবে দেখেছে, দাবী করেছে আর নিজে যা, যেটা তার পদক্ষেপ দিয়ে নির্ধারিত হয়েছে বারবার, এই দুইয়ের বিবাদ গড়মিল আমরা কখনও শুধরাতে পারিনি। ফলে আমরা যা সেই ধরণের পার্টিই ক্ষমতাদখল করেছে।
এখনকার ক্ষয়িষ্ণ সিপিবির দিকে তাকিয়ে দেখুন, ও মনে করে গেল দুবছরের সরকার একটা ভালো সরকার, দুর্নীতি ও সৎপ্রার্থীর সংস্কারমূলক কাজের সরকার। এটা যে পরাশক্তির দুর্নীতির-রাজনীতির সরকার, বাংলাদেশকে ওয়ার অন টেররের রাজনীতিতে পক্ষভূক্ত করার সরকার এটা তার চোখে পড়েনি। একই রাজনীতি আওয়ামি লীগ করে ক্ষমতার সুখস্বপ্ন দেখছে। আওয়ামি লীগের সাথে তফাৎটা হলো সিপিবি নিজেকে ক্ষমতায় দেখে - এই স্বপ্ন দেখার সাহস বা ক্ষমতাটা কোনটাই তার নাই। বিএনপিও এই ক্ষমতার সুখস্বপ্ন দেখছে। সারকথায় আমি বলতে চাচ্ছি, "র‌্যাডিক্যাল ইসলাম" এর ক্ষেত্রে এর রাজনীতি আর পদক্ষেপ (step) বিচারের ক্ষেত্রে, রাজনীতিটা (সে যেটা হতে চায় বা উচিত বলে ভাবছে) এটা র‌্যাডিকাল নয়, পদক্ষেপ বা step টা র‌্যাডিক্যাল, এটাই গড়মিল।
এখন প্রশ্ন হলো, এই গড়মিল কী নিজে কাটিয়ে উঠতে পারবে? উত্তর হলো না। তবে যতক্ষণ step টা র‌্যাডিক্যাল বা লড়াকু আছে ততক্ষণ অন্য একটা আশা আছে। এর মধ্যে রাজনীতিটা যদি একটা অগ্রসর ভাবাদর্শ পেয়ে যায়, অর্থাৎ অগ্রসর ভাবাদর্শ যদি একে জয় করে নেয়, র‌্যাডিক্যাল রাজনীতির রূপ দিয়ে ফেলতে পারে - তবে ইতিবাচক পরিণতির দুয়ার খুলে যাবে। কিন্তু কাজটা ভাবাদর্শগত এবং এক্সটারনাল ফ্যাক্টর - যে গড়মিলটা নজর করতে পারে। এবং এটা ভাবাদর্শগত লড়াই ও শ্রেষ্ঠত্ত্বে জয় করার ব্যাপার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাস্তবতা এর পক্ষে বা তৈরি নয়। ওর ধর্মতাত্ত্বিক লেবাসে আড়ালের কারণে সে শত্রু বিবেচিত হয়ে আছে, কোন ডায়লগের সম্পর্কও নাই।
এই বাস্তবতাটাকেই আমি তুলে ধরেছি মাত্র।
এখন যদি এই এক্সটারনাল ফ্যাক্টরটার কথা বাদ দেই, নিজেদের দায়িত্ত্ব কাজ না দেখতে পাই - তাহলে এর মানে অবশ্যই অন্যকে র‌্যাডিক্যাল দেখে তার পানে সকল স্বপ্ন তাক করে বসে থাকার মতই মনে হবে।
হুবহু একরকম না হলেও সমতুল্য মনে করে আমাদের পিছনের একটা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলি।
ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির আন্দোলন কিন্তু কমিউনিষ্টদের আনুকূল্য জোগাড় করতে সমর্থ হয় নাই, সর্বভারতীয় পর্যায়ে পেরেছিল মুসলিম লীগের বা বলা যায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল মুসলিম লীগে। শক্তিশালী কৃষক-প্রজা পার্টির আন্দোলন, প্রজাসত্ত্বের, জমির জন্য আন্দোলন, কৃষকের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার স্ফুরণ মুসলিম লীগ লেবাস পরিচয় গায়ে চড়িয়ে দেশভাগে একধরণের নিরুপায় পরিণতি পেয়েছিল। নিজেদের অকর্মন্নতা ঢাকতে আমার আজও যাকে জিন্নাহর দ্বিজাতিত্ত্বের ধর্মীয় দেশভাগ বলে ভাবতে পছন্দ করি। আবার খুবই খারাপ কাজ একটা ঘটে গেছে বলে ঘৃণায় এর দায়দায়িত্ত্ব অস্বীকার (disown) করি।
আগামি দিনের ইতিহাস কী আবার এধরণের একটা অভিজ্ঞতার জন্য অপেক্ষা করছে?

শেষ করছি। সবাই ভাল থাকবেন।

৪৫| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১:০২

সুমন রহমান বলেছেন: "প্রত্যেক শ্রেণীকে স্ব স্ব স্বপ্ন কল্পনার পছন্দের রংয়ের বিপ্লবকে বাস্তবে সম্পন্ন করে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় তাঁর স্বপ্ন সঠিক, এটা কোন পেটিবুর্জোয়া কল্পনার ফানুস না। এখানে কেউ কাউকে তাঁর পছন্দের রংয়ের বিপ্লব করে দিবে - এটা ভাবা অবিবেচক বেআক্কলী ও অনৈতিহাসিকও বটে।"

-- পি মুন্সী, এই অংশটা উদ্ধৃত করে রাখলাম।

ফ্রেমওয়ার্কে এসে আলোচনা ঠেকেছিল। গ্রামশি পূবের কি পশ্চিমের তা আপনার অজানা নয়। আমি কোথাও বলি নি যে আমি ফ্রেমওয়ার্কে পূবের প্রয়াসী। আপনি কোথাও কোনো একটি বিষয়কে "পশ্চিমা" ঠাউরেছিলেন সেই প্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম আপনিও পশ্চিমা ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে কথা বলছেন। এর অর্থ এটা দাঁড়ায় না যে আমি পূবের ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে কথা বলছি। আপনার এই ধরে নেয়ার বিষয়টি আমায় খানিকটা অবাক করল।

