নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হইচই, হট্টগোল এড়িয়ে চুপচাপ, নিরিবিলিতে লুকিয়ে থাকতে ভাল লাগে।

রিম সাবরিনা জাহান সরকার

যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/

রিম সাবরিনা জাহান সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

রিপোস্টঃ সাইকেল আউর আওরাত

১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৩:৫৪


১.
লাল বাতিতে দাঁড়িয়ে আছি। পেছন থেকে জড়ানো গলায় হাঁক আসলো, ‘সাইকেল নিয়ে কই যাও?’ ফিরে দেখি, মহল্লার পরিচিত মাতাল। চলতে ফিরতে সামান্য হাই-হ্যালোর মত আলাপ। কি ভেবে এক গাল হাসি হেসে সাইকেল ঘুরিয়ে আনলাম তার কাছে। বাস স্টপের বেঞ্চিটায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে ভদ্রমহিলা। চোখে মুখে এই সাত সকালে গাঢ় মেকাপ। কড়া লিপস্টিকে বয়সটা ষাট থেকে ধাক্কায় পঞ্চাশে এমে এসেছে। পরিপাটি ববকাট চুল আর লম্বা ঝুলের ফুলেল স্কার্টের সাথে একেবারেই বেমানান ভঙ্গিতে পায়ের কাছে অ্যাবস্যুলুট ভদকার স্বচ্ছ একটা বোতল অলস গড়াগড়িতে ব্যস্ত। দৃশ্যটা বলেই দিচ্ছে, আর দশজনের মত বাস ধরার তাড়া নেই বোতল মালিকের। বেঞ্চিতে সে আজকে একাই বসে। অন্য সময় সহ-মাতাল হিসেবে দু’চার জনকে পাশে ঝিমোতে দেখা যায়। এক সাথে চোঁ চোঁ টেনে চুর চুর হয়ে পড়ে না থাকলে মজা কোথায়।

‘তা, তোমার লোকজন কই?’। ভকভকে ধোঁয়া ছেড়ে সে জবাব দিল, ‘নাস্তা আর মালপাতি কিনতে গেছে’। এবার কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘ধোঁয়াটা বড্ড বেশি সাদা। কি টানছো, বলো তো?’ নির্লিপ্ত উত্তর এলো, ‘এই ঘাসপাতা আর কি’। মানে গাঁজার পুড়িয়া টুড়িয়া জাতীয় কিছু হবে। আর নাক না গলিয়ে ‘আচ্ছা, খাও মজাসে, আসি এখন’ বলে চলেই যাচ্ছিলাম।

আবার ডাক পড়লো, ‘হেই, হেই, হঠাৎ সাইকেল কেন বললে না যে? মিউনিখের বাস-ট্রেনে কি ঠাডা-গজব পড়েছে?’। কথার ধরনে হাসি চেপে বললাম, ‘গজবই তো। করোনা গজব। আপিশ যেতে ভিড় এড়াতে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়েছি। আজকেই প্রথম। খাস দিলে দোয়া করে দাও তো’। দোয়ার বদলে করোনা ভাইরাসের বাবার উদ্দেশ্যে দাঁত খিঁচে সে এমন কতগুলো গা হিম করা গালি দিল যে কলিজায় রীতিমত কাঁপন ধরে গেল। অবশ্য পর মুহূর্তেই চমৎকার সহজ গলায় আশীর্বাদ করে বলল, ‘আস্তে ধীরে চালিয়ো, মেয়ে। লোকে গালি দিলে দিক। ট্রামের নিচে পড়লে কিন্তু নিমিষেই চার টুকরো। আর মাথা থেঁতলে গেলে তো আরো বিশ্রী কান্ড। ঘিলু-মিলু ছড়িয়ে একাকার, ছ্যাহ্ ছোহ্...‘।

আশীর্বাদের বহর আর সেটা বলার বাহার দেখে মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ‘হেঁ হেঁ, তা আর বলতে...।‘ ভাঙ্গা একটা দেঁতো হাসি আড়ালে চরম গ্রাফিক আশীর্বাদটা কপাৎ করে গিলে নিলাম। এমন শুভাকাংক্ষী আর হয় না। নার্ভাস ভঙ্গীতে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম সিগনালে।

