নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
( এই অংশটুকু আগেই লিখা, শহরের কথা নেই, কিন্তু শৈশব উপস্থিত, তাই আপলোড করব কিনা, ভাবছিলাম, লিখাটা আগাচ্ছেও না অগত্যা করেই দিলাম আপলোড।)
(৮)
দিনমান ছুটোছুটি তে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে যেতাম সন্ধ্যার একটু পরেই, লম্বা শীতের রাত কত আর ঘুম হবে? মাঝে মাঝে মাঝরাত্তিরে ঘুম যেত ভেঙে, ঘর ভর্তি ঘুম আর অন্ধকার। বাড়ির পিছে ঘন জঙ্গল আর বাঁশঝাড়, কত অদ্ভুত সব শব্দ আসত ভেসে, এক অচিন পাখি ডাকত “কুউক” ‘কুউক”, ছোট্ট বুকটা কেমন এক তরাসে তিরতির করে কাঁপত, শীতের ঘন কুয়াশা জমে গাছের পাতা থেকে ঝরত টুউপ টুউপ টুউপ। শিয়াল কি বাঘ ডাশ দৌড়ে যেত, খচমচ শব্দে। লেপের ওমের ভিতর আরও সেঁধিয়ে যেতাম, মুখ মাথা ঢেকে শুয়ে থাকতাম, একসময় ঘুমিয়ে যেতাম আবার। সে কি ঘুম, মখমল !
ঘুম ভাঙ্গত ছোট দাদার দু’আর শব্দে, শ্লেষ্মা মেশানো বৃদ্ধ আওয়াজের আহাজারি “আল্লাহ হেদায়েত কর! আল্লাহ হেদায়েত কর!!” সেই ঘোর লাগা কুয়াশা ভোরে, ঘুম ভাঙ্গানিয়া শব্দ মালা যে কত গভীর, কত যে হাহাকার ছিল মিশে, আজ বুঝি। হেদায়েত পাবো কিনা জানি না, প্রতিনিয়ত আমিও সে দু’আই আউড়াই। এ দাদা কেই আমি জীবিত পেয়েছি আমার তিন দাদার ভিতর, যৌবনে দুরন্ত আর পরিণত বয়সে দাপুটে, ফুট ছ’এক লম্বা,ছিপছিপে মেদহীন দেহ, জোব্বার উপর লং-কোট, আর মাথায় সফেদ পাগড়ী। দাদার জানালায় উঁকি দিলেই বলতেন “চা খাবিন?”। বিরল দন্ত আর বলিরেখার জ্যামিতির ফাঁকে হাসি মাখা সে আহ্বান উপেক্ষা করার কোন উপায়ই থাকত না, দাদু চা দিয়ে যেতেন, লিকার চা, একটুকরো গুড় মুখে দিয়ে চুক চুক করে সে চা খেতে হত। হাজ্বের সফরে দাদা শিখেছিলেন এ চা খাওয়ার কায়দা, সুগার কিউবের বদলে গুড়ের টুকরা। লাগসই বিকল্প। বিছানার লাগোয়া টেবিলে রাখা টলটলে কাপের সে ধূমায়িত লিকার আর লেপ বালিশ কম্বলে মিশে থাকা রাত্তিরের তুষের আগুনের গন্ধ, গরাদবিহীন জানালা দিয়ে ঢুকতে থাকা অবারিত উত্তুরে বাতাসের মত ঠিক এখনই ঝাঁপিয়ে আসছে আমার এই নগরের বনধ খাঁচার শীতাতপ কামড়ায়। ঝুল কোটের ব্বলিন , কি অধিক ব্যবহারে তেল চিক্কণ ছড়ির হাতল, খড়মে কালচে পায়ের ছাপ,সব, সওব, মন আজ সব খুঁটে খুঁটে দেখতে চায়। সে প্রাচীন প্রানের কোন স্পন্দন কি এখনো কোথাও কোন ঢেউ জাগায় কিনা! এখনো দেখি খালের উপর বাঁশের সাঁকো পেরুচ্ছি বালক আমি, আমার কাঁধে হাত দিয়ে অহংকারের মত