গ্রামশিয়ানরা মূল মার্কসে দখল কম রাখতে পারেন, তাতেও আমার সমস্যা নাই। আমি মার্কসশরীফে হাফেজ হতেও চাই না। খেয়াল করলে দেখবেন গ্রামশি-র কথা আমি বলেছি এভাবে যে, ব্যক্তিগত একটি গবেষণায় আমি পোস্ট গ্রামশিয়ান ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করছি। আপনার এই মন্তব্যটিও আমায় অবাক করল। মার্কসে দখল রেখে বাড়তি কি সুবিধা পাচ্ছেন আপনি বর্তমান আলোচনায়, বোধগম্য হচ্ছে না।

তবে, মোটের ওপর, আলোচনাটি আমার কাছে মনোজ্ঞ লেগেছে এ কারণে যে আমার মনে হয় আমি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পেরেছি এই প্রসঙ্গে। এর উত্তর পাই বা না পাই সেসব খুব জরুরি নয় এ মুহূর্তে। আর প্রশ্নগুলো করার জন্য সামনে আপনাকে পেয়েছিলাম, এও সৌভাগ্য আমার।

শুরুতে উদ্ধৃত করেছি আপনার কথা। অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনার উপসংহার হিসেবেও। আমি এই আলোচনার গোড়াতে বলে নিয়েছিলাম একটা পারফর্মেটিভ জায়গা থেকে তর্ক করতে চাইছি। রূচিশীল মধ্যবিত্তের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাস্কর্য ইস্যুটা বুঝতে চেয়েছিলাম। শেষে এসে আপনি বললেন যে প্রত্যেক শ্রেণীকেই তার নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়েই বিপ্লবের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে পেটি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত কিভাবে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখবে? তার বিপ্লবের রঙ কি মাদ্রাসা ছাত্রদের রঙের মতই হবে? এই শ্রেণীর কেউ যখন রেডিক্যাল ইসলামকে আন্দোলন হিসেবে সমর্থন করবে তখন তার নিজের শ্রেণী অবস্থান থেকে সেটা সে কিভাবে করবে?


না, এগুলো প্রশ্ন নয়। প্রশ্নের জবাবগুলোই এখন প্রশ্ন আকারে থাকল।

রেডিক্যাল ইসলাম প্রসঙ্গে আপনার পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যাটি ভালো লাগল। আমিও বলছিলাম, এই ফেনোমেনা যতই রেডিক্যাল দেখাক কিন্তু আদতে সে রেডিক্যাল না। আপনিও তাই বললেন। কিন্তু এটা শক্তি হিসেবে রেডিক্যাল এবং বাইরের কোনো অগ্রগামী শক্তি একে জয় করে নিলে এই শক্তি কাজে লাগবে এটাই আপনার অভিমত। আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু বাইরের কোনো অগ্রগামী শক্তি কিভাবে এই রেডিক্যাল রিসোর্সকে আত্মীকরন করবে সেই রোডম্যাপ অগ্রগামী শক্তিকে গোড়াতেই পরিষ্কার করে দিতে হবে। কারণ সবচে বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলছে সে। "রূচিশীল" মধ্যবিত্তের শত্রু হয়ে উঠার ঝুঁকিই বা কেন সে নেবে?

৪৬| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:৩০

পি মুন্সী বলেছেন: আপনার ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে এখনকার ব্যাখ্যা দেখে বুঝলাম আমি যে ব্যাখ্যায় একে গ্রহণ করেছিলাম তা ঠিক না। ফলে এটা আপনার অবাক হবার মত একটা ঘটনা বটে।
আবার আমি কেন "পশ্চিমা" সঙ্কট বলে সমালোচনা করেছি এটাও আপনাকে আমি বুঝাতে পারি নাই। ফলে তা নিয়ে আপনারও একটা ভুল বুঝার সমস্যা আছে। আমি কেন "পশ্চিমা" সঙ্কট বলেছি, কী বুঝাতে চেয়েছি তা সম্ভবত কোথাও ব্যাখ্যা করে লিখেছি। সেটা যাই হোক, আমার কাছ থেকে এটা জানা আপনার পাওনা রইল - আপাতত এটুকু ধরে রাখুন।

আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, "গ্রামশি কী মার্কসিষ্ট? আপনার বিবেচনা কী?"।
উত্তরটা আপনার লেখায় বাদ পরেছে।
আপনার কথা থেকে আমার অনুমান হচ্ছে মার্কস সম্পর্কে একধরণের রিজার্ভেশন আছে আপনার। জানতে চেষ্টা করব ধীরে ধীরে। তবে আমি কমবেশী নিশ্চিত এটা মূল মার্কসের লেখা পড়ে হয়নি; মার্কসবাদ বা কোন সেকেন্ডারি রচনার পাঠের কারণে হয়েছে। আমি কিভাবে মার্কসে দখল রেখেছি কিভাবে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছি তা আমার বর্তমান আলোচনা দেখে আপনার বোধগম্য না হওয়াটাই আমার কাছে স্বাভাবিক। আমি কি করে মার্কসকে ব্যবহার করি বা করছি এটা বাইরে থেকে বুঝা মুশকিল। তবে আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার কোন পর্যবেক্ষণ বা ব্যাখ্যা আপনার ভাল লাগলে বুঝবেন এর অন্তত ৭০ ভাগ কৃতিত্ত্ব মার্কসের। আপাতত এভাবেই বলতে হচ্ছে। তবে আগামিতে আমার লেখা ফলো করলে দেখবেন পরিস্কার হবে কেন আমি একথা বলছি। এই কথা প্রসঙ্গে বলি, আমার জানা হয়নি, "মার্কস ও তথাকথিত প্রকৃতি বিজ্ঞান" নিয়ে আমার পোষ্ট টা আপনি দেখেছেন কী না।

আপনি আপনার এবারের মন্তব্যে আমাকে উদ্ধৃত করে যেটা কেটে এনেছেন, এবার পড়ে মনে হলো, একটা না বলা কথা থেকে গেছে; কথাটা হলো এরকম: প্রত্যেকে শ্রেণীকেই তার স্বার্থকে (ফলে তাঁর বিপ্লবের রংকেও) অন্য সব শ্রেণীর কাছে উপস্হাপন করে দেখিয়ে দিতে পারতে হয় যে এর মধ্যে তাদেরও স্বার্থ আছে, ফলে এটা একমাত্র ভায়াবল স্বার্থ ও সমাধান। এটা দেখাতে না পারলে বিপ্লব হবার কোন কারণ নাই।
এবার পড়ুন, দেখুন নতুন কোন স্পষ্ট অর্থ এতে যোগ হলো কী না।