২.
মাতালদের অন্তর্দৃষ্টি দারুন প্রখর। নইলে কি করে বললো যে লোকে গালি দেবে? এই মাত্র একজন ‘চল্, ফোট্’ বলেছে। অপমান লাগার কথা। কিন্তু লাগছে না। খানিক আগেও দুই বার গালি শুনতে হয়েছে। একবার মোড়ের সিগনালে। আরেকবার ট্রামের সামনে লাল বাতিতে। বাতি সবুজ হতেই চট্ করে প্যাডেল মেরে রওনা দিতে পারি নি। সাইকেল লগবগিয়ে এদিক সেদিক এঁকেবঁকে কাত হয়ে পড়ার যোগাড়। আর তাতেই বাকি সাইকেলওয়ালা মাইকেলরা সব রেগে টং। মাঝবয়সী এক লোক বলেছে, ‘আরে ভ্যাট! আগে বাড়তে পারে না আবার সাইকেল চালায়!’ আরেক জন গজগজিয়ে উঠেছে, ‘এ্যাই তুমি আন্ধা না লুলা?’ তারপর কিছু বুঝে ওথার আগেই সাইকেলের চাকায় ঠ্যাং দিয়ে ল্যাং মেরে ফসফসিয়ে পগাড় পার।

এ শহরের লোকজন যে এতটাই দুর্ধর্ষ, কে জানতো? এমনিতে গাড়ি চালক হিসেবে মিউনিখের লোকেদের বেশ বদনাম আছে। কারো পান থেকে চুন খসলেই এরা মিছেমিছি হর্ন চেপে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। নতুন লাইসেন্স পাওয়া নবীশ পেলে তো আরো মজা। আঙ্গুল উঁচিয়ে গালির বন্যা বইয়ে দেয়। তর্জনী, মধম্যা কিছুই বাদ যায় না। ভালমানুষ চেহারার সাইকেলম্যানরাও যে একই দলের, এই সত্য জেনে কিছুটা মিইয়ে গেলাম।

মাঝপথে এসে ফিরে যাবার মানে হয় না। তাছাড়া অফিস তো যেতেই হবে। তবে সব খারাপেরই ভাল দিক আছে। খানিক আগেও হালকা তিরতিরে বাতাসে চিন্তার ঘুড়ি এদিক সেদিক হারিয়ে যাচ্ছিল। এখন সব মনোযোগ পিচ ঢালা রাস্তার সরল রেখা ধরে চলছে। এও মন্দ কি। বেরিয়েছিলাম দুরুদুরু বুকে টিকটিকি হয়ে। এখন বিশ মিনিটের মাথায় টক-ঝাল গাল-টাল খেয়ে মোটা চামড়ার কুমির বনে গেছি। কথাটা ভাবতেই লেজ দাবড়ে এঁকেবেঁকে সরসরিয়ে চলতে থাকলাম সরু পথটা ধরে।

ঘাম ছুটে গিয়েছে দেখে অল্প থেমে জ্যাকেট খুলে কাঁধের ছোট্ট ঝোলায় পুরে নিয়েছি। সূতীর লাল টকটকে ফতুয়াটা সকালের নরম রোদে ঝিকিয়ে কমলা দেখাচ্ছে। নিজেকে আগুনের গোলা মনে হচ্ছে হঠাৎ। আবার কেউ গাল দিতে আসলে এবার আগুন লাগিয়ে দেবো। অনেক হয়েছে তোমাদের দাদাগিরি!

