নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাঝে মাঝে খুব ঝড় জল হলে ছেলে বেলায় ফিরে যাই।
যদি খুব ভোরে বৃষ্টি হত, নিশ্চিত সেদিন বাসায় খিচুড়ি হত আর স্কুলে যাওয়া বাঞ্চাল! দিন মান তাস কি দাবা কি লুডু! আমাদের বাসাটি “মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির” মতই ছিল খানিকটা। কত্ত লোকদের আনাগোনা আর কত্ত লোকেদের যে পাত পরত ইয়াত্তা নেই। তিন তলা বাসা ভর্তি লোকজন। আড়াই তলার গেস্ট্রুমে থাকতেন এক কাকা, বাবার মামাত ভাই, আর আমার সৎ এক মামা। বড় ভাইএর রুমে থাকতেন আমাদের এক ফুফাত ভাই। আরও দু চারজন থাকতেন গ্রাম সম্পর্কীয় আত্মীয়। মেঝ ভাই সদাই বন্ধু বৎসল দু চারজন ইয়ার দোস্ত তার থাকতোই, কোথায় যে খেত, কোথায় যে শুত, কে জানে? তাদের একজন কে দেখতে ঠিক আনন্দমেলার কমিকস “রোভার্সের রয়” এর রোভার্স এর মত ছিল। ঘার অবধি লম্বা চুল, সকাল হতেই হাতের দু আঙ্গুলে বুট ঝুলিয়ে যেতে দেখেছি খেলার মাঠে, কোন এক ক্লাবে খেলতেন তিনি। আরো আসতেন এক সময়ের হিট মুভির পরিচালক, তার গুঁফো মুখ, আর বুক খোলা শার্ট তাকে আমার চোখে চির যুবক করে রেখেছে! কত মামা চাচা, ভাই বেরাদর, আন্টি খালা, এখন তো বলে হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজলেও দু চারটা অতিথি পাই না! এক জন আসতেন, “গুতুম মাছ”, কেন যে বেচারার এই নাম ছিল কে জানে। আরও আরও ছিল আনেকের কথা ভুলে গেছি, অনেকের কথা লজ্জায় লিখছি না, যাদের অনেক জ্বালিয়েছি, এই উসিলায় ক্ষমা চেয়ে নেই, অনেকেই নেই আজ। দিন আজ বদলে গেছে অনেক। কারুর সাথে আজকাল কারুর দেখা হয় না বড়। সে একটা সময় গেছে বটে! কি আনন্দ ছিল, এখনকার মত এত গ্লেমারাস না কিন্তু ফুর্তি ছিল ভরপুর। তবে সব কথার শেষ কথা আমাদের কাছে ছিল আমাদের বড় ভাই “শামিম” যাকে “শাইম ভাই” ডাকতাম, দ্রুত ডাকার কারনে শামিম হয়ে যেত শাইম। তাস খেলতে বসলে ওঁকে ট্রাম্প করতাম না। ব্রে খেল্লে রঙের ফোঁটা দিতাম না, যদি কখন বড়দের সাথে খেলার স্কোপ পেতাম! আমার চোখে মনে হত ইস শাইম ভাই কি লম্বা, হাত দিয়ে আয়রন কিঙ্গের আল্মিরার উপর থেকে জিনিষ নামিয়ে আনতে পারে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র মানেই আমার চোখে এখনো এমনই ভাসে, হাল্কা পাতলা, লম্বা কোন এক যুবক! আমি ওঁর মত এমন মানুষ কমই দেখেছি। কি সৃষ্টিশীলতায়, কি ব্যাবহারে, কি ভাষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ই তার নাটক বাংলা একাডেমির