রেডিক্যাল ইসলাম প্রসঙ্গে, বলেছেন "রিসোর্সকে আত্মীকরণ করবে সেই রোডম্যাপ অগ্রগামী শক্তিকে গোড়াতেই পরিষ্কার করে দিতে হবে"। আমার ভাবনাটা আপনার মত এত শর্তের আটুনি, বা মেকানিক্যাল না। ভয়ের সম্পর্কও না। আমার মতে,
ধর্মতাত্ত্বিক ও ধর্মের ফারাক টেনে ধর্মের পর্যালোচনা বা মোকাবিলার কাজটা চালিয়ে যেতে হবে।
একটা সক্রিয় ও গঠনমূলক ডায়লগ করার জায়গা বের করতে হবে। আস্হায় নিয়ে বলে যেতে হবে কেন ধর্মতাত্ত্বিক বয়ানে কাজ হবে না। ইসলামের অবদান উপাদান হিসাবে সাথে থাকবে কিন্তু ইসলামের নামে ঝান্ডা তুলে আগান যাবে না। ইসলামি যদি সত্যি সত্যি র‌্যাডিকাল মীন করে তাহলে একথাগুলো অপছন্দ করার কথা না।

আপনার "রূচিশীল" মধ্যবিত্তটা ঠিক বুঝি নাই। মধ্যবিত্ত আসলেই যদি রুচিশীল হয় তবে এর তাৎপর্য না বুঝতে পারার কথা না। অবশ্য যাই ঘটুক একটা বড় অংশ পশ্চিমের প্রচারণায় ভড়কে গিয়ে নিজেকে বিপদগ্রস্হ তো করবেই।

বাংলাদেশে আগামিতে যে কোন র‌্যাডিক্যাল বদলে "রূচিশীল" মধ্যবিত্তের শত্রু হয়ে উঠা ছাড়া পথ কই?




৪৭| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ২:১৭

তরিকুল হুদা বলেছেন: হুমম............কথা অনেক হলেও জল বেশী দুর একেবারেই গড়ায় নাই।ওপরের মন্তব্যগুলির (আমার সর্বশেষ মন্তব্যের পর........) ব্যাপারে খানিক কথা অবশ্যই ছিল।তা বলার আগে "রূচিশীল" মধ্যবিত্তের সংগঠন 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন' সম্পর্কে একটি জরুরী সমালোচনা তুলে দিলাম।লেখকত্রয়কে সালাম জানাই।

রিফাতের আসল প্রশ্ন স্যুয়িং খেয়ে ইসলামী আন্দোলনের লুম্পেন নেতৃত্যের কাছে আসলো পরে গিয়ে ঠেকলো মার্ক্সবাদ আর গ্রামসীর পায়ে।পানি থেকে ট্রেনটাকে আবার লাইনে আনার একটু চেস্টা করি।
যত যাই হোক সুমন আর পি মুন্সীকেও ধন্যবাদ জানাই।

উৎস: http://arts.bdnews24.com/?p=2037

------------------------------------------------------------------------------

'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর ধারণাগত এবং অনুশীলনগত পাটাতন প্রসঙ্গে ভাস্কর্য-ভাঙা পরবর্তী আন্দোলনপ্রবাহের সংকট ও আমাদের বিহ্বলতা
#২৬ december ২০০৮ ৬:৩৬ অপরাহ্ন

লেখাটি নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য ভাঙা ও অপসারণের প্রতিবাদে ঢাকার চারুকলা অনুষদকে কেন্দ্র করে গঠিত ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর মতবিনিময় সভায় প্রচারিত বক্তব্যের [‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’: আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষিত৯০] সমালোচনা হিসাবে যৌথভাবে লিখিত। উল্লেখ্য, সভাটি ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ১২ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত হয়। — বি. স.

-স্বাধীন সেন, মানস চৌধুরী ও মাসউদ ইমরান-

এই নাতিদীর্ঘ রচনাটিকে দেখা দরকার বিগত কয়েক মাস যাবৎ মহানগরের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সংমিশ্রণের প্রশ্নে আমাদের চলমান অস্বস্তির একটা প্রাথমিক দলিল হিসেবে। এই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি-প্রণালীর মুখ্য অনুঘটক হিসেবে সাম্প্রতিক ভাস্কর্য-ভাঙা ও তৎপরবর্তী নাগরিক আন্দোলন এখানে স্মর্তব্য। রচনাটিতে একটি নথিকে কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্ত করা হয়েছে। সেটা করা হয়েছে নথিটির গুরুত্ব বিবেচনা করেই, এবং সূত্রানুযায়ী অপরাপর প্রসঙ্গ এখানে পর্যালোচিত হয়েছে। আলোচ্য নথিটি অধুনা সংগঠিত ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর ঘোষণাপত্র হিসেবে ১২ই ডিসেম্বর ২০০৮-এ এই সংগঠনের মত বিনিময় সভায় — দৃক গ্যালারিতে — প্রচারিত। এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে বিমানবন্দরে ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার পর গড়ে-ওঠা নাগরিক আন্দোলনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের লক্ষ্যে। তবে উল্লেখ করা দরকার যে, মতবিনিময় সভার দিন ঘোষণাপত্র হিসাবে পাঠ ও প্রচার করা হলেও কয়েকজন সহকর্মী নথিটিকে প্রাথমিক-পর্যায়ের আর তাড়াহুড়ো-করে-তৈরি করা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। পরবর্তী নথির জন্য আমাদের সাগ্রহ অপেক্ষা আছে। প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে ওই ভাস্কর্য ভাঙার (মতান্তরে অপসারণের) ঘটনার পর একাধিক মোর্চায়, এবং বিশেষভাবে চারুকলা চত্বরকে ঘিরে, নানান রকমের আন্দোলন সংঘটিত করবার প্রয়াস ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক প্রবাহের চিন্তকবর্গ নিয়ে চলছেন। পেশাগতভাবে হিসেব কষলেও এই বিষয়ে আমাদের অসম্পৃক্তি নৈর্লিপ্তিজনিত নয়।