দাদা আমার । আমি দেখেছি সেই বয়সেও কুড়ল দিয়ে কাঠ চেড়াই করতে, এটি ছিল তাঁর ব্যায়াম। খুব খাইয়ে মানুষ ছিলেন, যৌবনে ঘোড়া দাব্রাতেন! নাটক থেটারও করতেন, রেঙ্গুন ফেরতা এহেন রঙ্গিন মানুষ হঠাত নাকি বাংলা ঘড়ের সামনে আজান দিয়ে চলে এলেন আল্লাহর পথে। দাদু বেচারি ছিলেন নিরীহ মানুষ, সারা দিন তটস্থ থাকতেন। দাদাকে দাদু ডাকতেন “ও হজ্বি” ( ও হাজ্বি ) বলে। এ দাদু ছিলেন দাদার দ্বিতীয় পক্ষ। দাদুর আগের স্বামী কলকাতাতে থাকতেন দাদুকে নিয়ে, দাদুর কাছে সে কলকাতার গল্প শুনতাম। ট্রাম গাড়ী আর রাবড়ির গল্প। একবার নাকি দাদুর চোখে কি একটা অসুখ করেছিলো, সেই আগেরজন কি একটা ভুল ওষুধের ড্রপ দিয়েছিলেন, তাতে দাদুর একটা চোখ হারাতে হয়েছিল। এ কথা শুনে দাদুকে জিজ্ঞেস করতাম, তখন তুমি কি করলে, অবাক হয়ে শুনতাম “কি করব, কিছুই করিনি, উনি তো ইচ্ছা করে দেন নি”, অবাক হয়ে ভাবতাম এও হয়। একটা চোখ হারালে আর কিচ্ছু বলবার নেই তোমার। কি গভীর বিশ্বাস, কি গভীর ভালবাসা! দাদু একটা কথা বলতেন প্রায়ই, “মানু অমানু হইব, ঘাট আঘাট হইব, পথ আপথ হইব”। আজ তো তাই দেখছি, মানুষ সত্যি “অ” প্রত্যয়কে প্রায় অবিচ্ছিন্নি করে ফেলছে। আর পথ সবই বদলে আপথ হয়ে যাচ্ছে, নদীর তো সে রমরমাই নেই তায় আবার ঘাট। বড় নিঠুর হে সত্য তুমি! বড় পাপ হে সত্য তুমি!!
আগেরজনের মৃত্যুর পর আমার দাদার সাথে বিয়ে হয়, তাঁদের কোন ঘরেই কারুর কোন সন্তান ছিলনা, হয়ইনি। আমার বাবা, কাকারা ছিলেন তার ভাইয়ের ছেলে। দাদারা ছিলেন তিন ভাই, বড় জনের ঘরে জন্ম আমার বাবা, কাকার। তাঁদের আড়াই আর দেড় বছরের রেখেই দাদা দাদুর মৃত্যু হয়, আর নিঃসন্তান দুই ভাই দুই ভাস্তে কে মানুষ করেন, মেজ ভাই ( মেজ দাদা, যাকে আমি দেখিনি)আমার বাবাকে দেকভাল করেন, আর ছোটদাদা নেন কাকাকে। মেজ দাদাই ছিলেন সংসারের কর্তা টানা সাতাস বছর ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট সব মিলিয়ে ছিলেন তিরিশ বছর, ছ’কি সাত ভোটে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি মিস করেছিলেন। উনি ছিলেন সংসারে কর্মী পুরুষ, তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন সংসার। তাঁর মেধা তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রবাদ প্রতিম, ব্রিটিশ আমলে যখন জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হল, সব জমি যখন সরকার বাহাদুর নিয়ে গেলো এক তুড়িতে তখন এই ব্যাক্তিটি