তালিকায় এসছিল, ছবি আঁকতেন ভালো, প্যান্টোমাইম করতেন, টিভিতে দেখেছিলাম তাঁর মূকাভিনয়। এমন কেউ নেই যে তাঁকে ভালোবাসতো না। যারা সবার ভালোবাসা পান তারা আল্লাহর ও প্রিয় পাত্র তাই তো তাকে অসময়েই আল্লাহ তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন, খুব অসময়েই! আসলে অসময় বলতে কিছু নেই, সময় হলে যেতেই হবে। সে অনেক হারিয়ে শিখলাম।
এমনই ভিড় ভাট্টায় বড় হয়েছি, কখন যে সময়গুলি আলগা বাঁধনে পেরিয়ে গেছে টের পাইনি অতটুকুও। জীবন সেতো পদ্মপাতার শিশির বিন্দু, মরুভূমির বুকে যেন বিষাদ সিন্ধু। বুঝে উঠার আগেই কোথায় এসে পৌঁছে গেছি, পিছনে কত টা পথ পেরিয়েছি, কতটা পথ আর আছে বাকী? সে এক অজানা অধ্যায়! সে কি এক বিপুল তৃষ্ণা, সে কি এক হাহাকার! এক অপার বিস্ময় এ জীবন! ক্যান্সাসের একটা গান “ডাস্ট ইন দ্য উইন্ড” যেটা স্করপিয়ন্স ও গেয়েছিল সে গানটিতে খুব সহজ কথায় জীবনকে ধরেছে...
“I close my eyes, only for a moment, and the moment's gone, All my dreams pass before my eyes, a curiosity,
Dust in the wind
All they are is dust in the wind
Same old song, just a drop of water in an endless sea All we do crumbles to the ground though we refuse to see
Dust in the wind
All we are is dust in the wind"
জীবন অতদূর এসে মনে হয়, হায় শুরু না হতেই বুঝি শেষের বাঁশি বাজার সময় চলে এল বলে! মনে হয় এইনা সে দিন স্কুল শুরু করলাম লাল সুটকেস নিয়ে। এই না সে দিন স্কুল পালিয়ে গেলাম লেকের ধারে, কলেজে উঠার উত্তেজনা এত সহসাই স্থিমিত হয়ে এল! কখন নিঃশব্দে সবার অলখে সময় যে চলে যায়, কেউ বুঝেও উঠতে পারি না। সময় কত ঘটনার, কত রটনার তাকে বোঝা দায়। ছোট বেলাকার ছোটো ছোটো ভুল, ছোটো ছোটো প্রাপ্তি, ছোটো ছোটো দুঃখ, ব্যাথা, কান্না, হাসি আজ এক বিশাল প্রাপ্তি। জীবন যেমনই হউক জীবন কিন্তু একটাই, তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচতে হবে, উপভোগ করতে হবে, ভোগ নয় , এর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। যদি কখনো বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতাম, জানতাম রাত ভোর হবেই, আবার এক নতুন শুরু হবে, শুধরে নেয়ার কি ক্ষমা পাবার সুযোগ হয়তো আসবে। এমনই কত রাত কত দিন কত ছবি আঁকা হয়ে আছে, কিছু কিছু উজ্জল কিছু ধোঁয়াশা মাখা, কিছু ছিন্ন, কিছু প্রায় হারিয়ে যাওয়া। সেই ছবি গুলি না জোড়া দিলে একটা বেশ ছায়া ছবির মত লাগে, নিজের ছবিঘরের অন্ধকারে কখন আপনি চলে। অত ডিজিটাল না, বেশ ঘরঘরে পয়তিরিশ মিলিমিটারে প্রোজেক্টরটা চলছে। কিছু গান কি হারিয়ে যাওয়া সুর টুরও বেশ বাজে।