বাংলা? কেন?-
'বাংলা'পদটিকে প্রায়শই দাবি করা হয়ে আসছে জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিস্থঃ একটা ধারণা হিসেবে যেখানে ভৌত পরিসরকে জাতীয়তা কিংবা ভাষাভাষিতার প্রশমনকারী হিসেবে প্রক্ষেপ করা হয়। এর অন্তঃসারশূন্যতা দেখার চেয়ে, ঐতিহাসিকভাবেই, ভণিতা হিসেবে একে দেখা কার্যকরী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রচারিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা ও চর্চা থেকেই তা অনুধাবন করা সম্ভব। ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর নামে কেন্দ্রীয় গুরুত্বের জায়গায় ‘বাংলা’ পদটি হাজির, এবং আমাদের আশঙ্কা, এটি ব্যবহৃত হয়েছে পদটির ক্রমাগত-সরলীকৃত ঐতিহাসিক নির্মাণের উপর দাঁড়িয়ে এবং জাতীয়তাবাদের বিতর্কটিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে। আমাদের এই অনুধাবনের প্রেক্ষিত হচ্ছে বাংলা সম্পর্কিত বলবান পাবলিক ডিসকোর্স যেখানে ‘হাজার বছরের বাংলা’র অতিকথন বাংলা পদটিকে উদ্ভাসিত করে।

এই বাংলা আধিপত্যশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে আমরা ঠাহর করি। আধিপত্যশীল ইতিহাস চর্চায় এবং এর সরল পাবলিককৃত জবানে ‘হাজার বছরের’ ইতিহাসের কথা বলা হয়। হাজার বছর তো দূরের কথা, বাস্তবে আকবরের সুবা বাংলা আর আজকের ‘বাংলা’ স্থান হিসেবেই এক এলাকাকে নির্দেশ করে না। ‘বাংলা’ অঞ্চলটি, এমনকি সীমানার দিক থেকেও, অনেক পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে যদি পদটির সঙ্গে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রবাহকে আপাততঃ বিবেচনাতে নাও আনি, আলাপের স্বার্থে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘বাংলা’ কেবল একটি স্থানিক সীমানাকে নির্দেশ করে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের পরিসরে ‘বাংলা’ প্রত্যয়টি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সস্পর্কাদি, শর্ত ও পরিবর্তনকে প্রকট ও প্রচ্ছন্নভাবে দ্যোতিত করে। অনেক চিন্তকই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণার উৎপত্তি, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা, প্রতীক ও অনুশীলনের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে চিহ্নিত করেছেন। ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসন ও ক্ষমতার সঙ্গে এই জাতীয়তাবাদের ধারণাগত আদান-প্রদানের শর্ত ও প্রক্রিয়াগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন। ‘সমন্বয়বাদী’ তৎপরতা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলা অঞ্চলের ধারণার ক্ষেত্রে প্রকট হলেও জাতীয়তাবাদী ধারণার অনুশীলন ও জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের বাস্তবায়নের অনিবার্য শর্ত হিসাবে মুসলমান, দলিত, অস্পৃশ্য, নারী এবং বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তাকে এই জাতীয়তাবাদ অধস্তন হিসেবে নির্মাণ ও পরিবেশন করে আসছে। সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিক) ঐতিহ্যের তত্ত্বের প্রধান ঝামেলা হলো এই তত্ত্ব অসমতা (ক্ষমতা ও উৎপাদন সম্পর্কগত) ও তার ধবংসক্ষম ও সৃষ্টিশীল সক্রিয়তাকে আমলে নিতে পারে না। দুর্বল জাতিগুলোকে বা সাংস্কৃতিক প্রবণতাগুলোকে তাই স্বীকৃতি/অস্বীকৃতির জন্য নির্ভর করতে হয় প্রবল জাতি বা সাংস্কৃতিক প্রবণতার উপরে। কারা সমন্বয় করছেন? কীভাবে সম্বনয় হচ্ছে? কেন সম্বন্বয় হচ্ছে? — এই জরুরি প্রশ্নগুলো এখানে উপেক্ষিত হয়। সমন্বয় কোনো একপাক্ষিক ক্রিয়া নয়। এটা দুই বা বহুপক্ষের মধ্যের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। সেকারণেই প্রবল অসমতার মধ্যে সমন্বয়ের ক্রিয়াটির কারক হয়ে সর্বদাই ওঠে প্রবল পক্ষটি। ‘রাষ্ট্রীয় সাংস্কুতিক অনুষ্ঠানে’ অথবা ‘প্রগতিশীল’ আন্দোলনের সঙ্গে মানানসই করে ‘আদিবাসী’ সাস্কৃতিক কর্মের বা ‘লোকজসংস্কৃতির’ পরিবেশন তাই প্রকারান্তরে হয়ে ওঠে প্রবল পক্ষের উদযাপন-আত্মস্তুতি-প্রদর্শন আর অবশ্যই, নিজকে ‘উদার’ ‘পরমতসহিষ্ণু’ হিসাবে জাহির ও প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম।

উপরন্তু, স্বাধীন বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড়ি বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে এই জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবেই যে আধিপত্যবাদী সাম্প্রতিক ইতিহাসের পঠনে তা দেখানো সম্ভব। পাহাড়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংঘাতময় সম্পর্ককেও স্মরণে রাখা জরুরি। যদি অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাকে’ নির্মাণ করার দাবি করা হয় (যেমনটি পিয়াস করিম ১২ই ডিসেম্বরের মতবিনিময় সভায় বলেছেন) কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাকে আমরা পেয়েছি সেই ‘বাংলাকে’ মানদণ্ড ধরে এগুতে হয় (যেমনটি আজফার হোসেন একই সভায় প্রস্তাব করেছেন), সেক্ষেত্রে কতগুলো সমস্যা চিহ্নিত না করে উপায় থাকে না। কাদের অনুশীলনের মাধ্যমে এই ‘বাংলা’ নির্মিত হবে? তাদের জাতিগত, উৎপাদন ও ক্ষমতা সম্পর্কগত, শ্রেণীগত, লিঙ্গীয় অবস্থান কী? বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ ‘উদারপন্থী’ ‘সেক্যুলার’ আওয়ামী লীগিয় ও বামপন্থী বলে স্বীকৃত একাংশের অনুশীলনে যে বাংলা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে সেই ‘বাংলা’র সঙ্গে এই ‘বাংলার’ ফারাক কোথায় ও কীভাবে হবে তা আর যাই হোক ঘোষণাপত্রে কিংবা এই মুহূর্তের তৎপরতায় স্পষ্ট নয়। যদি এই ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ করোটিতে ধারণ করে ব্যূপনিবেশীকরণ (সেদিনকার আলোচনায় একটা তাগিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে; ঘোষণাপত্রের সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য থাকেনি সেটা হিসেবের বাইরে রাখলেও) একটা নির্ভেজাল স্ববিরোধ।