কিন্তু এক ফুঁয়ে আগুনের গোলা নিভিয়ে ফেলতে হলো। চোখে পড়লো, চৌরাস্তার মোড়ে খাম্বার কাছে চাকা তোবড়ানো একটা নীল সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখা। তাতে ফটোফ্রেমের মত কি যেন ঝুলছে। পাশ কাটিয়ে যাবার সময়ে পুরোটা পড়া গেল। বড় বড় হরফে লেখা ‘প্রিয় অ্যালেক্স, না বলেই চলে গেলে। ওপারে ভাল থেকো। তোমার জন্যে প্রতিদিন তাজা ফুল।‘ তাকিয়ে দেখি সাইকেলের পায়ের কাছে এক গুচ্ছ লাল-সাদা গোলাপ। বুঝি বা এই মাত্র কেউ রেখে গেছে। কে জানে কোন দুর্ঘটনায় অ্যালেক্স মিয়ার ইহলৌকিক কম্ম সব কাবার হয়ে গিয়েছে। অজানা আতংকে ঘেমো হাতে সাইকেলের হাতলটা আরো শক্ত করে ধরলাম। চার কিলোমিটারের পথকে এখন চল্লিশ মাইল লাগছে। কি ফ্যাচাঙেই যে পড়া গেল আজকে।
৩.
সামান্য দুই চাকার সাইকেল চালাতে পারে না, এমন বলদ লোক এই শহরে নেই বললেই চলে। দুর্ভাগ্য, আমি সেই সংখ্যালঘুদের একজন। সেই বছর দুয়েক আগে অতি কষ্টে খুঁজে পেতে একটা কোর্সে ঢুকেছিলাম। চার দিন প্যাডেল মারা শিখিয়ে আশি ইউরো কেড়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আমিও ঘরে ফিরে যা যা শেখা হয়েছিল, সব ইচ্ছে করে মাথা ঝাঁকিয়ে ভুলে গেলাম। তারও এক বছর পর একরকম অনিচ্ছায় এ দোকান সে দোকানে ধর্না দিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মাল জুটিয়ে ফেললাম। এখানেই শেষ না। আলসেমির কুখ্যাতিটা আরো একবার সত্যি প্রমান করে বছর ঘুরিয়ে সাইকেলটা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে ছয় ইঞ্চি ধূলোর পরত ফেলে নিষ্ঠুর আত্মতৃপ্তি পেলাম যেন। সাইকেল অধ্যায়ের ইতি প্রায় এক রকম ঘটেই গিয়েছিল।

তাই ভাবছি, কোনো রকম টেস্ট ট্রায়াল ছাড়াই আজকে এমন ফটাৎ করে রাস্তায় নেমে যাওয়া কি ঠিক হল। করোনার এমন দুর্দিনে বাস-ট্রেনের ভিড়-ভাড়াক্কা আর হাঁচি-কাশির ছোঁয়াচ এড়ানো যাচ্ছে বটে কিন্তু অ্যালেক্স ভাইয়ের মত বেখেয়ালে একটা অঘটন ঘটলে তখন কি হবে? হঠাৎ সম্বিত কেড়ে কে যেন পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘গো, গো, গো। থেমে গেলেই চিৎপটাং।‘ বুঝে ওঠার আগেই লোকটা দারুন গতিতে ওভারটেক করে উধাও হয়ে গেল। সে লোক মিলিয়ে গেলেও কথাটা মাথায় ঘুরতেই থাকলো, ‘থেমে গেলেই চিৎপটাং’। আগেও কোথায় যেন শুনেছি। আইনস্টাইন বা তেমন তাবড় কেউ বলেছিলেন। ‘জীবন আর সাইকেল একই রকম। তাল রাখতে ছুটে চলার বিকল্প নেই।‘ নইলে নাকি পপাৎ ধরনীতল।

কিন্তু আইনস্টাইন তো ওভার অ্যাচিভার টাইপ লোক ছিল। জীবন নিয়ে অমন উচ্চাশা টুচ্চাশা কিচ্ছু নেই আমার। নিতান্তই এলেবেলে ম্যাংগো পাবলিক। নাহ্, পা দু’টো টনটনিয়ে উঠছে। রাস্তাটা সামান্য ঢালু হতেই আইনস্টাইনের অমৃত বাণীর নিকুচি করে প্যাডেল ঘোরানোতে আলাব্বু দিলাম। সাইকেল দেখি আপনা আপনি বাতাসে শিস্ তুলে দুপেয়ে পংক্ষীরাজ হয়ে ছুটে চলছে। আইন্সটাইনের কথায় আসলে গলদ আছে। জীবনের সাইকেল শুধু গাধার মত চালিয়ে গেলেই হবে না। মাঝে মাঝে সুযোগ খুঁজে খানিকটা জিরিয়ে নিতে হয়। এত ইঁদুর দৌড়ের আছেটা কি? তাছাড়া, কোথায় আইন্সটাইন আর আমি কোথাকার কোন আইন-গাইন-ফা-কাফ-ক্বাফ। বড় মানুষের বড় কথা ছোট মানুষের ছোট জীবনে খাটে না সব সময়।