সে ছবিতে এ শহর টা ছিল জাদুর শহর! কি মেঘ, কি ঝকঝকে রোদ্দুর সবেতেই এ শহরটা ঝলমল করে হেসে উঠত। কৃষ্ণচূড়ার লাল তখন বুঝিবা আরও ছিল উজ্জল, রাস্তা গুলি ছিল অনেক ফাঁকা। তখন আমরা ধান্মন্ডির সরকারী বাসা ছেড়ে উঠে এসেছি, ইন্দিরা রোডে টি এন্ড টি এর পিছনে, স্কুল তখনো কলাবাগান, সেই কলা বাগান থেকে যদি রিক্সাওয়ালা কে বলতাম ইন্দিরা রোড লন্ডনির বাসা, রিকশা ওয়ালা ঠিক চিনে ফেলত। ভাবা যায়? ধান্মন্ডির খোলা হাওয়া, কিংবা শের এ বাংলা নগর এর লালচে ইটের কাব্য এখানে নেই, গলিটা তখনো কাঁচা, দু চারটে দালান পিছনে সারি সারি টিনের বাড়ী। গলি থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে ডানে গেলেই এক মাঠ লালচে এঁটেল মাটির, এবড়ো খেবড়ো মাঠটা পেরুলেই ফিরোজা রঙের গেইট ওয়ালা একটা বাসা, সিরামিক ইটের, ওটা টেলি সামাদ সাহেবের বাসা, তখন তিনি তুমুল জনপ্রিয়। বাসাটি হাতের ডানে রেখে বামের রাস্তা ধরে চলতে থাকলে একটা সুন্দর স্কুল ছিল বাগানঘেরা, দোলনা ছিল, সি-স ছিল আমরা তখন সি-স কে ঢেঁকিই বলতাম। রোজার সময় সেহেরি খাওয়ার পর সবাই ঘুমিয়ে পরলেই আমি আর শার্মীন ( ইমিডিএট বড় বোন) বেরিয়ে পরতাম সাথে থাকতো আমাদের গ্রামের এক মেয়ে, কত আর বড়, হয়তো উনিশ কি কুড়ি বছর তার। হাঁটতে বেরিয়ে যেতাম, টি এন্ড টির পিছন দিয়ে সোজা ফারমগেইটের দিকে রওয়ানা দিতাম এখন যেখানে কালিন্দী এপার্টমেন্টটা ঠিক সেখানে কিংবা রাস্তার উলটো দিকের বাড়ীটাতে বিশাল এক বকুল গাছ ছিলও ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক বকুল গাছ! কি উঁচু! ফুলে ফুলে ভরে থাকতো আর ঝরা ফুলে সাদা হয়ে থাকতো রাস্তা আমার পকেট কি শার্টের কোচর ভরে সে ফুল নিয়ে আসতাম, বোনের পরনে থাকতো ফ্রক তাই তার কুড়ানো ফুলই বেশি থাকতো। বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে আমরা মালা গাঁথতাম, সূঁচটা আমি হাতে পেতাম না শলার ঝাড়ুর কাঁঠি দিয়ে মালা গাঁথার টেকনিকটা আমাদের গাঁয়ের মেয়েটাই শিখিয়ে ছিল। তার নাম ছিল যামিনি। দীর্ঘদিন আমাদের সাথেই ছিল, কাজের মেয়ে কখনই ভাবিনি, বেশ আপনার জন হয়েই ছিল আমৃত্যু, বহু বছর পর কঠিন ক্যান্সারে কাঠির মত হয়ে গিয়েছিলো সে, আমি গ্রামে এসছি শুনে, লাঠি ভর করে ঠিক হাজির হয়ে ছিল,সেই তিনজনার একজন। সেই তিনজনার মাঝে দু’জনাই আজ নেই। ভাবলেই মনটা হু হু করে উঠে। এত সহজ অনায়েস এ চলে যাওয়া! এতই কিঞ্চিৎ আমাদের এ জীবন! যে বিরাট শিশু খেলিছে এ বিশ্ব লয়ে সেই জানেন এত কেন মায়া! হারাবো জেনেও কেন সব কিছু ধরে রাখবার এ উদগ্র বাসনা? এ উত্তর জানি একদিন পাবো নিশ্চয়ই।