সর্বোপরি, ‘বাংলা’ পদটির প্রশ্নাতীত আত্তীকরণ নিয়ে আমরা চিন্তিত এই কারণে যে এই পদ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র অনুধাবনের প্রচেষ্টাতে গোড়াতেই কপাট বন্ধ করে দেয়। কর্পোরেট পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নতুন নতুন প্রকাশগুলোর কথা মাথায় রাখলে উত্থাপিত প্রশ্নাবলীর সমাধান না-করে কিংবা আরও আরও প্রশ্ন উত্থাপন না-করে আন্দোলন পুরানো-ব্যঞ্জনাসর্বস্ব হয়ে পড়বে বলে আমাদের আশঙ্কা। এটা পরিতাপের যে, এমনকি সীমিত পরিসরে উত্থাপনের পরও, আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা ও আশু করণীয় এজেন্ডাগুলোর সাপেক্ষে এসব প্রশ্নকে সেদিনের বক্তারা গুরুত্বহীন দাবি করেছেন। গত ৩৭ বছরে বিভিন্ন ‘প্রগতিশীল’ আন্দোলনেই বিভিন্ন ছুতায় এধরনের যে-কোনো প্রশ্নকে কোণঠাসা করে তোলার অনুশীলন দাম্ভিক জাতীয়তাবাদী চেহারা পেয়েছে। লক্ষ্য রাখা দরকার যে, ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তীকালে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যের সীমারেখাগুলো সাম্রাজ্যবাদের নতুর পরিসরে অনেকটাই ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্র এবং তার প্রতিষ্ঠানাদি, মিডিয়া আর সিভিল সোসাইটি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে এবং জাতি-রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য রক্ষার নামে এমন সব বিধিবদ্ধতা তৈরি করেছে/করছে যা খোদ গণতন্ত্রের মূলনীতিমালাগুলোর পরিপন্থী। এই ধোঁয়াচ্ছন্নতা কথিত ফ্যাসিবাদবিরোধী হিসেবে দাবিদার আন্দোলনগুলোতেও আছর ফেলছে নানান ভাবে।

সম্প্রীতির গালগল্প-
ঘোষণাপত্রের ও উল্লিখিত আলোচনার আরেকটি কেন্দ্রীয় থিম বা মূলভাব হচ্ছে সম্প্রীতি। বিবরণীটা এরকম: ‘হাজার বছর ধরে’ বাংলায় সবাই সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে! মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়টি যেন এই সম্প্রীতিদার বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই মুখ্য পরিচয় থেকে এক ধরনের বিচ্যুতি! কিন্তু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত স্পষ্টভাবেই দেখায় যে, ‘আবহমান বাংলার’ এ জাতীয় চিত্রায়ন বেঠিক, মিথ্যা। ধর্মীয়, জাতিগত ও অন্যান্য সংঘাত অত্যন্ত প্রাচীন, এবং চলমান। যে জিজ্ঞাসা বরং এখানে কার্যকরী হতে পারত, এবং জরুরি, তা হচ্ছে কীভাবে আধুনিক রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দর্শন প্রাক-আধুনিক সংঘাতমেরুর এবং সংঘাতপ্রবণতার খোলনলচে বদলে দিল; কীভাবে সংঘাতের চারিত্র্যের মধ্যে আধুনিক সহিংসতা অনুপ্রবেশ করল; কী কী উপায়ে রাষ্ট্র এসব সংঘাতকে, মীমাংসার বদলে, জিইয়ে রাখল। ইত্যাদি।

বাস্তবে প্রবল জাতীয়তাবাদী অনুভূতি এখানে পুনরুৎপাদিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ঐতিহাসিক গতিপ্রকৃতি ও রূপান্তরপ্রবণতা অস্বীকার করা হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এই উপেক্ষা আত্মপরিচয়ের একটা পল্কাবোধ বা নিরাপত্তাহীনতা থেকে এসেছে বলেই কেবল ঠাহর হয়। এই ইনসিকিউরিটি জাত্যাভিমানী ছাড়া কার থাকে? আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সম্প্রীতির ঐতিহাসিক সরল চিত্রপ্রকাশ সম্প্রীতির লক্ষ্য অর্জনে তো সাহায্য করেই না বরং তা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার অনুশীলনকে বাধাগ্রস্ত করে। এই ‘সরল’ বাংলার উদ্যাপন-উৎসবে কোন জাতির বা ধর্মের লোকের পক্ষে নিজ অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এবং ইতিহাস দিয়ে কালি ছিটানো সম্ভব?

তাহলে ‘প্রগতি’ বনাম ‘মৌলবাদ’ নয়?-
‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর ঘোষণাপত্রে যদিও বলা হয়েছে যে এই আন্দোলন তার এজেন্ডাগুলোকে ‘প্রগতি’ বনাম ‘মৌলবাদের’ লড়াই হিসাবে দেখছে না, তথাপি তার থেকে ভিন্ন কিছু ঘোষণাপত্রে দেখা যায়নি। আলোচকগণের আলোচনার মুখ্য স্বরও এই ঘোষণার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। ‘প্রগতি’ বনাম ‘মৌলবাদ’ যুগ্ম- বৈপরীত্যের বিকল্প তত্ত্বায়ন বিপজ্জনকভাবে ঘোষণাপত্রে দুর্বল, যদি আদৌ কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক কী, কোথায় সেই সম্পর্ককে প্রেক্ষিতকৃত করে পাঠ করা যাবে, কীভাবে সেই সম্পর্ককে তীক্ষèভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে সেসব জিজ্ঞাসার সঙ্গে সংমিশ্রিত মনে করা সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে এই ঘোষণাপত্রকে কিংবা এই পক্ষীয় আন্দোলনকারীদের। ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে-কোনো সাংস্কৃতিক তৎপরতার আগুয়ান চারিত্র্য বিবেচনা করলে বিকল্প তত্ত্বানুসন্ধানের অভাবটা গুরুতর যেহেতু ‘জনগণের’ কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়ার একটা দায়িত্ব ধারাবাহিকভাবেই সংগঠকেরা করে আসছেন।