৪.
রাস্তাটা গাছের ছায়ায় ছাওয়া। সবুজ পাতার ফোকর গলে রোদ হানা দিয়ে চোখ অন্ধ করে দিতে চাইছে যেন। হুশিয়ার হয়ে চাকা ঘোরাচ্ছি। ফুটপাতের সমান্তরালে মসৃন পথ। সাইকেল ছাড়া আর কিছুর চলা নিষেধ। গাড়ি ঘোড়ার সাধ্যি নেই গাছের বেড়া ডিঙ্গিয়ে হামলে পড়ে সামনে। নিরিবিলি পথটায় উঠে এসে বেশ নির্ভয় লাগছে। ঢং ঢং শব্দ ভেসে আসছে পুরানো গির্জার চূড়া থেকে। চিরকালের খা খা করা চার্চটার সামনে আজকে দেখি ফুলের তোড়া আর মোমবাতির ভিড়। মহামারীর অদ্ভুতুড়ে পৃথিবীতে ভরসার জায়গা হারিয়ে লোকে আবার শিকড়ে ফিরে আসছে।

গির্জার পাশে সারি সারি পুরানো দালান। মিউনিখ শহরটা বেশ পুরানো। দারুন একটা বনেদী ভাব আছে সেকেলে ইট কাঠের চেহারায়। লাল টালির গায়ে গায়ে জোড়া লাগানো কাঠামোতে খাঁটি ইউরোপীয় ট্রেডমার্ক আভিজাত্য। গোঁড়া ক্যাথলিক ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে অনেক দালানের খাঁজে আবার সাধু সন্তদের মূর্তি সাজানো। সেগুলোর কোনোটা সযত্নে ধাতব তারের জাল দিয়ে ঘিরে রাখা। কিন্তু কোনোভাবে একটা সাধু বাবাও যদি হুরুমুড়িয়ে ঘাড়ে পড়ে, তাহলে আর রক্ষা নেই। সাথে সাথে ভবলীলা সাঙ্গ করে স্বর্গপানে রওনা দিতে হবে। সাধু বাবাদের থেকে বেশ খানিকটা তফাতে চলছি দেখে নিশ্চিন্ত লাগছে।

সময়টা বেশ নিরুপদ্রুবই কাটছিল। নতুন এক উপদ্রুব উদয় হল। উল্টো দিক থেকে বাঁই বাঁই শাঁই শাঁই সাইকেল আসছে। তবে আসল উপদ্রুব দ্বি চক্রযানগুলো না। বরং তার সওয়ারী। তাদের আঁটোশাঁটো টিশার্টের ভেতর থেকে সিক্স প্যাক তেড়ে ফুড়ে বেরোচ্ছে। আর তাতেই এই নবীশের সাইকেলের হ্যান্ডেল বিগড়ে যাচ্ছে। প্রতি ছয় জনের পাঁচ জনেরই সিক্স প্যাক থাকলে এই জার্মান দেশে সব মিলিয়ে এমন কত লক্ষ গ্রীক দেবতা আছে, ভাবতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।

শুধু কি তাই? ভাল করে ফুটপাথ বরাবর তাকিয়ে দেখি, লোকজন সেখানে উসাই বোল্টের বেগে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পুরুষেরা যেমন সুঠাম, নারীরা তেমনি সুগঠিত, সুললিত। বিন্দু বিন্দু ঘামে সামর্থ্য আর সৌন্দর্য্য মিশে একাকার। শহরের সব ভাস্কর্যগুলো কি আজকে আড়মোড়া ভেঙ্গে পথে নেমে আসলো? আর একটা দেশের গড়পড়তা সবার শরীর সৈনিকের মত পেটানো হলে হাজার ঝড়-ঝঞ্জা আসলেও সামলে নেবার ক্ষমতা আপনা থেকেই তৈরি হয়। তাই বুঝি করোনাযুদ্ধটা সবাই মিলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে জিতে নিল এবার।