আমার বাবাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন আজ থেকে নতুন জীবনের শুরু পড়াশোনা করে মানুষ না হলে সংসার চলবে না। পড়াশুনাই একমাত্র মুক্তির উপায়। উনি ছিলেন খুবি পড়াশুনা পাগল ব্যক্তি, ব্যারিস্টারি পড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হল বলে সে স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেলো। কিন্তু সে স্বপ্নের সঞ্চারণ দিয়ে গেলেন তাঁর সন্তানসম ভাতুস্পুত্রের র মাঝে। পরবর্তী জীবনে যিনি বহুদূর যাবেন, তাঁর আরম্ভটা তো সেই ঘরেই হয়েছিল।
এহেন এক প্রাচীন বিরহ বাতাস ছিল ঘর-বার, চৌকাঠ কি সিন্দুকে। পালঙ্কের পাটাতনের গোপন কুঠুরিতে কত না রহস্য খুঁজে ফিরতাম। হারানো দিন গুলির গৌরবগাঁথা কাকা কিংবা দাদার মুখে রূপকথার মত লাগতো। প্রাচীন কোন তৈজসপত্র কিংবা কোন কিছুর ভাঙ্গা ছেড়া টুকরো টাকরা গুপ্তধন-সম যত্নে দেখতাম। পুরানো আসবাবে, চিনে মাটির বাসনে, দেরাজের হাতলে কত গল্প কত হাহাকার যেন জড়িয়ে থাকত। রসুনের খোয়ার মত চিনেমাটির নব হৃত যৌবন আল্মিরাতে বহুল ব্যবহারে চকচকে। কাপবাসনের তুঁতে নীল নক্সা,হ্যরিকেনের লালচে কমলা আলোতে ঘুমচোখে কি যেন বলে যেত, কোন বিশেষ উপলখ্যেই, প্রাচীন দেরাজ থেকে বেরুত। আধুনিকতার বানিজ্য বাতাসে সব উড়ে খুড়ে কোথায় পরে আছে, অথবা কোথাওই তার কিছুই নেই অবশেষ। নিঃশেষে সব শুধু বিভাজিত হয়। “ইস্তানবুল” – এর বালক পামুকের মত সব ক্ষয়ে যেতে দেখেছি নিঃস্পৃহ চোখে, কারুর কিছুই করার নেই। নিভে যাওয়া উনুনের আঁচটুকুও নেই আজ কোথাও, শুধুই ভেসে চলা, পরিবার, সমাজ, দেশ, শুধু ভেসে থাকা।
এই দুরের ঘোর লাগা ভোর গুলো মনেই হয় না আমার জীবনেরই অংশ, কত দুরের মনে হয়, এই বন্দী খাচায়। যখের ধনের মত আগলে রাখি স্মৃতি গুলো, কাঁচের টুকরো রঙ্গিন যেমন, বালকের গোপন বাক্সে জমা থাকে, নিকাজ, অলস,হায় স্মৃতি আমার, তার অধিক তো নয়! এই সঞ্চালন কি আমার অপত্যে হবে প্রবাহমান, হাজার কাজের ভিড়ে সহসা কি তুলবে কোন অনুরণন বুকের খুব কাছটাতে, আলগোছে ঝাপসা হবে কি দৃশটি আমারই মত। মানুষ বড় ভীতু প্রাণী, হারিয়ে যাওয়ার ভয় তার বড় প্রকট, নিজের শাখা, প্রশাখায় রয়ে যেতে চায় সবসময়। কখন কর্মে, কখন কীর্তিতে রয়ে যেতে চায়। অপনীত উপস্থিতি মেনে নিতে মন কেমন করে। ভাবতেই ব্যথায় ব্যাথায় মন ভরে যায়, যেই ভাবি কোনখানে আমি নেই। এ অমোঘ! এড়ানোর সাধ্য কারুর নেই।
©somewhere in net ltd.