‘প্রগতি’ বনাম ‘মৌলবাদ’-এর পাকচক্রটা, নিরীখ করে দেখলে, বাংলাদেশে অর্থোডক্স বাম-লিবেরেল মিথোজীবী ঘরানায় দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত তাত্ত্বিক পাটাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্ম সম্পর্কে যে রকম জনসমাজবিচ্ছিন্ন, ঊর্ধ্বপদ ও দুর্বল তত্ত্বায়ন ও অনুশীলন বলবৎ রয়েছে সেটাই প্রকট হয়ে উঠেছে আলোচ্য ঘোষণাপত্রে এবং আন্দোলন মোর্চায়। সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ ও রাজনৈতিক ধর্মের বহুমাত্রিক পরিবর্তনশীল সম্পর্ক এবং সেই সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধে ধর্মীয় প্রতীক ও অনুশীলনের বহুমাত্রিক তাৎপর্য এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। এই উপেক্ষা আলসেমিজনিত নাকি অজ্ঞতাজনিত সেই প্রশ্ন আমাদের ভাবিয়েছে এবং পরিশেষে দুটোই সমান বিপজ্জনক বলে আমাদের মনে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম, ধর্মীয় অনুশীলন ও রাজনৈতিক ইতিহাসের পাঠ এখানে অসহিষ্ণু এবং হালকা-পলকা। ‘জামাত’ এমন একটা জেনেরিক বর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং আলোচ্য সভাটিতেও বারংবার হয়েছে, যে কোনো রকম গূঢ় উপলব্ধির ভরসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

যদি ‘প্রগতি’ বনাম ‘মৌলবাদ’ এর প্রথাগত বৈপরীত্যের বাইরে তত্ত্বায়ন করতে হয়, আগেই যেমনটা জাতীয়তাবাদের ঔপনিবেশিক পাটাতন নিয়ে উল্লেখ করেছি, প্রগতির দার্শনিক বনিয়াদ নিয়ে কেবল সজাগ হলেই চলবে না বরং এই জোড়কে অকার্যকর করে দেবার যুক্তিতর্ক হাজির করতে পারতে হবে। সেসব আত্মাবয়ব, বিদ্বেষ ও ভীতিবোধ প্রথমেই পরিহার করা দরকার বলে আমরা মনে করি যা এই বিপরীত জোড়ের লেগ্যাসি হিসেবে বহন করা হচ্ছে।

সর্বরোগহরা লোকসংস্কৃতি লালন-
লোকসংস্কৃতি লালন-পালন এবং খোদ লালন সম্ভবতঃ সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ। এই প্রপঞ্চ, আমাদের সতর্ক পর্যবেক্ষণ, বাঘ-মহিষ এক ঘাটে নিয়ে এসে ছেড়েছে। কর্পোরেট পুঁজি কেন্দ্র থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট টেলিভিশন, বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে শুরু করে দেশজ চিন্তক, ফ্যাশন হাউজ থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকারী পর্যন্ত একটি ‘আইডিয়া’তে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করেছে। যখন কোনো সাংস্কৃতিক-লক্ষণা পরস্পর সম্ভাব্য বিপ্রতীপ বর্গসমূহের দ্বারা এরকম নির্বিশেষে আত্তীকৃত হয় তখন গভীরভাবে তা তদন্তের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। এই তদন্ত ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’ করতে ইচ্ছুক বলে মনে হয়নি। বরং ঘোষণাপত্রটিতে লালন ও লোকসংস্কৃতি লালন-পালন একটা সর্বরোগহরা দাওয়াই হিসেবে উপস্থিত হয়েছে এবং আশু মীমাংস্য জিজ্ঞাসাবলীর সঙ্গে যথেষ্ট সংমিশ্রণ না-ঘটানোর একটা পরিত্রাণ-পথ হয়েছে (যেমন, আলোচ্য সভায় লোকসংস্কৃতির প্রতিভূ হিসেবে ছিলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক লুবনা মরিয়ম)।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে যখন ‘ফোক-ফ্যান্টাসি’ যখন একটা চলচ্চিত্র-বর্গ হিসেবে জনপ্রিয়, তখন অনেকের মতোই, আমরা এই বর্গটি শনাক্ত করতে যথেষ্ট সমর্থ ছিলাম না। এর একটা কারণ আমাদের অল্প বয়সের শব্দভাণ্ডার-সীমাবদ্ধতা, আমাদের সাহিত্য-সমালোচনা পাঠের অভাব ইত্যাদি। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রবল ধারার চলচ্চিত্র নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে বাতিকগ্রস্ত দূরত্ব এবং কোনোরকম পাঠপরিক্রমার অভাবও আমাদের অবোধ থাকার কারণ। এই এত বছর বাদে ‘ফোক’ কীভাবে ‘ফ্যান্টাসি’ তা হাড়েমজ্জায় উপলব্ধি করবার সুযোগ আমাদের হয়েছে। ‘লোকসংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘হাজার বছরের বাঙালি’র বৌদ্ধিক সাফাইকারী/জাস্টিফায়ার। ‘লোকসংস্কৃতি’ এক কল্পদূরত্বের সাংস্কৃতিক জমিন যার উপর দাঁড়িয়ে সেক্যুলার-লিবেরেল চিত্ত তার নিজের অভিব্যক্তির সমরূপতা খোঁজে।

লোকসংস্কৃতির, এবং বিস্ময়করভাবে এর প্রতিভূ হিসেবে লালন-এর, উদবর্তন অধুনা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার একটা বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হিসেবে আমরা শনাক্ত করি। প্রপঞ্চটি মূর্ত হয় অস্ট্রেলিয় এ্যাবরজিনাল আর্ট-এর মোটিফ ঢাকার ফ্যাশন শিল্পের কোনো একটি পোশাকে প্রস্ফূটিত হবার মাধ্যমে যেমন, ইউনেস্কোর মহাসম্মেলনে ‘হেরিটেজ’ বিষয়ক ধারাবাহিক আহাজারির মধ্যেও তেমনি। সাংস্কৃতিক আইকন নির্মাণের বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কীভাবে এবং কোথায়-কোথায় বাংলাদেশ সামিল হয়ে আছে সে বিষয়ে বৌদ্ধিক অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি কাজ। ধারণা করি যে, এই বিষয়ে আরও আলাপ-আলোচনার দরকার পড়বে। এবং প্রয়োজনীয় তর্কাতর্কির মধ্যে এই বিষয়ে পুনর্বার কথা বলবার ইচ্ছা আমরা রাখি এবং জরুরিত্ব আমরা অনুভব করি।