যখন ভাবি, অবাক হই কি নিরাপদ ছিল এ শহর একদিন। শিশু বান্ধব, ভয় নেই ডর নেই কোন। কোথায় কোথায় চলে যেতাম আমরা! সে এক অদ্ভুত সময় ছিল সুন্দর! এ বাসাটা ভাড়া নেবার আগে আমি আর বাবা দেখতে এসছিলাম, সাড়ে তিলতলা দালানের দোতলা বিশাল ফ্ল্যাট, পাঁচ-ছ খানা শোবার কামড়া, বিশাল গ্রিল দেয়া টানা বারান্দা। বারান্দার শেষ মাথায় সারভেন্ট কোয়াটার যেখানে, সেখানে কেন যেন উপর দিকে গ্রিলটা এক্টুকুন ফাঁকা। সে দেখে আমি বলি বাবা এইদিক দিয়ে তো চোর আসবে,বাবা হেসে বললেন চোর আসার আগে তুমিই এদিক দিয়ে পালাবে। কি অবাক কান্ড ঠিক তাই হল! কোন এক রবিবার, তখনো রবিবার ছুটি ছিল, দুপুরের খাবার পর সবাই যখন বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছে সে ই ফাঁকে ওই ফাঁক গলে আমি বেরিয়ে এলাম, প্রায়ই এটা করতাম, পাশে ছিল রুমিদের বাসা, আমি ক্লাস ওয়ান আর ও তখন ক্লাস ফাইভে কিন্তু খুবই বন্ধু ছিলাম আমরা,ওই রুমিদের বাসায় চলে আসতাম, কত গল্প যে হত আর ওদের বাসায় ছিল লেডিবারডের বই, কি সুন্দর আলাদিন, কি বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট বানান করে করে পড়তাম, কি যে সুন্দর ছিল ইলাস্ট্রেশন গুলি, এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে! সে রবিবারটি আমার ছিল না! ছুটির দিন, বিমাতা উনার বাবার বাড়ী গেছেন যা কালে ভদ্রে যেতেন, যা হউক গেছেন, বাবার ডাক পরল শোবার জন্য, আমি নেই! সদর দরজা বন্ধ, কেউ খুলেনি আটকায়ও নি। খোঁজ খোঁজ,কই গেলো পাজিটা! প্রথমেই রুমিদের বাসা রোঁদ হল, কিন্তু দুই বন্ধু তখন, ওদের বিল্ডিঙের এক সাইডে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে বসে রাজ্যের গপ্পো করছি, বাসার লোকরা এসে ফিরে গেল, বাবা খুঁজতে খুঁজতে নাকি ফারমগেইট চলে গেছেন, বোনেরা কান্না জুড়ে দিয়েছে!এদিকে আমি নিশ্চিন্তে গল্প করছি!আমার তো জানবার কোন উপায় কি কারণ কোনটাই নেই। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ বাসার কাজের লোক আমাদের ওখানে উঁকি দিলো আর আমাকে পেয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে মুখ চুন করে বাসায় এলাম, বাবা অবাক করে বললেন কোন দিক দিয়ে বেরিয়েছিলে, আমি বারান্দায় নিয়ে ফাঁকাটা দেখালাম, বাবা মুচকি হেসে কানটা একটু মুচড়ে দিলেন, “যাও শুতে”, আমি শুতে গেলাম সুরসুর করে, এদিকে টিভিতে টারজান শুরু হয়ে গেছে মন উশখুশ করছে, “বাবা যাই?” বই পড়তে পড়তে গম্ভীর উত্তর “না, চোখ বনধ কর”।আধেক খোলা চোখে দেখি বাবা পড়ছেন, বিশাল টেরডাক্টাইলের ছবিওয়ালা এক বই,দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড, বহু বছর পর যা আমার অনেক প্রিয় হয়েছিলো। মনে আছে শেষ মেশ বহু কষ্টে ছুটকারা পেয়েছিলাম। জনি ওয়জ মুলারের সেই টারজান জাদুর মত এখনো আমাকে টানে। সেই থেকে হুট হাট বের হওয়া বন্ধ হল, বিকালে ছাদে উঠতাম বাড়ীওয়ালার ছেলেদের সাথে একটু মাঝে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতাম, আর তখনি শুরু হল ঘুড়ী উড়াবার নেশা, সে অমোঘ নেশা এখনো কাটেনি, ছেলেদের দোহাই দিয়ে দিব্বি এখনো উড়িয়ে যাচ্ছি ঘুড়ী। বৃষ্টি হলে মনে হত ইস যদি আমার প্লাস্টিকের একটা ঘুড়ী থাকতো! প্রায়ই ভাবতাম বড় হলে একটা ঘুড়ী উড়াবার যন্তর বানাবো, আর সব ঘুড়ী কেটে সাফ করে দিবো। মনে আছে পাঞ্জা কি হাতুরি মার্কা সুতা কিনে মাঞ্জা দিতাম, আমাদের বাসায় তখন ছিল ইস্রাইল নামে বাবুর্চি সেই উস্তাদ, সেই সব করত, কি কি যোগার যন্তর যে করত, উলট কমল, গজ ইত্যাদি অনেক অনুপান আজ মনেও নেই, বাবা কুড়ি টাকা দিয়েছিলেন, ডজন খানেক ঘুড়ী আর মাঞ্জা টাঞ্জা দেয়ার পরও বেশ কিছু টাকা রয়ে গিয়েছিলো, ফারমগেইটে গিয়ে “সুহানি” খেয়েছিলাম, দু জনে মিলে। তখন ফারমগেইটের মার্কেটটা বেশ খোলা মেলা লাগতো আর অনেক দোকানেই সবুজ কমলা নেশেস্তার হালুয়া বিক্রি করতো, আমার দেখতে বেশ লাগতো! সেই ইস্রাইলের কাছেই ঘুড়ী উড়ানোর যত প্যাঁচ পয়জার, আর ঘুড়ী বানানো শিখেছিলাম! শুধু তাই ই নয়, বড়দের জীবনের অনেক পাঠই সে আমাকে দিয়েছিল, সেই অবুঝ বয়সেই, আমি খেলাধুলা আর পড়াশুনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম তাই ওই কথার মানে কিংবা প্রভাব এতুকুও আমাকে স্পর্শ করেনি। আজ আমি যখন পিতা আমাদের ছেলেদের ড্রাইভার কি আমার অফিসের পিওনদের সাথে কোন সংশ্রবে আসলে আমি সাবধান থাকি, যে পাঠ আরও পরে হলেও চলবে তা তার এখনি জানবার দরকার নেই, দরকারে আমিই বলব! এখনকার পাঠ্য পুস্তকের এই আজানা জিনিশ নিয়ে উতসুক তৈরি করা, আমার কাছে পাগল কে সাঁকো নাড়াতে নিষেধ করার মতই লাগে! অঁরি দ্য ভেরের ব্লু লেগুনে সেই দুজনা কিন্তু জীবনের পাঠ আপনি আপনি শিখে নিয়েছে। না দরকার পরল কোন ইস্রাইলের না কোন অপরিপক্ক পাঠ্য পুস্তকের। এ তো অমোঘ নিয়তি, গাছের পাতা যেমন আসে, কলিরা যেমন ফুল হয়ে উঠে সহজ আনায়েসে, এ ও তেমনি।