মোড়ের কাছে এসে পথ বেঁকে গেছে। এবার পার্কের কোল ঘেঁষে যেতে হবে। এই পথ জনশূন্য। কতগুলো বেরসিক হোৎকা দাঁড়কাক কর্কশ ডেকে চলছে, ‘ক্রা ক্রা...’। একেবারে লোক নেই বললে ভুল হবে। অল্পবয়সী মায়েরা বাচ্চাদের সকালের রোদ খাওয়াতে স্ট্রলার নিয়ে বেরিয়েছে। পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে তেমনি এক রোদখেকোকে আড়চোখে হালকা ভেঙচি কেটে দুষ্ট হাসলাম মিটমিটিয়ে। বেচারা দুষ্টুমিটা ঠিক ধরতে পারলো না। তার বদলে এমন চিল চিৎকার জুড়ে দিল যে কাকগুলো ডানা ঝাপটিয়ে হুটপুটিয়ে পালালো। বাচ্চাকে কোন বেয়াদপ ভয় দেখিয়েছে, তাকে খুঁজতে মাকে চারপাশটা দ্রুত স্ক্যান করতে দেখা গেল। জোরসে প্যাডেল মেরে কালপ্রিট আমি ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলাম। ছোট শিশুর মায়ের হাতে কিল খেলে আজকে সাইকেল চালানো বীরত্ব ঠুশ্ করে ফুটে যাবে।

৫.
সব পথেরই শেষ আছে-এই আপ্তবাক্য প্রমান করে ম্যাক্স ওয়েবার প্লাৎজ-এর ক্যাম্পাসটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। ছোট্ট একটা মুশকিল। নিরিবিলি রাস্তাটা ফুরিয়ে গিয়ে গাড়িঘোড়ার ব্যস্তসমস্ত রাজপথে গিয়ে পড়েছে। জোরে একটা দম নিয়ে নেমে পড়লাম। সাথে সাথেই আলাদিনের দৈত্য আকারের এক লরি ‘প্যাঁওও...’ করে ভেঁপু বাজিয়ে কান ঘেঁষে চলে গেল। এক মুহূর্তের জন্যে জমে কাঠ হয়ে গেলাম। জার্মান ‘মান’ কম্পানির সুবিশাল এই লরিগুলো সেই রকম মরদ এক একটা। তার পাশে লিকলিকে আওরাত আমি তেমনি তুচ্ছ আর ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র, ভীতু, ক্যাবলাকান্ত আমিই যে গরিয়ে গড়িয়ে কিভাবে চলে এসেছি সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেলে সওয়ার হয়ে, সে-ই এক বিস্ময়। বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে অজান্তেই নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম।

দিন যে কোথা দিয়ে উড়ে গেল হাজারটা কাজে কর্মে, খেয়ালই ছিল না। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে মনের ভুলে পাতাল রেলের স্টেশন বরাবর পা চালিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়ালাম। ছাউনিতে সাইকেলটা ঠায়ে দাঁড়িয়ে। কালো ধাতব শরীরটাকে এক পলকের জন্যে কালো পশমে ঢাকা টগবগে ঘোড়া বলে ভুল হল যেন। আহ্, নিজের একটা বাহন! আনন্দটাই অন্য রকম। এক লাফে উঠে বসলাম কালো ঘোড়ার পিঠে। পিচ ঢালা মেঘ কেটে প্রায় উড়ে চললাম ফিরতি পথে। দুই চাকায় ভর দিয়ে নতুন এক স্বাধীনতার টিকেট কিনলাম যেন আজকে।

কখন যে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি, খেয়ালই হয় নি। উদগ্রীব একটা কন্ঠ ডাক দিয়ে থামালো হঠাৎ, ‘সব ঠিক ছিল তো?’। তাকিয়ে দেখি সকালের সেই পাড়াতুতো মাতাল ভদ্রমহিলা। ঘোর লাগা লাল টকটকে রক্তজবা চোখ আগ্রহে চকচক করছে। অন্য সময় হলে হয়তো দূড় থেকে হাত নেড়েই এড়িয়ে যেতাম। বেসামাল অবস্থা বলে কথা। কিন্তু এখন দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট এসে ভর করেছে কাঁধে। খুব উৎসাহে এগিয়ে গেলাম, ‘হ্যাঁ ঠিক তো ঠিক, একেবারে ঠিকের বাপ ছিল‘। তবুও সন্দিগ্ধ প্রশ্ন শোনা গেল, ‘ঘিলু-টিলু বেরিয়ে যায় নি বলছো তাহলে?’।