একটা আর্তনাদের মতো শোনায়-
বিমানবন্দরের ঘটনার পর মুখ্যত চারুকলা চত্বর থেকে বিকশিত যে আন্দোলনটি দানা বাঁধছে তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মুখ্য একটা হচ্ছে একটা আর্তনাদ-প্রায় দাবি: “আমাদের ‘ওরা’ সংস্কৃতিচর্চা করতে দেবে না।” এখানে এই ‘ওরা’ বিস্ময়করভাবে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে। প্রায়শঃ, যখন আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা সংঘটিত হয় তখন, ভাস্কর্য ভাঙাকে সংস্কৃতি-চর্চার-বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সাম্রাজ্যবাদী আঘাত হিসাবে সরল ভাবে পাঠ করার প্রবণতা অনুভূত হয়। আবার একই সঙ্গে, এবং প্রায়শঃ মধ্যবিত্ত পাবলিক-জবানে ভাস্কর্যভাঙার বিষয়টাকে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ধর্মীয় ‘গোঁড়ামি’র সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখা হয়। যখন এই দুই থিসিসের সম্পর্ক, ন্যায্যভাবেই, নিয়ে একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে তখন অবধারিতভাবেই ধর্মগোষ্ঠীকে দেখানো হয় রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের ‘দালাল’ কিংবা ক্রীড়নক হিসেবে। এ কথা বলবার সময়ে আমরা সবিশেষ সতর্ক আছি যে রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক আঘাত-থিসিস অন্যটার থেকে লক্ষণীয়ভাবে অল্পচর্চিত।

রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মগোষ্ঠী এবং প্রতি-সাংস্কৃতিক চর্চাদি এত সরল বিষয় হলে হয়তো সুবিধা হতো। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না যে এগুলো এত সরল ও দ্বিমুখী। প্রতি-সংস্কৃতি কেবল ধর্মীয় বা ধর্মশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয় নয়। গত এক শতকের ইতিহাসের মধ্যেও এগুলো লক্ষ্য করা দরকার। বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়াতে, কিংবা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর গণচীনে ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ আছে যেখানে পূর্বতন সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির নিদর্শন হিসেবে এন্তার মূর্তি/ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় নকশাল আন্দোলনের অংশ হিসেবে শহর-সজ্জার জন্য প্রতিষ্ঠিত বহু ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে সেগুলোকে বুর্জোয়া চিন্তাচেতনার সম্প্রসারণ হিসেবে অনুধাবন করে। আবার তালেবানদের বামিয়ানের বৌদ্ধ ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাটি, আমরা যতই ক্ষুণ্ন হই না কেন, ইউএন-এর চতুর ও লাঙ্গুর-ধরা রাজনীতির প্রতি একটা বার্তাপ্রদানও বটে। এসমস্ত জটিল অভিব্যক্তি পাঠের ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ তত্ত্বায়ন ও ক্ষুরধার বিশ্লেষণ ছাড়া লঘুতার ঝুঁকি প্রকট।

আর্তনাদটা আমাদের চিন্তিত করবার কারণ আছে। প্রধান কারণ এই যে এটি কোনোরকম রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বদলে একটা সেন্টিমেন্টাল সহমর্মিতা যাচনা করে। উপরন্তু এই আর্তনাদ ইতিহাসে নানাবিধ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি প্রণালী জারি থাকার নজিরের সঙ্গে বেমানানও বটে। সর্বোপরি, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতা নির্ধারণের জন্য এবং মৈত্রী স্থাপনের জন্য রাষ্ট্র ও এর নানাবিধ এজেন্সিকে বুঝতে বাধা প্রদান করে।

প্রতিমা/মূর্তি/ভাস্কর্য: অথ দুর্গা সমাচার-
ভেঙে-ফেলা ভাস্কর্যগুলো কেমন ছিল এ নিয়ে ভাস্কর্যগুলো চাক্ষুষ দেখনেওয়ালাদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। এটা কাকতালীয় যে আমরা স্বচক্ষে সেগুলো দেখি নাই। পরবর্তীকালে মনে হয়েছে না-দেখার কারণে গ্লাণিবোধের বিশেষ কারণ আমাদের নেই। কিন্তু সঙ্গত কারণেই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন ‘ভাস্কর্য’ আর ‘মূর্তি’র পার্থক্য বিষয়ে ধর্মগোষ্ঠীকে সজাগ করতে সচেষ্ট হলেন, তখন উদ্দীষ্ট মানুষজন হোন বা নাই-হোন, আমরা কিন্তু হয়েছিলাম। ‘মূর্তি’ বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রায় দৈনন্দিন ব্যবহার্য একটা পদ। নানান ব্যাঞ্জনায় কখনো এটি ‘প্রতিমা’। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো অঞ্চলে ‘মূর্তি’ ভাঙা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এটি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে একটা প্রপঞ্চ-মর্যাদা লাভ করে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই করে না। কেন অপরাপর পূজার তুলনায় দুর্গা পূজাতে, কিংবা কখনো কখনো কালী পূজায়, এই আক্রমণ অধিকতর তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেয়া খুব জটিল কিছু হবে না। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, ভাস্কর্য কিংবা যেকোনো ‘শিল্পরূপ’ সম্পর্কে মোহগ্রস্ততা থাকলে তা আসলে সহিংসতা এবং প্রতিপক্ষতার রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক বৈরিতার অনুশীলনকে উপলব্ধি করতে সহায়তা দেবে না।

পাবলিক পরিসরে সেক্যুলার ভাস্কর্য ভাঙা, আর ‘প্রাইভেট’ পরিসরে ধর্মীয় ভাস্কর্য (প্রতিমা) ভাঙার ঘটনার মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ককে আমরা কীভাবে বুঝব? এসব ক্ষেত্রে প্রতি-সাংস্কৃতিক তৎপরতার নানাবিধ বহিঃপ্রকাশকে, সমান্তরালভাবে, পাঠ করবার মতো যথেষ্ট উদযোগী হওয়া দরকার। সেক্যুলার-লিবেরেল আইকন বা মোটিফ ইত্যাদির উপর আঘাত নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা ঘন হয়ে গেলে সহিংসতা কিংবা রাষ্ট্রের চালিয়াতি দুটোই অনুসন্ধান কঠিন হয়ে পড়বে।