ঘুড়ীর নেশা ছাড়া আর এক নেশায় তখন আমায় পেয়ে বসেছে, টেবিল টেনিসের নেশা। আমি ছোট তাই বাড়ীওয়ালার ছেলেরা সবসময় আমায় খেলায় নিতে চাইত না, তাতে কি? আমি দিন মান খেলতাম কখন পিং পং বল হাত দিয়ে মেরে মেরে কখন নেভিয়া মিল্কের প্লাস্টিক কন্টেইনার দিয়ে, যেটার আদল অনেকটা টেবিল টেনিসের ব্যাটের মতই ছিল। আমার তখন ব্যাট ছিল না প্রথম ব্যাট কিনি ক্লাস সেভেন এ পঁচাশি টাকা দিয়ে, ডাইরি তে লিখেছিলাম, রনপলেঙ্কের এক খানা ছোটো নীল নোট বুক ছিল আমার, লিখেছিলাম “আজ আমার একটা স্বপ্ন পুরন হল” আহা কি সহজ স্বপ্ন, এই স্বপ্ন গুলো নিয়েই এ জীবনটা বেশ কাটিয়ে দিলাম। একখানা কবিতা ছিল “চয়নিকা” পুস্তকে, “শীতের শেষে গিয়েছিলাম বাদাম তলির মেলা, একটি মোটে পয়সা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম বেলা”, এ জীবনের সহজিয়া দর্শন! আমি এ দর্শনেই বিশ্বাসী, ছোটো ছোটো এ স্বপ্ন গুলিই আমাদের জীবন কে ভরিয়ে তোলে, হাজার রঙ্গে সাজিয়ে তোলে, আর বড় স্বপ্ন পূরণে সাহস যোগায়। এ নেশাটিও আমার এখনো রয়ে গেছে নিজের বাসা তাই ডিজাইন করবার সময় বিশাল এক ফাঁকা জায়গা রেখেছি, ছেলে দুটো একটু খেলাটা শিখলেই পেতে ফেলব টেবিল! আর ওই বাসাতে আরেকটা নেশা ধরিয়ে ছিলেন আমার বড় ভাই! উনিও নেশাগ্রস্থ! তা যাক সেবার পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হই, আমি জীবনে এক বারই কোন পরিক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম,(কোন পরিক্ষাতেই আমি প্রথম হইনি জীবনে!), সে উপলক্ষে শাইম ভাই তিনটে বই দিয়েছিলেন, সুন্দর হাতের লিখায় লিখেছিলেন, “অনেক বড় ‘হ”! কত আর বড় হতে পারলাম! বই গুলি ছিল “কিন্ডার গার্টেনের জীবনী”, “জিনহুয়া” আর একখানার নাম মনে নেই কি যে সুন্দর ছবি ওয়ালা চাইনিজ বই গুলা ছিল!জখের ধনের মত আঁকড়ে রেখেছিলাম, কিন্তু এত ওলট পালট ওয়ালা জীবনে আনেক কিছুর সাথে সেগুলোও কই হারিয়ে গেছে! মানুষই হারিয়ে যায় আর এত সামান্য বই! যাক সে নেশায় আমি আজো আচ্ছন্ন, জীবনে কত কিছুর আলোতে যে বই পড়েছি রাত গভীরে। কত রাত যে ভোর করেছি আর এখনো করছি তার গুনা গুন্তি নেই! সে বই গুলি ছিল যেন এক একটা স্বপ্ন! চাইনিজ আর রাশান আর মুক্তধারার বই!