প্রমান দিতে এক ঝটকায় হেলমেট খুলে ফেললাম। তারপর মাথা হাতড়ে চুঁইয়ে পড়া ঘিলুর সন্ধান না পেয়ে ফিক্ করে হেসে জানালাম, ‘না, খুলির ভেতরেই সব আছে দেখছি’। উত্তরে পাড়াতুতো পাড় মাতাল ফোশ্ করে হাঁপ ছেড়ে হাতের বোতলটা দেখিয়ে বলে বসলো, ‘জানো, তোমার চিন্তায় বাড়তি এই বোতলটা শেষ করেছি। খালি ভেবেছি হাবাগোবা বিদেশী মেয়েটা জ্যান্ত ফিরতে পারবে তো। ভালোয় ভালোয় এসেছো। এখন এই খুশিতে আরেকবার হয়ে যাক।‘ তাকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাতের পুটলি থেকে সবুজ আরেকটা মাল বার করতে দেখা গেল।

বিচিত্র পৃথিবীর মমতার ধরনগুলোও বিচিত্র। পড়ন্ত বিকালে উষ্ণ মায়ার রেশ নিয়ে ফুটপাঠ ধরে হাঁটতে থাকলাম। বোকাসোকা বিদেশী মেয়েটা আর তার হাতে ধরা সাইকেলের ছায়াটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো যেন। কোথায় যেন কোন সবুজ বোতলের ছিপি গড়িয়ে পড়লো টুংটাং শব্দে।

-মিউনিখ, জার্মানি
২৮.০৬.২০২০

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই মে, ২০২৪ ভোর ৫:২৮

জনারণ্যে একজন বলেছেন: অনেকদিন পর, রিম!

দিন কয়েক আগেই ভাবছিলাম অনেকদিন আপনার কোনো লেখা দেখছি না এখানে। রিপোস্ট হলেও ক্ষতি নেই - বার বার পড়ার মতো লেখা এটি।

আপনার নীল সাইকেলের কথা শুনে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো।

অনেকদিন আগের কথা, অন্য স্টেট্'এ ছিলাম তখন। উইকএন্ডে টুকটাক বাজার-সদাই করতে বেরিয়েছি। সোজা রাস্তা দিয়ে গেলেই রাইট টার্ন নেবো চৌরাস্তার মোড়ে - রেড লাইট'এ বসে আছি। হঠাৎ চোখে পড়লো, চৌরাস্তার কোনায়, আমার সামনের ডিভাইডারের শেষপ্রান্তে, হাতের একটু বাঁয়ে; যেখানে অনেক ফুল স্তুপ করে রাখা - সেখানে সাইঁ করে বিশাল এক এসইউভি এসে থামলো। অতি সুদর্শন এবং কেতাদুরস্ত পোশাক পরা এক যুবক বের হয়েই হাঁটু মুড়ে বসলো ফুলের স্তুপের সামনে। পরক্ষনেই স্যুটের পকেট থেকে বোতল বের করেই সুদীর্ঘ এক চুমুক....এবং সাথে সাথেই প্রস্থান। বুঝলাম বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজন কেউ হবে। ড্রাঙ্ক-ড্রাইভিং এর করুন পরিণতি।

যাই হোক, সাবধানে সাইকেল চালাবেন। এবং ভালো থাকবেন।

বি: দ্রঃ হেডলাইনটা অসাধারণ। সেন্স অফ হিউমারের চমৎকার এক উদাহরণ।

২| ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:২৯

আহমেদ জী এস বলেছেন: রিম সাবরিনা জাহান সরকার,




মাত্রই আপনার "..... এলোকেশি-৩" পর্বের লেখাটিতে মন্তব্য করে এসেছি। আপনার " কি করি বলুন তো?"র জবাবে বলে এসেছি গা- ঝাঁড়া দিয়ে চর্ব-চোষ্য কিছু লিখতে।
দেখি, যে রকমটা চেয়েছিলুম এই রি-পোষ্টে সে রকমই জবরদস্ত "আউরত কী কাহানী"। ঝাক্কাস লেখা। মাতাল ভদ্রমহিলার সবুজ বোতলের "কারনবারি"খাওয়ার মতো "রীম"এর লেখার "রসবারি" চেটে চেটে ঝিম ধরার অবস্থা! :)

৩| ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫

শায়মা বলেছেন: মাতালরা এত ভালো হয় আপুনি!!!

আসলেও মহিলাটা মমতাময়ী মাতাল নারী।

লেখাটা সত্যিই মজার হয়েছে। আর অনেক মমতায় ভরা। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.