রাষ্ট্রকে অনুধাবনের আবশ্যকতা-
খুশির কথা যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রবক্তা বিষয়টিকে নগর-পরিকল্পনার সার্বিক রাষ্ট্রীয় তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করতে ব্যবহার করেছেন। তবে ১২ই ডিসেম্বরের সভায় কিংবা ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর ঘোষণাপত্রে এই জিজ্ঞাসার কোনো ছাপ ছিল না। ঢাকা মহানগরীর মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠছে ‘নান্দনিক’ স্থাপনা। এসব স্থাপনা কর্পোরেট পুঁজির উল্লম্ফিত সামর্থ্যকেই ইঙ্গিত দেয় মাত্র। এসব স্থাপনা কি আমাদের আরাম দেয়? কেবল ‘নান্দনিক’ বলে? অন্যদিকে, রাষ্ট্রকে সরলভাবে কেবল একটি কারক (এজেন্ট) হিসেবে তত্ত্বায়িত না করে একটি বিশ্বজনীনীকৃত চরম ক্ষমতাবান শর্ত/শর্তের সমষ্টি হিসেবে ঠাহর করা এই মুহূর্তে দারুণ দরকার। উপনিবেশীকীকরণ এবং আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভব ও বিশ্বজনীনীকরণের ইতিহাস মনে রাখলে দখল-নিয়ন্ত্রণ-হস্তক্ষেপ-রূপান্তরের দুনিয়াব্যাপি বিস্তারে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের নতুন পরিকাঠামোয় এই ধারণায়ন আমলে নেয়া অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রীয় (অ-রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্রোর্ধ্ব) প্রতিষ্ঠানাদি, মিডিয়া, কর্পোরেট বাণিজ্য ও ধর্মের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাসের বিবিধতার ক্ষুরধার বিশ্লেষণে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের শর্তাবলির স্থানিক ও বৈশ্বিক জটিল সম্পৃক্ততাকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস আলোচ্য আন্দোলনের এজেন্ডায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বাংলাদেশে ভাস্কর্য-ভাঙার দৃশ্যমান শক্তিগুলোর সংগঠিত ও বিকশিত হয়ে ওঠার ইতিহাসে এই শর্তসমূহ সবল ভূমিকা রেখেছে বলে আমরা মনে করি। এই শর্তগুলো, চুলচেরা বিশ্লেষণে, রাষ্ট্রীয় ও বহুরাষ্ট্রীক সমরতন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত দেয়।

জিজ্ঞাসাটি, তাহলে, হচ্ছে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিসমূহের মধ্যে বৈরিতা ও সদ্ভাবের জায়গাগুলো নিয়ে। যদি বৈরিতার পক্ষ বহুমাত্রিক হয় তাহলে বহুমাত্রিক হতে হবে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।

৪৮| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১০:৫৮

সুমন রহমান বলেছেন: তরিকুল হুদা, "রিফাতের আসল প্রশ্ন" বিষয়টা বুঝলাম না। আলোচনা কোনো একটা ভনিতা থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেখানেই যে থেমে থাকতে হবে এমন তো না। আর দীর্ঘ যে লেখাটি উদ্ধৃত করলেন, তাকে সারসংক্ষেপ করে কিছু লিখুন (পড়েছেন যেহেতু)। এত দীর্ঘ লেখায় সময় বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। :)

৪৯| ১৫ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:২৪

তরিকুল হুদা বলেছেন: সুমন রহমান,ভাস্কর্য বিতর্কে তথাকথিত 'রুচিশীল',সুশীল,....... মধ্যবিত্তের অবস্হানের ক্রিটিকই ছিল রিফাতের আসল প্রশ্ন।এটাকে ভনিতা ভেবে জোর করে যেভাবে আলোচনাকে ভিন্ন যেই খানে নেয়া হলো সেইটাকে অবশ্য আমি ভনিতা বলব না বরং যারা তা করলেন তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গেলেও নিজের অবস্হান পরিস্কার করেছেন।যদিও আলোচনাটা একটা লুপহোলের মধ্যেই ঘুরপাক খাইছে।রিফাতের আসল প্রশ্ন বুঝেন নাই নাকি বুঝতে চান না সেটাও আমি বুঝলাম না।

যদি উপরের লেখা পড়া আপনার কাছে সময় অপচয়ের ঝুঁকি মনে হয় তাইলে আপনে বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলনের ঘোষনাপত্র পাঠ করেন, আলবৎ আনন্দ পাইবেন মনে হয়।তারপরও শর্টকাট সারমর্ম দিলাম আপনার জন্য-
'রাষ্ট্রীয় (অ-রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্রোর্ধ্ব) প্রতিষ্ঠানাদি, মিডিয়া, কর্পোরেট বাণিজ্য ও ধর্মের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাসের বিবিধতার ক্ষুরধার বিশ্লেষণে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের শর্তাবলির স্থানিক ও বৈশ্বিক জটিল সম্পৃক্ততাকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস আলোচ্য আন্দোলনের এজেন্ডায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বাংলাদেশে ভাস্কর্য-ভাঙার দৃশ্যমান শক্তিগুলোর সংগঠিত ও বিকশিত হয়ে ওঠার ইতিহাসে এই শর্তসমূহ সবল ভূমিকা রেখেছে বলে আমরা মনে করি। এই শর্তগুলো, চুলচেরা বিশ্লেষণে, রাষ্ট্রীয় ও বহুরাষ্ট্রীক সমরতন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত দেয়।

জিজ্ঞাসাটি, তাহলে, হচ্ছে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিসমূহের মধ্যে বৈরিতা ও সদ্ভাবের জায়গাগুলো নিয়ে। যদি বৈরিতার পক্ষ বহুমাত্রিক হয় তাহলে বহুমাত্রিক হতে হবে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।'

এরমধ্যে গাজায় অভিযান চলতেছে আর সামহোয়ারে রিফাতের লেখা মুছা হইছে.................তারপরও হামাসের প্রতিরোধও চলতেছে আর আমরাও কমেন্টাইতেছি।

ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.