দুটি বেড়াল ছানা, চুক আর গেক, তোর কি সূর্য আছে, জাদুর পেন্সিল, সিংহ আর ইঁদুর, আরও আরও অজস্র। প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো! এ লেখাটি দেখলেই মনটা আনচান করে উঠে এখনো! মুক্তধারার ছিল খাজা খোর রাজা, এক যে ছিল সাদা ঘোড়া, পুপুর মুমু, শেষ হবে না লিখে, আর ছিল রুস দেশের উপকথা, সব বই এর রাজা! “সিবকা বুরকা জাদু কি ল্যাড়কা সামনে এসে দাঁড়া”...সে কি ভুলবার! কি ইলাস্ট্রেশন আর ছিল ছোটো সাইজের আনন্দ মেলা, কারুর মনে আছে কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে এক খানা কপি এখনো আছে! তার একটা কবিতা এই ফাঁকে লিখছি,”এই সেরেছে হারিয়ে গেছে পড়ার বই আর অঙ্ক খাতা ,খাটের পরে রেখেছিলাম খুঁজতে গিয়ে ঘুরায় মাথা”, অনেক শব্দ হারিয়ে গেছে কিন্তু ছবিটা হারায়নি! এই হারনো কি খুঁজে পাওয়া এ ও এক অদ্ভুত নেশা। অনেকেই আজ বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা আমি ক্লাস থ্রি তেই রবিবাবুর “গ্লপগুচ্ছ” পড়ে ফেলেছিলাম, আর আনন্দমেলার প্রথম যে পূজা বার্ষিকীটি হাতে পেয়েছিলাম সেখানে ছিল শীর্ষেন্দুর “গোঁসাই বাগানের ভুত”, আশা পূর্ণার “গজ উকিলের হত্যা রহস্য”, শৈলেন্দ্রর “টোরা আর বাদসা”; সত্যজিতের “ প্রোফেসর শঙ্কু” ; সুনিলের “ডুঙ্গা”। কমিকস ছিল শরদিন্দু বাবুর! ওই বয়সে এত্ত আনন্দ আর কেউ পেয়েছে কিনা কে জানে! এর কিছুদিন পরেই পড়েছিলাম, “ইস্পাত”, নিকলাই অস্ত্রভস্কির, নিজেকে পাভেল ক্রচাগিনই ভেবে গেলাম সারা জীবন, আর তনিয়া আমার প্রথম ক্রাশ। সেই লালচে গাল নিয়ে লেকের ধারে বই পড়া তনিয়া আর পাভেল ক্রচাগিনের সেই একশন, “ আপার কাট, একটা মোক্ষম আপার কাট”, কোথায় পাভেল? এ তো আমি! এই আমি কখন পাভেল; কি কখন কিশোর পাশা, এই যাপিত জীবন নেহাতই মন্দ নয় কখন কখন!
এ কিস্তি শেষ করবার আগে আমাদের ইন্দিরা রোডের বাড়িওয়ালীর দু চারটি কথা না বললেই নয়। যে হেতু তারা লন্ডনি তাদের কেতা ছিল ভিন্ন, ছেলে মেয়ে দুটি গ্রিন হেরাল্ডে পরত বেশ ইংরিজিতে কথা বারতা কইত, আন্টিও তাই অপচেস্টা করতেন তবে অতটা তো পারতেন না ভালও, শুধু বলতেন “দিস গুলি নিয়ে যাও, দ্যাট গুলি আন” বলে আমাদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়াতেন, সেইপ্রথম ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়া! আর তাঁদের মেয়ে ছিল, আমার বোনের সাথে একি ক্লাসে পরত ওর নামও ছিল সারমিন আমরা ডাকতাম “উতাসা” মানে উপরের তলার সারমিন। কোথায় তারা, নেই আজ কোন খবরে। তবুঅ,মাঝে মাঝে কানে বাজে “দিস গুলি নিয়ে যাও, দ্যাট গুলি আন”। নাহে এ যাপিত জীবন নেহাতই মন্দ নয় একদম!
১২ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৩
রবাহূত বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই! লিখাটা অসাধারণ নাকি ক্যান্সাসের লিরিক্সটা?
২| ১২ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:০৮
লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: আহা দিলেন তো ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে --- আপনার লেখাটা সত্যি দারুন ----- মনে হয় সেই আগের সেই ছোট সময়ে ফিরে যেতে পারতাম
১২ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৫
রবাহূত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই। আগের গুলি কি পড়তে পেরেছিলেন? পড়ে জানালে খুশী হব।
৩| ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৩৩
কালনী নদী বলেছেন: লিখাটার সাথে লিরিটার অন্তমিলটা সুন্দর। অবশ্যই দুটোই
©somewhere in net ltd.
১| ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ২:২০
কালনী নদী বলেছেন: “I close my eyes, only for a moment, and the moment's gone, All my dreams pass before my eyes, a curiosity,
Dust in the wind
All they are is dust in the wind
Same old song, just a drop of water in an endless sea All we do crumbles to the ground though we refuse to see
Dust in the wind
All we are is dust in the wind" (স্করপিয়ন) !
অসাধারণ।